অন্তর্দহন,পর্ব:১২+১৩

0
2090

#অন্তর্দহন_১২ (ধামাকা পর্ব)
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

মোল্লা সাহেবকে আজ বাসায় ডেকেছে পাপন। উল্লাসী ডাকতে বলেছে বিধায় ডেকে আনা হয়েছে তাকে। পাপন নিজেও জানে না এর পেছনের কারণটা কী। উল্লাসী একটি অদ্ভুত মেয়ে। আগেভাগে পাপনকে কিছু বলবে না, একেবারে করে দেখাবে। পাপনও তাই উল্লাসী তেমন একটা ঘাটায় না।
দুপুরে বেশ ভালো একটা ভোজন করল তারা তিনজন মিলে। মোল্লা সাহেবের জন্য পানের ব্যবস্থাও করে রেখেছিল উল্লাসী। কয়েক পদের জর্দা দেওয়া মিষ্টি পান। মোল্লা সাহেব বেশ আরাম করেই পান চিবুতে লাগলেন।
-“আপনার সাথে কিছু বিষয়ে আলাপ করতে চাই চাচা।”
উল্লাসী সুযোগ বুঝে আসল কথাটা তুললো। মোল্লা সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন,
-“কও মা।”
-“এই শহরে আপনি ছাড়া আমাদের পরিচিত কেউই নেই চাচা। তাই আমাদের সব ব্যাপারে আপনার সাহায্যই কাম্য। ওর বয়স তো অনেক কম, এই বয়সে চাকরি পাওয়া কঠিন। চারদিন শুয়ে বসে কাটালেও আর শুয়েবসে থাকা যায় না চাচা। তাই আমি চাচ্ছিলাম, ও যেন কিছু একটা করে।”
-“হুমম.. সেটা তো খুবই ভালো পরিকল্পনা। শুয়ে বসে কতদিন?”
-“হ্যাঁ, এটাই চাচা। তো আমি ভাবছিলাম, যদি পাইকারী মূল্যে ছেলেদের শার্ট বা মেয়েদের ড্রেসাপ এনে ফুটপাতের উপর একটা জায়গা নিয়ে দোকান দিয়ে বসত, তাও প্রতিদিন কিছু তো আয় হতো। পাশাপাশি আমি অনলাইনেও বিক্রির চেষ্টা করতাম। এটা কেমন বুদ্ধি চাচা?”
পাপন কপাল কুঁচকে ফেলল উল্লাসীর কথা শুনে। সে ফুটপাতে জামাকাপড় বিক্রি করবে! ইয়া আল্লাহ… পাপন অসহায়বোধ করল। এছাড়া আর উপায়ই বা কী! তাও তো উল্লাসী কিছু একটা ভেবে বের করেছে! পাপন গোপনে মৃদু শ্বাস ফেলে।
মোল্লা সাহেব বেশ খানিকক্ষণ ভাবলেন। ভাবার পর বললেন,
-“বুদ্ধি ভালোই। আচ্ছা চেষ্টা করা যাক। কবে যাবা বলো। আমিই নিয়ে যাবো তোমাকে পাইকারি বাজারে।” পাপনকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললে পাপন উল্লাসীর দিকে তাকায়। উল্লাসী চোখ রাঙিয়ে মোল্লা সাহেবকে জবাব দিলো,
-“আগে জায়গা ঠিক করুন চাচা। রোড খরচের ব্যাপার আছে তো। চাইলেই তো আর রাস্তায় দোকান বসানো যায় না। আর চাচা, ভালো প্লেস বাছবেন, যেন বিক্রি ভালো হয় মোটামুটি।”
-“আগামীকাল থেকেই খোঁজা শুরু করি?” মিনমিনিয়ে বলল পাপন। উল্লাসী জোরালো কণ্ঠে বলল,
-“নাহ, আজ থেকেই। সন্ধ্যের পরই বের হবে।”
অগত্যা পাপনকে রাজী হতে হলো। এই মেয়ে একে পুরোদস্তুর সংসারী বানিয়ে তবে ছাড়বে!

মোল্লা সাহেব মাগরিবের নামাযের পর পাপনকে নিতে আসবেন, এই বলে চলে গেলে বিছানায় ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিলো পাপন। উল্লাসী এঁটো থালাবাসন গুলো গুছিয়ে এক পাশে সাইড করে রেখে দিয়ে নিজেও পাপনের পাশে এসে বসল।
-“তুমি কী ভাবছো, বলো তো।” প্রশ্ন করে উল্লাসী।
পাপন না বোধক মাথা নাড়ে।
-“উঁহু.. কিছু না।”
-“আমি জানি তুমি কী ভাবছো।” বলেই ভ্রু নাচায় উল্লাসী। রহস্য করে হাসে। পাপন এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-“তাই? তো বলো.. কী ভাবছি।”
-“উমম.. তুমি ভাবছো, এ আমি কাকে বিয়ে করলাম! যে কীনা আমাকে রাস্তায় বিক্রি করার জন্য ঠেলে দিচ্ছে।”
পাপন চমকিত বোধ করল। নাহ, এই মেয়েটা তার মনের গোপন কুঠুরিতে বেশ ভালোভাবেই নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ এত কিছু বুঝে যায় কী করে! কীভাবে! পাপন উত্তর দিচ্ছে না দেখে উল্লাসী জয়ের হাসি হেসে উঠে বলল,
-“দেখলে.. আমি ঠিকই ধরছি।”
পাপন উদাসীন গলায় জবাব দেয়,
-“হুম।”
উল্লাসী নিচু হয়ে পাপনের বুকের উপর মাথাটা রাখলো। ধীর কণ্ঠে বিজ্ঞের ন্যায় বলল,
-“দেখো, কাজ কোনোটাই ছোট বড় না পাপন। আল্লাহ যে আমাদের একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন, এই-ই বা কম কীসে! তুমি যদি প্রতিদিন বেচাকেনা শেষে ২০০-৩০০ টাকাও লাভ ঘরে নিয়ে আসো, তা দিয়েও আমি সংসার চালাতে পারব পাপন। আর আমিও তো বসে থাকব না। একটা কিছু অবশ্যই করব। তোমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব। আমরা পারব পাপন, শুধু জোর হারিয়ো না। সামনে না জানি কত কঠিন পরিস্থিতি আসবে! তখন যদি দিশেহারা হয়ে পড়ো, তাহলে আমি কী করব বলো তো? আমার জন্য হলেও নিজেকে শক্ত রেখো৷ আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। উনি নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবেন পাপন!”
পাপন দু’হাতে উল্লাসীকে শক্ত করে চেপে ধরল নিজের বুকের ভেতর। উল্লাসীও মিশে গেল নির্দ্বিধায়। পাপনের বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তবুও নিজেকে বুঝ দিলো সে। এরচেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে কত মানুষ আছে! তবুও সে ভাগ্যবান, নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেয়েছে। কত মানুষ আছে, যারা ভালোবাসার মানুষকে শত চেষ্টা করেও বেঁধে রাখতে পারে না!
টাকাপয়সা হাতের ময়লা। এই আছে, এই নেই। এই নেই, এই আছে! পাপন মনে মনে স্বগতোক্তি করল,
-“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব। বাকিটা ওই উপরে বসে যিনি আমার ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, তিনিই জানেন।”

