#অন্তর্দহন_১৪
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
সকাল সকালই উল্লাসীর জন্য বেশ ভালো একটি খবর নিয়ে ঘরে ফিরলো পাপন। সাত সকালেই মোল্লা সাহেবের সঙ্গে জায়গা দেখতে বেরিয়েছিল সে। মনের মতো একটা প্লেস পাওয়া গেছে। খুবই সুন্দর এবং জাকজমকপূর্ণ। বেলা গড়াতে গড়াতে ভীড় হয় নাকি! সেখানেই আপাতত কাপড় নিয়ে বসার পায়তারা করছে পাপন। এর পাশাপাশি আরও একটি সু-সংবাদ হলো, মাত্র আড়াই হাজার টাকায় খুবই চমৎকার একটি স্মার্টফোন পেয়েছে পাপন উল্লাসীর জন্য। উল্লাসী যেহেতু অনলাইনে বিজনেস করার ইচ্ছা পোষণ করেছে, তাই অতি অবশ্যই একটি ফোন জরুরি। সকাল বেলায় ওই জায়গাতেই এক লোকের সাথে দেখা হয় পাপনের। লোকটি নেশাখোর যে,তা স্পষ্ট বুঝতে পারে সে। নেশা খাওয়ার জন্যেই খুবই দ্রুত ফোনটি বিক্রি করে দিতে চাইছিলো লোকটি। পাপন সুযোগ বুঝে কিনে ফেলে। ফোনের ক্যামেরা, র্যাম, রোম সবই ভালো। উল্লাসীর কাজ ভালোভাবে চলবে, আশা করা যায়।
উল্লাসী ভীষণ খুশি হলো। ওরা যে বাড়িতে থাকে সেই ফ্ল্যাটের নিচ তলায় এক আপা থাকে, উনিও অনলাইনে বিজনেস করে। তার থেকেই টুকটাক তথ্য জেনেছে উল্লাসী। অনলাইনে বিক্রেতার চেয়ে ক্রেতা বেশি বলা চলে বর্তমানে। কমবেশি সবাই-ই বিজনেস করতে চায়, এবং করছে। তাই অন্যরকম ইউনিক কিছু নিয়ে যদি বিজনেস করা যায়, তাহলে লাভের আশংকা রয়েছে। আর নইলে তেমন একটা সফলতা আসে না। আর জামাকাপড় বিক্রির অনেক পেজ রয়েছে, গ্রুপ রয়েছে। ওই আপা উল্লাসীকে বুদ্ধি দিয়েছেন, ভেবেচিন্তে অন্যরকম কিছু বের করতে। তা দিয়ে ব্যবসা করতে পারলে সাফল্য আসবেই।
আর অনেক ভেবেচিন্তে উল্লাসী পাটের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাট এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ঘর সাজানোর জিনিসগুলো, পাটের কারুকাজ, ব্যাগ, পাপোশ ইত্যাদি নিয়েই শুরু করতে চাচ্ছে সে। মোটামুটি হাজার বিশেক দিয়ে শুরু করবে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
পাপন চিন্তিতবোধ করল। বিশটা হাজার টাকা খরচ করবে! যদি লাভ না হয়? যদি কেউ কিনতে না চায়? তখন? পুরো টাকাটাই জলে যাবে। আর রাস্তাঘাটে তো এসব বিক্রি করা যায় না! উল্লাসী আশ্বাসের সুরে বলল,
-“তুমি চিন্তা নিচ্ছো কেন? উপরে একজন আছে না? উনি যদি এখানেই আমাদের সফলতা নির্ধারণ করে রাখেন, তাহলে এখান থেকে সাফল্য আসতে বাধ্য। তুমি উনার উপরে ভরসা রেখো। তোমার যত দুশ্চিন্তা সেটা উনার কাছে বলো। উনি সমস্যা যেমন রেখেছেন, সমাধানও রেখেছেন।”
পাপন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এই কথা শুনে। কেন যেন, ‘উপরে একজন আছেন’ কথাটি শুনলেই তার মনে আত্মবিশ্বাস এবং স্বস্তি এসে ভর করে কেন যেন। মনে হয়, সবকিছুই খুব সহজ। আল্লাহর রহমত এবং বরকত থাকলেই সব পারা সম্ভব। বলতে বাঁধা নেই, উল্লাসী এবং মোল্লা সাহেবের অনুপ্রেরণাতেই পাপন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ে মনোযোগী হয়েছে ইদানীং।
★
দু’দিন পর অভ্র আর পড়ন্ত বিয়ে করে বাড়ি ফিরেছে। অভ্রর হাতে তিন কেজি মিষ্টি। পড়ন্ত বকেছে, চোখ রাঙিয়েছে, শেষ পর্যন্ত অনুরোধ করেছে, তাও অভ্র বিয়ে করার খুশিতে মিষ্টি সমেত বাড়ি এসেছে। পড়ন্ত লজ্জায় আর ভয়ে মাথানিচু করে রাখলেও অভ্রর মুখে হাসি। যেহেতু ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গীনি হিসেবে পেয়েই গেছে, সেহেতু খামোখা ভয় পাওয়ার দরকার কী?
