সূর্যোদয় শেষ পর্ব

0
114

#সূর্যোদয়
#শেষ_পর্ব
#কারিমা_দিলশাদ

১৫৭.

কক্সবাজার এসেছে জয় আর ঐশী। হানিমুনে। বিয়ের প্রায় সাড়ে পাঁচমাস পর তারা হানিমুনে যাচ্ছে। এতদিন দুজনের ব্যস্ততায় দূরে কোথাও যাওয়ার সময় সুযোগ হয়ে উঠে নি। স্মৃতির ভর্তি পরীক্ষা, ঐশীর পরীক্ষা, জয়ের বিদেশ যাওয়ার ফর্মালিটিজ পূরণ করা নিয়ে এতদিন বেশ ব্যস্ত ছিল দুজনে। তাই এবার সময় সুযোগ মিলতেই ইলোরা ইয়াসমিনের তত্ত্বাবধানে ব্যাগ চ্যাগ বেঁধে দুজনে পাড়ি জমিয়েছে সমুদ্র অভিমুখে।

এত লং জার্নি ঐশীর জন্য এবারই প্রথম। এর আগে ময়মনসিংহের বাইরে ঐশী কখনো কোথাও যায় নি। কলেজ কিংবা ওর বাবার অফিসের পিকনিকের জোরে কয়েকটা জায়গা ঘুরার সুযোগ হলেও এটাই তার প্রথম লং জার্নি। ঐশী বাসে যাতায়াত করতে পারে না৷ তাই ট্রেন দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এসেছে। এটুকু জার্নি বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসতে, বাসে উঠেই তার অবস্থা কাহিল। সারাটা রাস্তা জয়ের কাঁধে মাথা রেখে এসেছে। আর জয় সারাটা রাস্তা ঐশীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। বিভিন্নভাবে মাইন্ড ডিস্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করেছে।

বাস থেকে নেমে চোখেমুখে একটু পানি দিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পড়ে দুজন। ঐশী পিছনে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। গাড়ির এতো শব্দ আর ভালো লাগছে না তার। এত টাকা আর কষ্ট করে কিনা পানি দেখতে যাচ্ছে! এসব নিয়ে জয়ের সাথে তার বেশ বাকবিতন্ডা হয়েছে। জয় যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল হানিমুনে কোথায় যেতে চায় তখন ঐশী কিছুক্ষণ ভেবে বলে জেলখানায়। এমন জবাবে জয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমন জবাবের বিপরীতে বেচারার কি বলা বা করা উচিত তার জানা নেই। তবে এই মেয়ের দ্বারা এমন আজগুবি উদ্ভট কথা বলা কোনো ব্যাপার না। সে কেবল শান্ত স্বরে বলেছিল,

“ কেন?”

“ আরে! এই দেশের প্রায় ম্যাক্সিমাম মানুষই হানিমুনে কক্সবাজার যায়। তো আমরা নাহয় একটু ব্যতিক্রম কিছু করলাম। আমরা জেলখানায় যাব৷ সারাদিন দুজনে একটা ঘরের মাঝে বন্দী থাকবো, শুধু আপনি আর আমি। সময় মতো ওরা খাবার দিবে। আর ফুল সিকিউরিটি তো আছেই।” – বলেই দাঁত কেলিয়ে হেসে ছিল। আর জয় মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল। এর বেশি আর কি করার আছে!? পরে অনেক বাকবিনিময়, মান অভিমানের পরে আজ তারা এখানে।

ঐশী চোখ খুলে জয়ের দিকে তাকায়। জয় ফোনে কারো সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। বলিষ্ঠ পুরুষালী গলায় কোনো পেশেন্ট নিয়ে কথা বলছে। কি অদ্ভুত জুটি তাদের। ঐশীর সারা শরীর রাগে ভরা। বসে থাকতে থাকতেও অযথা রাগ হয় এমন মানুষ সে, রাগে কারো মাথাও ফাটিয়ে দিতে পারে। আর এই জনাব! এখন অব্দি জনাবের রাগ দেখার তেমন সুযোগ হয় নি। তবে অভিমান! ওরে বাপরে বাপ। পান থেকে চুন খসলেই অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। আর কারো কোনো কথা বা কাজে কষ্ট পেলে মুখ ফোটে কিচ্ছু বলবে না, কিচ্ছুটি না। ইন্ট্রোভার্ট একজন মানুষ, আর সে! আল্লাহ তায়ালা এমন দুজন মানুষকে এক করে দিয়েছে। নে এবার একজন আরেকজনের মাথা ফাটাতে থাক, আর আরেকজন সেটারই মলম পট্টি করুক। এইজন্যেই বোধহয় জয় ডাক্তার। ভেবেই ঐশী হালকা হেসে বাইরে তাকায়।

রাস্তাটা ভীষণ সুন্দর। ঝকঝকা তকতকা। রাস্তার দুই ধারে বিভিন্ন রিসোর্ট, হোটেল,মোটেল আরও বিভিন্ন ছিমছাম সুন্দর ভবন। ঐশী জানালায় মাথা রেখে এসব দেখছে। হঠাৎ সে অন্যরকম একটা শব্দ শুনতে পায়। চকিতে মাথা তুলে এদিক ওদিক শব্দের উৎস খুঁজতে লেগে পড়ে। কিন্তু তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। নিজের ডান পাশ থেকে হাসির শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় জয় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে গম্ভীর মুখ করে তাকাতেই জয় হাসি থামিয়ে বলে,