-“এই.. কী হলো? কী ভাবছো?” উল্লাসীর কথায় পাপন সহাস্যে জবাব দিলো,
-“না, কিছু না।”
উল্লাসী মাথা তুলে তাকাল। চোখ পাকিয়ে সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো,
-“আমাকে ফেলে ভেগে যাওয়ার কথা ভাবছো না তো?”
পাপনের হাসি পেয়ে গেল৷ কী চিন্তাভাবনা! যার জন্য আজ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গাছ তলায় বলতে গেলে, তাকে ছেড়ে আবার কোথায় যাবে সে! পাপন হাসিটা চেপে রেখে খুন সন্তর্পণে বলে উঠল,
-“চলে গেলেই বা কী?”
-“মেরে ফেলব।” সঙ্গে সঙ্গে হুমকি দিলো উল্লাসী। পাপন সশব্দে হেসে উল্লাসীকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরল।
-“ওরে পাগলি! কোত্থাও যাব না। চিন্তা নিও না।” আহ্লাদী কণ্ঠে কথাটি বলতেই উল্লাসী শান্তি অনুভব করল। নিজের নাক পাপনের বুকের উপর ঘঁষতে লাগল মৃদু ভাবে…
পাপনের মনে হলো, এর চাইতেও কষ্ট আর পরিশ্রম করতে হলে করবে সে… তবুও উল্লাসীকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। এই জীবন তার, এই সংসার তার, আর এই ছোট্ট মেয়েটিও তার.. তাদের জীবনে অভাব থাকলেও, সুখপাখি তবুও ধরা দিয়েছে।

পড়ন্ত বড় চাচার ঘরের দিকেই যাচ্ছিল, বারান্দায় তার পথরোধ করে দাঁড়াল অভ্র। পড়ন্ত থমকে গিয়েও গেল না। সে যেন দেখেইনি, এমন ভঙ্গি করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে অভ্র পড়ন্তর এক হাত পেছন থেকে টান দিয়ে ধরল। পড়ন্ত গরম চোখে তাকাল। চাপা চিৎকারে বলে উঠল,
-“সমস্যা কী?”
অভ্রও সমান তেজ নিয়েই জবাব দিলো,
-“কথা বলতে চাই। তোর সমস্যা কী?”
-“আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি কথা বলতে চাই না।” মুখ বাঁকাল পড়ন্ত। হাত মোচড়ামুচড়ি লাগিয়ে দিলো, অভ্র এবার আরও শক্ত করে চেপে ধরল।
-“হাত ভেঙেই ফেলব একদম, এত তেজ তোর আসে কোথা থেকে?”
-“যেখান থেকে আসুক, সেটা তোমার দেখার বিষয় না অভ্র ভাই.. তুমি ছাড়ো আমার হাত। অন্যথায় আমি তোমার বউকে ডাকবো।”
অভ্র টিটকারির সুরে বলল,
-“বউ! আমার বউ! নিজেই নিজেকে ডাকবি? আচ্ছা, ডাক। আমিও দেখি একটু।”
পড়ন্তর গলার কাছে একটা কান্নার রোল উঠে এসে দলা পাঁকিয়ে রইলো। পড়ন্ত নিজেকে শক্ত এবং স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে চোখ পাঁকিয়ে বলল,
-“আমি তোমার বউ না। তোমার বউ শায়লা।”
অভ্র সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো,
-“শায়লা আমার বউ না। আমার বউ তুই..”
-“আচ্ছা, শায়লা তোমার বউ না!” পড়ন্তর ঠোঁটে আচানক একরত্তি তাচ্ছিল্য খেলা করে উঠল।
-“সে তোমার বউ না, অথচ তার বুকে তোমার দাগ থাকে! বাহ… ভাবা যায়? হাস্যকর ব্যাপার স্যাপার!”
অভ্র এইবার যারপরনাই অবাক হলো। সেই সঙ্গে হাতের টান ঢিল হয়ে এলে পড়ন্ত ঝট করে টান মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে ওই হাত ডলতে শুরু করল। অভ্র বেয়াদবটা বেশ ভালো ভাবেই চেপে ধরেছিল হাতখানা৷ ইশ! লাল হয়ে গেছে।
পড়ন্ত রক্তচক্ষু করে অভ্রর দিকে একটা চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে অভ্র ডেকে উঠল,
-“এই পড়ন্ত, দাঁড়া, তুই কী বললি? আমি বুঝলাম না।”
পড়ন্ত দাঁড়াল, অভ্রর দিকে দাঁট কটমটিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“ওহ এখন বুঝো না? সাধু বাবা? হুঁ? তোমার বউ…. তোমার বউয়ের বুকের উপর নখের আঁচড়। আমি নিজে দেখেছি। আর তুমি এখন নাটক করো? নাটক?”
অভ্র চোখজোড়া পিটপিট করে বলল,
-“শায়লার বুকের ভেতর আমার নখের আঁচড়? সিরিয়াসলি! ছি…! আমি ওকে টাচ করব? ওমন ফিলিংস নিয়ে? ইয়াক থু.. ” বলে সত্যি সত্যি একদলা থুতু পড়ন্তকে দেখিয়ে দেখিয়ে বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে ছুঁড়ে মারলো অভ্র। পড়ন্তর রাগ এবার মাথায় চড়ে বসল।
-“একদম নাটক দেখাবে না বললাম.. একদম না… নাটক হচ্ছে আমার সাথে! সিনেমা? তুমি যদি না-ই ছোও, তাহলে ওই আঁচড় এলো কোথাথেকে? আমি দিয়েছি?”
-“তুই দিবি কেন? ও নিজেই দিয়েছি কী-না দেখ গিয়ে… আমি যে বলতাম তোর মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি বলতে কিছু নেই। কথাটা আসলেই সত্য।” অভ্র পড়ন্তর গাল বরাবর একটা চড় মারতে গিয়েও থমকে গেল। রাগে ভেতরটা তেতো হয়ে উঠছে। যতটা না শায়লার জন্য লাগছে, তার থেকেও বেশি লাগছে পড়ন্তর উপর। এই বিশ্বাস তার! শায়লা এসে কী না কী দেখিয়েছে, আর তার জন্য বিয়েতে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছে সে? এত বড় সাহস!
পড়ন্ত ফের কিছু বলতে নেওয়ার আগেই অভ্র বলল,
-“কী ছুঁয়ে বললি বিশ্বাস করবি বল তো? আমি সত্যি বলছি, ওর সঙ্গে ওসব তো দূর.. এক ছাদের তলায় থাকতেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। যাকে ভালোবাসা যায় না, যার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান বা মর্যাদা আমার নেই, তার সঙ্গে একত্রে থাকার মতো কষ্ট আর কীসে আছে! তুই-ই বল। ওর আর আমার সম্পর্ক এখন সাপে নেউলের মতো। ওকে দেখলেই তো মেরে ফেলতে মন চায় আমার। কখন না ছাদ থেকে ধাক্কা মেরেই ফেলে দেই ওটাকে.. আর তুই বলছিস আমি ওর সাথে..! শোন পড়ু, আগে গিয়ে ভালোমতো যাচাই করে দেখ, আসলেই আমি সত্যি বলছি নাকি ও সত্য বলছে। তবে এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুই যদি এই বিয়েতে মত প্রকাশ করিস, তাহলে আমার আর কিছু বলার নাই। আমি তোকে যথেষ্ট বুঝিয়েছি। আমি মানছি, আমার ভুল ছিল। আমি সময়মতো স্ট্যান্ড নিতে পারিনি৷ কিন্তু এখন তো চাইছি কিছু একটা করতে তাই না? যার প্রতি আমার চোখ ফিরিয়েও দেখতে ইচ্ছা করে না, তার সঙ্গে কীভাবে জোর করে হলেও সম্পর্ক আগাবো বল? তুই যদি আমার না হস, তবুও আমি শায়লাকে ডিভোর্স দিবোই দিবো। ওর সঙ্গে এক ঘরে থাকা জাস্ট অসম্ভব!! আর ওর সাথে শুধু বিয়েটাই হয়েছে। এর বাইরে এমন কিছুই ঘটেনি যে আমি ওকে ফেলে তোকে বিয়ে করতে পারব না.. দ্বিতীয় বিয়ে আমাদের সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না,এটা ঠিক। বাট দ্বিতীয় বিয়ে করে যদি কেউ সুখী হতে পারে, তাহলে দোষটা কোথায়? যার প্রতি ভালোবাসা তো দূর, সম্মানটাই থাকে না, তার সঙ্গে টেনেটুনে কতদূর আগানো যায় জীবনে? বল পড়ু..”

