অতঃপর তুমি পর্ব-১৪

0
1229

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

১৮.
জুবায়ের স্যারের ক্লাস চলছে।জুবায়ের স্যারের ক্লাস মানে নো নড়াচড়া একদম স্ট্যাচু হয়ে থাকা।স্যারের নজর খুবই তীক্ষ্ণ।
আজ স্যার মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে এক গাঁদা লেকচার দিচ্ছেন।তার এই লেকচারের মাঝে স্যারের ভাষায় আমি একটা ভয়ংকর কাজ করে ফেললাম।মাথায় হাত দিয়ে আমি ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম।খুবই অল্প সময়ের জন্য,হয়তোবা চার সেকেন্ড।আমি বসেছি ছয় সারির মাঝের বেঞ্চটায়।স্যার যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে কোনো সাধারণ মানুষের এটা খেয়াল হওয়া সম্ভব না।কিন্তু আমার মতে স্যার কোনো সাধারণ মানুষ না।তার চোখ ঈগলের চেয়েও তীক্ষ্ণ।তার নজরে কোনো কিছুই এড়ায় না।
আমার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত না হতে দিয়ে স্যার ডেকে উঠলেন,
‘মিস হলুদ!’

স্যারের এই আরেকটা অভ্যাস।ক্লাস চলাকালীন কাউকে ডাকতে হলে তিনি বেশিরভাগই তার জামার রঙ ধরে ডাকেন।আজ আমার গায়ে একটা হলুদ রঙের সুতি সেলোয়ার কামিজ আছে।আমি ভয়ের মধ্যেও একটা খুবই ছোট্ট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।কারণ হলুদ কামিজটির সাথে পড়া সাদা ওড়নার বর্ডারে ছাই রঙের কাজ করা।ভাগ্যিস স্যার আমাকে মিস ছাই বলে ডেকে উঠেননি।নয়তো ভার্সিটির যেই অবস্থা,হঠাৎ করে একটা উদ্ভট নাম কারো জন্য পুরো ভার্সিটি লাইফ জুড়ে স্থায়ী হতে সময় লাগে না।কে বলতে পারে!কাল হয়তো স্যারের মুখে মিস ছাই নাম শুনে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে পরদিন থেকে সবাই মিস ছাই!মিস ছাই! বলেই ডাকতো।

‘মা,একটা বালিশ এনে দিবো।’

পুরো ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো।আমি ঢোক গিলে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।আজকে আমি গেছি!স্যার যেমন মানুষ তাতে এই অদ্ভুত কথার প্রতিউত্তরে যে চুপ করে থাকবো তাও হবে না।যাই বলুক জবাব দিতে হবে।তাই আমাকেও দিতে হলো,

‘না স্যার।’

স্যার খুব নরম গলায় বললেন,
‘কেনো?’
‘লাগবে না স্যার।’
‘অবশ্যই লাগবে।বালিশ ছাড়া ঘুমাতে কি শান্তি লাগে?সবকিছুরই একটা সঠিক দিক আছে না!
আমি একটা কাজ করি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি কোনো বালিশ জোগাড় করতে পারি কিনা।তোমার এখন ঘুমানোটা অবশ্যই প্রয়োজন।মাইক্রোবায়োলজি ক্লাসের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা টপিকে যে ঝিমুতে পারে তার নিশ্চয়ই এই মুহুর্তে ঘুমের ভয়াবহ সমস্যাই হয়েছে।পৃথিবী এদিক থেকে সেদিক উল্টে যাক তোমাকে তো এই মুহুর্তে ঘুমুতেই হবে,তাই না!’
সবাই আবারো জোড়ে হেঁসে উঠলো।আমি মাথা নিচু করে বললাম,
‘স্যরি স্যার।’
‘আহা! স্যরির কি আছে।ঘুম আসাটা কি খারাপ নাকি!ঘুম ছাড়া মানুষ বাঁচে?যাও তুমি এখন বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো।যাও।’

আমি আবারো স্যারকে স্যরি বললাম।কিন্তু স্যার কোনো উত্তর না দিয়ে সামনে ঘুরে বোর্ডে পড়া বুঝাতে লাগলেন।যেন আমার কথা এই মুহুর্তে তিনি শুনতেই পাচ্ছেন না।আমি বুঝে গেলাম আর কিছু বলে লাভ নেই।ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আস্তে করে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলাম।
মেজাজটাই পুরো বিগড়ে গেলো।কিভাবে ক্লাস থেকে বের হতে হলো!

