অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২০

0
523

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২০
#তাশরিন_মোহেরা

মুগ্ধের নিচের দিকটা রক্তে ভিজে গেছে। তার পায়ে গুলি লেগেছে। সে পা টা ধরেই আর্তনাদ করে চলছে। আমি তার এই অবস্থায় আঁতকে উঠি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি গুলিটা আসলে কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু আশেপাশে সন্দেহজনক কাউকে দেখা গেল না। মানুষগুলো আমাদের দিকেই চেয়ে আছে। মুগ্ধ আমার হাত খামচে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘ম্যাম, আমি ব্যাথা পাচ্ছি। খুব!’

আমার মস্তিষ্ক হঠাৎ অচল হয়ে যায়। এইটুকুন একটা বাচ্চাকে গুলি করার সাহস কে পায়? এদের কি বিবেক নেই? চারদিকে মানুষজন জড়ো হওয়া শুরু করেছে। কিন্তু এগিয়ে এসে ছেলেটাকে কেউ তুললো না। রক্তে ভেজা ছেলেটাকে নিয়ে আমি কি করবো বুঝে উঠছি না। পুরো শরীর অসম্ভব রকমের কাঁপছে আমার। এর মধ্যে দেখলাম মুগ্ধ কাঁদতে কাঁদতেই বেহুশ হয়ে পড়ছে। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,

‘দয়া করে কেউ সাহায্য করুন। বাচ্চাটার গুলি লেগেছে, এখনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। দয়া করুন! কেউ তো একটু সাহায্য করুন।’

আমি অঝোরে কেঁদে দিলাম। মুগ্ধের এমন অবস্থা আমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভীষণভাবে। একটা মধ্যবয়সী লোক এসে মুগ্ধকে পাজাকোলে তুলে নিলো। মুগ্ধ হুশ হারিয়েছে কিন্তু এর মাঝেও ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো। আমি মুখে হিজাব চেপে কান্নাদের কোনোমতে আটকে রাখলাম। লোকটা একটা গাড়িতে আমাদের তুলে দিলো। পাশের একটা মেডিকেলে আসতেই আমি তড়িৎ নেমে পড়লাম। ড্রাইভারটাকে অনুরোধ করে বললাম,

‘বাচ্চাটাকে একটু ভেতরে নিয়ে আসুন, প্লিজ!’

ড্রাইভারটা বিরক্ত হয়ে আমায় বললো,

‘এর জইন্য ভাড়া বাড়াই দেওন লাগবো।’

আমি আর্তনাদ করে বলে উঠলাম,

‘এমনটা করবেন না, প্লিজ। আমার কাছে খুব বেশি টাকা নেই। আর বাচ্চাটাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’

‘তো আমি কি করুম, আপা? গাড়িত উঠছেন অহন টেকা দিতে না করতাছেন। পোলাটারে ভিত্রে নিয়া যাইতেই তো মেলা কাম!’

আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম,

‘আচ্ছা আমি একটু পরেই আপনাকে টাকা পরিশোধ করে দেবো। ছেলেটাকে আগে ভেতরে নিয়ে আসুন, জলদি। এমন নির্দয় হবেন না।’

এতে ড্রাইভারটার মন কিছুটা হলেও গললো বোধহয়। সে মুগ্ধকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে এলো। আমি তড়িৎ মুখরকে ফোন দিয়ে বলি,

‘মুগ্ধের পায়ে গুলি লেগেছে। জলদি কাছের হাসপাতালটায় চলে আসুন।’

.

হাসপাতালের বেডে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে মুগ্ধ। পায়ে বেন্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে তার। বেশি রক্তক্ষরণ না হওয়ায় অবস্থা কিছুটা ভালো তার। এবার মুগ্ধের জ্ঞান ফেরার পালা। মুখর কেবিনের সামনে গম্ভীরমুখে পায়চারি করছে। সে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছে এই কয় ঘণ্টায়। সে এবার ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। দু’হাতে মাথা চেপে বসে আছে সে। আমি এ মুহুর্তে কি বলবো, কি করবো বুঝতে পারছি না। ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও আমার নেই। বেশ একটা কঠিন সময় পার করছে মুখর। তাকে কিছু বলতে গিয়েও অনেকবার ভাবতে হবে আমার। আমি চুপচাপ তার পাশে গিয়ে বসলাম।

মিনিট খানেক নিরবতার পর মুখর মুখ খুললো। ক্ষীণ স্বরে বললো,

‘আমি ভাই হিসেবে ব্যর্থ, মিস.তিথিয়া! এই একা শহরে মুগ্ধকে আমি একা ছেড়ে দিয়েছি।’

কথা বলতে গিয়ে মুখরের গলা কাঁপছে। কিছু বলতে গিয়েও যেন সবটা তার গলায় বিঁধছে। তার প্রত্যুত্তরে আমি কিছু বলতে পারলাম না। কেমন রাগ লাগছে নিজের উপর! আমার ভরসায় ছেলেটাকে ছেড়েছিলো মুখর। অথচ তার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আমি নিজেই ব্যর্থ!

