সূর্যোদয় পর্ব ৪৩

0
80

#সূর্যোদয়
#পর্ব_৪৩
#কারিমা_দিলশাদ

১৪২.

সকালে ঘুম ঘুম চোখে নিজেকে কারো বাঁধনে আবিষ্কার করে ঐশী। চট করে চোখ মেলে ঐশী নিজেকে একজন পুরুষের বাহুবন্ধনে পায়। বিষয়টা বুঝতে তার খানিকটা সময় লাগে। সে যে এখন আর সিংগেল নেই। এখন সে বিবাহিত, আর এই পুরুষটা তার স্বামী। এখন থেকে এই পুরুষটার সাথেই তার থাকতে হবে।

কিন্তু এভাবে পেঁচিয়ে ধরার কি মানে? সকাল সকাল ঐশীর মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। সে বিরক্তি নিয়ে নিজেকে জয়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বিছানা থেকে উঠে একটা শ্বাস ছাড়ে সে। ফোনে সময়টা দেখে তার চোখ কপালে। আটটা বেজে গেছে। সে বাসাতেই নরমালি ভোরবেলায় উঠে। আর আজ নতুন জায়গায় এসে প্রথমদিনই লেইট। সে চুলটা হাত খোঁপা করে হাতমুখ ধোঁতে ওয়াশরুমে ঢুকে কি মনে করে আবার স্যুটকেস থেকে একটা শাড়ি বের করে নেয়। একেবারে গোসল করেই নাহয় বের হবে।

জয় মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। উঠে আশেপাশে ঐশীকে দেখতে পায় না। সে ভ্রু কুঁচকে রুমের দরজার দিকে তাকায়। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, তাহলে ঐশী বের হয় নি। ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে তারমানে ঐশী বাথরুমে। জয় মুচকি হেসে উপুড় হয়ে বালিসে মুখ গুঁজে দেয়। তারও বউ আছে। ভেবেই একটু জোরে হাসে জয়।

একটুপর ঐশী গোসল করে বের হয়। দরজা খোলার শব্দ শুনে জয় বালিশ থেকে মুখ তুলে তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায়। এ কেমন সৌন্দর্য! এ কেমন চক্ষুশীতল করা সৌন্দর্য! এমন একটা সকালও তার ভাগ্যে ছিল! এতো সুন্দর স্নিগ্ধ সকাল।

কালো পাড়ে খয়েরি রঙের শাড়িতে সদ্য ফোটা কোনো গোলাপ। ভেজা চুলগুলো গামছা দিয়ে পিছনে বাঁধা। সামনের দুই সাইড দিয়ে কিছু চুল বেরিয়ে আছে। গালের একসাইড দিয়ে পানি বেয়ে গলায় এসে পড়ছে। জয়ের পড়িয়ে দেওয়া গয়নাগুলো ঐশীর শরীরে একদম জ্বলজ্বল করছে। কি শান্ত স্নিগ্ধ রুপ! এমন রুপ দেখেই তো শরীর মন শান্ত হতে বাধ্য। ঐশীর গলার কালো তিলটা জয়কে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে।

ঐশী আঁচল দিয়ে গলা মুছে বিছানায় তাকাতেই জয়কে জাগ্রত অবস্থায় পায়। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,

“ উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন।” – জয় কোনো উত্তর দেয় না। ঐশী নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে। ড্রেসিংটেবিলে হেলান দিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ এসবের কি দরকার ছিল?” -জয় এবারও নিশ্চুপ। জয়ের উত্তর না পেয়ে ঐশী ভ্রু কুঁচকে নেয়। ওভাবেই বলে,

“ এই যে মিস্টার কিছু বলছি তো আপনাকে শুনছেন?”