অভ্রর চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। গতকাল রাতেই সে শুনেছে, পড়ন্ত নাকি মত দিয়ে দিয়েছে জাওয়াদদের প্রস্তাবে। তারপর থেকেই পাগলের মতো পড়ন্তর সঙ্গে একদণ্ড কথা বলার জন্য সময় ও সুযোগ খুঁজছিল অভ্র। কোনোমতেই পায়নি দেখে বারান্দায় সকাল থেকে এই পর্যন্ত ঘাপটি মেরে বসে ছিল সে। অবশেষে শেষ বিকেলে ম্যাডামের দেখা মিললো। ঘর ছেড়েও বের হতে কষ্ট বোধহয়!
অভ্রর এত অসহায় লাগল নিজেকে নিজের কাছেই… ভুল তো মানুষ মাত্রই করে। যদি মানুষ ভুল না করত, তাহলে ফেরেশতার সঙ্গে তার কী পার্থক্য থাকত? সেই ভুল শুধরে আজ যখন সবকিছু ঠিকঠাক কর‍তে চাইছে তখন কেন পড়ন্ত শুনছে না? মানছে না? সংসার ভাঙা ঠিক না, এটা ঠিক। কিন্তু যেই সংসারের শুরুটাই অভিশপ্ত, সেই সংসারে আদৌও কী সুখ ধরা দেবে? পাগলেও নিজের ভালো বোঝে! নিজের সুখ বোঝে! তাহলে অভ্র কেন বুঝবে না? তার সুখ যে একজনের মাঝেই নিহিত.. আর সেটা পড়ন্ত। পড়ন্তকে ছাড়া অন্য কাউকেই ভাবতে চায় না সে। অন্তর্দহনে সারাজীবনের জন্য পুড়তে চায় না…

পড়ন্ত প্রত্যুত্তর করার জন্য যুতসই কিছু পেল না। তার শব্দভান্ডারে শব্দ মজুদ নেই। তার বুক চিঁড়ে ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, আজও ঠিক ভেবে পায় না সে। সবকিছু আগের মতোই আছে, তবুও কোথাও কী যেন একটা নেই! চারপাশে তাকালে শুধু ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একরাশ শূন্যতা তার মনবাড়ির ভেতর। সত্যি বলতে, শায়লার সংসার সে ভাঙতে চায় না, কিন্তু শায়লা অভ্রর সঙ্গে কোনোদিনও সুখী হবে না। সে না চাইলেও শায়লার সংসার ভাঙবে, এমনটা অভ্রই বলল মাত্র! আর ওটা সংসারের ক্যাটাগরিতেই পড়ে না! ওখানে সামান্য সমঝোতাটুকু নেই…
পড়ন্ত শায়লার কথা শুনে আর বুকে ওই আঁচড়ের দাগ দেখেই দিকদিশা হারিয়ে ফেলে জাওয়াদদের প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিল। আর দু’দিন বাদে শুক্রবার। সেদিন জাওয়াদদের পরিবার আসবে তাকে আংটি পড়াতে। তাই নিয়ে মোটামুটি একটা তোরজোর শুরু হয়েছে বাড়িতে। পড়ন্ত বড় চাচীর কাছ থেকে উপহার স্বরুপ কী চায়, সেটা জানার জন্যেই বড় চাচার ঘরে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
পড়ন্ত এতক্ষণ যাবত ভেবে রেখেছিল, সে বলবে, আমার কিছুই চাই না। শুধু তোমরা দোয়া দিও। কিন্তু এখন তার মত পাল্টেছে। সে চাইবে… কিছু একটা চাইবে। যেটা তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আত্মসম্মানবোধ মাঝে মাঝে ভালোবাসার কাছে হেরে যায়। মরণব্যাধি ‘ভালোবাসা’ যার একবার গভীর ভাবে হয়েছে,সেই জানে এর জ্বালা কতটুকু! কখনো সুখের আতিশয্যে পৌঁছে দেয়, আবার মাঝে মাঝে দুঃখের সাগরে ডুবিয়ে মারে। তবুও মানুষ ভালোবাসে, ভালোবাসাকে ভালোবাসে, প্রতিমুহূর্তে বাসতে থাকে.. মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাসতে চায়। কী অদ্ভুত সাইকোলজি! তাই না?

অভ্র নিজেকে সামলে নিলো। হাত দিয়ে পুরো মুখ ডলে চোখের পানিগুলো কার্নিশ টপকানোর আগেই মুছে নিলো।তার ভেতরটা কাঁদছে.. চিৎকার করে কাঁদছে। শুধু চাইছে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাক। একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে নিয়ে সংসার করা যায় না! গেলেও সেই সংসারে কেউ সুখী হয় না! আর আজীবন অসুখী থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে এই পৃথিবীতে কেউ আসেনি… সবাই সুখী হতে চায়। যার কিচ্ছু নেই, একদম নিঃস্ব, সেই মানুষটাও গভীর রাতে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে সুখচিত্র দেখে…

