সূর্যোদয় পর্ব ৩৮+৩৯

0
74

#সূর্যোদয়
#পর্ব_৩৮
#কারিমা_দিলশাদ

১১৪.
সময় তার নিজ গতিতে চলে। সময় যখন চলে যায় আমরা তখন বুঝতেই পারি না। একসময় খেয়াল হয় আর তখন ভাবি এতো তাড়াতাড়ি সময় চলে গেল!

দেখতে দেখতে দু’মাস কেটে গেছে। এরমধ্যে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ইলোরা ইয়াসমিন আর স্মৃতির সাথে ঐশীর বন্ডিং আরও জোরালো হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় তাদের সাথে। স্মৃতি তো দিনের মধ্যে হাজারবার ফোন করবে, বাসায় কি হয় না হয়, সারাদিন সে কি করে না করে সবকিছু ঐশীকে না বললে তার পেটের ভাত হজমই হয় না। ইলোরা ইয়াসমিনের সাথেও মাঝেমধ্যে ঐশীর কথা হয়। কিন্তু তবুও একটা দেয়াল তাদের দুজনের মধ্যে আছে। তবে এটা খারাপ না। কিছু কিছু সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট গন্ডি থাকা প্রয়োজন। সিয়াম, ফয়সাল, নিতু, রুপা এদের সাথেও ঐশীর সম্পর্ক অনেক ভালো। সেদিনের পরেও তাদের সাথে ঐশীর অনেকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কথা হয়েছে।

ওরা কোনো প্রোগ্রাম করলে সেখানে ঐশীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। মোট কথা জয়ের সাথে জড়িত সব মানুষের সাথে ঐশীর বন্ডিং খুব ভালো। জয়ের জীবনের সাথে জড়িত সবকিছুর সাথে ঐশী পরিচিত। কিন্তু ঐশীর পরিবারের মানুষের সাথে জয়ের বন্ডিং তেমন না।

এই দুইমাসে অনেকবার ঐশীদের বাসায় তার যাওয়া আসা হয়েছে। ঐশীদের বাসায় কোনো প্রোগ্রাম হলে বা কোনো আয়োজন হলেই জয়কে এবং তার পরিবারকে ডাকা হয়। যেমনটা সাধারণত হয়ে থাকে আরকি। ফর্মালিটি। কিন্তু জয় চেয়েও ঐশীর পরিবারের সাথে সেভাবে ভালো বন্ডিং তৈরি করতে পারে নি। মানুষগুলোর মানসিকতা আর জয় এবং তার পরিবারের মানসিকতা একদমই মিলে না। যতবার জয় ঐশীদের বাসায় গেছে সে বিব্রত আর খুব অকওয়ার্ড পরিস্থিতিতে পড়েছে।

বিশেষ করে ঐশীর বড় খালার দ্বারা। মহিলাটি এমন এমন সব কথা বলে প্রথম প্রথম তার মূর্খামি আর চাপাবাজী দেখে হাসি পেলেও এখন খুব বিরক্ত লাগে। তার মেয়ে কলি স্মৃতির সমবয়সী। এসএসসির পর এখানকার কোনো কলেজে চান্স পায় নি। পরবর্তীতে ঐশীদের গ্রামের বাড়ির একটা কলেজে চান্স হয়। তাই মেয়েকে নিয়ে আবার গ্রামে চলে যান তিনি। এখন গ্রামেই থাকে। আর তার ছোট ছেলেটা এবার চবিতে চান্স পেয়েছে। পালি ও সংস্কৃত ভাষায়। বাংলাদেশে যদিও সাবজেক্ট ভিত্তিক জব নেই কিন্তু মহিলার যেই গালগল্প বাপরে বাপ!

তার ছেলেকে নাকি এখনই বড় বড় কোম্পানি থেকে চাকরির জন্য ডাকে, বিদেশে যাওয়ার অফার করে হেনতেন কত কি। অথচ সবে পড়ে ফার্স্ট ইয়ারে। আর পালি নিয়ে পড়া স্টুডেন্টকে বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি কে দিবে? কিন্তু জয় সবসময় চুপই থাকে। সে মনে করে মূর্খদের সাথে তর্ক করে নিজেকে মূর্খ পরিচয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তারউপর আবার সে হবু জামাই। তার কিছু বলাটা মোটেই সাজে না।

বলতে নেই তবুও এমন ছোটলোকি কায়কারবার তার পছন্দ নয়। জয় ভেবে পায় না এরকম একটা টক্সিক ফ্যামিলিতে বড় হয়েও ঐশী এতো ভিন্ন হয়েছে কিভাবে। ঐশীর জন্য তার কষ্ট অনুভব করে। এমন একটা পরিবেশে ঐশী থাকে কিভাবে! যদিও জয় সবার সাথে খুবই ভালো, আন্তরিক ও ভদ্র ব্যবহার করে। তার মনে যে তাদের নিয়ে এমন বিরুপ মনোভাব তা কেউই জানে না। সে খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও মনে মনে সে তাদের খুবই অপছন্দ করে।

১১৫.

