#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-২১
আয়ন্তিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে অহর্নিশ কে। বারংবার সে ঘুরেফিরে অহর্নিশের দিকেই দৃষ্টি দিচ্ছে! পড়ার প্রতি আপাতত তার মন নেই। কান্না পাচ্ছে আয়ন্তিকার। রাগে, দুঃখে সে ফ্লোরে পায়ের নখ দ্বারা আঘাত করতে থাকে। ক্ষুদ্র আওয়াজে অহর্নিশ একবার ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতে দৃষ্টি দিয়ে আয়ন্তিকার দিকে তাকায়। ভ্রুকুটি কুঁচকে যায় মূর্হতে। নখ দ্বারা আঘাত এক পর্যায়ে ভেঙে যায় নখ! ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে ‘উহ্ ‘ শব্দ করে পুরোপুরি চুপ হয়ে যায় আয়ন্তিকা।
অহর্নিশ হাতে ঘড়ি পড়ে নিয়ে নিজেকে আরেকবার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখে নিল। যেনো তার আশপাশে কি হচ্ছে তাতে অহর্নিশের কোনো মাথাব্যাথাই নেই! অহর্নিশের ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে আয়ন্তিকা ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কেঁদে দেয়,
অহর্নিশ এতে বিরক্তি হয়ে বলল,
‘ এই মেয়ে, এই! কি সমস্যা হ্যা?আজ কি শুরু করেছো তুমি? কখনো পাগলের মতো হাসছো, অদ্ভুত বিহেভ করছো! তো কখনো একা একাই কান্না করছো। প্রবলেমটা কি?’
অহর্নিশের কথা কর্ণপাত হতে আয়ন্তিকা মাথা উঁচু করে অভিমানী চাহনিতে তাকায়। সে তার চাহনিতে উপলব্ধি করাতে চাচ্ছে অহর্নিশ কে, যাতে অহর্নিশ একটু তার ভেতরটা বুঝুক! এইযে অহর্নিশ তাকে দুদিন ধরে ইগনোর করছে এতে যে আয়ন্তিকার বেহাল দশা প্রায় তা একটু বুঝুক সে। অহর্নিশ এগোয় সামনে। আয়ন্তিকার সামনে হাটুগেড়ে বসে বলল,
‘ কি হয়েছে আমার না হওয়া বাবুর আম্মু? রাগ কেনো আমার প্রতি? কি করেছি বলবা তো! এভাবে অযথা নিজেকে আঘাত করছো ক্যানো?’
আয়ন্তিকা লজ্জায় নুইয়ে না গিয়ে মাথা উঁচু করে সে অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘ পুরোটা দিন বাসায় একা থাকি! একা থাকতে আর কতো ভালো লাগে? আমাকে এখানে আনলেন কেনো? সারাদিন বাসায় আমাকে একা রেখে রেখে পাগল বানানোর ফন্দি আঁটছেন নাতো?’
অহর্নিশ তপ্তশ্বাস ফেলে বলল, ‘ যে নিজেই পাগল, সে আবার অন্যকে কি পাগল বানাবে? ‘
‘ মানে? বুঝিনি আপনার কথা! কি বললেন আবার বলুন। ‘
‘ কিছুনা। তোমাকে এখানে এনেছি কারণ তুমি ওখানে থাকলে একটা না একটা অঘটন ঘটে তোমার সাথে। তাই এখানেই থাকা ভালো! আমি তোমায় টাইম দিতে পারছিনা কেনো? কারণটা তুমি ভালো করেই জানো আয়ন্তিকা। আমায় আরেকটু সময় দাও। নির্বাচন শেষ হলে সারাদিন আমি তোমায় কোলে নিয়ে বসে থাকবো! এন্ড এন্ড এন্ড, আমার না হওয়া বাবুকে পৃথিবীতে আনার জন্য পরিকল্পনা করবো দুজন মিলে ওকে?’