অভ্র ভাঙা গলায় বলল,
-“পড়ু, তোর যদি মনে হয় এই বিয়েটা করে সুখে থাকবি, তাহলে কর। আমি বাঁধা দিবো না। কিন্তু প্লিজ, আমি তোকে ঠকিয়েছি, সময়মতো স্ট্যান্ড নেইনি, এর জন্যে এমন কোনো ডিসিশন নিস না, যাতে আজীবন দীর্ঘশ্বাসের ভীড়ে চাপা পড়ে যেতে হয়। আমি জানিরে পড়ু, ঘুম থেকে উঠে যাকে দেখার জন্য চোখজোড়া উদ্ভ্রান্ত হয়ে ওঠে, তাকে বাদে অন্য কাউকে দেখলে কতটা ক্ষতবিক্ষত হয় ভেতরটা। তুই শুধু একঘরে আমাকে আর শায়লাকেই থাকতে দেখলি। অথচ দেখলি না,শায়লার পাগলপানা দেখেও নিজেকে কীভাবে আমি শক্ত করে রেখেছি। নিজেকে কোনো মতেই পুরুষত্বের কাছে মাথা নোয়াতে দেইনি। শায়লাকে আমি ছুঁয়েছি, তবে সেটা জিদে, রাগে, ক্ষোভে। ওকে মারতে গিয়ে ছুঁয়েছি। ভালোবেসে না… তুই বলবি, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। শায়লাকে একসময় না একসময় আমি মেনে নেবো! আসলে এটা তখন হতো, যখন আমার জীবনে তুই থাকতি না। তখন জোরজার করে হলেও একজনের প্রতি মন আঁটাতাম। আজ আমার আত্মা ‘তুই,তুই’ করে কাঁদে। তাহলে কীভাবে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসার স্পর্শ করবো? বল? শারীরিক সুখ ইজ নাথিং পড়ু… মনস্তত্ত্ব শান্তিটাই সব… সেই শান্তি আমি শায়লার থেকে কোনোদিনই পাবো না। আর পেলেও ওকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারব না। আমার সব চিন্তাভাবনা তোর কাছে গিয়েই থামে। যদি পারিস, আমাকে একটা সুযোগ দিস পড়ু। আমি এবার পরিবার, সমাজ, কারো কথাই ভাববো না। ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে, পাপনকে দেখেই বুঝলাম। কত ছোট আমার চেয়ে! অথচ কত বড় একটা স্টেপ নিলো! আমার ভেতরে সাহস ছিল না পড়ু, পাপন সেই সাহস জাগিয়ে তুলেছে। এবার আমি সত্যি সত্যি তোকে যেভাবেই হোক, নিজের করে পেতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দিস পড়ু… জাস্ট একটা।”
হাতজোড় করে ফেলে কথাগুলো বলতে বলতে। পড়ন্ত আর সহ্য করতে পারে না। দ্রুত পায়ে অভ্রর সামনে থেকে সরে গেলে অভ্র হাঁটু ভেঙে ওখানেই বসে পড়ে। সবটাই শেষ… পড়ন্ত আর কোনোদিনও তার দিকে ফিরে তাকাবে না! পড়ন্তর জীবন থেকে অভ্র নামটাই মুছে ফেলবে হয়তো একসময়… আর অভ্র ‘পড়ু, পড়ু’ করেই শেষ শ্বাসটা ছাড়বে।
হাঁটুতে হাত রেখে মাথাটা নিচু করে ফেলে অভ্র। চোখ দিয়ে কখন যে পানি বেরিয়ে আসলো,সেটা সে টের পেল না। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শ পাওয়ায় অভ্র চকিতে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত চোখমুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে পেছন ঘুরতেই দেখল, নিতু দাঁড়িয়ে…

নিতুর চোখজোড়ায় প্রশ্নরা খেলা করছে। অভ্র আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলার চেষ্টা করল,
-“ইয়ে মানে..”
তার আগেই নিতু বলে উঠল,
-“আমি সব জানি ভাইয়া।”
অভ্র চুপসে গেল। নিশ্চয়ই পড়ন্তর থেকে শুনেছে। পড়ন্ত আর নিতুর তো গলায় গলায় ভাব! অভ্র কথা বাড়ালো না। এগিয়ে চলে যেতে চাইলে নিতু বলে উঠল,
-“আপা এত সহজে মানবে বলে মনে হয়। মাঝে আছে একদিন মাত্র। তারপরই আপার এনগেজমেন্ট। এর আগেই যা করার করে ফেলো ভাইয়া। নইলে আজীবন পস্তাতে হবে তোমাদের দু’জনকে। ভালোবাসার মাঝখানে ইগোকে আসতে দিও না ভাইয়া। আমি ছোট মানুষ, তোমাকে আর কীইবা জ্ঞান দিব! তাও বলব, যা ভালো মনে করো,তাই করে ফেলো। আমাদের পরিবার কখনোই তোমাদের অনুভূতির মর্যাদা দিবে না। তার উপর এখন তুমি বিবাহিত।”
অভ্র নিতুর দিকে তাকালে নিতু আশ্বস্ত ভঙ্গিতে হাসল।
-“আমি দোয়া করি, তোমরা যেন এক হতে পারো, আর সুখী হও। এই পৃথিবীতে ভালোবাসা ছাড়া আর কীইবা আছে বলো!”
অভ্র জবাব দিলো না। চুপচাপ প্রস্থান করলো।

নিজের ঘরে বসে গভীর ভাবনায় ডুবে রয়েছে অভ্র। কী করবে তার মাথায় আসছে না। একটা উপায় অবশ্য পেয়েছে। কিন্তু পড়ন্ত… ও কী রাজী হবে? পড়ন্ত তো তাকে সুযোগই দিতে চায় না! তার উপর এই শায়লা তো গোদের উপর বিষফোঁড়া! অভ্রর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনি ঘরের ভেতর আবির্ভাব হলো শায়লার। অভ্র চোয়াল শক্ত করে ফেলল। মনে মনে বলল,
-“শয়তানের নাম নিছি, আর শয়তান হাজির হয়ে গেছে!!”
শায়লা গুনগুন করে গান গাইছে। তার মনে আনন্দ যেন আর ধরে না। এত আনন্দের কারণ পড়ন্তর বিয়েতে রাজী হয়ে যাওয়া…আরও একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে শায়লা। পড়ন্তর বিয়ের পর পরই যেভাবেই হোক, অভ্রর সাথে ইন্টিমেট হওয়ার চেষ্টা করবে সে। দরকার পড়লে উল্টাপাল্টা জিনিস খাইয়ে অভ্রকে বেকায়দায় ফেলে হলেও করবে। তবুও একটা বাচ্চা তার চাই.. বাচ্চা হয়ে গেলে অভ্র আর কখনোই তাকে ফেলতে পারবে না। তাকে মানতে বাধ্য হবে এবং এই পরিবারেও তার গুরুত্ব বাড়বে। নিজের তারিফ নিজেকে করতে হয় না কখনোই, তবুও শায়লা মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রশংসনীয় মন্তব্য করল। কীভাবে নিজের বুকে নিজে নখের আঁচড় টেনে পড়ন্তকে ঘোল খাইয়ে বিয়েতে রাজী করালো- ভাবতেই শায়লা উত্তেজিত হয়ে উঠল। ভেতরে ভেতরে খুশির সাগরে ঢেউ খেতে লাগল সে। আলমারির পাল্লা খুলে একটার পর একটা শাড়ি সরিয়ে পছন্দনীয় কোনো রংই চুজ করতে না পেরে এবার পেছন ঘুরে তাকাল। টিটকারির সুরে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“কোন শাড়িটা পড়ব? একটু বেছে দাও তো..”
অভ্র কিছুই বলল না। সে চুপচাপ শায়লার আনন্দ দেখছে। তার ভেতরটা যে রাগে ফুঁসে উঠছে জলামুখীর মতো, তা চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে না।
শায়লা একা একাই স্বগতোক্তি করল,
-“পড়ন্তটার এনগেজমেন্ট, আমাকে সুন্দর করে রেডি হতে হবে তো সেদিন৷ বাট একটা শাড়িও পছন্দ হচ্ছে না। এই, আমাকে নিয়ে একটু শপিংয়ে যাবে? একটা নতুন শাড়ি কিনতাম.. তুমি কী পরবে? পাঞ্জাবি? নাকি শার্ট?”
বলতে বলতে ঠোঁট চিঁড়ে ফিচেল হাসি খেলা করতে শুরু করল। অভ্র নির্নিমেষ চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে শায়লা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। যদিও অভ্রকে এভাবে জ্বালাতে তার ভালো লাগছে না, তবুও এমনটা করছে তাকে চড় মারার অপরাধে। যতক্ষণ অবধি পড়ন্তর বিয়েটা না হচ্ছে, অভ্রকে তার চূড়ান্ত শাস্তি স্বরুপ টিটকারিগুলো শুনে যেতে হবে। তারপর শায়লা অভ্রকে একদম আপন করে নিবে। অভ্রকে নিজের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে বলবে মন খুলে…

