অতঃপর তুমি পর্ব-৩

0
1491

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অভ্র আমাকে যাওয়ার দিন নিতে আসলো না দেখে আমাদের বাড়ির সবাই বেশ অবাক হলো।কিন্তু আমি একটুও হলাম না।তবুও কোথায় যেন একটু খারাপ লাগলছিলো।নিজে একা, একাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আসলাম।বাবা শুধু হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।হয়তো বুঝে গেছে তাদের আদরের ছোটো মেয়েটি ও বাড়িতে কতটা ভালো আছে।এখন বুঝেই বা কি লাভ!যখন বোঝা উচিত ছিল তখন তো কিছু না জিজ্ঞাসা করেই সব করে ফেললো!
সে বাড়ি পৌছাতেই তুতুল সোনা এসে আমার কোলে উঠে পড়লো।আর তার মিষ্টি ভঙ্গিতে আমাকে বলতে লাগলো আমাকে সে কতো মিস করেছে।রুমে গিয়ে দেখলাম অভ্র সোফায় বসে ল্যাপটপ টিপছে।তিনি ছাড়াও আরো একটা মানুষ যে এই রুমে আছে সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।

রাতে আরিশা আপু আমার হাতে তার কফির মগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন উনাকে গিয়ে দিয়ে আসতে আর তাকে আপুর কাছে পাঠাতে।আমি মগ হাতে গুটি গুটি পায়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।খুব বিব্রত বোধ করছি,উনাকে কিভাবে বলবো?তার সাথে এখনো আমি সেভাবে তেমন একটা কথা বলিনি।তিনি সোফায় বসে সামনে অফিসের কিছু কাগজপত্র মেলে বসে আছেন।তবে তিনি দেখছেন না।হাঁটুর উপর রাখা মুষ্টিবদ্ধ হাতে মাথা ভার দিয়ে রয়েছেন।আমি তার মুখের সামনে কফির মগটা বাড়িয়ে তাকে ডেকে বললাম,
‘আপনার কফি।’
তিনি নিশ্চুপ হয়ে রইলেন।
‘কফিটা নিন।’
অভ্র মাথা না উঠিয়েই খুব থমথমে গলায় বলল,
‘এখান থেকে যাও।’
তার থমথমে গলার স্বরে আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম।ফিরেই যাচ্ছিলাম কিন্তু আবারো আমাকে থামতে হলো কারণ আরিশা আপু যে তাকে ডেকেছে এই কথাটা তো বলা হয়নি।
আমি আবারো তাকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
‘শুনুন…..
আমার কথা শেষ না হতে দিয়েই এবার তিনি খপ করে আমার হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে খুব মেজাজ সহ বললেন,
‘একটা কথা একবার বললে কানে যায় না!বলেছিলাম না আমার থেকে দূরে থাকতে!একদম আমার সামনে ভালো সাজতে আসবে না।’

কথাগুলো বলে তিনি আমার হাত এক ঝটকায় ছেড়ে দিলেন।তার এমন আচরণে আমি এক কদম পিছনে ছিটকে গেলাম।আর আমার হাতের কফির মগ থেকে গরম কফি খানিকটা ছিটকে আমার হাতে এসে পড়লো।আর খানিকটা টি টেবিলে মেলে রাখা তার কাগজে।অসহ্য যন্ত্রণায় আমার হাত পুড়ে গেলো কিন্তু সেদিকে তার চোখও পড়লো না।তিনি কাগজগুলোতে কফি পড়ায় সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।আরো আমাকেই রুক্ষ স্বরে বললেন,

‘কি করলে এটা?জানো এগুলো কতটা ইম্পরট্যান্ট!’

আমার চোখ পানিতে ভরে উঠলো।আমি জানি না,সত্যিই জানি না।কিছু কাগজ মানুষের থেকেও কি করে বেশি ইম্পরট্যান্ট হতে পারে।