আয়ন্তিকা নতজানু হয়। মেদহীন গালদুটো রক্তিম আকার ধারণ করেছে। এই লোক আস্ত এক বজ্জাত অলওয়েজ তাকে উদ্ভট কথাবার্তা বলে লজ্জায় জর্জরিত করে ফেলে। সেই ক্ষনটায় আয়ন্তিকার ইচ্ছে হয় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে। এমন এক বেলাজ লোকের সাথে তার বিয়ে হলো কেন?তা ভাবতে গিয়ে আগামাথা উত্তর খুঁজে পায়না সে।
আয়ন্তিকা কে মৌনরূপে দেখে অহর্নিশ স্নান হাসে। উঠতে নেয়ার সময় টুপ করে সে আয়ন্তিকার কপালে চুমু খায়! অতঃপর এক মূর্হতও না দাঁড়িয়ে সে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। আজ তার প্রচুর কাজ! কাল নির্বাচন! যাওয়ার আগে অহর্নিশ দরজার কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
‘ রেডি থেকো রাতে! বাহিরে যাচ্ছি আমরা। ঠিক ১২ টার সময় এসে তোমায় নিয়ে যাবো। ‘
আয়ন্তিকা স্বস্তিপূর্ণ শ্বাস ফেলল! পরিশেষে তাহলে বলা যায় এই বন্দী, গুমোট পরিবেশ হতে একটু হলেও তার মুক্তি মিলতে চলেছে। ক’দিন ধরে অহর্নিশ তাকে একটুও টাইম দেয়না। শুধুমাত্র ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর সে অহর্নিশের উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে আবিষ্কার করে। ব্যাস! অতটুকুই! তারপরই ক্ষনের মধ্যিতে অহর্নিশ ঘুম থেকে উঠে নিজ কর্ম সম্পূর্ণ করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়তো। যদিও আয়ন্তিকা জানে এমনটাই হওয়ার ছিলো!
___________________________
হালকা কমলা রঙের শাড়ী! পরিপাটি মতোন নিজেকে তৈরি করে আয়ন্তিকা শেষবারের মতোন নিজেকে দেখে নেয় আরশির মাঝে! পরক্ষণেই লজ্জায় লাজুকলতা রূপ নিয়ে চুপসে যায় সে। ইশ! আজ সে প্রথমবারের মতো অহর্নিশের সাথে একা কোথায় ঘুরতে যাচ্ছে। অনুভূতিটাই আলাদা! চমৎকার এক অনুভূতি।
কলিংবেলের আওয়াজ কর্ণগোচর হতে আয়ন্তিকা দ্রুত পায়ে মেইন দরজার কাছে এগোয়! দরজা খুলতেই আয়ন্তিকার চক্ষুর সম্মুখে দৃশ্যমান হয় অহর্নিশ ক্লান্তিমাখা মুখশ্রী। ললাটে ঘামের ছোট ছোট কণা বিন্দু রূপে জায়গা দখল করে আছে। আয়ন্তিকা অহর্নিশের দিকে পূর্ণরূপে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘ আপনাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনো?’
অহর্নিশ শুভ্র রঙের পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে ঘাম মুছে নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ কাজ একটু বেশিই ছিলো আজ। কাল নির্বাচন! তাই, ‘
আয়ন্তিকা ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘ ভেতরে আসুন জলদি! খেয়ে রেষ্ট নিন। ভালো লাগবে। ‘
অহর্নিশ সটান হয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ অমনোযোগী দৃষ্টি এখন মনোযোগীতে পরিপূর্ণ করে। থম মেরে তাকিয়ে আছে সে আয়ন্তিকার দিকে। পা হতে মাথা অব্দি দেখে নিয়ে অহর্নিশ শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে! ‘
আর চার – পাঁচটা মেয়ের মতো আয়ন্তিকার এই মূর্হতে লজ্জা পেতে ইচ্ছে হলো স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে। কিন্তু নিভৃতে হতে ধিক্কার জানায় সে তার বর্তমান চিন্তাধারা কে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ এসব কথা পরে হবে। ভেতরে আসুন তো আপনি। আপনার রেষ্ট দরকার। ‘
অহর্নিশ সামনে এগিয়ে এসে একটুখানি ঝুঁকে আয়ন্তিকার দিকে। আয়ন্তি হতভম্ব হয়ে পিছন সরে যেতে নিয়েও পারেনা। ইচ্ছে হলোনা পিছন যেতে। অহর্নিশ ফু দেয় আয়ন্তিকা মুখশ্রীতে। চটজলদি চোখ বন্ধ করে নেয় আয়ন্তি! বুকে ধুকপুক ধ্বনি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নরমাল হওয়ার নামই নেই। যেনো হৃদপিণ্ড এখুনি বেড়িয়ে আসবে এত তুমুল বেগে স্পন্দিত হতে হতে!