বড় চাচীর সঙ্গে পড়ন্তর কী কথা হলো, কে জানে! রাতের সময় তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। তার চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে রইলেও চেহারায় অদ্ভুত এক প্রশান্তি। অভ্র বারান্দার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে তারই অপেক্ষা করছিল। পড়ন্ত অভ্রকে দেখতে পেয়ে এবার আর উপেক্ষা করল না বরং নিজেই আগ্রহ করে তার দিকে এগিয়ে গেল। হাত ইশারায় ডেকে বলল,
-“একটু এদিকে আসবে? কথা আছে।”
অভ্র বলল,
-“আমারও কথা আছে। নিচে আয়। ওখানে কথা বলব। এখানে কেউ না কেউ দেখতে পারে।”
পড়ন্ত রাজী হয়ে গেল। অভ্র চলে গেল আগে আগে, পড়ন্ত পেছন পেছন গেল। মেইন গেট খুলে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলল অভ্র। পড়ন্ত অবাক হলেও থামল না। তাকে অনুসরণ করে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর অভ্র থামল। তারা বড় রাস্তায় চলে এসেছে। পুরো রাস্তা নির্জন। একটা মাইক্রো অবহেলায় রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর কোথাও কেউ নেই। পড়ন্ত ডাকল,
-“এই.. এখানে নিয়ে এলে কেন?”
অভ্র পেছন ফিরে তাকাল। পড়ন্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই তার খুব কাছাকাছি চলে এসে একটা রুমাল নাকের সামনে তুলে ধরল।
-“ঘ্রাণটা জোস না?” বলতে বলতে পড়ন্তর নাকের ভেতর পারে না রুমালটা গুঁজে দেয় সে। পড়ন্ত একটা তীব্র গন্ধ পেল। সেই সঙ্গে তার ব্রেইন ক্রমশ ভোঁতা হয়ে আসতে লাগল। চোখজোড়া এত ভারী হয়ে গেল, খুলে রাখা দায়। পড়ন্ত চেতনা হারানোর আগে শুনতে পেল, অভ্র বলছে,
-“আই এম সরি পড়ু। এছাড়া আর কোনো উপায় আমার জানা ছিল না। তোকে আমি খুব আদরে রাখব, প্রমিস…”
পড়ন্ত প্রত্যুত্তর করতে পারল না। অভ্রর গায়ের উপর নেতিয়ে পড়ল।

চলবে…

#অন্তর্দহন_১৩
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

ভোরের আলো একটু একটু করে ফুঁটছে। পূর্ব দিগন্তে নববধূর ন্যায় রাঙা সূর্য উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আঁধার সরিয়ে প্রকৃতি আলোকিত হলেও উদ্দিন বাড়িতে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার বিরাজমান।
রাত শেষ হতে চললেও একজোড়া চোখও বিশ্রাম পায়নি। সদর দরজার মুখে তমিজ উদ্দিন মাথা উঁচু করে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে রয়েছেন, মনে মনে খুঁজে চলেছেন অভ্রকে। মিথুন উদ্দিন ডাইনিং টেবিলের উপর মাথায় হাত রেখে চুপচাপ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। খোকন উদ্দিন একবার বড় ভাইয়ের কাছে যাচ্ছে, একবার ছোট ভাইকে স্বান্তনার বাণী শোনাচ্ছে। বড় চাচী আর নাসরিন দু’জনেই ঘরের দরজা আঁটকে থম মেরে গেছেন। শুধু শিখা খানিক বাদে বাদে আক্রোশপূর্ণ চাপা চিৎকারে বাড়ির নিরবতা কাটিয়ে কান্নার সুর ভাজছে। আর শায়লা? সে যেন জনমের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বড় জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশপানে মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, ঝড়ের আঘাতে আহত এক পাখি, যার ডানাজোড়া ভেঙে গিয়েছে। চিরজীবনের জন্য উড়ার সাঁধ মিটে গিয়েছে।
খোকন উদ্দিন শিখাকে একটা রাম ধমক লাগালেন। বললেন,
-“এত কান্নাকাটি কীসের হ্যাঁ? যাও ভেতরে যাও।”
শিখা থামলেন না বরং সমান তেজ নিয়ে গলা বাড়ালেন,
-“আমাকে থামতে বলছো তুমি? আমার মেয়ের এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল, আর তুমি আমাকে থামতে বলছো? চেয়ে দেখো,আমার মেয়েটা কেমন হয়ে গেছে। আর তুমি বাপ হয়েও কী করে এত চুপচাপ থাকতে পারো? হ্যাঁ?”
খোকন উদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। সে তো আগেই বলেছিলেন, শায়লা আর অভ্রর বিয়ে যেভাবেই হোক, ছাড়াছাড়ি করিয়ে দিতে। অথবা দু’জনের পরিপূর্ণ মত নিয়ে তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে। শিখাই তখন বাড়াবাড়ি করে খোকন উদ্দিনকে থামিয়ে রেখেছিলেন। আর শায়লারও মত পেয়ে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো অভ্রও এই বিয়েতে রাজী আছে। তাই আর কথা বাড়াননি। অথচ আজ শুনলেন, শায়লাকে কোনোদিন ভালোবাসা তো দূর, অন্যরকম চোখেই দেখেনি অভ্র! তার সম্পর্ক আর কারো সাথে নয়, তাদেরই পরিবারের মেয়ে পড়ন্তর সঙ্গে! শেষমেশ কী হলো? একই পরিবারের তিন-তিনটে জীবন নষ্ট হয়ে গেল! আজ শায়লা থমকে গিয়েছে, অভ্র-পড়ন্ত ঘরছাড়া হয়েছে… এরপর আর কী কী ঘটবে! কে জানে!
খোকন উদ্দিন নিতুকে বললেন,
-“ওকে ঘরে নিয়ে যা তো। ওরে একটু ঘুমোতে বল।”
নিতু দু’কদম এগোতেই শায়লা পেছন ফিরে তাকালো। খোকন উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আমার ঘুম আসবে না বাবা। আমি এখানেই থাকি না.. ও আসবে। আমি জানি বাবা, ও আসবে।”
নিতু চমকে উঠল। শায়লার কথার ধরন এবং সুর, কোনোটাই ভালো ঠেকলো না তার কাছে। শায়লার ব্রেইনে অতিরিক্ত চাপ পেয়ে পাগল টাগল হয়ে যাবে না তো! ইশ, কী যে হবে… নিতুর চিন্তা হলো। মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করলো, ‘সবকিছু ভালোভাবে ঠিকঠাক হয়ে যায় যেন খোদা। এই তিনটি জীবনকে তুমি গুছিয়ে দাও।’