মুখর আবারো বলে উঠে,

‘একটা বিশাল সাপ আমার পেছনে পড়ে আছে। ক্রমেই গিলছে আমার পুরো পরিবারকে। তাদের রক্ষা করতে গিয়ে আমি ব্যর্থ! ব্যর্থ এক পথহারা পথিক আমি!’

মুখরের কথার কিছুই আমি বুঝলাম না। শুধু অপলক চেয়ে আছি ভেঙে পড়া একজন শক্ত খোলসে মোড়া মানুষকে। হঠাৎ সেখানে হনহনিয়ে আসে একটি ছোটখাটো গোছের মহিলা। তার দৃষ্টি এলোমেলো। মুখরকে দেখতেই তার দিকে তেড়ে আসেন তিনি। মুখর মহিলাকে দেখেই তড়িৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। মহিলাটা মুখরের বুকের উপর আঁচড়ে পড়ে বলে উঠে,

‘মুখর, আব্বা আমার! আমার ছেলে কোথায়? আমার মুগ্ধ কোথায়? আমি দেখতে চাই!’

মুখর মহিলাকে জোরে জড়িয়ে বলে,

‘মা, তুমি এসেছো? মুগ্ধ ঘুমাচ্ছে ভেতরে, মা। আমাদের চিন্তায় ফেলে ডেভিলটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দেখো!’

দুজনের কথায় বুঝলাম মহিলাটা মুখর-মুগ্ধের মা। মুখরের মা মুখরকে ধরেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। আমারও বুক ভেঙে কান্না এলো। কিছু সময় দুজনেই নিঃশব্দে অশ্রুপাত করলো। মুখরের মা এবার কেবিন থেকে মুগ্ধকে দেখে এলো।
কিছুক্ষণ পর তিনি এসে মুখরের পাশে চেয়ারে বসলেন। চোয়াল শক্ত করে বললেন,

‘কাজটা কে করেছে তুই ধরতে পেরেছিস তো, আব্বা?’

ক্ষণেই মুখরের ভ্রু জোড়াও কুঁচকে এলো। নিঃশব্দে কিছু একটা ভাবলো সে। পরমুহূর্তেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার মায়ের দিকে ফিরে বললো,

‘এর একটা সুরাহা না করলে হয় না, মা। আমি আসছি!’

মুখরের মা তখনি পথ আটকে বলে,

‘এখন যাসনে, আব্বা! ওরা আমার মুগ্ধের পায়ে গুলি করেছে। এখন তোর কিছু হয়ে গেলে আমি তা সহ্য করতে পারবো না রে, মুখর!’

মুখর তার মায়ের হাত সরিয়ে বলে উঠে,

‘আমার কিছু হবে না, মা। আমি ফিরে আসবো!’

এই বলে এদিক সেদিক না দেখেই মুখর
হাসপাতাল ছাড়ে। পুরো দৃশ্যটা দেখেও আমি তাকে আটকানোর সাহস পাইনি। আমি জানি না মুখর কোথায়, কেন যাচ্ছে! তবে আমার বুঝতে বাকি নেই মুখর নিরাপদ কোথাও অবশ্যই যাচ্ছে না! নির্বাক হয়ে তাকে দেখছি আমি। ছেলেটার চোখটা ক্রমেই লালবর্ণ ধারণ করেছে। এই দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ চোখ রাখা দায়, যেন এতেই জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাবে সবটা!
আমি মনমাঝে বললাম,

‘মুখর সাহেব, যেখানেই গিয়ে থাকুন, সুস্থভাবে ফিরে আসুন। আপনার আম্মা আর ভাইয়ের জন্য হলেও আপনাকে শত বিপদের মুখ থেকে ফিরে আসতে হবে!’

(চলবে)

(আগামীকাল রহস্যের গিঁট খুলবে একেক করে, ইনশাআল্লাহ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here