অন্তঃপুরে দহন পর্ব ৪

0
580

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-4)

#আরশিয়া_জান্নাত

অন্তরা এই অন্তরা তাড়াতাড়ি শুনে যা তো! মা,,, মা

কিরে এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?

তুই আমার ওয়ালেট ধরেছিস আবার তাই না?

আমি কেন তোর ওয়ালেট ধরতে যাবো স্ট্রেইঞ্জ!

একদম নাটক করবি না। তোর জন্য আমি কোথাও শান্তিতে টাকাও রাখতে পারিনা। উফফ!

শোন ভাইয়া পরিবারে আমার তোর বলে কিছু নেই। এখানে যা আছে তা সবার। তোর টাকা মানে আবার কি?

ওহ তাই? তাহলে তোর টাকা মানেও আমার টাকা! বাবা তোকে রোজ কত টাকা দেয় তাও তোর হয় না? তুই আসলে অতি আদরে বান্দরনী হয়ে গেছিস। যত পাই তত চাই স্বভাব। এই স্বভাব বদলা নয়তো পরের ছেলের ঠেঙ্গানী খাবি!

তুই সামান্য কিছু টাকার জন্য এতো কথা শুনাচ্ছিস! কত কৃপণরে তুই ছিঃ! শোন এতো ছোট মন রেখে চলিস না তোর বৌ এলে পরে ছোটলোক বলবে। আর টাকা নেওয়াই দেখলি আমি যে রোজ তোর ঘর গুছিয়ে দেই শার্ট প্যান্ট ইস্ত্রি করে দেই ঐসবের চার্জ দিস কখনো? হিসেব করে দেখ মাসে কত টাকা আসে আর আমি কত টাকা নেই। দেখবি আমি মহান বলেই কম টাকায় তুষ্ট হই কিন্তু তুই যেভাবে কথা শুনাচ্ছিস এখন থেকে হিসাবনিকাশ লিখে রাখতে হবে। ভালোর যামানাই রইলো না।

ওমর অন্তরার কান মলে বললো, ওরে আমার ভালোর রাণী। ভাইয়ের কাজ করে দিবি তাতে আবার হিসাবনিকাশ! বোন হয়েছিস কিজন্য?

আহ ভাই লাগছে তো! আমার দোষ কি? আমিতো আগে হিসাব করিনি বাপু! তুই ভাই হয়ে যদি বোনের টাকা নেওয়া সহ্য করতে না পারিস তবে আমাকেও যে ঐ পথে চলতে হবে।

ওমর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই শামীমা কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী গলায় বললো, তোরা ফের ঝগড়া করছিস? তোদের না কতবার বারণ করেছি ঝগড়া করতে? ওমর তুই ওর কান মলে দিচ্ছিস কেন? তোরা পারিস ও বটে গায়েগতরেই বড় হয়েছিস কাজেকর্মে এখনো ছোট বাচ্চা।

মা শোনো আমি বলে দিচ্ছি এই বাসায় যে চুন্নিটা আছে এর হাত দিনদিন পাক্কা হয়ে যাচ্ছে। এ তোমার নাম ডুবাবে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা রোজ কল করে বলবে আপনাদের মেয়ে তো পাকা চোর। সবসময় চুরি করতেই থাকে,,,

মা দেখলে দেখলে তুমি তোমার ছেলে আমাকে চোর বললো!

অনুমতি ছাড়া কারো জিনিস নিয়ে গেলে তাকে চোর না তো কি বলবো?

অন্যের জিনিস নেই নি ভাইয়ের টা নিয়েছি।

অভ্যাস তো চোরেরই এখন ভাইয়ের নিক বা অন্য কারো!

শামীমা কানে হাত দিয়ে বললেন আল্লাহ রক্ষা করো! ছিঃ ওমর ছোট বোনকে কেউ চোর বলে? তোর কি দশটা পাঁচটা বোন আছে? একটাই তো বোন সে তোর থেকে নিবে না তো কার থেকে নিবে?

মা নিলে নিক না। কিন্তু না বলে নিবে কেন? তুমি জানো আমি গতকাল মিটিং শেষে কফিশপে গিয়েছিলাম। আমিতো জানি ওয়ালেটে টাকা আছে। কিন্তু বিল দিতে গিয়ে দেখি বাস ভাড়া ছাড়া কিছুই নেই! কি একটা ইমবেরেসিং ঘটনা বুঝতে পারছো?