“ সামনে গিয়ে দেখতে পাবে।”

“ সমুদ্র?! ” ঐশীর প্রশ্নে জয় কেবল হাসিমুখে সম্মতি জানায়। ঐশী অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই বিশাল সমুদ্রকে দেখার। আরও কিছুটা সামনে গিয়ে জয়ের ডাকে ডান দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় সেই বিশাল জলরাশির কিছু ঝলক। ঐশীর চোখমুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। জয়ের কাঁধে হাত রেখে সে উৎসুক হয়ে তা দেখছে। সুযোগ পেয়ে জয় ঐশীর কোমড়টা দু’হাতে ধরে তাকে নিজের আরও কাছে নিয়ে আসে। ঐশীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে তো সমুদ্র দেখতে ব্যস্ত। ঐশী সমুদ্রের দিকে তাকিয়েই বাচ্চাদের মতো আবদার করে,

“ ডাক্তার সাহেব, ডাক্তার সাহেব চলুন না যাই। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

জয় হেসে বলে,

“ যাব তো জান। আগে হোটেলে যাই। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে তারপর যাব। তোমার রেস্টের প্রয়োজন।”

হঠাৎ করেই চোখের সামনে সমুদ্রের বদলে মানুষের তৈরি কৃত্রিম দালানকোঠা চোখে পড়তে থাকে। তারা বাজারের মধ্যে চলে এসেছে হয়তো। ঐশী করুণ চোখে জয়ের দিকে তাকালে জয় হেসে ঐশীর নাক টেনে বলে,

“ ওরে প্রেয়সী আপনাকে তো নিয়েই যাচ্ছি ওই সমুদ্রের কাছে। তখন যতখুশি দেখিয়েন। সাতটা দিন আমরা এখানেই থাকছি।”

জয়ের কথায় ঐশী নিজের উৎসুকভাব নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে। এতক্ষণে তার খেয়াল হয় সে জয়ের খুব কাছে। লোকটা তার কোমর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। সে সামনে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে তারাতাড়ি সরে আসে। জয় তাকে তার জায়গায় বসতে দিয়ে নিজে ঐশীর জায়গায় বসতে বসতে বলে,

“ এখান থেকে ভিউগুলো ভালো করে দেখতে পাবে।”

“ কোথায় যাচ্ছি আমরা? সব হোটেল টোটেল তো পিছনে ফেলে এলাম।”

“ রয়েল টিউলিপ। নাম শুনেছ? আমরা ওখানেই যাচ্ছি।”

“ রয়েল টিউলিপ!! শুনেছি ওখানে অনেক টাকা খরচ হয়!”

“ তা হয়। বাট এই প্রথম আমার মনের রাণীকে নিয়ে এলাম, তাকে তো আর যেভাবে সেভাবে রাখা যায় না। আর আমার মনটা অনেক বড়।”

“ আহা…..”

“ হোটেলে যেতে আর বড়জোর ২০ মিনিট লাগবে।”

বেশ অনেকক্ষণ পর জয় ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ লুক এট দ্যা ভিউ ঐশী।”

ঐশী চোখ খোলে বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও বের হচ্ছে না। সে জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেয়। সারি সারি ঝাউ গাছ। তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে উত্তাল ঢেউ। নিস্তব্ধ গাছপালায় ঘেরা রাস্তা। ডান পাশে ঝাউ বন। উত্তাল সমুদ্র। ইশশ কি মনোরম দৃশ্য। হঠাৎ হঠাৎ করে বেশ কয়েকটা সাম্পান চোখে পড়ছে। এসমস্ত কিছু এতদিন সে কেবল টিভি চ্যানেলে দেখা এসেছে। আজ বুঝি সে এসব সামনাসামনি দেখছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। ঐশী জয়কে হাত দিয়ে ডাকতে ডাকতে বলে,

“ এই ডাক্তার সাহেব চলেন না আমরা নামি, প্লিজ প্লিজ।”

“ জান আমাদের চেক ইন করতে হবে। অলরেডি আমরা লেইট। পরে আসবো তো আমরা।”

“ একটু ডাক্তার সাহেব, একটু প্লিজ। ”

“ জেদ করে না জান। ইনশাআল্লাহ আমরা আসবো তো।”

ঐশী আর কিছু বলে না। মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন খারাপ ভাবটা আর থাকে না। এবার সমুদ্রটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঐশী মুখ হা করে দেখছে। কি বিশাল সমুদ্র!!

১৫৮.