এভাবেই কেটে গেলো দেড়মাস।এই দেড়মাসে উনি আমার সাথে ভালো ব্যবহার তো দূরে থাক ভালো করে কথা পর্যন্তও বলেননি।যখনই কথা বলেন হয়তো ধমক দিয়ে নয়তো পিন্চ মেরে।মুখের কথা দিয়ে অত্যাচার তিনি আমার উপর ভালোই চালিয়ে যাচ্ছেন।দেড়মাসেও কিছুই বদলায়নি,পার্থক্যটা শুধু এতটুকু এখন আমিও মাঝে মাঝে উত্তর দেই।তবে ভয় তাকে আমি এখনও পাই।মাঝে মাঝে খুব মায়াও হয়।বিয়ের আগে তাকে যেমন দেখেছিলাম সেই অভ্র এখন আর নেই।এই অভ্র অন্য অভ্র!সে নিজেকে যদি একটু খেয়াল করে দেখতো তাহলে হয়তো সে নিজেই চমকে যেত।চেহারাটা শুকিয়ে গেছে,ঠিকমতো শেভ করেন না সবসময় মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়ে থাকে।এখন তিনি আর অফিসেও যান না,কাজ ঠিকমতো করেন না।বাইরে বাইরে ঘুরেই সারাদিন কাটিয়ে দেন।তবুও তার বাবা তাকে ঘরেই কিছু কিছু কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন।তার ইচ্ছে করলে মাঝে মাঝে করেন,নাহলে না।সঠিক,ভুল বোঝার বোধ শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে।ইরা আপু তার হৃদয় এমনভাবে টুকরো টুকরো করে ভেঙেছে যে সে এখন সম্পূর্ণ হৃদয়হীন হয়ে গেছে।আর সেই হৃদয়হীন অভ্র প্রতিনিয়ত আমাকে নিষ্ঠুরভাবে অদৃশ্য জখম করে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে।আমিও তাকে বাঁধা দেই না কারণ আমার মনে হয় আমাকে জখম করার এই আনন্দই এখন তার সঞ্জিবনী শক্তি।তার মত আরেকজনও যে কষ্টে আছে এটা ভেবে সে শান্তি পায়।এই শান্তিটা তার প্রয়োজন।কারণ এই হৃদয়হীন অভ্রও যে মাঝে মধ্যে মাঝরাত হলেই হৃদয়ের দগ্ধে পুরে নিরবে কাঁদে।নিচ থেকে যা আমি স্পষ্ট বুঝতে পাই।কিন্তু তবুও না আমি তাকে আমার জেগে থাকার উপস্থিতি টের পেতে দেই আর না তাকে প্রশ্নে বিদ্ধ করি।শুধু রাতের অন্ধকারে মেশা তার অশ্রুর সাথে আমার একটি দীর্ঘশ্বাস জানালা দিয়ে বয়ে আসা মধ্য রাতের স্তব্ধ বাতাসকে আরেকটু ভারী করে তোলে।

৬.
সকালে ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে মেঝে থেকে বিছানাপত্র উঠিয়ে ঠিক করে রাখলাম।নিচে ঘুমাতে ঘুমাতে আমার সারা শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে আর উনি কি সুন্দর আরাম করে একা পুরো বিছানা জুড়ে ঘুমিয়ে আছে।গোসল সেরে বাথরুম থেকেই হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে চুল শুকিয়ে তারপর বের হতে হয়।কি জ্বালা!
সকালের নাস্তা শেষে অভ্র বাইরে চলে গেলো।বাবাও অফিসে আর অভ্র’র মা তার রুমে ঘুমিয়ে পড়লেন।আমি এই বিশাল বাড়িতে একা হয়ে পড়লাম।কিছুই করার নেই ভেবে রুমে আসতেই দেখলাম অনেক কিছুই করার আছে।পুরো রুম নোংরা হয়ে আছে।ফ্লোরটাও মোছা দরকার।বাড়ির বেশিরভাগ চাকর গেছে ছুটিতে।বুয়া এসে সকালে রান্না করে দিয়েই চলে গেছে।অগত্যা আমাকেই নামতে হলো কাজে।
একটা রুম পরিষ্কার করতেই আমার দফা রফা হয়ে গেল।বাবা!এটা কি রুম নাকি ফুটবল ময়দান!
পুরো রুম মোছা শেষে সবে একটা ক্লান্তিকর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁড়ালাম তার মধ্যেই অভ্র জুতা পায়ে রুমে প্রবেশ করলো।আর সেই জুতা পড়েই সারা রুমে হাটাহাটি করতে লাগলো।আমি শুধু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।আমার মাত্র পরিষ্কার করা রুমটা এখন জুতার নোংরা ছোপ ছোপ দাগে ভরা।
‘আপনি এটা কি করলেন?’
‘কি করলাম?’
‘দেখতে পাচ্ছেন না আমি মেঝে মুছে পরিষ্কার করেছি।আর আপনি জুতা পায়ে এসে এগুলো কি করলেন?’
‘উফ!স্যরি,কম হয়ে গেছে?ওয়েট।’
কথাটি বলে তিনি অপরিষ্কার করায় যতটুকু অংশ বাকি ছিলো সেগুলোও পূরণ করতে লাগলেন।পাউডার দানি থেকে সব পাউডার ফ্লোরে ফেলে দিলেন।একেকটা জিনিস ইচ্ছে করে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন।আর আমি শুধু অবাকের উপর অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।কে বলবে এখন এই রুমকে একটু আগেই পরিষ্কার করা হয়েছে।পুরো লন্ডভন্ড অবস্থা।তার কাজ সম্পূর্ণ করে তিনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন।আর আমি মুখ ফুলিয়ে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললাম,
‘আপনি একটা নিষ্ঠুর।’