একটা চাপা নিঃশ্বাস নিতুর নাসিকা রন্ধ্র ভেদ করে বেরিয়ে আসলো। সে শায়লার কথাকে পাত্তা না দিয়ে তাড়া কণ্ঠে বলে উঠল,
-“আপা, চলো। ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও।”
-“আমি কী বললাম, তুই শুনিসনি? ও আসবে, আমি জানি। আমি কোত্থাও যাবো না, আমি এখানেই থাকবো।”
নিতু পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করল,
-“আচ্ছা, আসবে তো ভাইয়া। আমি কী বলছি যে আসবে না? আসুক আগে। আসলে তো তোমার কাছেই যাবে আগে তাই না? তুমি ভেতরে চলো। আসো..”
শায়লার একটা হাত চেপে ধরলে ঝটকা মেরে সেটা সরিয়ে নেয় সে। নিতুর দিকে কটমট করে তাকালে তমিজ উদ্দিন এগিয়ে আসেন। শায়লার মাথায় হাত রেখে বললেন,
-“তোর সংসার আমি ভাঙতে দিবো না মা। তুই চিন্তা করিস না। অভ্র যদি আমার কথা না শোনে, তাহলে এই বাড়িতে ওর আর কোনো জায়গা হবে না।”
মিথুন উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
-“তাহলে আমার মেয়ের কী হবে ভাইজান? শায়লার কথা আপনি চিন্তা করলেন, আর আমার মেয়ের কথা চিন্তা করলেন না?”
-“বিয়ের আগে কেন সে পরিবারে জানায়নি এই কথা? এখন শায়লার সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তামাশা করলে তো চলবে না। আর যদি অভ্রকে পড়ন্ত না ছাড়ে, তাহলে ওর-ও এই বাড়িতে কোনো জায়গা হবে না।”
কঠিন গলায় কথাটি বলতেই মিথুন উদ্দিন হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। সেই সঙ্গে একরাশ ক্রোধ তাকে ঘিরে ধরল। বড় ভাইয়ের কথা শুনেই আজ পাপনকে হাতছাড়া করে ফেলেছে তিনি! এখন আবার নিজের মেয়ের জীবন নিয়েও টানাটানি!
-“পড়ন্ত তো মেয়ে মানুষ। আর মেয়েরা চাইলেই তো মুখ খুলতে পারে না তাই না?”
বললেন মিথুন উদ্দিন। তার জবাবে শায়লা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল,
-“অথচ অভ্রকে ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে! তাই না?”
-“তুই চুপ থাক.. বড়দের মাঝখানে তোর কথা কীসের? ঘরে যা..” ডাইনিংয়ে পা ফেলতে ফেলতে বড় চাচী শায়লাকে ধমক লাগালেন। শায়লা চুপসে গেল। বড় চাচার কাছে প্রশ্রয় পেলেও বড় চাচী তাকে কোনোদিনই প্রশ্রয় দেইনি। এমনকি অভ্রর বউ হওয়ার পরেও বড় চাচী তাকে নামেমাত্র মেনে নিয়েছিল, মন থেকে নয়। শ্বাশুড়ি আর বউয়ের যে একটা সুন্দর বন্ধন থাকে, তা বড় চাচীর সঙ্গে কখনোই গড়ে উঠেনি।

শায়লাকে ধমকানো দেখে শিখা জ্বলে উঠলেন। তেজী গলায় বললেন,
-“ওরে ধমকান কেন ভাবী? ও তো সত্য কথাই বলছে। যে মেয়ে মুখ ফুঁটে কথা বলতে পারে না, সে কেমনে অভ্রকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল?”
-“অভ্রকে ও কেন ভাগাতে যাবে? না জেনে শুনে একটা কথা বলে দিলেই তো হলো না। এমনও তো হতে পারে, এই পালিয়ে যাওয়ার পেছনের পুরো পরিকল্পনাটাই অভ্রর করা। কারণ, গতকাল সন্ধ্যায় পড়ন্ত আমাকে সব খুলে বলেছিল। ওর আর অভ্রর সম্পর্কের কথা..মাঝ দিয়ে কীভাবে শায়লা উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল, সেটাও। এমনকি যখন আমরা গ্রামে গিয়েছিলাম, সেদিন অভ্রও আমাকে বলেছিল, আমরা নাকি ওর জীবনটা শেষ করে দিয়েছি। শায়লার সঙ্গে এক ছাদের তলায় বসবাস করা ওর পক্ষে সম্ভব না। সেদিন আমি পুরোটা না বুঝলেও পড়ন্ত গতকালকে আমাকে সবকিছু বিস্তারিত বলেছে। অভ্র আর ও যে কতটা কষ্ট পাচ্ছে ভেতরে ভেতরে তা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। আর শায়লা, আমার জানামতে তোদের দু’জনের বিয়েটাই হয়েছে শুধু, দাম্পত্য জীবন শুরু হয়নি…!”

উপস্থিত সবাই শায়লার দিকে চোখ ফেরালে চোখ কঠিন সুরে বলল,
-“আপনি কী রাতের বেলা আমাদের ঘরে উঁকি মেরে দেখেছেন যে এই কথা এত জোর দিয়ে বলতে পারলেন?”
বড় চাচী চিৎকারের সুরে বললেন,
-“কথাবার্তা সাবধানে বল শায়লা। তোমার মেয়েকে দেখছি শিক্ষাটাও দিতে পারোনি শিখা। শুধু সেজেগুজে পুতুল সেজে থাকলেই হয় না… ন্যূনতম আদবটা অবধি নাই! অভ্র তো আমার পেটের সন্তান, আমি চিনি ওকে.. ওর চোখে তোর জন্য যে ঘৃণা আমি দেখেছি, তারপরও তুই বলছিস তোদের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছে?”
শায়লা দাঁত দিয়ে দাঁত ঘঁষলো। প্রত্যুত্তর করতে পারল না।

তমিজ উদ্দিন বললেন,
-“গলা বাড়ানো শিখে গেছো দেখছি।”
বিয়ের প্রথম থেকেই স্বামীর সঙ্গে কখনো কোনোপ্রকার তর্কে যাননি তিনি। তমিজ উদ্দিন যা বলেছেন, তাই মেনে নিয়েছেন। সেটাকেই সঠিক ভেবে জীবনে এগিয়েছেন। বিয়ের বয়স কম হলো না, তবুও এতদিনে তার এই অভ্যাস পাল্টায়নি। কিন্তু আজ, অভ্রর জন্য হলেও তিনি চুপ করে থাকতে পারলেন না। তমিজ উদ্দিনের মুখোমুখি হলেন। এবং বললেন,
-“আজকে আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবেন না। আপনি চোখ খুলে একটু বাস্তবতা দেখুন। শায়লার সঙ্গে জোরাজুরি করে আমার ছেলে কোনোদিনই ভালো থাকবে না। বিয়েটা কয়েক মাসের ব্যাপার না, সারাজীবনের ব্যাপার। আমি চাই না বুড়ো বয়সে আমার ছেলে এই ভেবে ভেবে আফসোস করুক যে, এমন এক বাবা-মা পেয়েছি জীবনে, যারা আমার সুখের মূল্যই দিতে জানলো না!”