বিগড়ে যাওয়া মেজাজকে আবার ঠিক করার জন্য কিছু পছন্দনীয় কাজ করা বাঞ্ছনীয়।তাই আমি সোজা ফুচকার স্টলে চলে আসলাম।ব্যাগটা পাশে ধপ করে রেখে একপ্লেট ফুচকা অর্ডার করলাম।ফুচকার প্লেট থেকে প্রথম ফুচকাটি হাত দিয়ে মুখে পুরতেই মেজাজ,মন সব ভালো হয়ে গেলো।

‘আবারো ফুচকা!’

পেছনে ঘুড়ে দেখলাম একটা কালো রঙের শার্ট গায়ে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে কৌতূহলে আমার ভ্রু কুঁচকে গেলো।কিছু বলতে পারলাম না কারণ আমার মুখে এখনো ফুচকা ভরা।
অভ্র আমার পাশের চেয়ার থেকে ব্যাগ তুলে আমার কোলে দিয়ে চেয়ারটিতে বসতে বসতে বলল,
‘এতো ফুচকা যে তুমি খেতো পারো!’

আমি অবাক ভাবটা কাটিয়ে উঠার আগেই তিনি বললেন,
‘এই সময় তো তোমার ক্লাসে থাকার কথা।তুমি এখানে কি করছো?’

আমি একটা ঢোক গিলে নিলাম।এখন তাকে সত্যিটা বললে নিশ্চয়ই এ নিয়ে আবার আমাকে ক্ষ্যাপানো শুরু করে দিবে।
‘আজ স্যার ক্লাসে আসে নি।’
‘জোবায়ের স্যার আসবে না ক্লাসে?অসম্ভব!’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘আপনি কি করে জানলেন এখন আমার জোবায়ের স্যারের ক্লাস?’
‘তোমার কখন কোন কার ক্লাস সবই আমার জানা আছে।এখন কথা না ঘুরিয়ে বলো এখানে কি করছো?ক্লাস এটেন্ড করো নি?’
আমি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললাম,
‘করেছিলাম,বের করে দিয়েছে।’
‘কেনো?’
‘আমি একটু ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম ক্লাসে।’
‘তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয়,জোবায়ের স্যারের ক্লাসে কিনা তোমার ঘুম পেয়ে যায়।’

আমি বুঝে গেলাম এখন নিশ্চয়ই তিনি আমাকে পচাঁনো শুরু করে দিবেন।তাকে আর সেই সুযোগ না দিয়ে বললাম,
‘এতো অবাক হবার কিছু নেই।জোবায়ের স্যারের কাছে সবাই বকা খায়।এটা নতুন কিছু নয়।আপনি যখন ছিলেন আপনি মনে হয় খান নি?’

‘জ্বি না ম্যাডাম।স্যার নিজে আমাকে নিয়ে এই কথা বলেছিলো আমিই একমাত্র ছাত্র যে কিনা জোবায়ের স্যারের কাছে কখনো বকা খায়নি।জেবায়ের স্যার আমাকে অনেক ভালো জানতো।’

‘আর নিজের প্রশংসা করতে হবে না।এখন বলুন আপনি এখানে কেনো?’

‘তোমাকে একটা জিনিস দিতে এসেছি।’

আমি দ্বিতীয় ফুচকাটা মুখে দিয়ে বললাম,
‘কি?’

তিনি আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমার দিকে আমারই ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘নাও রুনাকে ফোন করো।’

আমি তৃতীয় ফুচকাটি মুখে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললাম,
‘কোন রুনা?’
‘তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।’

তার কথা শুনে আমার বিষম উঠে গেলো।অভ্র একটা পানির বোতলের ছিপি খুলে আমার হাতে দিয়ে বলল,
‘দেখো বিষম উঠে গেলো!সাবধানে খাও।’

তার হাত থেকে পানির বোতলটি নিয়ে আমি তার থেকে মুখ আড়াল করে ঘাবড়ে গিয়ে পানি খেয়ে নিলাম।

‘কি হলো ফোন দাও।’

একটা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে আমি আমতা আমতা করে ফোনের ডায়াল চাপতে লাগলাম।এখন রুনাকে কোথায় পাবো তাই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম।ফোন না করার কোনো একটা বাহানা ঝটপট খুঁজতে লাগলাম।
‘হঠাৎ ফোন দিবো কেনো?কি বলবো?’