৭.
আজ আরিশা আপু আর দুলাভাই আসবেন এ বাড়ি।সেই সুবাদেই সকাল থেকে ভালো ভালো রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে।অভ্র’র মা আজ সব দেখছেন নিজ হাতে।আজ হয়তো উনার শরীরটা একটু ভালো।এমনিতে তিনি বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ থাকেন মাইগ্রেইনের ব্যাথায়।অভ্র’র মা আমার সাথে খুবই কম কথা বলেন।প্রয়োজন না পড়লে নাই বলেন।
যেকোনো সময় আপু,দুলাভাই এসে পরবে তাই আমি তাড়াতাড়ি গোসলের জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলাম।কিন্তু যেতে না যেতেই বাইরে থেকে দরজায় টোকা পড়তে লাগলো।আমি বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি অভ্র।
‘কি হয়েছে?’
‘বাইরে আসো।’
‘কেনো?’
‘এখন আমি গোসল করবো।’
‘তা করবেন,আমি আগে করে নেই।’
‘এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবো না।আমি এখনই করবো।তাড়াতাড়ি বাইরে আসো।’
‘ইশ!বললেই হলো,আমি আগে এসেছি দেখতে পাচ্ছেন না?আমি আগে করবো তারপর আপনি করবেন।’
‘অরু আমার মাথা গরম করো না।বের হতে বলছি বের হও।’
অন্যদিন হলে তার এতো কথাও বলতে হতো না তার আগেই আমি ভয়ে চুপচাপ বের হয়ে আসতাম।কিন্তু আজ যেনো আমার মধ্যে জেদ চেপে বসেছে।যাই হয়ে যাক গোসল করবো তো আগে আমিই।
‘কি হলো শুনতে পাচ্ছো না?’
কথাটা বলতে বলতে তিনি আমার বেখেয়ালির সুযোগ নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়লেন।
‘আপু আর দুলাভাই কিন্তু এখনই চলে আসবে।শুধু শুধু তোমার আজাইরা কথা বলে সময় নষ্ট করো না।বের হও।’
‘দেখুন শুধু শুধু চেচাঁমেচি করবেন না।এটা একটা সোজা হিসাব,আমি আগে এসেছি তার মানে তো আমিই আগে গোসল করবো ঠিক কিনা!’
‘সোজা কঠিন আমি বুঝি না।এটা আমার ওয়াশরুম তাই আমার যখন ইচ্ছা আমি তখন গোসল করবো।’
‘আচ্ছা!তাহলে একটা কাজ করুন,আমার বাড়ি থেকে আমার ওয়াশরুমটা এখানে উঠিয়ে নিয়ে আসুন তারপর আমি না হয় আমার ওয়াশরুমে গোসল করবো।যত্তসব!’
‘এই তুমি বের হবে?’
আমি বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে ঘুরে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘না।আপনি বের হোন।’
‘আমি বের হবো না।’
‘তাহলে আমিও বের হবো না।’

‘থাক তোমাদের দুজনের আর কারোরই বের হতে হবে না।তোমরা দুজনেই ওয়াশরুমে থাকো আর ঝগড়া করো।’

তুতুলের কথা শুনে আমরা দুজনেই চমকে উঠে কিছু বলার আগেই তুতুল ওয়াশরুমের দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে দৌড় দিলো।

‘তুতুল সোনা…তুতুল সোনা দরজা খোলো।’

‘তুতুল সোনা মামু তোমাকে অনেকগুলো চকলেট দেবে দরজা খুলে দাও বাবা।’