ঐশী রুমের দরজা খুলে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। কি সুন্দর সাজানো গোছানো রুম। ঐশী রুমে ঢুকে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। বেডে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ ডিজাইন করা, আবার টাওয়াল দিয়ে দু’টো হাস বানানো। সেন্টার টেবিলে সুগন্ধি ক্যান্ডেল জ্বা’লানো। সবকিছু দেখার পর ঐশীর নজর গেল বারান্দায়। ঐশী গ্লাস ডোর স্লাইড করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই মনোরম দৃশ্য দেখতে পায়। সৃষ্টিকর্তার তৈরি আর মানুষের কৃত্রিমতার মিশ্রণে এক অপরুপ সৌন্দর্য। বারান্দা থেকেই সাগরের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়। তারা বর্তমানে দশ তলায় অবস্থান করছে। নিচে বিশাল সুইমিংপুল।

জোরেশোরে বাতাস বইছে। বাতাসে ঐশীর চুল, ওড়না উড়ছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি বিদ্যমান। এর মাঝেই পিছন থেকে জয় এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। ঐশীর মাথায় তার থুতনি ঠেকিয়ে সেও উপভোগ করতে থাকে দৃশ্য। কিছুক্ষণ দুজনের কেউই কথা বলে না। নিরবতা ভেঙে জয় বলে,

“ ভালো লাগছে?”
“ হুমমম খুব খুব..”
“ রুম ভালো লেগেছে?”
“ হুমমম খুব খুব.. ”
“ খিদে পায় নি?”
“ বুঝতে পারছি না।”
“ পারবেই না। সেই কোন সকালবেলা ইদুরের মতো কি একটু খেয়েছে, তাও সেটা বমি-টমি করে ফেলে দিয়েছে। এখনও নাকি সে বুঝতে পারছে না। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার পরে আমি যাব। এরপর এসে দুজনে লাঞ্চ করবো।” – কিছুটা ধমকের সাথে বলে উঠে।
“ ওমম… আগে আপনি যান। আমি আরেকটু দেখি। আপনি এসে অর্ডার করুন এরমধ্যে আমি ফ্রেশ হয়ে এসে পড়বো।”

জয় হেসে ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়। জোরে জোরে শ্বাস টেনে ঐশীর গায়ের ঘ্রাণ নেয়। ঐশী জয়ের এই কাজের সাথে খুবই পরিচিত, এমনটা জয় প্রায়ই করে। কিন্তু কখনও ঐশী বিষয়টায় নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। ওর কেমন জানি গা কেঁপে উঠে। এখনও তার ব্যতিক্রম হয় না। জয় ঐশীর ঘাড়ে ছোট ছোট চুমু একে দিতে থাকে। ঐশী জয়কে থামিয়ে দিয়ে তাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। জয় হালকা হেসে ঐশীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

জয় ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেই ঐশী সেদিক থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকায়। এরপর হেসে ফেলে। পাগল একটা লোক। কখন কি করে তার কোনো ঠিক নেই। ঐশী ভাবতে থাকে, আর ভাবতে থাকে। তার ভাবনার কোনো শেষ নেই। ঐশী এখন কক্সবাজারে। একটা হোটেলে। তাও আবার রয়েল টিউলিপের মতো একটা ফাইভ স্টার হোটেলে। যেখানে সে আজ পর্যন্ত ঢাকা শহরটাও ভালো করে ঘুরে দেখে নি। সে কি না কক্সবাজারে। এটাই ঐশীর প্রথম কোনো হোটেলে আসা৷ ঐশীর বিশ্বাসই হচ্ছে না। মানুষের ভাগ্য কখন কি থেকে কি যায় কেউ বলতে পারে না।

১৫৯.

ঐশী ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে জয় তার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে। দুজনে একসাথে লাঞ্চ শেষ করে। বারান্দার কাউচে বসে কোল্ড ড্রিংকস পান করছে। কি মনে করে ঐশী যেন জয়ের দিকে তাকায়, ঠিক সেই সময় জয়ও তার দিকে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হতেই দুজনে কোনো কারণ ছাড়াই হেসে দেয়।

“ তো এখন কি করবেন ডাক্তার সাহেব? ”
“ কি করবো। এই তুমি কি কিছু করতে চাও?”
“ একদম ডাবল মিনিং অসভ্য কথাবার্তা বলবেন না। ঘুরতে যাবেন না নাকি জিজ্ঞেস করেছি।”
“ ছি: বউ! ডাবল মিনিং-এর কি হলো! আর অসভ্যেরই বা কি হলো এখানে?” জয় অবাক হওয়ার ভান করে কথাটা বলতেই ঐশী চোখ গরম করে তাকায় জয়ের দিকে। জয় বিনিময়ে হালকা হেসে দুজনের গ্লাসটা টেবিলে রেখে হুট করেই ঐশীকে পাঁজা কোলে নিয়ে নেয়। আর রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
“ ঘুরতে তো যাবোই। কিন্তু তার আগে এখন আমরা একটা ঘুম দিব। আমাদের দুজনেরই এখন একটা ঘুম প্রয়োজন। সো চুপচাপ আমার বুকে ঘুমিয়ে পড়ো।”

বলতে বলতেই নিজে বিছানায় শুয়ে ঐশীকে বুকে জড়িয়ে নেয়। ঐশী জয়ের বুক থেকে মাথা তুলে নরম স্বরে বলে,

“ কিন্তু আমার তো এখন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।”
“ ইচ্ছে না হলেও ঘুমাতে হবে। Aren’t you tired?” -ঐশী কোনো জবাব দেয় না। এই নিরবতার মানে হ্যা। জয় চোখ বন্ধ করতে করতে বলে,