নাসরিন, বড় চাচী আর নিতুর মনে আনন্দের জোয়ার থাকলেও বাকি সবার মুখ ভার। শায়লা তো কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে ঘরে গিয়ে দরজায় সিটকিনি এঁটেছে। আর খোলার নাম নেই। শিখা খানিক বাদে বাদে চিৎকার চেঁচামেচি করে আশেপাশের মানুষদের জানান দিচ্ছে, এই বাড়িতে ঘোর অপরাধ হয়েছে। তার মেয়ের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। সে পড়ন্তকে কিছুতেই ছাড় দেবে না। তাই শুনে নাসরিন চেঁচিয়েছেন, পড়ন্তকে একা কেন দোষের ভাগীদার ধরা হচ্ছে? অভ্রর কী সমান দোষ নেই?
শিখা আর নাসরিনের চুল টানাটানি অবস্থা, বড় চাচী দু’জনকেই থামিয়ে যার যার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পড়ন্তকে তার ঘরে পাঠিয়ে অভ্রকে নিজের সঙ্গে করে রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় অভ্র মিনমিনিয়ে একবার বলল,
-“মিষ্টি গুলা ফ্রিজে রাখো। টক হয়ে যাবে নাহয়।”
তমিজ উদ্দিন এমন ভাবে চোখ রাঙালেন, যেন পানি ছাড়াই কাচা কচকচ করে চিবিয়ে খাবেন অভ্রকে। অভ্র মিইয়ে গেছে এরপর। গলা দিয়ে আপাতত স্বর বের না করারই সিদ্ধান্ত বহাল হলো।
ঘরে ঢুকতেই নাসরিন ঠাস করে পড়ন্তর গালটা লাল করে দিলেন। পড়ন্ত কেঁদে ফেলল। এমনিতেই ভয়ে আছে। তার উপর মারামারি! কান্নারত কণ্ঠে বলল,
-“আম্মু আমি ভুল করছি মানলাম, কিন্তু..”
তার কথা শেষ করার আগেই নাসরিন চড়া গলায় বলে উঠলেন,
-“আমি সেজন্য মারিনি তোকে।”
পড়ন্তর কান্না থেমে গেল।
-“তাহলে?”
-“তুই এতকিছু সহ্য করেছিস, অথচ আমার কাছে সব লুকিয়ে গেছিস। কেন? আমি কী তোর মা না? আমাকে অন্তত একবার বলতি! আমি কী মেরে ফেলতাম তোকে? অভ্র আমাদেরই বাড়ির ছেলে। আমি কক্ষনো ওর হাতে তোকে পাত্রস্থ করতে দুইবার ভাবতাম না।”
পড়ন্ত মুখ নামিয়ে ফেলল।
-“আম্মু, আমি অনেকবার তোমাদের সবাইকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সাহস বা মনের জোর কোনোটাই পাচ্ছিলাম না। তার উপর ও বলল, পড়াশোনাটা একদম শেষ করেই বাসায় পারিবারিক ভাবে এই টপিকটা তুলবে।”
-“এখন দেখলি, মা-বাবার থেকে কথা লুকানোর ফলাফল? যদি আমি অন্তত জানতাম, অভ্রর বিয়ে শায়লার সাথে হতে দিতাম?”