‘বলবে যে তোমার স্বামীরও যোগ্যতা আছে তার স্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার।যোগ্যতাটা অন্য কারোর চাইতে বরং একটু বেশিই আছে।অভ্র আহমেদের স্ত্রীকে তার হাত খরচের জন্য অন্য কারোর কাছে হাত পাততে হয় না।’

কথাগুলো বলে উনি তার মানিব্যাগ থেকে একটা ক্রেডিট কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
‘এটা তোমার।যত ইচ্ছা তত খরচ করবে।আনলিমিটেড।বুঝেছো?এটা তোমার স্বামীরই উপার্জনের।’

তার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।উনি আবারো তাগাদা দিতে লাগলেন রুনাকে ফোন দেওয়ার জন্য।আমি বললাম,
‘আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই।’

‘ও এই কথা!আমার ফোন দিয়ে দাও।নাম্বার বলো আমি ফোন দিয়ে দিচ্ছি।’

ফোনের ডায়ালের উপর হাত রেখে নাম্বারের আসায় উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উনার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছি।নাম্বার নিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম।কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।কিছুক্ষণ এভাবেই চলার পর উনি হঠাৎ জোরে জোরে হেঁসে উঠলেন।হাসতে হাসতে বললেন,

‘কি হলো নাম্বার বলতে পারছো না?একটা কাজ করে কাল্পনিক রুনার মতো একটা কাল্পনিক নাম্বারও বানিয়ে ফেলো।’

তার কথা শুনে আমি থতমত খেয়ে উঠলাম।এই রে!উনি সব ধরে ফেললো নাতো!একটা ফ্যাকাসে হাসি মুখে টেনে বললাম,
‘মানে?’
‘মানে আবার কি!যেভাবে সেদিন লোন এজেন্সির কলকে কাজে লাগিয়েছিলে সেভাবেই আজকেও না হয় তাকেই ফোন করে দাও।’

তার কথা শুনে আমি চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছি।উনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন,

‘ম্যাম,আমাকে দেখে কি আপনার বোকা মনে হয়?’

আমি একটা ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।অভ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে আবারও হাসতে লাগলো।এবার আমি মুখ ফুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

‘অরু,তুমি কি ভেবেছিলে?আমি বুঝতে পারিনি তোমার চালাকি?’

‘বুঝেছেন ভালো করেছেন।এবার এই ক্রেডিট কার্ড ধরুন।আমি তো এমনিই বলছিলাম আপনিই সত্যি সত্যিই কার্ড বানিয়ে আনতে গেলেন কেনো?’

‘কারণ তুমি এমনি এমনি বললেও কথাগুলো তো সত্যিই।বাবার বয়স হয়েছে তার পক্ষে এখন সবকিছু সামলানো আসলেই কষ্টকর।তোমার কথাগুলো শুনে আমিও অনেক ভেবে দেখেছি।সত্যিই তো!ইরা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে তার জন্য আমি আমাকে আর আমার আশেপাশের মানুষকে কেনো কষ্ট দেবো?আমি কেনো স্বাভাবিক ভাবে থাকবো না?’

যেই কথাটি আমি এতোদিন ধরে তাকে বোঝাতে চাইছি তা যে তিনি বুঝতে পেরেছেন তা দেখে আমার ভালো লাগলো।বেশ ভালো লাগলো।

‘এই কথাটাই আপনাকে সবাই বোঝাতে চাইছে।আপনি কাউকে বিশ্বাস করেছেন, এটা আপনার ত্রুটি নয়,যে আপনার বিশ্বাস রাখতে পারেনি সেটা তার অক্ষমতা।যদি কারও কষ্ট পেতেই হয় তবে তা তার পাওয়া উচিত।ভালো থাকাটা আপনি ডিজার্ভ করেন।এই কথাটাই বোঝানোর জন্যই আমি ঐ কাজটা করেছি।শুধু একটু বাঁকা পথে।’

অভ্র মৃদু হেঁসে উঠলো।আমি বললাম,
‘এবার প্লিজ কার্ডটা নিন।আমি এর জন্য এসব করিনি।’

‘তুমি কি পাগল!আমি বলেছি তুমি এর জন্য করেছো?আমি এটা দিয়েছি তোমার জন্য,নিজের থেকে।’

‘আমি এতো টাকা দিয়ে করবো?বাবা কি আমাকে কম টাকা দেয় নাকি!বাবা যা দেয় তাই তো শেষ করতে পারি না।’

‘বাবা যা দেয় তা তার ইচ্ছা।আর আমি দিচ্ছি কারণ এটা আমার দায়িত্ব।অরু,তোমার সব দায়িত্ব আমি নিয়েছি।তাই তোমার ভরণপোষণের দায়িত্বও আমার।এখন এ নিয়ে আবার তর্ক শুরু করলে কিন্তু বকা খাবে।আই এম সিরিয়াস।’

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here