“ ঘুমাও আর না ঘুমাও। কিন্তু এখন তোমাকে এভাবেই আমার বুকে শুয়ে থাকতে হবে। আমি ঘুমাবো, আর তুমি আমাকে দেখবে। যেভাবে ট্রেনে দেখছিলে।” – এটা শুনে ঐশীর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ট্রেনে যে ঐশী সারাক্ষণ জয়কে দেখছিল তা জয় জানে। অথচ ঐশী ভেবেছিল জয় ঘুমিয়ে আছে। ঐশী আমতা আমতা করে বলে,

“ আসলে রাতের বেলা বাইরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না তো। তাই…”
“ তাই আমাকে দেখেছো তাই তো? সে তুমি এমনিও দেখতেই পারো। আফটার অল আমি তোমার হাসবেন্ড। আমাকে তুমি দেখবে না তো আর কে দেখবে। কিন্তু তুমি আমাকে চুরি চুরি করে না দেখে সরাসরিই দেখতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। আমি জানি আমি সুন্দর। তুমি দেখো আমাকে, সমস্যা নেই।” – ঐশী লজ্জায় চোখ বন্ধ করে জয়ের বুকেই মুখ গুঁজে দেয়। কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথায় ঐশীকে লজ্জা দিল লোকটা। অভদ্র লোক।

১৬০.

ছোট্ট ছোট্ট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল।

কথাগুলো হয়তো জীবনের চরম কিছু শিক্ষা লুকিয়ে আছে। এখন ঐশী সেটারই যেন ফলিত রুপ দেখছে। এই যে সমুদ্রে এতো পানি কিভাবে হয়েছে? হয়তো বিন্দু বিন্দু জলরাশি একত্রিত হয়েই এই বিরাট সাগরের সৃষ্টি। আচ্ছা এই সমুদ্রের শুরু কোথা থেকে? আর শেষই বা কোথায়? এই যে এত বিশাল সাদা বালুর বিছানা এটাও তো ছোট্ট ছোট্ট বালুকণা থেকেই এতো বিশাল হয়েছে। আমরা মানুষরাও তো একটু একটু ভুল করে ভুলের পাহাড় তৈরি করছি। একটু একটু করে পাপ করে বিশাল বিশাল পাপের ভাগিদার হচ্ছি। এর শেষ কোথায়? মৃত্যুতে। আর এর ফলাফল পাব ওই পরকালে।

জয় আর ঐশী পাশাপাশি বসে সূর্যাস্ত দেখছে। দুজনের শরীরই সাগরের নোনাজলে ভেজা। এতক্ষণ দুজন মিলে বেশ লাফঝাঁপ করেছে এই সাগরের জলে। এখন ক্লান্ত হয়ে একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখছে। কি অদ্ভুতভাবে অতবড় সূর্যটা সমুদ্রের মাঝে ডুবে গেল। ঐশী অবাক চোখে দেখছে।

আজ ঐশীর কেবল অবাক হওয়ার পালা। হোটেল থেকে বিচে এসে জয়কে ফেলেই ঐশী এক দৌড়ে এখানে চলে এসেছে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ বারেবারে যখন তার পায়ে এসে বারি খাচ্ছিল, তখন তার সে কি আনন্দ। আনন্দে মেয়েটার চোখে পানি এসে গেছিল। জয় তখন পিছনে দাঁড়িয়ে ঐশীর এই খুশির সাক্ষী হচ্ছিল। এই খুশিটার জন্যই তো এতকিছু। মেয়েটা যতই উপরে উপরে নিজেকে স্ট্রং আর ডোন্ট কেয়ার টাইপ দেখানোর চেষ্টা করুক, ওর মাঝেও ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ে আছে। যে পরিস্থিতির কবলে পড়ে কখনো নিজেকে মুক্ত করতে পারে নি। জয় সেটাই বের করার চেষ্টা করছে।

ঐশী খুশিতে চিল্লাচ্ছে, লাফাচ্ছে। একসময় অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে ঐশী জয়কে জড়িয়ে ধরে। সেই মুহূর্তে, ঠিক সেই মুহূর্তে জয় স্তব্ধ হয়ে যায়। এই প্রথম বারের মতো মেয়েটা তাকে নিজের থেকে জড়িয়ে ধরেছে। হোক সেটা আবেগতাড়িত হয়ে। ঐশী জয়কে জড়িয়ে ধরে আনন্দ আর কান্না মিশ্রিত গলায় অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। আর জয় তাকে আগলে নেয়। খুব আবেগ নিয়ে সে ঐশীর কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে ঐশীর মুখের দিকে। এই মেয়েটা তার অর্ধাঙ্গীনী, তার জীবনসাথী, তার প্রেয়সী। ভাবতেই জয়ের শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। সে ঐশীর দুই চোখে ঠোঁট ছোঁয়ায়। এরপর তার নজর যায় ঐশীর হালকা গোলাপি ঠোঁটের দিকে। খুশিতে হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে মেয়েটার ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে । জয় কিছু না ভেবেই বিশাল জলরাশি, আর অসীম আকাশকে সাক্ষী রেখে ঐশীর ঠোঁটে চুম্বন করে। ঐশী ঝট করে সরে আসতে চাইলেও জয়ের বলিষ্ঠ বাহু থেকে সরে আসতে পারে না।

জয় নিজের কার্য হাসিল করে তারপরই ছাড়ে তাকে। ঐশী লজ্জায় চোখ নিচু করে এদিক ওদিক তাকায় কেউ দেখেছে কি না তা আড়চোখে দেখে নেয়। রাগে দাঁতের সাথে দাঁত চেপে বলে,

“ লজ্জা শরম কি বেঁচে রেখে এসেছেন? পাবলিক প্লেসে এসব কি করছেন?”