আমাদের কারো ডাকেই তুতুলের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।
‘দেখেছেন তুতুলরা এসে পড়েছে আর আমি এখনো গোসলও করতে পারলাম না।কি ভাববে তারা এখনো তাদের সামনে যেতে পারলাম না!সব আপনার জন্য হয়েছে।আপনি এতক্ষণ এমন না করলে আমার গোসল এতক্ষণে হয়েও যেতো।’

‘আমার জন্য হয়েছে?সব তোমার জন্য হয়েছে।জেদটা না করলেই হতো।তুতুল তো কখনো এমন করে না।নিশ্চয়ই তুমি শিখিয়ে দিয়েছো!আমাকে ফাঁসানোর ফন্দি।তোমার তো এভাবে ভালোই লাগছে।’

তার কথা শুনে আমি জাস্ট হতবাকের উপর অবাক।মুখ হা করে কথা বলতেও আমার সময় লেগে গেলো।

‘আপনার সবসময় এটা কেনো মনে হয় আমি আপনার পেছনে পড়ে আছি।আপনার এটেনশন পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি।আর কি বললেন?আমার ভালো লাগছে?আপনি যতটুকু বিরক্ত হচ্ছেন না আমিও ঠিক ততটাই বিরক্ত…না ততটা না আমি তার থেকেও দ্বিগুণ বিরক্ত হচ্ছি।’

‘দ্বিগুণ কেনো?’

‘দ্বিগুণ কারণ….কারণ….

আমতা আমতা করেও তার থেকে দ্বিগুণ বিরক্ত হওয়ার কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছি না।আর উনি সেই তখন থেকেই আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘কি হলো বলো!’

‘আমি আপনার থেকে দ্বিগুণ বিরক্ত কারণ..কারণ আমার গরম লাগছে।’

‘ওহ!এই ব্যাপার।নাও।’

কথাটি বলে তিনি আমার মাথার উপরের শাওয়ার অন করে দিলেন।আমি ঠান্ডা পানিতে ভিজে পুরো চুপচুপে হয়ে যেতে লাগলাম।আর তিনি একটা ঠান্ডা লুক নিয়ে আমার দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন।আমাকে ভিজিয়ে দিলো আর আমি কি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি!আমিও তার হাত ধরে টেনে শাওয়ারের নিচে আমার সামনে দাঁড়া করিয়ে দিলাম।এবার তিনিও পানিতে পুরো ভিজে গেলেন।ঠান্ডা পানির ভাব সামলাতে সামলাতে তিনি বাম হাত দিয়ে শাওয়ার অফ করে দিলে আমি আবারো অন করে দিলাম।আবারও তিনি অফ করে দিলেন আর আবার অন করে দিলাম।এভাবে অন অফ করতে করতে কল খুলে আমাদের হাতে চলে এলো আর শাওয়ার ডাইরেক্ট হয়ে গেলো।আমরা দুজনই হতভম্ব হয়ে মাথার উপরে তাকালাম।লাইন শুধু ডাইরেক্টই হয়নি পানির তেজ আগের থেকেও দ্বিগুণ বেড়েছে।
‘আর ইউ মেড!কি করে দিলে দেখেছো!এখন এখানে বন্দি হয়ে ঠান্ডা পানিতে ভিজতে থাকো!’

‘দোষটা তো আপনারই।আপনি প্রথমে শুরু করলেন কেনো?এখন আবার আমাকেই ধমকাচ্ছেন!’

‘দয়া করে মুখটা একটু বন্ধ রাখবে।নাকি এখানেই সারাজীবন আটকে থাকার ইচ্ছা।’

প্রায় পাঁচ ছয় মিনিট ধরে ডাকাডাকি করেও কারো কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।এদিকে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমার শরীর জমে যাচ্ছে।অভ্র’র অবস্থা বুঝতে পারছি না।সে এখন ডাকা ডাকি করায় ব্যস্ত।তার গায়ের সাদা টি শার্ট টা একদম ভিজে লেপ্টে আছে।হঠাৎ সে আমার দিকে বেখেয়ালি ভাবে তাকিয়ে থমকে গেলো।আমিও অবাক হয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমার দিকে তার এমন থমকে যাওয়া দৃষ্টি দেখে।
সে এবার ধীরে ধীরে আমার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।তার এক পা এক পা করে এগিয়ে আসা কদমে একটু একটু করে আমাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচতে লাগলো।এবার আমার বুকে কেমন যেনো ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো উনি এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো।আমিও একটু একটু করে পেছাতে লাগলাম।দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে যাওয়ার আগেই তিনি আমার খুব কাছে চলে এলেন।আমি কিছু বলতে চাইলে তিনি আমার ঠোঁটে তার আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দিলেন।আমি পুরো ফ্রিজড হয়ে গেলাম।এরপর তিনি ধীরে ধীরে তার বাম হাত আমার চুলের মধ্যে গলিয়ে আমার গালে রাখলেন।তারপর খুব দ্রুত তার ডান হাত দিয়ে আমার মাথার পেছন থেকে কি যেন ছুঁড়ে ফেললেন।আমি চমকে উঠে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি ফ্লোরে ইয়া বড় একটা মাকরসা।
আমি ছিটকে দু পা পেছনে গিয়ে বললাম,
‘মা গো!কত বড় মাকরসা!’