এসব কি শুনছি অন্তরা? ছেলেমানুষের পকেট এভাবে ফাঁকা করে কেউ?

আমি কি জানতাম নাকি ভাইয়া কফি খেতে যাবে!

তাই বলে গনা গনা টাকা রাখবি কেবল? রাস্তাঘাটে বিপদ আপদের কথা বলা যায়। কখন কোথায় টাকা লাগে! এখুনি গিয়ে টাকা নিয়ে আয় যা!

অন্তরা গাল ফুলিয়ে তার রুমে চলে গেল টাকা আনতে। শামীমা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কোথাও বের হবার আগে চেক করে নিতে পারিস না বাবা। জানিস তো বোনটা একটু বেশি দুষ্ট! হ্যাঁ রে পরে বিল দিলি কি করে?

ঐখানে আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়েছিল। ও ই বিল পে করে দিল।কি যে লজ্জা লাগছিল মা জানো না!!

থাক মন খারাপ করিস না আমি অন্তরাকে বুঝিয়ে বলে দেব।

ওমর মনে মনে বললো, মা কিভাবে বলি যার সামনে ঐ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সে যে খুব স্পেশাল। ঐ লজ্জা আমি কিভাবে ভুলি বলো!!


অনীলের শরীর আজকাল বিশেষ ভালো থাকেনা। বয়সের সাথে সাথে শরীরে বাসা বেঁধেছে কত রকম রোগবালাই। ডায়বেটিসের চক্করে আজকাল মনমতো চা টাও খেতে পারে না। রোজ দু’বেলা আটার রুটি আর এক ঘন্টা করে দু’বার হাঁটা। সবকিছুতেই নিয়মকানুন। একটু উনিশ বিশ হলেই অশান্তির শেষ নেই! মিষ্টিপাগল মানুষের জীবনে মিষ্টির নিষেধাজ্ঞা কতোটা নির্মম তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেনা। তবুও বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কত অসাধ্যই না সাধন করে চলেছে।
অফিসের উদ্দেশ্যে বের হবার আগে অন্তরা তার বাবার জন্য যত্ন করে একটা মিক্সড শরবত বানায়। করলা, শশা, টমেটো সহ কিসব হাবিজাবি মিলিয়ে একটা দ্রবণ বলা চলে! সে নাকি কোথায় পড়েছে এই শরবত খেলে ডায়বেটিসের রুগীর অনেক উপকার হয়। এই অখাদ্য অনীলকে আর কেউ খাওয়াতে পারবেনা বলেই অন্তরা নিজে বানিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বাবাকে খাইয়ে তবেই দম নেয়। অনীলও বাধ্য ছেলের মতো তার ছোট মায়ের আদেশ মান্য করে। মেয়েটা যে তাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসে। যতক্ষণ সে বাসায় থাকে সবসময় আশেপাশে থাকবে। তার কখন কি লাগবে হাতে হাতে এনে দেয়। নিত্যনতুন আইটেম রান্না করে তাকে দিয়ে টেস্ট করায়। এই পর্যন্ত কত জঘন্য খাবারই না সে হাসিমুখে গলাধঃকরণ করেছে!!
তবুও মেয়েকে একটুও বকা দেয় নি। এখন অবশ্যই তার মেয়েটা ছোট নেই। সামনেই অনার্স ফাইনাল দিবে। ইতিমধ্যেই সে অনেক ছেলের বায়োডাটা চেক করে রেখেছে। মনমতো পেলেই ফরজ কাজ আদায় করবে। এই বিষয়ে সে বিন্দুমাত্র ছাড় দিবেনা বলেই সে ধীরেসুস্থে আগাচ্ছে। তেমন তাড়াহুড়ো নেই।
যৌবনের উচ্ছাসিত সমুদ্র এখন শান্ত নদীতে পরিণত হয়েছে। বয়সের পরিপক্বতা অনেক অভ্যাসকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। নিজের মেয়েটা যতো বড় হয়েছে অনীল ততোই সতর্ক হয়েছে। অন্তরার জন্য যে মানুষটা সেই কৈশোরকালীন সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পেরেছে তার কাছে এ আর কঠিন কি? এখন তার জীবনটা বেশ গোছানোই বলা চলে। ছেলেটা ইন্টারন্যাশনাল ফার্মে ভালো পদেই জব করছে। মেয়েটাও জ্ঞানে গুণে পারফেক্ট। সন্তানদের সে বেশ ভালোভাবেই গড়ে তুলেছেন। এখন ওদের যোগ্য মানুষের সাথে বিয়ে দেওয়াটাই তার শেষ দায়িত্ব। তারপর সে লম্বা বিরতি নিবে। ঘুরে বেড়াবে দূরের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের দর্শনার্থী স্থানগুলো তার মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। এখন তার ঝোঁক বাইরের দেশের দিকে। সে যাই হোক ওসব নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। এখন আপাতত মেয়ের বিয়ের দিকে সে ফোকাসড।