জয় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রসিকতার সহিত বলে,

“ বউয়ের সাথে রোমান্স করছি জান। এন্ড লুক আশেপাশে কেউই নেই। আমরা এখান থেকে সবাইকে যেমন ছোট দেখছি ওরাও আমাদের ওমনই দেখছে।” – ওরা এমন একটা জায়গায় আছে যেটা ইনানী বিচ আর রিসোর্টের বিচের মধ্যবর্তী জায়গা। তাই আশেপাশে তেমন কেউ নেই। দূরে একটা জেলেকে দেখা যাচ্ছে তাও সেটা তার কর্মকাণ্ডে বুঝা যাচ্ছে। তারপরও এভাবে একটা খোলামেলা জায়গায় এমন কিছু ঐশী মোটেই ভাবে নি। তার আশপাশ দেখার মাঝেই জয় আবার ঐশীর কোমর ঝাপটে ধরে নিজের সাথে চেপে ধরে বলে,

“সো….. আমি আপনাকে আরেকটু আদর করতেই পারি ম্যাডাম।” – বলেই আবার ঐশীর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। জয়ের সাথে জোরজবরদস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ থেকে ভেজা বালি নিয়ে জয়ের দিকে ছুড়ে মারে ঐশী৷ জয় বালি নিয়ে ঐশীর দিকে ছুড়ে মারার আগেই ঐশী ছুটে পালিয়ে যায়। দুজন দুজনকে ইচ্ছেমতো পানিতে ভিজিয়েছে, ঝিনুক কুড়িয়েছে। যেগুলো এখন ঐশীর উড়নার এক অংশে বাঁধা আছে।

রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ইলোরা ইয়াসমিনের সাথে কথা বলে। এরপর এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কৃত্রিম আলোয় বাইরে ঝলমল করছে। সুইমিংপুলসহ পুরো রিসোর্টটা লাল নীল বিভিন্ন রঙিন আলোয় সাজানো। নিচের দিকে তাকালেই চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া অবস্থা। এটা একটা অন্যরকম সৌন্দর্য।

জয় ফ্রেশ হয়ে পিছন থেকে এসে ঐশীর পিঠে নিজের ভেজা চুলগুলো ঝাঁকি দেয়। এতে ঐশীর পিঠে হালকা পানি পড়ে। ঐশী বিরক্ত হয়ে তাকে চোখ রাঙায়। বিনিময়ে জয় মুচকি হেসে ঐশীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুৃমুক দিয়ে আবার ঐশীকে দেয়। ঐশীও তাতে স্বাভাবিকভাবে চুমুক দেয়।

জয় তা দেখে হেসে ফেলে। ঐশী OCD তে আক্রান্ত না। তবে সে মারাত্মক শুচিবাইগ্রস্ত। বিষয়টা একটু এক্সট্রিমই, বাট সেটা ডিসঅর্ডার পর্যায়ে না। ঐশীর নিজের খুঁতখুঁতে বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে কিছু লক্ষণ মিলিয়ে নিজে নিজেই ভেবে নিয়েছিল সে OCD তে আক্রান্ত। কিন্তু আসলে তা না। বিষয়টা সে বিয়ের পর পরই বুঝতে পারে। এটা সে ঐশীকে বুঝায়ও। হ্যা ঐশী এখনও অমন, একটুও বদলায় নি। তবে বিষয়টা বেশ কিছু অংশে কমেছে। জয়ের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। যেই মেয়ে একসময় অন্যের খাওয়া গ্লাসেও পানি খেতো না সে এখন জয়ের এঁটো চা-কফি এমনকি খাবারও খায়।

জয় ঐশীর মুখের চুলগুলো ওর কানে গুঁজে দেয়। ঐশী তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। হাসতেই মেয়েটার ঠোঁটের সাইডের টোল’টা দৃশ্যমান হয়। জয় টুপ করে ঐ টোলে ঠোঁট ছোঁয়ায়।এরপর আরও একটা, এরপর আরও একটা। একসময় জয়ের ছোঁয়াগুলো আরও গভীর হতে থাকে। ঐশীর সারা শরীরে জয়ের হাতের বিচরণ শুরু হয়। সে ঐশীকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যায়। দাম্পত্য সম্পর্কগুলো স্বামী স্ত্রীর জন্য আল্লাহর নেয়ামত। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কগুলো সবসময় পবিত্র হয়।

১৬১.