অহর্নিশ মিটিমিটি হেঁসে বলল,
‘ তা তো হয়না! বউ আমার এতো কষ্ট করে নিজেকে পরিপাটি মতোন তৈরি করেছে স্বামীর সাথে ঘুরতে যাবে বলে।এখন আমি এই কষ্ট বিফলে যেতে দিই কি করে? ‘
আয়ন্তিকা টেনে চোখ খুলে বলল, ‘ যাওয়া লাগবে না আ..আজ.. ‘
অহর্নিশ আয়ন্তিকার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল,
‘ হুশশ! চলো চলো। এমন সুযোগ বারংবার আসে না ফিরে। আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। ‘
অহর্নিশ আয়ন্তিকার কোমল মেদহীন হাত শক্ত করে ধরে নেয়। বাসা লক করে নিয়ে আয়ন্তিকা কে নিয়ে সে সামনের দিকে আগায়। মৃদু হাসিটা এখনো বিদ্যমান অহর্নিশের অধর কোণে!
কিন্তু আয়ন্তিকা বিচলিত! কি বলল অহর্নিশ খানিক আগে? ‘ আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি ‘ এটা কেনো বলল অহর্নিশ? চিন্তার বেগ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে আয়ন্তির। উফ! এতো টেনশন দেয় কেন অহর্নিশ? এতো রহস্য নিয়ে ঘোরে নিজের মধ্যিতে! কবে জানি আয়ন্তিকা এর কারণে ঠাস ঠাস থাপ্পড় মেরে বসবে অহর্নিশ কে।
______________________
হাতিরঝিল ছেড়ে কিছুটা দূরে নির্জন এক জনশূন্য স্থানে নিয়ে এসেছে অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে! আসার পর সেই যে আয়ন্তিকা চারিপাশ দেখতে বেশ ব্যাস্ত হলো, তার খেয়ালই নেই একজোড়া নেশাক্ত আঁখি পল্লব তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। অহর্নিশ অপ্রতিভ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আয়ন্তিকার দিকে।আদুরে ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা জেগেছে মন গহীনে। কিন্তু সেটা করা কি সম্ভব? তা কি আদও ঠিক হবে? একে তো, বাল্যবিবাহ করে পাপের বোঝা ভারী করেছে তার ওপর এখন যতো বাজে চিন্তা মাথায় এসে ভর হয়েছে তার।
লম্বা শ্বাস টেনে নেয় অহর্নিশ! আঁখিপল্লব ফের আয়ন্তিকার ওপর নিবদ্ধ করে নিয়ে সে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ এটা কেনো হলো আয়ন্তিকা? কেনো আমি তোমার প্রতি বড্ড বেশি আসক্ত হয়ে গেলাম? এই মেয়ে! কি আছে তোমার মাঝে?নারীজাতির ওপর তীব্র ঘৃণাটা যে তুমি নিমিষেই দূর করে দিলে। তুমি নারী নয়! তুমি প্রেমময়ী, মোহময়ী এক কিশোরী! ‘
অহর্নিশ এলোমেলো পায়ে সামনে চলা শুরু করল। যতটা সামনে সে সেকেন্ড, মিনিটে এগোচ্ছে! ততটা করে বোধহয় তার নিভৃতে গড়ে ওঠা সেই অপরাধ মূলক তীব্র বাসনা গভীরতর হচ্ছে। অহর্নিশ নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যাবধান নিয়ে দাঁড়ায়। ফিচেল কন্ঠে বলে,
‘ আয়ন্তিকা? ‘
আয়ন্তিকা পিছন ফিরে তৎক্ষনাৎ। ঘাড় কাত করে সে বলল,
‘ কিছু বলবেন?’