‘এখন মা গো?এই মাকরসাটা তোমার কাঁধে ছিলো।’

কিহ!এতবড় মাকরসা আমার কাঁধে ছিলো?ভাবতেই তো যেনো কেমন গা রি রি করছে।ভাগ্যিস আমি দেখিনি।নাহ! উনাকে যতটা পঁচা ভেবেছিলাম অতটাও উনি নন।

‘এখন এতটা ভয় পেয়ে চুপসে থাকতে হবে না।তাছাড়া মাকরসাকে তুমি ভয় পাবে কি!মাকরসা যদি তোমাকে দেখতো তাহলে নিজেই ভয় পেয়ে যেতো।’

এই মাত্রই উনাকে একটু ভালো ভেবেছিলাম আর এক্ষুনই উনি আমার ভাবনাটাকে ভুল প্রমাণিত করে দিলেন।যাহ!ফিরিয়ে নিলাম আমার আগের কথা।

‘তবুও তো আমাকে দেখে এই অবুঝ প্রাণী কিছু বুঝে না বলে ভয় পাবে আর কিছু কিছু মানুষ যে আছে এদের দেখে তো মানুষরাই ভয় পেয়ে যায়।পুরো একটা ড্রাগন।’

আমার কথা শেষ না হতেই তিনি আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘যতক্ষণ অবদি আমরা এখানে আটকে রয়েছি একবারো এসে তুমি দরজা পিটিয়েছো?নিজে তো আরামে ওখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো আর আমাকেও বারবার ডিসট্রাক্ট করে যাচ্ছো।তুমি একটা ফাজিল মেয়ে!’

ছোটো থেকে নিজেকে সবসময় লক্ষী মেয়ে বলেই সবার থেকে শুনে এসেছি।এই প্রথমবার তার মুখে ফাজিল মেয়ে শুনে রাগে দুঃখে আমার চোখে পানি চলে আসার উপক্রম।
‘দেখুন আমাকে ফাজিল মেয়ে বলবেন না।’
‘কেনো বললে কি করবে!’
‘আমি কিন্তু তাহলে সবাইকে বলে দেবো যে….বলবো আপনি রাতে নাক ডাকেন।’
‘হোয়াট রাবিশ।একদম উল্টো পাল্টা কথা বলবে না।আমিও মোটেও নাক ডাকি না।’

উনি যে নাক ডাকেন না তা আমিও জানি।কিন্তু উনাকে জব্দ করার জন্য এর থেকে ভালো বুদ্ধি আর মাথায় এলো না।

‘আপনি নাক ডাকেন।আমি নিজে শুনেছি,আপনার নাক ডাকার জ্বালায় আমি ঘুমাতে পারি না।এই বয়সে যে এমন বুড়ো মানুষের মতো নাক ডাকে তা আমি এই প্রথম দেখলাম।’

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে রাগে গজগজ করছে।এবার আমি একটু ঢোক গিললাম।আজ আমার হয়েছেটা কি!একটু বেশিবেশিই করে ফেলছি মনে হয়।