রাতের বেলায় হঠাৎই ঐশীর ঘুম ভেঙে যায়। বরাবরের মতোই নিজেকে জয়ের বাহুবন্ধনে পায়। ঘুম ভাঙা চোখে কিছুক্ষণ জয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ওর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দেয়। এইতো আর কয়েকটা দিন। তারপরই লোকটা বিদেশ বিভুইয়ে উড়াল দিবে। মানুষটা যে আজকাল তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। এই মানুষটা চলে গেলে সে থাকবে কিভাবে? কি দরকার ছিল তাকে নিজের সাথে এভাবে জড়ানোর? নিজের সাথে জড়িয়ে এখন চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। দুইটা বছর! কম সময় এটা? নিজেকে বাইরে থেকে যতোই শক্ত দেখাক, লোকটা চলে যাবে ভেবেই তার বুকটা কেমন মুচড়ে উঠে। জয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঐশীর চোখের কূল ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়ে।

ঐশী তা মুছে নিয়ে উঠে পড়ে। জয়ের শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। জয় তার থেকে অনেক লম্বা। অমন লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ লোকের শার্ট তার হেংলা পাতলা শরীরে জামার মতো মনে হচ্ছে। হাতা তার হাত ছেড়ে বেশ অনেকটা ঝুলে আছে। গলা বড়, এক্ষুনি খোলে পড়বে পড়বে ভাব, লম্বায় তার হাঁটু থেকে বেশ অনেকটা নিচে। আয়নায় নিজেকে দেখে মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেলে সে।

গ্লাস স্লাইড করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। চুলগুলো এক সাইডে এনে হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দেয়। উপর থেকে নিচে তাকিয়ে দেখে সারা রিসোর্টে রঙবেরঙের আলোয় ঝলমল করছে। যদিও গভীর রাত হওয়ায় এখন কিছু আলো কমিয়ে দিয়েছে। সবগুলো লাইট বন্ধ থাকলে বেশি ভালো লাগতো। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় সমুদ্র যেন ফুঁসে উঠছে।

রাতের এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মাঝেই কেউ এসে তার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়। সে ভয়ে চমকে পিছনে তাকায়৷ তাকে এভাবে ভয় পেতে দেখে জয় সরি বলে।

“ এটা কি ধরনের ব্যবহার। উফফ…. রাতের বেলা এভাবে পিছন কেউ আসে?”
“ সরি তো সোনা….. আমি তো তোমাকে ডাকলাম। কিন্তু তুমি তো কোনো জবাব দিলে না।” – ঐশী এবার মিইয়ে যায়। সে নিজের ভাবনায় এতো বেশি মগ্ন ছিল যে জয়ের ডাক তার কর্ণগোচর হয় নি। ঐশীও সরি বলে ডাক না শোনার জন্য।

কথা বলতে বলতেই জয় কাউচে বসে পড়ে। ঐশী কি মনে করে জানি জয়ের কোলে বসে জয়ের গেঞ্জির মধ্যে ঢুকে গেঞ্জির গলা দিয়ে নিজের মাথা বের করে দেয়। জয় প্রথমে অবাক হলেও পরে জোরে হেসে উঠে। ঐশী চট করে জয়ের মুখে হাত দেয়।

“ পাগল নাকি। এতো রাতের বেলা এতো জোরে হাসে কেউ?”
“ পাগল তো আপনি মেডাম। কখন যে আপনার মাথায় কি চলে। তা হঠাৎ এতো রোমান্টিকতার কারণ কি?”
“ কিছুই না। মন চাইলো তাই। আমি আমার জামাইয়ের সাথে যা ইচ্ছা করতে পারি তাতে আপনার কি?”

জয় কিছু না বলেই হেসে দেয়। গভীর রাতে দুই কপোত-কপোতী মেতে আছে নিজ দুনিয়ায়।

১৬২.

কক্সবাজারে জয়-ঐশী দম্পতির চারদিন কেটে গেছে। যদিও তাদের এখানে একসপ্তাহ থাকার কথা ছিল কিন্তু কালকেই তাদের ফিরে যেতে হবে। জয়ের ইমার্জেন্সি কাজ পড়ে গেছে। তার উপর আবার ফ্লাইটের সময়ও এগিয়ে এসেছে। খবরটা শুনেই ঐশীর ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যায়। এমনিতেই আর কয়টা দিন ছিল এখন যাওয়ার সময় আরও ঘনিয়ে এলো! খবরটা শোনার পর থেকেই ঐশী বিষন্ন হয়ে আছে।

একটু একা থাকতে চায় বলে ঐশী জয়কে রেখে সমুদ্রের পাড়ে বসে আছে। ঐশী মনে মনে ভাবছে,