অতীতের প্রভাব কি বর্তমানে পড়ে? ঝকঝকে চকচকে বর্তমানটায় অতীতের কৃতকর্মের কালো দাগ ঠিকই কলঙ্কিত করে যায়। বিধাতা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না! দেখার বিষয় হলো অনীলের কৃতকর্মের ফল কার জীবনে হানা দিবে নিয়তির প্রতিশোধ হয়ে!

___________________

ওমর নিজেই নিজেকে ছাঁচে ঢেলে সাজিয়েছে। তার বাবার যেসব দিক তার মায়ের জন্য অসহনীয় ছিল সে ঠিক তার বিপরীত চরিত্র গঠন করেছে। বাবার চরিত্রের প্রভাব ছেলেদের মাঝে সাধারণত দুই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। হয় সে বাবার পথ অনুকরণ করে নাহয় তার বিপরীত হয়। ওমর যেহেতু মাভক্ত ছেলে তাই সে মায়ের দুঃখ বুঝে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে যেন অন্য আরেকটি শামীমার গল্প রিপিট না হয়! ওমর বরাবরই ভদ্র ছেলে। আজেবাজে নেশা তার একদমই নেই। তার বদঅভ্যাস বলতে এইটুকুই সে যখন রেগে যায় নিজেকে প্রচুর আঘাত করে। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে নিজের শরীরের উপর। অল্প বয়সের মানসিক বিষাদগ্রস্ততা তার এই ক্ষতি করে দিয়ে গেছে, এই সম্পর্কে কেউই বিশেষ অবগত না! ওমর কখনোই তার মা-বোনের সামনে খালি গায়ে থাকেনা। এমনকি টিশার্টেও না। সে সর্বদা ফুল হাতা টিশার্ট বা শার্ট ইউজ করে। তার শরীরের একেকটা ক্ষত এতোই গভীর হয়, যার দাগ পুরো শরীরজুড়ে বিদ্যমান। রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষতগুলি দেখে আর নিজেই মলম লাগায়। এই ক্ষতবিক্ষত শরীরটা তাও চোখে দেখে মলম লাগানো যায়। মনের ক্ষতগুলির মলম কি আছে? সে কি পারবে কোনোদিন ঐ লোকটাকে মন থেকে সসম্মানে বাবা বলে ডাকতে? ওমর অবশ্য বাবা বলে ডাকা ছেড়েছে সেই বারো বছর আগেই। কেবল জন্মদাতা বলেই বাধ্য হয়ে কথাবার্তা বলে। কিন্তু বাবা শব্দটা মুখ দিয়ে আসে না। অবশ্য সে এতোটাই স্বাভাবিক থাকে কারোই এই বিষয়টা মাথায় আসেনা কি বলে সম্বোধন করছে! এমনকি অনীলেরও না।
তার এই দূর্বিষহ যুদ্ধ আর কতদিন চলবে?একা একা আর কত বয়ে চলবে সে? সে কবে বলতে পারবে তার মা কে, চলো না দূরে কোথাও চলে যাই? এই বাড়িতে আমার যে দমবন্ধ লাগে,,,
ওমর বলতে পারেনা কিছুই। এখন কি বলবে? সবকিছুই যে স্বাভাবিকভাবে চলছে। সমাজে এখন তারা পারফেক্ট হ্যাপি ফ্যামিলি। তবুও কেন সে হ্যাপি হতে পারে না??

ওমরের এই অশান্তি কেউ কি দূর করতে পারবে? ইশ এমন কোনো যন্ত্র থাকতো যদি, যা দিয়ে মস্তিষ্কের স্মৃতি ইচ্ছেমতো মুছে ফেলা যায়!

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here