জয় উঠে বসে ঐশীকে নিজের কাছে আসতে বলে। ঐশীর ভ্রু আরও কুঁচকে যায়। ঐশী এগিয়ে আসতেই জয় ওকে হাত দিয়ে বিছানায় বসতে ইশারা করে। ঐশী বসতেই জয় ঐশীর দুই গাল ধরে টেনে দেয়। ঐশী নিজের গাল ধরে অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে জয়ের দিকে তাকায়। জয় হেসে ঐশীকে আরও অবাক করে দিয়ে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। পরক্ষণেই ঐশীর কোমর পেঁচিয়ে পেটে মুখ গুঁজে দেয়।

ঐশীর সারা শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠে। সে জয়ের মাথা ধরে সরিয়ে দিতে চাইলে জয় ঐশীর কোমর আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে মুখ গুঁজে দেয়। ঐশী জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। জয় বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। ঐশী কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

“ ডাক্তার সাহেব স..সরুন। অনেক দেরি হয়ে গেছে আ আমি বাইরে যাব।” – জয় এবার মুখ উঠিয়ে অবাক হয়ে বলে,

“ এখন বাইরে কোথায় যাবে?”

“ বাইরে বলতে রুমের বাইরে বুঝিয়েছি।”

জয় ওহহ বলে আবারও ঐশীর পেটে মুখ গুঁজে দেয়। ঐশী চট করে সবটা শক্তি প্রয়োগ করে উঠে পড়ে। গামছা খুলে চুল মুছতে মুছতে বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ যান ফ্রেশ হতে যান।” – জয় ঐশীর কথায় লাজুক হেসে বলে,

“ জান বললে!! যাচ্ছি জান।” – ঐশী জয়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ ঢংয়ের জান বলি নি, আপনাকে যেতে বলেছি। আর কি দরকার ছিল এসব গয়নার? আমি এসব পড়ি না।”

জয় উঠে এসে ঐশীর সামনে দাড়িয়ে বলে,

“ এখন থেকে পরবে।” – ঐশীর হাত থেকে গামছাটা নিয়ে ঐশীর চুল মুছে দিতে দিতে বলে,

“ দেখো তোমার জন্য স্পেশালি গাইড করে বানিয়ে এনেছি। একদম পাতলা করে। তোমার ভার ভার লাগবে না। গলার চেনটাও দেখো ছোট করে বানিয়ে এনেছি। দেখি। হ্যা এই দেখো গলার সাথে লেগে আছে। এদিক ওদিক হবে না। সুন্দর লাগছে। একদম জয় আহসানের বউ বউ লাগছে।”

“ আমি কানে গয়না পড়ে ঘুমাতে পারি না। ব্যাথা লাগে।”

“ রাতে তো দিব্যি ঘুমালে। ব্যাথা পেয়েছ?”

“ সারাদিন চুড়ি পড়ে থাকবো?”

“ ইশশ এমন করছো কেন? তুমি মনে হয় এসব কোনদিন পরো না।”

“ আরে শখ করে এক আধ দিন পরা আর সারাক্ষণ পরা কি এক হলো?”

“ অভ্যাস হয়ে যাবে জান। আমার খুব শখ। আমার বউ শাড়ি-চুড়ি পড়ে টুকটুক করে ঘুরে বেড়াবে। আর আমি দেখবো।”

এরপর কি মনে হতেই বলে,

“ এই তুমি শাড়ি পড়ে কমফোর্টেবল ফিল করো?” – ঐশী অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ গোমড়া করে বলে,

“ চালিয়ে নিব।” – মুখে এটা বললেও ঐশীর নিজেরই শখ ছিল বিয়ের পর শাড়ি পড়ে থাকবে সবসময়। কিন্তু জয়ের সামনে তা প্রকাশ করে না। জয় হেসে বলে,

“ তাহলে তো হলোই। শাড়ি পড়ে আন-কমফোর্টেবল ফিল করলে তোমার কমফোর্ট কাপড়ই পড়তে পারো। তবে মাঝে মধ্যে শাড়ি পড়ো। আমার খুব ভালো লাগে।”

“ নুপুর…..” – ঐশীকে কিছু বলতে না দিয়ে বলে,

“ নুপুরের আওয়াজ আসছে না দেখো। আমি ঠিক করেই এনেছি। শোনো আমি জানি তোমার কি কি সমস্যা আছে গয়না নিয়ে। আমি তা মাথায় রেখেই সেগুলো বানিয়ে এনেছি। তাই আর এসব নিয়ে বাহানা করো না প্লিজ। যখন তোমার বেশি অসুবিধা হবে তখন খুলে রেখো। আপাতত যতক্ষণ পারো পড়ে থাকো। ওকে?” – ঐশী মাথা নাড়াতেই। জয় হেসে গামছাটা বারান্দায় নেড়ে দিতে দিতে বলে,