পড়ন্ত জবাব দিতে পারল না। তার আবার চোখ ভারী হয়ে আসছে। ঘরে মিথুন উদ্দিন ঢুকলে তার উপস্থিতিতে পড়ন্তর আত্মা এতটুকুন হয়ে গেল। ভয়ের চোটে বাবার দিকে মুখ তুলেও তাকাল না।
মিথুন উদ্দিন ক্ষণকাল সময় নিরব রইলেন। তারপর পড়ন্তকে উদ্দেশ্য করে নাসরিনকে বললেন,
-“ওদের কী বিয়ে হয়ে গেছে? জিজ্ঞেস করো ওকে।”
নাসরিন মেয়ের দিকে তাকালেন। পড়ন্তকে জিজ্ঞেস করতে হলো না, পড়ন্ত নিজ থেকে মাথা কাত করে ‘হ্যাঁ’ বলল।
মিথুন উদ্দিন ক্রোধিত স্বরে বললেন,
-“এখন কী সতীন নিয়ে সংসার করার সাধ জাগছে?”
পড়ন্ত সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল,
-“ও বলছে, শায়লা আপুকে ডিভোর্স দিবে।”
-“বললেই হয়ে গেল? তোর মনে হয় শায়লা এত সহজে তোদের দুটোকে ছেড়ে দিবে? আর শিখা ভাবী তো তোর উপর পুরোপুরি ভাবে রেগে আছেন। তোর বড় চাচাও ওদের পক্ষে। এখন যদি শিখা ভাবী শায়লাকে নিয়ে থানায় যান, আর শায়লা তোদের নামে কেস করে দেয়, তখন কী হবে? পারবি কিছু করতে?”
পড়ন্ত আঁতকে উঠল। এভাবে সে একটুও ভেবে দেখেনি। ঝোঁকের মাথায় কী থেকে কী করে বসল! এবার… এবার কী হবে তার? আর অভ্র…
যদি বাবার কথাই সত্যি হয়, যদি সত্যি শায়লা পুলিশি ঝামেলা করে? পড়ন্ত দিব্য স্বপ্ন দেখতে লাগল। তার হাতে হাত কড়া, অভ্রর কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে আগে নিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষের মিছিল, সবাই হা হা করে হাসছে। তাদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে টিটকারি ছুঁড়ছে। আর শায়লা দাঁতে দাঁত ঘঁষে পড়ন্তকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, এবার বোঝো মজা! পড়ন্ত আর ভাবতে পারল না। দরকার হলে সে শায়লার পা ধরে ভিক্ষা চাইবে…
নিজের জন্য, অভ্রর জন্য, ওদের ভালোবাসার জন্য পড়ন্ত সবকিছু করতে পারে। সবকিছুই…
★
ওদিকে যখন এই চিত্র, এদিকে তখন ভিন্ন অবস্থা। অভ্রকে তমিজ উদ্দিন আগাগোড়া শাসিয়ে গেলেন, মারতে পর্যন্ত আসলেন, বড় চাচীকে টপকে আর এগোতে পারলেন না। তিনি ঢাল হয়ে ছেলেকে রক্ষা করে গেলেন। ছেলের পক্ষে হাজারটা যুক্তিযুক্ত কথা শোনালেন। আর অভ্র মাথা নিচু করে চুপচাপ সব শুনতে লাগল আর হাসল মুচকি মুচকি। তার কেন যেন খুব আনন্দ হচ্ছে। পড়ন্তকে বিয়ে করার পর থেকে তার ভেতর একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব চলে এসেছে। তার মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীর সব তো কোন ছাড়, সেই মূল নাটের গুরু… তাকে আর পায় কে!
তমিজ উদ্দিনের হাপানির ন্যায় উঠলে উনি বুকে হাত চেপে বসে পড়লেন। নিজেকে স্থির করে স্ত্রীকে বললেন,
-“ওকে চলে যেতে বলো। ওর চেহারাও আমার সহ্য হচ্ছে না।”
অভ্র ফট করে বলে বসল,
-“একেবারের জন্য চলে যাব বাবা? নাকি তোমার সামনে থেকে শুধু? স্পেসিফিক ভাবে না বললে বুঝব কেমন করে?”