‘ বাসায় যাবেনা? দুই ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। ‘
‘ যাবো! আরেকটু পর যাই?প্লিজ..!’
অহর্নিশ চোখমুখ ছোট করে বলল, ‘ আচ্ছা! ‘
আকাশে মেঘের গর্জন শুরু হয় মিনিট দুয়েক পর। অহর্নিশ চিন্তিত হয়ে বলল,
‘ বাসায় চলে এখন। আর থাকা লাগবেনা। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। ‘
আয়ন্তিকা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ হোক না! বৃষ্টিতে ভিজবে আমি। ‘
অহর্নিশ কঠিন কন্ঠে বলল, ‘ একদমই না। চলো!’
অতঃপর অহর্নিশের কথা সমাপ্ত হতেই বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে! মূর্হতেই সিক্ত হয়ে যায় দু’জন। অহর্নিশ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ধ্যাত! এখন সে নিজেকে সামাল দিবে কি করে?সিক্ত রূপে রূপান্তর হওয়া আয়ন্তিকার খয়েরী বর্ণের ওষ্ঠাধর বোধহয় অহর্নিশ কে একটু উল্টো পাল্টা করে দেয়। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করার এক পর্যায়ে অনুভব করলো তার বক্ষ পিঞ্জরে কারো ছোঁয়া। তীব্র ব্যাথায় অহর্নিশ চোখ খুলে দেখল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বুকের বাম পাশ হতে! সামনে তাকাতে দেখে আয়ন্তিকার বাকরুদ্ধ চাহনি। অহর্নিশ মৃদু হাসে। মুখ থুবড়ে সে তৎক্ষনাৎ পড়ে যায় মাটিতে।
চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-২২
অহর্নিশ বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে এক প্রকার। অহনার কাছে আকুতিভরা দৃষ্টি দিতেই সে কড়া চোখে তাকিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার আগে কঠিন কন্ঠে বলে গিয়েছে, অহর্নিশ সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া অব্দি কোথাও বের হতে পারবেনা। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে অহর্নিশ শুধুমাত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। সে যতই অহনা কে নিজের মা হিসেবে না মানুক কিন্তু অহর্নিশ চেষ্টা করে অহনার কথা রাখার, তার আদেশ, নির্দেশ যথাযথ ভাবে পালন করার।
অহর্নিশের আঘাত পাওয়ার জন্য দায়ী মাসুদ। মাসুদ চেয়েছিলো প্রাণে মেরে ফেলতে অহর্নিশ কে। তবে সে ব্যার্থ প্রতিবারই! প্রমান না থাকায় অহর্নিশ মাসুদের বিরুদ্ধে কোনো একশন ও নিতে পারেনি। তবে অনেকেই বুঝতে পেরেছে এরজন্য দায়ী কে!
