অনুরাগে অনুরক্তি পর্ব ৪

0
1213

#অনুরাগে_অনুরক্তি
||৪র্থ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ফোনের রিংটোন বেজেই চলেছে। অনুরক্তির বাবা তারেখ হাওলাদারের কল। গত আড়াইটা মাস ধরে পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই। শুধু একটা লম্বা ইমেইলের দ্বারা জানিয়েছিল গোটা পরিস্থিতি।

অনুরক্তির অসহ্য লাগে দিনের এ সময়টা, প্রতিদিন এ সময়টাতেই কল দেন বাবা। না কল ধরার শক্তি হয়, না কাটার। এক দোটানার মাঝে পাড় হয় এই সময়টুকু। মাত্র আড়াইটা মাসে কতো কিছু বদলে যেতে পারে। অচেনা মানুষ কাছের হয়ে উঠে, শত দিনের চেনা চেহারাও ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়।

“Bu adamla kalmayacağım. O çok kibirli! Ne kaba bir adam!” (আমি থাকবো না এই লোকের সাথে! অনেক অহংকারী উনি! কি অভদ্র মানুষ!)

আমিরা শাহিনের চিৎকার শুনে নিজের বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিংরুমে আসে অনুরক্তি। আমিরা শাহিন তখন রাগে রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন টিভির সম্মুখে দাঁড়িয়ে।

মাহমুদ মোস্তফা বিরক্তির গলায় প্রশ্ন করেন,
“আমি টো কিছুই বুজতে পারছি না কী বলো টুমি?”

“কী হয়েছে আন্নে? আঙ্কেল কিছু বলেছেন আবার আন্নেকে?”

“He called me a loser! Who says this to his wife?”

“Astagfirullah! I never said this! She is totally lying!” (আস্তাগফিরুল্লাহ্! আমি কখনও এই কথা বলি নাই। ও একদম মিথ্যা বলছে)

“Tövbe! Tövbe! Ne inatçı bir adam! Ben yalan söylemem mustafa bey.” (তওবা! তওবা! কি জেদি মানুষ! আমি মিথ্যা বলি না মিস্টার মোস্তফা!)”

“আন্নে তুমি কী বলছো আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আঙ্কেল কী এমন বললা যে আন্টি এতো রেগে গেল!”

“Trust me dear! I just said team Argentina is going to lose this time too! Actually called loser! But didn’t say a word about her.” (বিশ্বাস করো প্রিয়। আমি শুধু বলেছিলাম আর্জেন্টিনা এবারও হারবে। কিন্তু তাকে নিয়ে একটা শব্দও বলি নাই।}

“আমি একজন আর্জেন্টিনা সাপোর্টার, তাদের লুজার বলা মানেই আমাকে বলা! তুমি তো একসাথে ব্রাজিল আর আরব দুটোই সাপোর্ট করো, তোমার মতো সাপোর্টার কী বুঝবা?”

“এই একদম আমার সাপোর্ট নিয়ে কোনো কথা বলবা না।”

আবার শুরু হয়ে গেল একচোট ঝগড়া। অনুরক্তি দু’জনের তর্কের মাঝে পা টিপে টিপে ব্যাকয়ার্ডে চলে গেল। এখানে থাকা এখন সংকটপূর্ণ, কবে এই ঝগড়ার ঘূর্ণিঝড়ে তাকে টেনে নেওয়া হয় ঠিক নেই।

আমেরদের ব্যাকয়ার্ডটা সন্ধ্যা বা রাতে বসার জন্য বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা জায়গা। সোনালি রঙের মরিচাবাতি দিয়ে ঝোপালো গাছগুলো ঘেরা, ছাউনিঘেরা কিচেন কাউন্টারের একটু দূরেই কাঠের ফায়ারপ্লেসে জ্বলন্ত অগ্নি। সাথে কানাডার শীতল আবহাওয়া তো আছেই।