“ মস্ত একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে সে। লোকটার সাথে সে নিজেকে খুব বেশি জড়িয়ে ফেলেছে। জয় তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। সে চলে যাবে এটা তো আগে থেকেই জানা। এর জন্যেই তো এতো তারাতাড়ি বিয়ে হলো। তাহলে তার এখন এমন মন খারাপ লাগছে কেন? শুধু মন খারাপ না, কষ্ট হচ্ছে তার। রীতিমতো বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। জয়কে শক্ত করে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে করছে। জয় চলে গেলে কার সাথে সে এতো মান অভিমান করবে। তার ভালো লাগা খারাপ লাগার খেয়াল কে রাখবে। জয় চলে গেলে তার সাথে কে একটু পর পর খোঁচাখোঁচি করবে। জয়ের যেই কাজকারবার তার একসময় বিরক্ত লাগতো এখন সেগুলোই তার সবচেয়ে ভালো লাগার কারণ। জয় চলে গেলে সময় অসময় তার সাথে কেউ আর অভিমান করবে না, বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে না কেউ। এটা সেটা বায়না করবে না। ওর সকাল শুরু হয় জয়কে দিয়ে, দিনের শেষও হয় জয়কে দিয়ে। এরপর কি হবে? এসবই কি কেবল অভ্যেস? যদি অভ্যেসই হবে তাহলে এতো বুকফাটা কষ্ট কেন হবে। বড়জোর মন খারাপ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। এটা কি সত্যিই অভ্যেস নাকি ভালোবাসা?”

ভিতর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলছে হ্যা হ্যা এটা ভালোবাসা। তুমি ওই ছেলেমানুষী করা, খাম-খেয়ালি করা লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছো। কংগ্রাচুলেশনস ইউ আর ইন লাভ। তোমার জ্বালা তো এখন শুরু হতে চলেছে। তোমার অপেক্ষার প্রহর তো কেবল শুরু হতে চলেছে।

ঐশী এসব ভেবে উঠে পিছন ফিরতেই দেখতে পায় তার থেকে কিছু দূরে জয় বসে আছে। যে এখন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঐশী ওর সামনে গিয়ে বসে,

“ আপনি এখানে কেন?”
“ হুমম…… তুমি একা থাকতে চেয়েছো তাই তোমাকে একা থাকতে দিয়েছি। তাই বলে কি আমার বউকে একা ছেড়ে দিব?” – ঐশী কেন জানি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। সে জয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। জয়ের একহাত ঐশীর কোমরে আরেক হাতে ঐশীর ঘাড়ে রাখা। হঠাৎ করেই সে ঐশীর ঠোঁটের ভাঁজে নিজেকে বিলীন করে দেয়। আজ ঐশীও নিজেকে যেন সঁপে দেয় জয়ের কাছে।

১৬৩.

খুব ভোরবেলা জয়ের ডাকে ঘুম ভাঙে ঐশীর। ঐশী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় জয়ের দিকে। বাইরে এখনও অন্ধকার। এরমধ্যেই জয় ঐশীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দুজনে সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটছে। একটু পরেই জয় ঐশীর হাত ধরে সমুদ্রের দিকে তাকাতে ইশারা করে। সূর্যোদয়! কক্সবাজারে আসার পর এই প্রথম ঐশী সূর্যোদয় দেখছে। এই কদিন কোনো না কোনো কারণে তা দেখা হয় নি। উঠতোই তো দেরি করে।

সমুদ্রের ভিতর থেকে যেন সূর্যটা বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেও কেমন যেন অন্ধকার ছিল চারপাশ। অথচ সূর্যোদয় হতেই ক্ষণিকের মধ্যে আশেপাশের সব অন্ধকার মুছে গিয়ে আলোকিত হয়ে উঠলো। সূর্যাস্ত দেখে ঐশী ভেবেছিল এটাই হয়তো সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। এটাই জীবনের চরম সত্যি। কিন্তু এখন সূর্যোদয় দেখে মনে হচ্ছে এটাই সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। এটা জীবন চালনার শক্তি। সূর্যাস্ত দেখে ভালো লাগার মাঝেও কোথাও যেন একটা খারাপ লাগা মিশে ছিল তবে এই সূর্যোদয় দেখে মন থেকে সত্যিই ভীষণ ভালো লাগছে। ঐশী হাসিমুখে জয়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় জয় মাটিতে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। ঐশী অবাক হয়ে বলে,

“ আপনি এভাবে বসে পরলেন কেন?”

জয় আস্তে আস্তে মাথা তোলে ঐশীর দিকে তাকায়। জয়ের মুখে তখন হালকা লজ্জা, খুশি আর কষ্টের সংমিশ্রণ। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি অথচ চোখজোড়া টলটল করছে। জয়কে এভাবে দেখে ঐশীর মুখের হাসি গায়েব হয়ে যায়। জয় ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠে,

“ তুমি আমার জীবনে এই সূর্যোদয়ের মতো ঐশী। তুমি আসার আগে আমার জীবনটা অন্ধকারচ্ছন্ন ছিল। ঠিক এই সূর্য উঠার আগেকার সময়ের মতো। তুমি আসার পর আমার জীবনটা আলোয় আলোয় ভরে গেছে। ঠিক এখনকার মতো। তোমায় আমি ভালোবাসি ঐশী। কতটুকু, কেন, কিভাবে তা আমি জানি না৷ আমি জাস্ট জানি তোমাকে আমি ভালোবাসি। তুমি আমার জন্য এই সূর্যের মতো। সূর্য না থাকলে এই পৃথিবী কি হবে জানোতো। তুমি না থাকলে আমার অবস্থাও এই পৃথিবীর মতোই হবে। তাহলে বুঝে নাও তুমি আমার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার জন্য তুমি ঠিক কতটা জরুরি। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন কিচ্ছু না। তোমাকে ছাড়া আমি ধ্বংস হয়ে যাব ঐশী। আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ আ লট। ইউ আর দা সানশাইন ইন মাই লাইফ। না আমি তোমাকে ছেড়ে যাব, না তোমাকে ছেড়ে যেতে দিব। কক্ষনো না।”