“ আর শোনো তোমার ফার্স্ট নাইটের গিফটটা আমার কাছে পাওনা রইলে। ওটা আমি তোমাকে সাথে নিয়ে দিতে চাই। আজকে তো হবে না। কালকে বৌভাত। এরপর দুদিন তো তোমার বাবার বাসায় থাকতে হবে। ওখান থেকে এসে তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব ঠিক আছে?” – বলতে বলতে এসে ঐশীর নাকটা টিপে দেয়। ঐশী নিজের হাতের চুড়ি দেখিয়ে গয়নাগুলো উদ্দেশ্য করে বলে,

“ তাহলে এগুলো কি ছিল?”

“ এগুলো তো গিফট না। এগুলো আমি আমার বউয়ের জন্য শখ করে বানিয়ে এনেছি। আর ওটা হবে তোমার গিফট।”

“ আচ্ছা ঠিক আছে। এবার ফ্রেশ হয়ে আসুন। ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়েই প্যাক প্যাক করে যাচ্ছেন।” – বলে জয় কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাথায় কাপড় দিতে দিতে রুমের বাইরে চলে যায়। জয় ঐশীর কথায় আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যি তো এতক্ষণ সে বাসি মুখ নিয়ে ঐশীর সাথে কথা বলছিল। ইশশ প্রেস্টিজ পাংচার।

১৪৩.

ঐশী বের হয়ে কিচেনের দিকে যেতেই দেখতে পায় ড্রইংরুমে জয়ের বড় মামা আর ছোট মামা বসে কিছু একটা নিয়ে ফুসুরফাসুর করছে। ঐশী উনাদের সালাম দেয়। উনারাও গম্ভীরমুখে সালাম নেয়। তখনই জয়ের বড় মামি আসে তাদের চা দিতে। ঐশী তাকেও সালাম দেয়। তিনি ঐশীকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে বলে,

“ তা এতক্ষণে সকাল হলো বুঝি মহারাণীর? নতুন বউ কোথায় সকাল সকাল উঠে সবার জন্য নাস্তা বানাবে তা না। ওদিকে শাশুড়ী আর আমরা খেটে খেটে ম’রছি। হুহ।”

ঐশী কিছু বলার আগেই ইলোরা ইয়াসমিন একটা বাটি ডাইনিং টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,

“ আপনার খাটতে হবে না বড় ভাবি। আপনিও তো মাত্রই উঠলেন। আমি তো বললাম কাজলকে দিয়ে আমি আপনাদের চা পাঠিয়ে দিব। কাজ করার জন্য কাজলকে রেখেছি তো। আপনার এই পরিশ্রম করার দরকার ছিল না।”

“ বাবা গো বাবা….. ছেলের বউকে তো ভালো মন্দ কিছু বলতেই দেও না দেখছি। ছেলের বউকে লাই দিয়ে অতো মাথায় তোলো না গো ইরি। এই ছেলের বউই তোমার কাল হবে দেখো। ছেলের বউকে সবসময় পায়ের নিচে রাখতে হয়।”

ইলোরা ইয়াসমিন হেসে বলে,

“ আমার ছেলের বউয়ের বিষয়টা আমার উপরই ছেড়ে দেন ভাবি। আমার ছেলের বউকে ভালো মন্দ কিছু বলার দরকার নেই আপনাদের। যখন যা বলার দরকার হবে আমিই বলবো। ওকে কোথায় রাখতে হবে তা আমার জানা আছে। ভাগ্য যা আছে তাই হবে। ভাগ্যের লেখা কেউ খন্ডাতে পারবে না ভাবি। ওসব ছেড়ে এখন খেতে আসুন সবাই। আর বৌমা জয় উঠেছে?”