সোফায় বসে আমিরা শেখ ও মাহমুদ মোস্তফার কথা ভাবছে অনুরক্তি। এই দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ কী করে যে প্রায় অর্ধশতক বছর সাংসারিক জীবন কাটিয়েছেন বোধগম্যই হয় না তার। আড়াই মাসে এই দুজনের কোনো ক্ষেত্রে মতের মিল তো দূরে থাক, ঝগড়া ব্যতীত একদিনও কাটেনি। তবে যত্নশীলতাও কারো মাঝে কম নেই। অথচ, তার বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদীর সম্পর্কটা ছিল একদম অন্যরকম।

বাবা মাটির মানুষ, মায়ের সাথে কখনও তর্ক বা খুব বেশি কথা বলতেন না। মায়ের সিদ্ধান্ত কোনো না কোনোভাবে বাবার সিদ্ধান্তকে নিষ্প্রভ করতো। অপরদিকে দাদা-দাদীর সম্পর্কটা ছিল ঠিক উলটো, দাদার কথা ব্যতীত একচুল নড়াও দাদীর জন্য প্রায় নিষিদ্ধ ছিল।

হুমায়ূন আহমেদ ‘মিসির আলি! আপনি কোথায়?’ বইয়ে লিখেছিলেন, “গভীর প্রেম মানুষকে পুতুল বানিয় দেয়। প্রেমিক প্রেমিকার হাতের পুতুল হয় কিংবা প্রেমিকা হয় প্রেমিকের পুতুল। দুজন একসঙ্গে কখনও পুতুল হয় না।”।

এই কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো অনুরক্তি। তাই তো সে পুতুল হয়েছিল সায়নের হাতের, আফসোস সায়ন তো প্রেমিকও হয়নি। তবে কানাডার এই দম্পতি তার বিশ্বাসকে আজকাল ভুলই প্রমাণ করছে।

“Hey! Amer? Amer? Won’t you go home? All our colleagues had left.”
সারা দিনের ক্লান্তিতে চোখ লেগে এসেছিল আমেরের। নিজের কলিজ ওলিভার ডাকে ভাঙে গভীর সেই ঘুম। আমের উঠে দ্রুতো নিজের ঘড়ি দেখে। কম করে হলেও দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ায়।

নিজের এ্যাপ্রোন ঠিক করতে করতে সে উত্তর দেয়,
“Yes, I am leaving. Thank you for calling me Oliva. Actually I was just a li’l tired.”

“No need to say thank you. Maybe you didn’t brought your car today. I can drop you if you want.”

“Thanks. I will book a uber for me.” (ধন্যবাদ। আমি নিজের জন্য উবার ভাড়া করে নিব।

“Why? Your home is in my way. I insist, please.” (কেন? তোমার বাসা আমার যাওয়ার রাস্তায়। আমি জোর করছি, প্লিজ)

এক মুহূর্ত ভেবে আমের সায় জানায়। দুজনে রওনা হয় নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে একই বাহকে।অলিভিয়া তার সাথে প্রথম থেকেই আছে ট্রেইনিংয়ে। তবে মাঝে মাঝে অলিভিয়ার সাথে টুকটাক বলা হলেও অতো একটা সখ্যতা গড়ে উঠেনি।

“Dinle kızım! (শুনো মেয়ে!) We are going out. Maybe we would come back tomorrow morning. Amer didn’t take his keys today. So please…” আমিরা শাহিন সহাস্যমুখে অনুরোধ করেন অনুরক্তিকে।

“উফঃ আন্নে প্লিজ বোলো না তো। তোমার বাড়ি, আমি বাহিরের লোক। তোমার রিকুয়েস্ট করা মানায় না।”

“মেয়ে, মার খাবে কিন্তু। আন্নে বলো না আমাকে! তাহলে আবার বাহিরের লোক হবা ক্যানো? আর বলবে না এসব, ঠিক আছে?”

মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকায় অনুরক্তি। আমিরা শাহিন মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে বলে,
“তুই যে কতো আপন আমার তুইও জানিস না। এতো বড়ো ধাক্কার পর তোকে আরেকটা বাস্তবতা জানাতেও চাচ্ছি না। তবে শীঘ্রই সব জানবি।”

একটু পরই বেরিয়ে পড়ে দু’জনে। অনুরক্তির মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠে।

আনমনেই ভাবে,
– ইশ! তার একান্ত নিজের যদি এমন একটা সম্পর্ক থাকতো!