তিনি ঝট করে আমাকে টেনে শাওয়ারের নিচে নিয়ে তার সাথের দেওয়ালটির সাথে হাত দিয়ে আটকে বললেন,
‘এসব উদ্ভট মিথ্যা কথা যেনো আর না শুনি বলে দিলাম।শুধু শুধু কি আর তোমাকে ফাজিল বলেছি!’
‘আামকে ফাজিল বলতে নিষেধ করেছি কিন্তু!’
‘আমি তো বলবোই।ফাজিল!’
‘তাহলে আমিও সবাইকে বলবোই আপনি নাক ডাকেন।’
তিনি রাগ হয়ে আমার দিকে আরেকটু ঘেষে দাঁড়ালেন।আর ঠিক তখনই এ বাড়ির কাজের মেয়ে চম্পা এসে দরজা খুলে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলো।আমরা দুজনই চকিত হয়ে পাশে তাকালাম।চম্পা মুচকি মুচকি হেঁসে গ্রামের নতুন বউদের মতো মুখে কাপড় চাপা দিয়ে এক ছুটে দৌঁড়ে গেলো।অভ্র চটজলদি আমাকে ছেড়ে দূরে সড়ে দাঁড়ালো।এখন সড়ে কি হবে!চম্পার যা দেখার তা তো দেখেই ফেলেছে।না জানি কি ভাবছে?ও যেমনটা ভাবছে তেমনটা তো কিছু না।এখন কি হবে!

ঝটপট করে তৈরি হয়ে নিচে গেলাম আপু,দুলাভাইয়েই সাথে দেখা করতে।চম্পা সেই রান্নাঘর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।এই চম্পার এখন কি করা যায়!আমার আসার একটু পরই অভ্র চলে আসলো।আমরা দুজনই চম্পার মুখ লুকানো হাসিতে ভীষণ অপ্রস্তুত।সেই অপ্রস্তুতের মাঝেই দুজনে একসাথে দুলাভাইকে প্রশ্ন করে ফেললাম,
‘দুলাভাই কেমন আছেন?’
আমি তার দিকে আর সে আমার দিকে তাকালো।আবারো প্রশ্ন করতে গেলাম আবার সেই একই প্রশ্ন একসাথে হয়ে গেলো।
‘রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো।’
এবার শুধু আমরা দুজন দুজনের দিকে নয় দুলাভাইও একবার আমার দিকে একবার তার দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
‘আমার কথা বাদ দাও।তোমরা নিউ মেরিড কাপল বলো তোমরা কেমন আছো?’
দুলাভাই উত্তর দেওয়ার আগে এবার আমাদের দুজনের একসাথে হাঁচি পেয়ে গেলো।
হাঁচি থামিয়ে আবারো উত্তর দেবো কিন্তু তার আগেই আবারো হাঁচি শুরু হয়ে গেলো।এবার আর থামছেই না।
‘আরিশা আপু উদ্বিগ্ন মুখে বলল,
‘কিরে অভ্র তোরা দুজন ঠিক আছিস তো?এমন ঠান্ডা লেগে গেলো কিভাবে?’
দুলাভাই বলল,
‘আহা!তুমি এতো টেনশন করছো কেনো?নতুন নতুন বিয়ের পর ঠান্ডা তো একটু আধটু লাগবেই।’
আরিশা আপু দুলাভাইকে চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘তুমি থামবে!এই চম্পা রাতে তোকে না বলেছি অভ্রকে প্রতিদিন এক গ্লাস করে গরম দুধ দিতে।এমনিতেই এখন মৌসুম পরিবর্তন হচ্ছে তার উপর অভ্র’র আবার ঠান্ডার ধাত আছে।তোর কাজ কর্মে কোনো মন নেই।সব মন খালি সিরিয়াল দেখায় পড়ে থাকে!’

এতবড়ো অভিযোগে চম্পা সেই রান্নাঘর থেকে তড়িৎ বেগে ছুটে এসে আরিশা আপুকে বলতে লাগলো,
‘আমি তো প্রতিদিনই ভাইজানরে দেই।এহন হেরা স্বামী স্ত্রী যদি এতবেলা কইরা এতক্ষণ ধইরা একসাথে নাইতে থাকে তয় তো ঠান্ডা লাগবোই।হেয়াতে আমার কি দোষ!

কথাটা বলে চম্পা আবার তার শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে দৌড় দিয়ে চলে গেলো।আর আমার মনে হলো আমার দম যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।আরিশা আপু,দুলাভাইয়ের সামনে ও কি বললো এটা!আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলাম।অভ্র’রও একই অবস্থা।
দুলাভাই মুচকি হেসে গলায় একটু খুকখুক করে কেশে আমাদের লজ্জাটাকে যেনো আরো বাড়িয়ে দিলেন।না এখন ছুটে কোথাও চলে যেতে পারছি আর না এখানে বসে থাকতে পারছি।হে আল্লাহ!তোমার এই বিশাল ধরণীতে কি একটু জায়গা হবে না আমার এই লজ্জা লুকানোর।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here