আজ নির্বাচন! ক্ষন আগে শুরু হয়েছে ভোট গ্রহণ।কিন্তু অহর্নিশ ভোট কেন্দ্রে যেতে পারছে না কিছুতেই। কাঁধ বরাবর ধারালো ছুরি লেগেছে তার। যদিও ছুরিটা ফুসফুস উদ্দেশ্য করে তার দিকে ছুঁড়ে মারা হয়েছিলো কিন্তু ভাগ্যবশত আয়ন্তিকা তখন সে দৃশ্য দেখে ফেলে। হাত দিয়ে সে ধাক্কা দেয় তৎক্ষনাৎ অহর্নিশ কে। তবে পুরোপুরি রক্ষা করতে পারেনি আয়ন্তি! ছুরিটা লেগেই গিয়েছিলো। তবুও এবার মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে অহর্নিশ আয়ন্তিকার জন্যই। ফুসফুসে ছুরি লাগলে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলোনা।
অহর্নিশ ঘাড় কাত করে ডান দিকে তাকায়। ডানের সোফাটায় আয়ন্তিকা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মুখশ্রীতে ক্লান্তি বিরাজমান! ঘুমের মধ্যেই মাঝেমধ্যে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে আয়ন্তিকা। অহর্নিশ মনোযোগী দৃষ্টিতে আয়ন্তিকা কে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে। পরিশেষে বলাই যায় এই ভীতু, ছোট্ট মেয়েটা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
.
ঘন্টা খানেক পর আয়ন্তিকার ঘুম ভেঙে যায়। মাথা চেপে ধরে সে চারদিকে দৃষ্টি দেয়। অহর্নিশের দিকে তাকাতে তার ভ্রু কুঁচকে আসে! চটজলদি উঠে বসে সে সামনে আগায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ‘
চোরের মতো চুপিসারে বের হতে গিয়ে থেমে যায় অহর্নিশ। পিছন ফিরে আয়ন্তিকা কে দেখে সে অস্ফুটস্বরে সুরে বলল, ‘ শিট! ‘
অহর্নিশ এগিয়ে এসে কাঁধ ধরে। চিনচিন ব্যাথাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আয়ন্তিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে অহর্নিশ আমতা আমতা করে বলল,
‘ কই যাবো? এইতো এইখানেই আছি। শুয়ে থাকতে ভালো লাগছেনা তাই হাঁটছিলাম। ‘
আয়ন্তিকার সন্দেহ কাটলো না। অসন্তুষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ অহ আচ্ছা! ‘
‘ তুমি ঘুম থেকে উঠে গেলে কেন? আরেকটু ঘুমাও। কাল সারারাত জেগে ছিলে। ‘
আয়ন্তিকা তার দু’হাত বুকের মধ্যে আবদ্ধ করে। ডান ভ্রু উঁচু করে সে বলল,
‘ আমি ঘুমাই, আর আপনি চোরের মতো চলে যান! সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তাই না?’
‘ ছিহ্! ছিহ্! কি বলছো এসব? এতো সুন্দর বউ ছেড়ে চোরের মতো বের হতে যাবো কোন দুঃখে?তোমায় এখনো ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। তাই বললাম আরেকটু ঘুমাতে। ‘
‘ দেখুন! একদমই মিথ্যা বলবেন না। আমি জানি আপনি বের হতে যাচ্ছিলেন। ‘
আয়ন্তিকার সাথে তর্কে না পেরে অহর্নিশ পরিশেষে বিরক্তি কন্ঠে বলল, ‘ হ্যা! আমি বের হতেই নিচ্ছিলাম। নাউ (Now) হ্যাপি?এটাই তো শুনতে চাচ্ছিলে? এবার আমি যাচ্ছি! যেতে হবে আমার। কাজ আছে।
অহর্নিশের রাগান্বিত কন্ঠে আয়ন্তিকা ভয় পেলো না।বরং দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,
‘ আপনি শুধু বের হোন। দেখুন কি করি আমি! ‘
অহর্নিশ মৃদু হেঁসে আয়ন্তিকার সন্নিকটে এসে ঝুঁকে দাঁড়ায়। দুষ্টুমির সুরে বলল,
‘ কি করবা জান?চুমু খাবা?হু? হু?’