ঐশী জয়ের কথায় নিজেও হাঁটু গেড়ে বসে জয়কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। দুজনই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। যেটুকু দ্বিধা ঐশীর মনে ছিল তা সব যেন আজ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর জয় কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঐশীকে ছেড়ে দেয়। পিছন থেকে একটা সূর্যমুখী ফুল নিয়ে ঐশীর সামনে ধরে। তরতাজা একটা সূর্যমুখী ফুল। ঐশী এইসময় সূর্যমুখী ফুল দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,

“ এই সময় আপনি এখানে সূর্যমুখী ফুল কোথায় পেলেন?” – জয় হালকা হেসে মাথা চুলকে বলে,

“ এটা প্লাস্টিকের। অনেক খুঁজেছি কিন্তু এখানে পাই নি। বাইরে থেকে নিয়ে আসাটাও এই সময় সম্ভব ছিল না। তাই এটাই দিলাম। এটা ফেইক হলেও আমার ভালোবাসা কিন্তু একদম খাঁটি, হু।”

জয়ের কথা শুনে ঐশী জোরে হেসে উঠে। আর জয় ভোরের আলোয় স্নিগ্ধ এক মেয়ের ভুবন ভোলানো হাসিতে আবারও মাতোয়ারা হয়। আরও একবার প্রেমে পড়ে এই মেয়েটির।

#পরিশিষ্ট: আজকে জয়ের ফ্লাইট। জয়, ইলোরা ইয়াসমিন, স্মৃতি আর ঐশী সবাই বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে আছে। ইলোরা ইয়াসমিন ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। স্মৃতিও নিরবে কাঁদছে। কেবল ঐশী স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে। জয় ইলোরা ইয়াসমিনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার কপালে পরশ একে দেয়। ইলোরা ইয়াসমিনও ছেলের কপালে মমতার পরশ একে দেয়। জয় স্মৃতি কে ভালো করে বুঝিয়ে শুনিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এরপর জয় তাকায় ঐশীর দিকে। সে তাকাতেই ঐশী তাকে একটা মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দেয়। বিনিময়ে জয়ও অনেক কষ্টে হাসে। জয় ঐশীর সামনে আসতেই ঐশী সন্তপর্ণে একটা ঢুক গিলে। সে ঐশীর কপালে অত্যন্ত ভালোবাসার সহিত একটা চুমু খায়। এরপর আস্তে করে বলে ‘আসি’। ঐশী চোখের পলক ফেলে সম্মতি জানায়। জয় চলে যাচ্ছে। জয় একবার পিছন ফিরে সবার দিকে তাকায়। ঐশীর সাথে চোখাচোখি হতেই জয় ঐশী দুজনেই হেসে দেয়। তারা যেন চোখে চোখেই দুজন দুজনকে জানিয়ে দেয় তারা একে অপরের জন্য অপেক্ষা করবে। তাদের যে এখনও একসাথে অনেকটা পথ চলা বাকি। অনেক কথা রাখা বাকি। জয় চলে যায় আর পিছনে অপেক্ষায় রেখে যায় ঐশীকে।

#প্রথম_খন্ডের_সমাপ্তি 😊🌼🙏

[ #বি:দ্র: এখানেই শেষ করলাম আমার লেখা প্রথম গল্প #সূর্যোদয়। আমি জানি খুব একটা ভালো হয় নি। অপরিপক্ক হাত, অগোছালো আর ভুলত্রুটিতে ভরা লেখনী। নিয়মিত গল্পও দেই নি। প্রথম গল্পেই আন-প্রফেশনাল তকমা লাগিয়েছি। আমি এটার জন্য অসংখ্য ক্ষমাপ্রার্থী। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিবেন। তবুও যারা এতগুলো দিন সাথে ছিলেন তাদের অসংখ্য অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কয়েকজন অধীর আগ্রহে গল্পটার জন্য অপেক্ষা করতেন। অনিয়মিত দেওয়ার জন্য তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আই ওয়াজ হেল্পলেস। এখনও আমার পরিবারের অবস্থা ঠিক নেই। যাইহোক সেসব বাদ। যারা যারা গল্পটা পড়েছেন তারা সবাই আজকে আপনাদের ভালো লাগা খারাপ লাগা বলবেন, গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। এতদিন যারা নেক্সট, নেক্সট প্লিজ এসব কমেন্ট করেছেন তারাও আজকে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন আশা করি। আমি এই ফিল্ডে নতুন। কি করলে আমার লেখনী ভালো হবে, কি কি পরিবর্তন আনা প্রয়োজন তা আমাকে বলবেন। আমি চেষ্টা করবো সেগুলো শুধরানোর। ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর কেউ যদি কোনোভাবে আমার লেখা আর কথার মাধ্যমে কষ্ট পেয়ে থাকেন মাফ করে দিবেন।
ধন্যবাদ। 😊🙏]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here