মাঝ রাস্তাতেই গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় অলিভিয়ার। দুজনকেই নেমে পড়তে হয় গাড়ি থেকে। এর মাঝেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সৌভাগ্যবশত কাছাকাছিই অলিভিয়ার এক কাজিনের বাসা। সে চলে যায় সেখানে রাতটা অতিক্রম করতে। যেহেতু রাত অনেক হয়েছে, আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি।

আমেরকেও অনেক অনুরোধ করে রাতটা এখানেই কাটানোর জন্য। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, কিছুতেই যাবে না। তাই অলিভিয়াকে একাই যেতে হয়।

অনেকক্ষণ উবারের জন্য চেষ্টা করেও না পেয়ে ছাতা খুলে আমের হাঁটা শুরু করলো। ভাগ্যক্রমে সামনে যদি কোনো ট্যাক্সি পায় তাও ভালো।

বাতাসের বেগের জন্য ছাতাও সামলানো বড়োই কঠিন। প্রায় কাকভেঁজাই হয়ে গেছে আমের। ঠাণ্ডায় প্রায় কাঁপুনি উঠে যাচ্ছে তার।

প্রায় মিনিট দশেক হাঁটতেই একটি ট্যাক্সি দেখতে পায়। আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ে গাড়িতে।

রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি। বসার ঘরে বসে আছে অনুরক্তি। ঘুমঘুম ভাব নিয়েও ঘুমাতে পারছে না। বিরক্তি, রাগ উভয়ই লাগছে তার। প্রায় পঞ্চাশ বার কল করা হয়ে গেছে আমেরকে, কিন্তু তার ফোন বন্ধ। দেরী হলে তো কল করে জানানো উচিত। নিশ্চয়ই বন্ধু-বান্ধবীর সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে জাগিয়ে।

তার ভাবনার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠে। নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় আমেরকে ইচ্ছে মতো কঠোর কিছু বলার জন্য।

তবে দরজা খুলতেই সব রাগ, বিরক্তি হাওয়ায় উড়ে যায় কর্পূরের ন্যায়। নয়নযুগলে দৃশ্যমান হয় শুধুই একরাশ উদ্বিগ্নতা ও মায়া। দ্রুত তোয়ালে এবং পোশাক এনে আমেরকে দেয়।

“চুল, গা মুছে নিন তাড়াতাড়ি। কাপড়-চোপড় নিয়ে আন্নের বাথরুমে যান। আপনার বাথরুমে একটু সমস্যা হয়েছে, কাল লোক আসবে। আমি কফি আর স্যুপ বসিয়ে দিচ্ছি চুলোয়।”

আমের হাতে তোয়ালে নিয়ে চুল মুছতে মুছতে অনুরক্তির পানে তাকিয়ে থাকে। নারীটির চিন্তিত মুখশ্রী তাকে ভাবাচ্ছে! ভীষণ ভাবাচ্ছে! এলোমেলো সব ভাবনা তার মস্তিষ্কে বয়ে যাচ্ছে। মাথায় ওড়না, কামিজের উপরে হুডি পরা মেয়েটি তার কাছে ভীষণ আলাদা।

তিন মাসের পরিচিত বাঙালি নারীটি তাকে নিজের শুভকাঙ্ক্ষী রূপে গণ্য করে, অনেক সম্মানও করে। কিন্তু এই তিন মাসে তিন ঘণ্টার জন্যও তার সাথে বসে আড্ডা দেয়নি। ইন্ট্রোভার্ট ভেবেছিল। অথচ, বয়সের বিপুল পার্থক্যের পরও তার মায়ের সাথে কিংবা বাবার সাথে নারীটির আড্ডা জমে ক্ষীর হয়ে যায়। বাড়িটিতে মেহমান মাত্র, সামনের মাসেই নিজের এপার্টমেন্টে উঠবে। এই যে তার সাথে অতো সখ্যতা নেই, তবুও তাকে নিয়ে উদ্বিগ্নতা। কারো প্রতি যত্ন বা মায়াও মেয়েটির কম নেই। সবাইকেই যেন অনুরাগে রাখতে জানে।

নারীটির এসব কর্মকে বেশ অদ্ভুতুড়ে লাগে আমেরের। তাই আড়ালেই এক নাম রেখেছে আমের তার, তা হলো- “অদ্ভুত অনুরাগিনী!”