“ জ্বি মা।”

“ ওহহ…. তোমাদের খাবারটা বেড়ে দিচ্ছি। দুজনের খাবারটা নিয়ে রুমে যাও। জয়কে তাড়াতাড়ি নাস্তাটা করে নিতে বলো। ওকে মনে করিয়ে দিও রেলস্টেশনে যাওয়ার কথা। ওর ফুফুকে নিয়ে আসতে হবে। আর স্মৃতিকে বলে যেও ছোট ভাবিকে সহ সবাইকে নাস্তার জন্য ডেকে দিতে।”

ঐশী আর কোনো কথা না বলে ইলোরা ইয়াসমিনের কথামতো কাজ করে ওদের খাবারটা নিয়ে রুমে যায়। গিয়ে দেখে জয় তৈরি হচ্ছে। ঐশী খাবারের ট্রে টা ছোট টেবিলটার ওপর রাখতে রাখতে বলে,

“ তারাতাড়ি নাস্তাটা করে ফেলুন। ফুফুকে আনতে নাকি আপনার স্টেশনে যাওয়ার কথা?”

“ হ্যা। বড্ড লেইট হয়ে গেছে। খাওয়ার সময় নেই। তুমি খেয়ে নাও প্লিজ।”

“ কি আজব কথা! সব তৈরি করা আছে খেতে কতক্ষণ লাগবে? কথা না বলে খেয়ে নিন এসে।”

জয় ঘড়িটা হাতে পড়তে পড়তে বলে,

“ আরে না এসে ফুফুর সাথে খাবো নি। তুমি কিন্তু খেয়ে নিও। যা শরীর স্বাস্থ্য তোমার।”

“ না খেয়ে একদম বের হতে পারবেন না। কখন উঠেছিলেন। তখন উঠে কাজকাম সারলে এখন এমন করতে হতো না। এখন ঢং না করে খেয়ে নিন।”

“ ওয়াও জান। বিয়ে হতে না হতেই তোমার মাঝে বউ বউ ঝাঁজ এসে গেছে। নট ব্যাড।”

ঐশী গরম চোখে তাকাতেই জয় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

“ খেয়ে নিন খেয়ে নিন না বলে খাইয়ে দিলেও তো পারো। খাইয়ে না দিলে আমি খাব না।”

ঐশী বিরক্তিকর একটা শ্বাস ফেলে বলে,

“ এতক্ষণে কিন্তু আপনার খাওয়া হয়ে যেত ডাক্তার সাহেব।”

জয় এখন বিছানায় সোজা হয়ে বসে আছে। যাচ্ছেও না। ঐশী রাগে গজগজ করতে করতে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে প্লেট হাতে নিয়ে সোফাটায় বসে শক্ত গলায় বলে,

“ আসুন। এসে গিলে উদ্ধার করুন আমায়।” – জয় ঐশীর কথায় একগাল হেসে লাফিয়ে গিয়ে ঐশীর পায়ের কাছে বসে পড়ে। জয়ের যা হাইট জয় নিচে না বসে সোফায় বসলে ঐশীকে দাঁড়িয়ে কিংবা টানা দিয়ে খাওয়াতে হবে।

ঐশী জয়কে খাওয়াচ্ছে আর ভাবছে। এই দামড়া মার্কা লোকের মাঝে যে এতো বেশি ছেলেমানুষী তা তার জানা ছিল না। ঐশী ভেবেছিল ছেলেমানুষী থাকলেও অতটা নেই। কিন্তু এর তো পুরা আগাগোড়া ছেলেমানুষীতে ভরা। কার্টুন একটা। শেষের কথাটা ঐশী আনমনেই ফিসফিসয়ে বলে ফেলে। জয় যেহেতু তার কাছেই ছিল তাই জয়ের শুনতে অসুবিধা হয় না। সে ঐশীর কথায় কিটকিটিয়ে হেসে উঠে। ঐশী চোখ মুখ কুঁচকে জয়ের দিকে তাকায়। জয় চোখ টিপে বলে উঠে,

“ এই কার্টুনের সাথে বুড়ি হতে হবে সুন্দরী। এটাই কিন্তু লাস্ট আর খাবো না।” – ঐশী জয়ের কথামতো লাস্টবার খাবার দিতেই জয় সেটা কোনোরকমে পানি দিয়ে গিলে ঐশীর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে ঐশীর গালে চট করে চু*মু দিয়ে বাইকের চাবি নিয়ে চলে যায়।