শায়লা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। শিখা মেয়েকে এক ধমকে চুপ করিয়ে বড় চাচীকে বললেন,
-“ভাবী, আপনি দেখি গভীর জলের মাছ। নিজের পেটের সন্তান সব, আর আমার মেয়ে কিছু না? বিয়েটা আপনার কাছে কিছুই না?”
-“না, কিছু না, যদি না সেই বিয়ে কোনো সুখী জীবন নিয়ে আসতে পারে। শায়লাই কী ভালো থাকবে আমার ছেলের সাথে? অভ্র তো কোনোদিন শায়লাকে মেনে নিবে না। একসময় আপনার মেয়েই ত্যক্ত হয়ে অভ্রকে ছেড়ে চলে যাবে। তাহলে সেই একসময় টা এখন কেন নয়? কেন আপনারা কেউ বুঝতে চাইছেন না, অভ্রর ঘাড়ে শায়লাকে চাপিয়ে দেওয়া মানে, অভ্র আর শায়লার দু’জনের জীবনই নষ্ট করা। মাঝ খান দিয়ে পড়ন্তটাও ধুকে ধুকে মরবে…তিনটা জীবন নষ্ট করে আমরাই বা সুখে থাকতে পারব কী? তারচেয়ে যে যেভাবে সুখে থাকতে চাইছে, সেভাবেই সুখে থাকতে দেওয়া উচিত। আমরা যদি পরিবার হয়েও ওদের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে কোথায় যাবে এই বাচ্চা দুইটা?”
-“ব্যস, অনেক হয়েছে তোমার লেকচার.. ভেতরে যাও তুমি। আর একটা কথাও না…” তমিজ উদ্দিন হুংকার ছাড়লেন। বড় চাচী ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেও বাহির থেকে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেন।

শিখা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠলেন,
-“তাহলে আমার মেয়ে যে অভ্রকে ভালোবাসে, সেটা? সেটা কিছু না?”
-“শায়লা কখনোই অভ্রকে ভালোবাসেনি শিখা। যদি বাসতো, তাহলে অভ্রকে সুখে থাকতে দেখে নিজেও সুখী হতো। ও বরং সব জেনেও অভ্রকে বিয়েটা করেছে। অভ্রর জীবনে জোরজবরদস্তি থাকতে চেয়েছে, অভ্র ওর সাথে সুখী না জেনেও…”

তুমুল সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল উপস্থিত সকলের মধ্য দিয়ে। শেষে দেখা গেল, বড় চাচীর কথার সঙ্গে মিথুন উদ্দিনও সম্মতি দিয়েছেন। নিতুও তাদের পক্ষেই…
মাঝদিয়ে তমিজ উদ্দিন আর শিখা শায়লার সঙ্গেই অভ্রকে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর খোকন উদ্দিন পড়েছেন দোটানায়। সে স্পষ্ট ভবিষ্যৎ দেখতে পারছে। সেখানে অভ্র বা শায়লা কেউ সুখী নয়, তবুও স্ত্রীর বিপক্ষে কিছু বলতে পারছেন না। শিখার মুখ ভালো না। সবার সামনেই একটা ঝারি টারি দিয়ে বসলে পরে খোকন উদ্দিনই লজ্জা পাবেন। তিনি শিখার হাত টানতে টানতে ঘরে নিয়ে দরজা আঁটকে দিলেন। শিখাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে হবে। কেন শুধু শুধু তিনটা জীবন নষ্ট করবে? শায়লার জন্য আরও ভালো পাত্র পাওয়া যাবে তো…

নাসরিন ভারী পর্দা টানিয়ে পুরো রুম অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছেন আর হু হু করে চিকন সুরে কাঁদছেন। এবার এক এক করে সব অংক তার সামনে পরিষ্কার। অভ্রর গায়ে হলুদের দিন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বিয়ের দিন অসুস্থতার বাহানায় ঘরে দরজা আঁটকে রাখা, রাতের বেলা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে, ‘আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মা..’ বলে কান্না করতে থাকা,গ্রামে না যেতে চাওয়া, আর বারবার ‘তোমরা তো নিজেদের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ায় ওস্তাদ’ বলার কারণটা তবে এই… ‘অভ্র’ যে তার মেয়ের প্রথম বেলার প্রেম, প্রথম বেলার আবেগ! কী করে চোখের সামনে অভ্রকে শায়লার সঙ্গে মিলিয়েছে পড়ন্ত, তা এক বিস্ময়! এর চেয়ে কঠিন কাজ বুঝি আর হয় না পৃথিবীতে!
অথচ সে মা হয়েও মেয়ের বুকের হাহাকার আর আর্তনাদটা শুনতে পাননি। মেয়েকে বুঝতে পারেননি। মন যে কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছিল পড়ন্তর তাও টের পাননি, উল্টো তাকে অন্যের গলায় ফের ঝুলিয়ে দেওয়ার পায়তারা করছিলেন!
যদি এই বিয়েটাও হয়ে যেতো, তাহলে কী হতো? পড়ন্তকে আগুনে ঠেলে দেওয়া হতো। আর পড়ন্ত,সে কী কোনোদিন তার বাবা-মাকে ক্ষমা করতে পারতো?

প্রেমঘটিত কোনো কারণে ডিপ্রেশনে চলে গেলে ব্যাপারটা আমাদের বাচ্চারা আমাদের বলতে পারে না! সামান্য আঙুল কেটে যাওয়ায় যে মেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে, মনবাড়ি ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় সেই মেয়ে কী শক্ত হাতে সবকিছু সামাল দেয়! তাও একদক একাকী ভাবে! অথচ বাচ্চারা চুপচাপ থাকলে,দুনিয়ার রঙিন জীবনের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে আমরা তাকে ‘ঢং’ বলে অবিহিত করতে এতটুকুও দ্বিধা করি না! পৃথিবীর সব ছেলে-মেয়ে ভালো, শুধু আমাদের বাচ্চাদের পছন্দ করা ছেলেটি, অথবা মেয়েটি ভালো না… তারা যখন ডিপ্রেশনের দুয়ারে মাথানিচু করে একটু বাঁচার আশা খুঁজে বেড়ায়, আমরা তখন আরও উল্টাপাল্টা কথা বলে তাদেরকে বিষিয়ে তুলি…আর এজন্যেই প্রতিদিন একজন করে মানুষ সুইসাইডের মতো ভয়ংকর পথটি বেছে নেয়!

নাসরিনও তো পড়ন্তকে সুইসাইডের দিকেই ধাবিত করছিলেন। অভ্রকে হারানোর শোকের পাশাপাশি যখন অন্য একটি ছেলের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে অনাঙ্ক্ষিত জীবন যাপনের শোক পুরোপুরি ভাবে পড়ন্তকে গ্রাস করে নিতো, সে সহ্য করতে না পেরে হয়তো সুইসাইড বা এরচেয়েও ভয়ানক কোনো পথ বেছে নিতো! পড়ন্ত এইমুহূর্তে অভ্রর সাথে কোথায় আছে,তা নাসরিন জানে না, তা নিয়ে সে চিন্তিতও নয়। শুধু একটা ব্যাপারই তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে, মা হয়েও মেয়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু তিনি কেন হতে পারলেন না! পড়ন্ত যখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি কেন তাকে সঙ্গ দিতে পারলেন না। মেয়েটা কেন তার বুকে মাথা রেখে মনপ্রাণ খুলে কাঁদার অবকাশটুকু পেল না?