আয়ন্তিকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
‘ আজাইরা চিন্তা! আসুন বিছানায় বসুন। আপনার ঔষধ খাওয়ার টাইম হয়ে গিয়েছে। ‘
আয়ন্তিকা অহর্নিশের বাহু ধরে আস্তেধীরে বেডের কাছে নিয়ে যায়। অহর্নিশ বসে পড়ে বিনা শব্দে! তার দৃষ্টি নিবদ্ধ আয়ন্তিকার মধ্যে। ঘুম থেকে ওঠার পর আয়ন্তিকে যেনো একটু বেশিই দারুণ দেখতে লাগছে। ফুলো ফুলো দুই চোখ! ফুলো ঠোঁট, গাল সব মিলিয়ে কিউট লাগছে দেখতে। অহর্নিশ ইচ্ছে করলো ঠুস করে একটা কামড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু অহর্নিশ অন্য সময়ের মতো নিজের ইচ্ছেকে দমন করে রাখলো না আবারও। সে আয়ন্তিকার হাত ধরে টেনে এনে আঙুলে কামড় বসিয়ে দেয়। আয়ন্তিকা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় সঙ্গে সঙ্গেই! আঁখিপল্লব বড় বড় করে বলল,
‘ এই আপনি আমার আঙুলে কামড় দিলেন কেনো?’
অহর্নিশ বিছানাতে নিজের প্রচেষ্টায় শুয়ে পড়লো! ওষ্ঠাধরে মৃদু হাসির রেখা টেনে নিয়ে বলল,
‘ কামড় কই দিলাম?ভালোবাসা দিয়েছি। ‘
আয়ন্তিকা আর কথা বলল না! নাক ফুলিয়ে সে নিজের কাজে মত্ত হলো। অহর্নিশের সাথে কথা বলে লাভ নেই। এই লোককে ‘ক’ বললে সে সেটাকে ‘খ’ তে রূপান্তর করে ছেড়ে দেয়।
আয়ন্তিকা অহর্নিশ কে খাওয়ানোর সময় পরে আরেক মুশকিলে! এই মানব তার আঙুলে কামড় দিয়ে ঝাঝরা করে ফেলছে। তবে আয়ন্তিকা ব্যাথা পাচ্ছে না। অস্বস্তি অনুভব করছে প্রচন্ড! বারবার চোখ গরম করে তাকালেও অহর্নিশের তাতে যেনো কিছুই যায় আসেনা। পরিশেষে খাওয়ানো হলে আয়ন্তিকা হাফ ছেড়ে বাঁচে। হাত ধুয়ে এসে নিজের আঙুলে লাল লাল দাগ দেখে সে চটে গিয়ে বলল,
‘ হাতের কি একটা অবস্থা করেছে। আল্লাহ..!’
আয়ন্তিকা মেডিসিন হাতে নিয়ে অহর্নিশের নিকট এগিয়ে যায়। মেডিসিন খাওয়ানো শেষে সে সোফায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। অহর্নিশ তা দেখে তপ্তশ্বাস ফেললো। সে জানে কেনো আয়ন্তিকা এমন মুখ করে বসে আছে। থাকুক! অহর্নিশ আয়ন্তিকার সাথে আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছে না আপাতত। টেনশনে তার মাথাব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাত নেমেছে! ভোটের রেজাল্ট আজই, একটু পর দিবে! অয়নকে ওদিকটা দেখতে বলেছে অহর্নিশ। তবুও যেনো শান্তি মিলছে না। একবার তার যাওয়া উচিত ছিলো তা নিভৃতে হতে ফিরে ফিরে আসছে!
অয়নের কল এলে চটজলদি রিসিভ করে অহর্নিশ। অপাশ হতে নিস্তব্ধতা! অহর্নিশ শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ অয়ন?’
অয়ন আরো কিছু সময় মৌনতা পালন করে হটাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ দোস্ত…! কংগ্রাচুলেশনস! এমপি হইয়া গেছস। টিভি দেখ। কেবিনে টিভি নাই?না থাকলে ফোন দেখ! মিষ্টি খাওয়া দোস্ত। ‘
অহর্নিশ চক্ষু কার্নিশে জমে থাকা পানি মুছে নিয়ে বলল, ‘ পরে কথা বলছি! ‘
‘ ক্যান?’