তমিজ উদ্দিন রক্তচক্ষু করে তাকালেন। অভ্র প্রত্যুত্তরে একটা চাপা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বেরিয়ে গেল। বড় চাচী হতবাক! অতি আনন্দে ছেলেটার মাথার তার-টার সব ছিঁড়ে গেল নাকি?
★
শায়লা ঘরের দরজা বন্ধ করে গুনগুনিয়ে কেঁদেছে, যদিও তার চোখ দিয়ে একফোঁটাও পানি আসেনি। তার ভেতরে খারাপ লাগার চেয়েও ক্রোধটা আর জিদটা বেশি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কীভাবে তাকে ফেলে পড়ন্তকে বিয়ে করে ফেলল শয়তানটা! এটা ভেবেই ফুঁসছে শায়লা। তার মতো সুন্দরী রেখে ওরকম কালো অভ্রর মতোন বলদরাই চুজ করতে পারে! হুহ!
শায়লা ঘরের দরজা খুলল, মায়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করবে বলে। কিন্তু বারান্দাতেই অভ্রর দেখা পেয়ে গেল। অভ্র দু-হাত পকেটে পুড়ে একটা ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে পড়ন্তদের ঘরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল, পেছন থেকে কারও আক্রমণে সে একেবারে চমকে উঠল, সেই সাথে ত্যক্ত-বিরক্ত…
শায়লা অভ্রর পিঠে মাথা রেখে ফোপাচ্ছে।
অভ্র নড়াচড়া করল, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকাল,
-“অন্যের স্বামীকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা করে না তোর?”
-“না করে না। আর তুমি অন্যের স্বামী মানে? তুমি আমার স্বামী!”
-“তালাক, তালাক, তালাক…
যা। আমি তোকে তালাক দিলাম। এই দেখ, একদম মন থেকে দিলাম। এবার দয়া কর আর বিদায় হ আমার জীবন থেকে। তোর জন্য অর্ধেকটা পুড়ছি, বাকিটুকু পুড়তে চাই না। প্লিজ… আমাকে উদ্ধার কর।”
একেবারে হাতজোড় করে শায়লাকে অনুনয় করতে লাগল অভ্র। শায়লার এত খারাপ লাগল! সে শুধু ভাঙা গলায় বলার চেষ্টা করল,
-“আমি তোমার জন্য সত্যি বিরক্তের হয়ে গেছি! তাই না?”
অভ্র দায়সারাভাবে জবাব দিলো,
-“অনেক।”
-“আচ্ছা, যাও, মুক্তি দিলাম।” মৃদু হাসল শায়লা। তারপর উল্টো ঘুরে ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করল। অভ্র এবার একটু চমকালো। শায়লা এত সহজে তাকে ছেড়ে দিবে, সেটা কল্পনাও করেনি অভ্র! তবে কী এবার সুখ এসে সত্যিই ধরা দিবে তাদের? পড়ন্তকে নিয়ে অভ্রর সুখের জীবনটা শুরু হতে যাচ্ছে?
রাতের বেলা অভ্র-পড়ন্তকে আলাদা ঘরে থাকতে বলা হলো। পারিবারিক ঝামেলা মিটমাট না হওয়া অবধি তারা কোনো দাম্পত্য জীবন শুরু করতে পারবে না। তাতে অবশ্য অভ্রর কিছু যায় আসলো না। সে যা করার বিয়ের দিন রাতেই করে ফেলেছে। খুব বেশি দিন নয়, আর ক’দিন পরেই পড়ন্ত তার ভেতর অন্য এক সত্তাকে অনুভব করতে পারবে। এই জন্যেই অভ্রর মনটা এত ফুরফুরে.. এই অনাগত অতিথি তাদের সব সমস্যা দূর করার জন্যেই আসছে, এমনটাই অভ্রর ধারণা। পড়ন্তর সঙ্গে ফোনে কথা বলে আড়াইটার দিকে ঘুমালো অভ্র। কিন্তু রাত ফুরানোর আগেই তাকে ডাকাডাকি করে ডেকে তোলা হলো। শায়লার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার কথাটা শুনে অভ্র হতবিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো শূন্যে…
চলবে..