“কী হলো যান! ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো! আপনিও না!” কিছুটা ধমকের সুরেই চেঁচিয়ে উঠে অনুরক্তি।

আমের দ্রুতো চোখ নামিয়ে ফেলে। কিছু বলতে গিয়ে বলে না, মিইয়ে যায়। তার হ্যাজেল চোখের মণিও আজকাল বেসামাল থাকে বেশ। চুপচাপ চলে যায় গোসল করতে। আবারও ভাবে এই রমণী কী অদ্ভুত! কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর্যায়ে আসে না! আবার ধমক দেওয়ার পর্যায়েও চলে আসে!

গোসল করে কিচেনে আসতেই অনুরক্তি ব্ল্যাক কফি এগিয়ে দেয়। একটা মগ দেখে আমের প্রশ্ন করে,
“তুমি নিবে না?”

“না, একটু পর তো শুয়েই পড়বো। আপনি ঠিক আছেন? খারাপ লাগলে ঔষধ খেয়ে নিয়েন। আর স্যুপটা চুলোয় আছে, আপনি কফি শেষ করলে নামিয়ে বেড়ে দিচ্ছি। আর খাবার গরম করা শেষ। টেবিলে রাখা আছে।”

“আমি নিজেই করে নিতে পারবো। তুমি যেয়ে শুয়ে পড়ো। এমনেও অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে আমার জন্য।”

“আপনি নিশ্চিত তো? তাছাড়া ডিশও তো ধুতে হবে।”

“I can do it, trust me. I am one hundred percent sure! Now please go Anu!” (আমি পারবো এটা করতে, বিশ্বাস করো। আমি শতভাগ নিশ্চিত! এখন তুমি যাও অনু!”

“Okay.”

অনুরক্তি খাণিক দ্বিধাবোধ করলেও চলে যায় ঘুমাতে। দরজা, জানালা ভালো ভাবে লক করে বিছানায় গা লাগাতেই নিদ্রায় তলিয়ে যায় সে।


গভীর রাতে ফোনের ডাকে ঘুম ভাঙে আমিরা শাহিনের। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে স্ক্রিনে ভাসছে অনুরক্তির বাবা তারেখ হাওলাদারের নাম। দ্রুতো রিসিভ করে সে।

“হ্যালো! সরি এতো রাতে কল দেওয়ার জন্য। মেয়েটার টেনশনে ঘুম আসে না কী করবো? মোস্তফা বললো ও না কি এপার্টমেন্ট দেখছে থাকার জন্য। মেয়েটা একা থাকবে অচেনা দেশে?”

“ওকে কোথাও যেতে দিব না আমি, চিন্তা করবেন না। চিন্তার কিছু নেই, ও এখানে বেশ আছে। তবে আমার মনে হয় এবার ওকে সত্যটা জানানো উচিত, ওর জানা উচিত আমার কতোটা আপন। তাহলে হয়তো আর পর ভেবে একা থাকার চিন্তা করবে না।”

“কিন্তু এতো বড়ো সত্য কি এখন সামাল দিতে পারবে? একটু সামলে নিক নিজেকে ও সায়ানের ধাক্কা থেকে। তারপর না হয় জানানো যাবে।”

“ঠিক আছে। তবে চিন্তার কিছু নেই। ও আমারও মেয়ে, ওর বিপদ আমি হতে দিব না।”

“আচ্ছা, তবে রাখছি। আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

অনুরক্তির বাবার কলটা কেটে গভীর চিন্তায় ডুবে যান আমিরা শাহিন। মাহমুদ মোস্তফা হাতে হাত রেখে সাহস দেয়।

“Everything will be fine.”

“অনু, আমার কাছে কতো বড়ো আমানত আপনি তো জানেন মিস্টার মাহমুদ মোস্তফা। ওকে নিজের সবটা দিয়ে ভালো রাখতে চাই আমি।”

“আমি জানি আমিরা। অনু ভালো থাকবে এখানে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here