‘ তোর ভাবী আছে পাশে। ওকে বলতে হবে না?’
‘ ওপ্স! হ ভুলে গেসি। খেয়াল রাখিস নিজের। কাল সকালে আসুম আমি। ‘
অহর্নিশ ফোন কেটে দিয়ে লম্বা শ্বাস টানে। নিজ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তার চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। অবশেষে! অবশেষে তার এতদিনের এত বড় এক স্বপ্ন পূরণ হলো। তার জীবনের বিশাল এক আকাঙ্খা ছিলো এটা বলা চলে। ঠোঁট কামড়ে কান্না দমনের প্রয়াস চালায় অহর্নিশ! আয়ন্তিকা সোফা হতে অহর্নিশের অবস্থা দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে। বিচলিত হয়ে পড়ে বলল,
‘ কাঁদছেন আপনি! কি হয়েছে? ব্যাথা করছে বেশি কাঁধে? ফোন দিলো কে?’
অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। নিবিড় ভাবে নিজ উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিয়ে সে ফিসফিস করে বলল,
‘ কংগ্রাচুলেশনস! তুমি এখন থেকে এমপির বউ। ‘
আয়ন্তিকা রূঢ় হয়ে বসে রইল! পরক্ষণে সে কিছুটা জোরে বলল,
‘ আ..আপনি ভোটে বিজয়ী হয়েছেন?’
‘ হু! অয়ন ফোন দিলো মাত্র। আমি তো ফোন চেক করিনি ভয়ে! কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। অয়নের ফোন ছাড়া কারো ফোনই রিসিভ করিনি। ‘
অহর্নিশ থামলো! কন্ঠনালি জমে আছে যেনো তার। ইশশ!এতো খুশি লাগছে কেনো?নিজের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সুখ এতোটা বেশি? অহর্নিশ আয়ন্তিকার কাঁধে নিজের অধরের ছোঁয়া দেয় অনবরত। আয়ন্তি তাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো না। বরং চোখ বন্ধ করে লাজুকলতা রূপ ধারণ করে সে তার জীবনের প্রিয় মানুষটার সাথে কিছু একান্ত, বিশেষ মূর্হত অনুভব করার প্রয়াস চালালো।
___________________________
শাফি, উজমার বিয়ে হয়েছে এক মাস! বিয়েটা মূলত একপাক্ষিক ছিলো। শাফি জোর করে বিয়ে করেছে উজমাকে। ইমোশনাল ব্লাকমেইল এবং মেন্টালি প্রেশার দিয়ে! বিয়ের পরপর উজমা অনুভব করার চেষ্টা করলো শাফিকে। তাকে যেই লোকটা এতোটা পছন্দ করে, তাকে চায়! আসলে সেই লোকটা ঠিক কেমন তা বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু সবকিছু মনে হলো ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। শাফিকে নিজের মতো করে অনুভব করতে পারলো না সে। বরং দিনকে দিন শাফিকে নানাভাবে অপমান করছে উজমা! নানাভাবে, নানাদিক দিয়ে।
পুকুর পাড়ে বসে এসবই ভাবছিলো শাফি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে উঠে আসে। অপেক্ষার প্রহর গুনে কবে উজমা তার প্রতি একটু ভালোবাসা দেখাবে?একটু কাছে টেনে আদুরে সুরে কথা বলবে?ঠিক কবে?
শাফি নিজের ছোট্ট টিনের বাসায় প্রবেশ করে দেখে উজমা কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে। ব্যাকুল হয়ে শাফি দৌড়ে যায় সেদিকে। উগ্র হয়ে বলে,
‘ এ্যাই উজমা?কি হইছে?এমনে শুইয়া আছো ক্যান?উঠো তো দেখি। ‘
উজমা চোখ মেলে তাকায়। উঠে বসে সে হটাৎ হুমড়ি খেয়ে শাফির বুকে আছড়ে পড়ে। কেঁদে দিয়ে বলল,
‘ আমারে মাফ কইরা দেন! ‘
‘ কিসের লেইগা মাফ চাও?’