ঐশী মুখ হা করে চোখ বড় বড় করে শাড়ির আঁচলটুকু ধরে বসে আছে। এই মুহূর্তে তার হাত পা ছড়িয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছেছে। সে নিজেও যেখানে কোনদিন মুখ না ধুয়ে কাপড় দিয়ে এভাবে মুখ মুছে না। তার নতুন শাড়ি। তারউপর বদমাশটা তার গালে চু’মু খেয়েছে। ইশশ… ঐশী দাঁতে দাঁত চেপে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ির আঁচলটুকু আর হাতটা ভালো করে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধুয়ে আসে।

১৪৪.

জয় যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সিয়াম-সায়মা, নিতু, রুপা, ফয়সাল সবাই নিজের কর্মস্থলে চলে যায়। কালকে বউভাতের অনুষ্ঠানে আবার দেখা হবে ওদের সাথে। যদিও যাওয়ার আগে ওরা বেশ অনেকক্ষণ জয়কে বকাঝকা করেছে। বাসর রাতে টাকা না দিয়েই ঢুকে পড়েছে। এখনও যাতে পাকড়াও না করতে পারে সেজন্য তারা নাস্তা করার সময়ই জয় তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। বাসায় এখন ঐশী, ইলোরা ইয়াসমিন, ওনার ভাই-ভাবী, আর জয়ের কাজিনরা।

ঐশী স্মৃতি, শ্রাবণী, মাজিদ, আর শোভনের সাথে এক অদ্ভুত গেইম খেলছে লেবুচো’র। এটা নাকি শ্রাবণীরা ছোট থাকতে খেলতো। মানুষ হিসেবে চিরকুটে কিছু ফলের নাম আর একটা তে লেবুচো’র লিখে রাখে। যে লেবুচো’র লেখা চিরকুট পাবে সে সবার নজর এড়িয়ে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে চোখ টিপ দিবে। যাকে দিবে সে তখন কনফার্ম বলবে। এরপর সবার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হবে কে কাকে চো’র ধারণা করে। যে সঠিক উত্তর দিতে পারবে সে পয়েন্ট পাবে। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই ঐশী ওদের সবার সাথে মিশে যায়। আগেও একবার দেখা হয়েছে সবার সাথে কিন্তু তখন অতো আন্তরিকতা হয় নি।

এরমধ্যেই জয় তার ফুফু আকলিমা আক্তারকে নিয়ে এসে পড়েছে। তিনি ঐশীকে দেখে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদেন। আর নিজের ভাইয়ের জন্য অনেক আফসোস করতে থাকেন।

১৪৫.

নতুন জায়গা নতুন মানুষের মাঝে ভালোই কাটছে ঐশীর সারাটাদিন। বিকাল বেলা সবাই বাসার সামনের খোলা জায়গায় বসে। বিকালে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে ওখানে। এতো হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে ঐশীর বেশ ভালো লাগতে শুরু করে। যদিও জয়ের মামা-মামীরা তাকে পছন্দ করে না। সারাদিনে তারা ঐশীকে অনেক অপদস্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইলোরা ইয়াসমিন, জয়, স্মৃতি আর আকলিমা আক্তার সবসময় তার ঢাল হয়ে পাশে থেকেছে। ঐশীর হয়ে ওরাই স্ট্যান্ড নিয়েছে। যেখানে এতগুলো মানুষ সবাই তাকে আপন করে নিয়েছে সেখানে কিছু চুনোপুঁটির কথায় কি আসেযায়। আর জয়ের মামা-মামীকে বাকিরা তো বাদই ইলোরা ইয়াসমিন নিজেও পছন্দ করে না। ঐশীর এখানে মোটেও আন-কমফোর্টেবল ফিল হচ্ছে না।