চোখের সামনে থেকে গাঢ় আঁধার ধীরে ধীরে কেটে চিকন একটা আলোর রেখা ধরা দিলো। পড়ন্ত পিটপিট করে চোখ মেলতেই কারো চাপা আওয়াজ শুনতে পেলো।
-“পড়ু.. এই পড়ু.. ডোজ বেশি হয়ে গেল নাকি!”
পড়ন্ত নাকমুখ কুঁচকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাতেই অভ্রর মুখমন্ডল টা তার রেটিনায় গিয়ে ধাক্কা খেলো। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল, তার সাথে ঘটা ঘটনাগুলো। তাকে অভ্র কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে! ইন্না-লিল্লাহ…
পড়ন্ত ধড়মড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করলে অভ্র একটা পানির বোতল তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“কুলি কর। মুখ দিয়ে গন্ধ বের হচ্ছে। তুই একদিন দাঁত না মাজলেই এই অবস্থা হয় নাকি?”
পড়ন্ত তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিতে পারল না। তার হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে। মাথার ভেতরটা ক্রমশ ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসছে।
কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় পড়ন্তকে স্ট্যাচু হয়ে থাকতে দেখে অভ্র কপালে ভাঁজের সৃষ্টি করে ফের বলল,
-“কী হলো? ধর বোতলটা।”
পড়ন্ত বোতল ধরল না, পাল্টা প্রশ্ন করল,
-“কয়টা বাজে?”
-“উমম.. সাতটা।”
-“রাত?”
-“দিন! সকাল.. সারারাত তো মরার মতো ঘুমিয়েছিস। এত পানি ছিটালাম তাও উঠলি না। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম।” বলে আড়মোড়া ভাঙলো অভ্র, তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি! সবকিছু ঠিকঠাক আছে। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল বোধহয়!
পড়ন্ত নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ধাতস্থ করতে গিয়ে নিজেকে রাগের আতিশয্যে আবিষ্কার করল।
দাঁত কটমট করে অসহায় গলায় পড়ন্ত বলল,
-“এটা কী করলে তুমি? আমাকে এভাবে কিডন্যাপ কেন করলে?”
-“তোর বাপের কাছে এখন টাকা চাবো। এক কোটি টাকা.. তারপর সেই টাকা দিয়ে আমি শায়লাকে নিয়ে পগারপার..”
হেয়ালি করে বললে অভ্র, পড়ন্ত চিৎকার করে উঠল,
-“কী…!”
-“কী আবার? তোকে কেন এনেছি জানিস না? আবার জিজ্ঞেস করিস কেন?”
-“তুমি জানো আমি বড় চাচীকে আমাদের ব্যাপারে সব বলে রাজী করিয়েছিলাম? উনি পারিবারিক ভাবে এই টপিক তুলবে, এমনটা বলছিলেন। আর তুমি কী করলে..” পড়ন্তর মুখটা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল। অভ্র টাশকি খেলো এবার।
-“বলিস কী! সত্যি বলছিস?”
-“তোমার মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি?”
-“তাহলে আমাকে আগে বললি না কেন এই কথা?”
-“তোমাকে বলার জন্যেই তো ডাকছিলাম। কে জানতো, আমাকে বাইরে নিয়ে ‘ঘ্রাণটা জোস না’ বলে আমার নাকের ভেতর রুমাল ঢুকিয়ে দিবে তুমি?”
চিবিয়ে চিবিয়ে বলল পড়ন্ত। ভীষণ রাগ লাগছে তার। আশেপাশে তাকিয়ে জায়গাটা সঠিক ঠাহর না পেরে অভ্রকে বলল,
-“এটা কোথায়? কতদূর নিয়ে আসছো তুমি আমাকে?”
অভ্র ঠোঁট দিয়ে ‘চ’ কারান্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করে মাথা দোলালো দুইদিকে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
-“আরে ধুর… এটা আমাদের বাসার পেছনের রাস্তাটা… চোখ মেলে দেখ।”
-“অ্যাহ!” পড়ন্ত অবাক, পালিয়ে গিয়ে কেউ বাসারই পেছনের রাস্তায় আশ্রয় নেয় বলে জানা ছিল না মোটেও! তার উপর তারা আছে একটা গাড়ির মধ্যে। এই গাড়িটাই বা কার?
-“এটা কার গাড়ি?”
-“আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের। ধুরো.. কথা বলে মেজাজ খারাপ করিস না তো। আমাকে একটু ভাবতে দে…”
-“কী? কী ভাববে তুমি? আমাকে উঠিয়ে আনার আগে ভেবে রাখোনি যে এরপর কী করবে? আর এখানে আছো কোন আক্কেলে? যে কেউ দেখে ফেলতে পারে।”
-“পারবে না। প্রথমত, রাতের বেলা রাস্তাঘাটে তেমন কেউ থাকে না, কুকুররা অবধি ঘুমায়, সো আমি নিশ্চিন্তেই রাত কাটিয়েছি। দ্বিতীয়ত, গাড়িতে কালো কাঁচ দেওয়া। বাহির থেকে কেউ দেখবে না ভেতরে কী আছে। সাউন্ডও পাবে না। সবাই মনে করবে একটা গাড়ি এমনিই অবলীলায় পড়ে আছে।”

পড়ন্ত ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বলল,
-“এখন কী করবে তুমি? সবকিছু তো গুবলেট পাঁকিয়ে দিয়েছো।”
-“উঁহু.. কিচ্ছু নষ্ট হয়নি। এবার আরও কাজ সহজ হবে। মা যেহেতু আমাদের পক্ষে আছে, সো সবাইকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে আমি শিউর। আর আমরা এখন বিয়েটা করব। বিয়ে শেষে বাসায় উঠব। দরকার পড়লে আমি দুই বউ নিয়ে থাকবো। কী প্রবলেম তাতে?” বলেই পড়ন্তর দিকে চোখ ফেরাতে না ফেরাতে পড়ন্তর ছোট্ট হাত জোড়া ধাম করে একটা ঘুষি মেরে বসল অভ্রকে। অভ্র হতচকিত! পড়ন্তর দিকে তাকাতেই দেখল, সে হিসহিসিয়ে বলছে,
-“তোর একটাই বউ থাকবে, আর সেটা আমি। মনে থাকবে?”
ফাঁকা ঢোক গিলে অভ্র মাথা কাত করল,
-“মনে থাকবে।”
পড়ন্ত নিভলো। অভ্রকে ‘সরি’ বললে অভ্র ‘ব্যাপার না’ বলে সরে বসল। কিন্তু সত্যি, ঘুষিটা দারুণ শক্ত ভাবেই লেগেছে। ইশ! এখন দাঁত নাড়ালেও ব্যথা লাগছে! অভ্র ভয়ার্ত চোখে চিন্তায় মগ্ন পড়ন্তর দিকে একবার তাকাল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here