‘ এতদিন আপনার লগে যা করছি তার লেইগা। আমি আপনারে বুঝবার পারিনাই। তাই অমন করছি। মাফ কইরা দেন। ‘
শাফি খানিকটা অবাক হলেও পরক্ষণে খুশিতে আপ্লুত হয়ে সে বলল,
‘ মাফ কইরা দিছি। তুমি কান্না থামাও উজমা। আমাট কষ্ট লাগে। ‘
শাফি উজমার মাথা নিজের বুকের মাঝে আগলে ধরে। উজমা হাসে! পৈশাচিক হাসি!
_______________________
সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সুস্থ হয়ে উঠেছে অহর্নিশ। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পরপরই সে তুমুল ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগে রাতে তাকে বাসায় দেখতে পাওয়া গেলেও এখন রাতেি আসেনা সে! দেখা মিলে তার দুই, চারদিন পর মধ্যরাতে। এসে জামাকাপড় পাল্টে আবার বের হয়ে যায়। এতে করে সবাই তার ওপর ভিষণ ক্ষুব্ধ! বিশেষ করে আয়ন্তিকা। কথাই বলেনা আর! কেমন চুপচাপ আর মনমরা হয়ে থাকে সারাদিন। অহন তা খেয়াল করে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। অহর্নিশ কে বলে কাজ হবেনা ।
রাতের দিকে আয়ন্তিকা বেলকনিতে বসে ছিলো চুপচাপ। এসএসসি শেষ হয়েছে তার। আর কদিন পর সে কলেজে উঠবে। তিনটা মাস আয়ন্তিকা চাচ্ছিলো নিজের বাবা মার সাথে দেখা করতে কিন্তু অহর্নিশ তাও বন্ধ করে দিয়েছে। রাগে, দুঃখে আয়ন্তিকার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় মরে যেতে!
‘ আমার প্রতি তৈরি হওয়া রাগ বেচারা ফুলটার ওপর ঝাড়ছো কেনো আয়ন্তিকা? ‘
আয়ন্তিকা চটজলদি পিছন তাকায়। অহর্নিশ তার কালে প্যান্টটার পকেটে দুহাত পুরে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে দাড়িয়ে আছে। অহর্নিশ কে দেখে আয়ন্তিকা বিশাল চমকে যায়! হাত হতে ছিঁড়ে কুটিকুটি হওয়া ফুলটা অজান্তেই মাটিতে আশ্রয় পায়। আয়ন্তিকা এগিয়ে গিয়ে চমকিত হয়ে বলল,
‘ আপনি?আপনি সত্যি এসেছেন?’
অহর্নিশ ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘ অবশ্যই আমি এসেছি। তো, তোমার কি আমায় দেখে ভুত মনে হচ্ছে? ‘
আয়ন্তিকা মাথা নাড়িয়ে না বলল। তার বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। অহর্নিশ কে দেখতে দেখতে সে যে কখন অহর্নিশের সন্নিকটে এসে পড়েছে তার খেয়াল নেই। অহর্নিশ তার চোখমুখ ফু দিতেই হকচকিয়ে পিছে সরে যায় আয়ন্তিকা। অহর্নিশ তা দেখে আহত হয়ে বলল,
‘ পিছু সরছো কেনো?’
‘ এমনি! ‘
‘ এমনি? এতদিন পর আসলাম কই একটু আদর, টাদর করবে! ইমোশনাল হয়ে বুকে মাথা রেখে কাঁদবে। অথচ দূরে সরছো কেনো? আমি কি চলে যাবো আয়ন্তিকা? যাবো বলো?’
আয়ন্তিকা তড়িৎ বেগে এসে অহর্নিশ কে জরীয়ে ধরে। ঘাড় কাত করে দুদিকে নেয়। যার অর্থ ‘আপনি যাবেন না। ‘
#চলবে…
[Sorry For Late]