এতো ভালোর মধ্যেও ঐশী বিরক্ত, চরম বিরক্ত। আর তার এই বিরক্তের কারণ জয়। লোকটা যে এতোটা ফা’জিল, বদ’মাশ, আর ছেলেমানুষ তা সে স্বপ্নেও ধারণা করে নি। সারাটাদিন এটা ওটা করে ঐশীকে বিরক্ত করে গেছে। ঐশী ইগনোর করেও সুবিধা করতে পারে নি। যেখানে গিয়েছে তার পিছন পিছন ঘুরেছে।

এই যে আপাতত সে আকলিমা আক্তারের সাথে সবার থেকে একটু দূরে বসে আছে। তাতেও ঐশীর শান্তি নেই। মহাশয় ঐশীর পিছ ধরে নিজেও এসে বসেছিল ওদের সাথে। আকলিমা আক্তারের ধমকে গিয়ে শোভনদের সাথে বসে আছে। ঐশীর সামনাসামনি বসে ঐশীকেই দেখছে। ঐশী যখনই ওদিকে তাকাচ্ছে তখনই দেখছে জয় তার দিকে তাকিয়ে। আর সে তাকালেই মেয়ে মানুষের মতো মুখ ভেঙচি দিয়ে মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকায়। ঐশী এতে চরম বিরক্ত। এক পর্যায়ে সে জয়ের দিকে পিছন ফিরে বসে।

আকলিমা আক্তার কিছু খেয়াল করেছে কি না ঐশী জানে না। তিনি হেসে ঐশীকে বলে,

“ আমার জয় বাবু খুব ভালো মানুষরে বৌমা। ওর মাঝে ভালোবাসার ক্ষমতা অনেক বেশি। আমি জানি বাবু তোমাকে পুতুলের বিষয়ে সব বলেছে। ও আড়াল করে রাখার মতো মানুষ না। ওর মাঝে লুকাছাপা নেই। বাবুর অতীত নিয়ে তুমি মনে কোনো দ্বিধা রেখো না বৌমা। বাবু তোমাকে খুব ভালোবাসে। যখনই কথা হতো সারাক্ষণ তোমাকে নিয়েই কথা বলতো। আমার ঐশী এই আমার ঐশী সেই। সারাক্ষন ঐশী আর ঐশী।” – বলেই হাসে উনি। ঐশী উনার এই কথায় একটু লজ্জা পায়৷ তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলা শুরু করেন,

“স্বামীর উপর ভরসা করতে হয় মা, সম্পর্কের ভিত্তিই হলো বিশ্বাস। ভুলেও কখনো আমার বাবুকে কষ্ট দিয়ো না বৌমা। এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ।” – বলেই তিনি কেঁদে দেন। ঐশী ওনার হাত জড়িয়ে ধরে ভরসা দেয়। এটুকু সময়েই ঐশীর মনে হয়েছে মহিলাটা খুব সরল মনের। জয় তার দূর্বল জায়গা। বলা যায় জয় অন্তঃ প্রান। ঐশী তার ইমোশনটা বুঝে।

ঐশী আকলিমা আক্তারকে শান্ত করে কিছুক্ষণ এদিক ওদিকের কথা বলে আমতা আমতা করছে কিছু একটা বলার জন্য। তার খুব কৌতুহল হচ্ছে। সে কৌতুহল দমিয়ে না রেখে আকলিমা আক্তারকে বলে,

“ ফুপিমা…. পুতুলের এখন কি খবর?”

“ আছে ভালোই আছে। সবাই ভালো আছে। খালি তোমার ফুপার শরীরের অবস্থাটা ভালো না। ওনার জন্যেই তো তোমাদের বিয়েতে আসতে পারলাম না।বাড়িভরা মানুষ থাকলেও একা একা তো আর মানুষটাকে রেখে আসতে পারি না বলো। তাই মিমকে রেখে এসেছি। মিম তোমার ননদ আরকি।” – ঐশী কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসে। ঐশীর কেনো যেনো মনে হলো উনি কথা কাটানোর চেষ্টা করছে। ঐশী যে এই অর্থে পুতুলের কথা বলে নি এটা তো তার বুঝার কথা। তবুও ঐশী আর এই বিষয় নিয়ে কথা বলে না।

১৪৬.

রাতের বেলা,

জয় বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে লেপটপে কিছু কাজ করছে। ঐশী হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ রিসিপশনের কাজ সব গুছানো হয়ে গেছে?”

জয় গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,

“ হ্যা অলমোস্ট। আর শুনো কালকে দশটার দিকে স্মৃতি আর শ্রাবণীকে নিয়ে পার্লারে চলে যেও। সাজগোজ শেষ হওয়ার আগেই ফোন করো গাড়ি পাঠিয়ে দিব। এখনই সব বলে রাখছি, কালকে সকাল থেকেই আমাকে দৌড়াতে হবে। তাই বলার আর সুযোগ হবে না হয়তো। কমিউনিটি সেন্টারে একবারে দেখা হবে। অবশ্য তোমার তো আমি না থাকলে কিছু যায় আসে না। আমি না থাকলেই তো তোমার ভালো।”

ঐশী শেষের কথাগুলো শুনে ভ্রু কুঁচকে নেয়। তারপর কি মনে করে নিঃশব্দে মুচকি হাসতে থাকে। বিকালের পর থেকে সাহেব আর ঐশীর কাছে ঘেষার সুযোগ পায় নি৷ সেই দেয় নি। সারাক্ষণ শাশুড়ী আর ফুফু শাশুড়ীর সাথে সাথে থেকেছে। সাহেব বেশ চটে আছে বুঝতে পারে। জয়কে আরেকটু জ্বালাতন করতে ঐশী বলে,

“ তা অবশ্য ঠিক বলেছেন।” – ঐশীর কথায় জয় চট করে ঐশীর দিকে তাকায়। যে এখন নির্বিকারভাবে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। যেন এইমুহূর্তে সে কিছুই বলে নি। জয় রাগে গমগমে স্বরে বলে,

“ হ্যা ঠিকই তো বলেছি। আমি না থাকলেই তো ভালো। কেউ আর বিরক্ত করবে না। থেকো তখন সারাক্ষণ দূরে দূরে। কোনো বাহানা করতে হবে না। সারাক্ষণ ননদ,দেবর, শাশুড়ীদের সাথে গল্পো করো।” – বলতে বলতে বিছানা ছেড়ে লেপটপ নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। মেজাজটাই খারাপ করে দিল তার। এই মেয়েটা একটা অসহ্য।

ঐশী মিটমিটিয়ে হাসছে জয়ের কথায়। জয় আবার গমগমে স্বরে বলে উঠে,

“ শোনো মেয়ে ওখান থেকে আমরা সোজা তোমার বাপের বাড়িতে যাব৷ পরেরদিনটা থেকে বিকালে চলে আসবো। আমায় ঢাকা যেতে হবে ইমার্জেন্সি। তুমি চাইলে থাকতে পারো। আমি দুজনের কিছু কাপড় একটা ব্যাগে নিয়ে নিয়েছি। কাউকে আর কিছু করতে হবে না। আর লাগেজ থেকে বারবার কাউকে কাপড় বের করতে হবে না। আলমারিতে একজনের জন্য আমি আগেই সব গুছিয়ে রেখেছি। আলমারিটা খুলে একবার দেখতেও তো পারে মানুষজন। আর পার্লারে গিয়ে অত সং সাজতে হবে না। যেভাবে কমফোর্টেবল সেভাবে সাজলেই হবে। যদিও আমি সব বলে রেখেছি। আর তিনজন মেয়ে যেন একা একা আসতে না যায়। বেশি পন্ডিতি করতে হবে না কারো।” – কথাগুলো জয় বেশ ঝাঁজ নিয়ে বলে। ওদিকে জয়ের এমন কথার ভাবভঙ্গিতে ঐশীর পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে। এ আবার কেমন ধরনের রাগ। রাগও করবে আবার কেয়ারও করবে।

ঐশী উঠে এসে জয়ের পাশের সোফায় বসে। জয়ের মুখে রাগের ছাপ। সে ভ্রু কুঁচকে লেপটপে কিছু করছে। ঐশী বলে,

“ বাপ বা আপনি তো দারুণ রাগ করতে জানেন। ”

“ আমি কোথায় রাগ করলাম? রাগ তো কেবল আপনি একাই করতে জানেন। নাকের ডগায় ঘুরে রাগ। ইউজলেস। ”

“ বিদেশ কবে যাবেন?” – জয় এবার ঐশীর মুখোমুখি ঘুরে বলে,

“ এখন কি আমি দেশে থাকাতেও আপনার সমস্যা হচ্ছে? ”

ঐশী এবার বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে বলে,

“ আমি সিরিয়াস। কবে যেতে হবে? প্রসেসিং শুরু হয়েছে?”

জয় এবার মিইয়ে যাওয়া গলায় গম্ভীরতা ধরে রেখে বলে,

“ যাওয়ার এখনো সময় আছে। প্রসেসিং এখনও শুরু হয় নি। ঢাকায় গিয়ে কিছু কাগজপাতি জমা দিতে হবে। তারপর সব হবে।”

“ ওহহ….” – বলেই ঐশী ফিক করে হেসে উঠে। জয় এবার বিরক্তিকর চোখে ঐশীর দিকে তাকায়। আবার সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ঐশী জয়ের গাল টিপে বলে,

“ বেশ কিউট করে রাগ করেন তো আপনি। আচ্ছা সরি। মজা করছিলাম আমি। এবার তো হাসুন। কিটক্যাট খাবেন?”

জয় এবার ঐশীর দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে বলে,

“ ঘোষ দিচ্ছ?” – ঐশী হেসে উপর নিচে মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বলে। এরপর উঠে নিজের ব্যাগ থেকে কিটক্যাটের বড় দুইটা প্যাকেট বের করে। এরপর সেটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। জয় তা দেখে অবাক হয়। একটুপর ঐশী এসে জয়ের পাশে বসে।

“ তুমি এগুলোও ধুয়ে আনলে?” – জয় অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

“ হ্যা। বাইরের জিনিস না। নিন।” – ঐশী একটা প্যাকেট জয় কে দেয়। আরেকটা নিজে নেয়। জয় একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে প্যাকেটটা নেয়। এরপর খেতে খেতে বলে,

“ চকলেট পছন্দ?” – ঐশী মাথা নেড়ে হ্যা বলে।

“ তুমি যে বাচ্চা মানুষের মতো চকলেট পছন্দ করো তা তো জানতাম না। বলো নি কখনো।”

“ বলার কি আছে? আমিও তো জানতাম না আপনার মাঝে এতো ছেলেমানুষী আছে। পান থেকে চুন খসলেই এমন মুখ ফুলিয়ে রাখেন, আজব আজব বিহেভিয়ার করেন। আমি আপনাকে কিছু বলেছি এটা নিয়ে? ”

“ এগুলো ছেলেমানুষী? এগুলো রোমান্টিসিজম। অবশ্য তুমি কি বুঝবে এসবের। এই যে দেখো অন্যকেউ হলে একটা কিটক্যাটই দুজন মিলে খেতো। আর তুমি কি করলে? তুমি এসবের কিছু বুঝো নাকি। পারো তো খালি রোবটের মতো চোখমুখ শক্ত করে রাখতে আর ষাট বছরের বুড়ির মতো সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে।”

“ আমি সারাক্ষণ চোখমুখ শক্ত করে রাখি, গম্ভীর হয়ে থাকি! সিরিয়াসলি! ও মাই গড…… যেখানে লোকে বলে আমি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা দাঁত বের করে হাসি সেখানে আপনি এসব বলছেন আমায়?”

“ তুমি অন্যদের সামনে হাসো, আমার সামনে তো আর হাসো না। সবার সাথে কতো আদর আদর করে কথা বলো। আর আমার সাথে কথা বলতে আসলেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলো, ভ্রু কুঁচকে ফেলো।”

“ ওওও তাই!!” – বলেই ঐশী জোরে জোরে হেসে দেয়। আর জয় মুখে হালকা হাসি নিয়ে প্রেয়সীর হাসি দেখতে ব্যস্ত। কত সময় ওরা এভাবে পার করে জানে না। কিছু কিছু সময় সময়ের খেয়াল না রাখাই ভালো।

#চলবে

( কপি করা নিষেধ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here