কালকে জয়ের জন্মদিন। জয় খুবই এক্সাইটেড। ঐশীর সাথে দেখা হওয়ার পর এটা তার দ্বিতীয় জন্মদিন। প্রথমবার ঐশী এই বিষয়ে অবগত ছিল না এবং তাদের বন্ডিংও খুব একটা ভালো ছিল না। টুকটাক হাই হ্যালো হতো এই আরকি। তার দিক থেকে ভালোবাসা থাকলেও ঐশীর দিক থেকে কিছুই ছিল না। তাই জয় ঐশীর কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করে নি। কিন্তু এবার তার আর ঐশীর মাঝে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুমাসে তাদের বন্ডিংটাও ভালো হয়েছে। যদিও ঐশীর মনের খোঁজ সে জানে না, বাট ঐশী এখন তারসাথে খুবই ফ্রী ভাবে কথা বলে, ফ্রী ভাবে মেলামেশা করে। তাই সে ঐশীর কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করতেই পারে। বেশি কিছু না সে আশা নিয়ে আছে ঐশী আজকে রাত বারোটায় সবার আগে তাকে উইশ করবে। এর বেশি কিছু না।

কিন্তু রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। ওর মা-বোন, ফ্রেন্ড-কলিগ, শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই তাকে উইশ করেছে। কিন্তু ঐশী তাকে উইশ তো দূরের কথা একটা মেসেজ বা ফোনও করে নি। উল্টো সে যখন রাতে ফোন করেছিল তখন তার মাথাব্যাথা করছে বলে কেটে দিয়েছিল।

জয়ের মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। বার্থডে নিয়ে কখনো কারো কাছ থেকে তার কোনো এক্সপেক্টেশন কোনদিনই ছিল না। বরং যখন কেউ তাকে বার্থডে উইশ করে সে মনে মনে কিছুটা লজ্জাবোধ করে। এখন বয়স হয়েছে তারজন্য না। অনেক আগে থেকেই সে এসব বার্থডে সেলিব্রেশন পছন্দ করে না। তবে যতদিন বাবা বেঁচে ছিল ততদিন সে বাবার গিফটের জন্য খুব এক্সাইটেড থাকতো। আর প্রতিবছর মায়ের হাতের স্পেশাল রান্না। ব্যস এটুকুই।

কিন্তু এই প্রথমবার মা বাবা ব্যতিত কারো কাছ থেকে একটা উইশ আশা করছিল। পরক্ষণেই জয় ভাবে ঐশীর তো মাথাব্যাথা তাই হয়তো উইশ করতে পারে নি। এটা ভেবে তার মন খারাপ কমে গেলেও সে তখন ঐশীর জন্য চিন্তিত হয়ে উঠে। না জানি মাথাব্যথায় মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে। ও থাকলে তো ব্যাথা কমানোর জন্য কিছু একটা করতে পারতো। সারারাত ঐশীর চিন্তায় নির্ঘুম রাত পার করে সে।

১১৬.

সকালে জয় ঐশীকে কল দেয়। ওপাশ থেকে ঐশী হ্যালো বলতেই জয় অস্থির কন্ঠে বলে উঠে,

“ তুমি ঠিক আছো? মাথাব্যথা কমেছে?”

“ হ্যা কমে গেছে। কি করছেন আপনি?”

“ কিছু না রেডি হবো এখন। তারপর হসপিটালে যাব।”

“ ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে। যান তাহলে। আমিও বের হবো এখন।”

“ ঐশী?”

“ জ্বি।”

“ আজ কয় তারিখ?”

“ আজ? আজ….. ১২ তারিখ। কেন?”

“ না এমনেই জিজ্ঞেস করলাম। আজ কি কোনো স্পেশাল দিন?”

“ কই না তো। কি হয়েছে বলুন তো?” – ঐশীর এমন নির্লিপ্ত জবাবে জয়ের মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভেবেছিল ঐশী এখন তাকে উইশ করবে। কিন্তু ঐশীর কথায় মনে হচ্ছে সে জানেই না কিছু। জয়ের অভিমান হয়। সে গম্ভীর কন্ঠে কথা শেষ করে কল কেটে দেয়।

রুম থেকে বের হতেই তার মা এসে কপালে চুমু খায়। জয় মায়ের আদরটা লুফে নেয়। প্রতিবছর এইদিনে মা তার পছন্দের সব রান্না করে। যদিও জয় এখন এসব করতে না করে, মায়ের বয়স হয়েছে এখন। এত ঝক্কি ঝামেলা না করাই ভালো, সে কি আর ছোট আছে। তবে তার মা তা আমলে নেয় না। কিছুক্ষণ মায়ের সাথে আহ্লাদ করে বোনের সাথে খুনসুটি করে। রেডি হয়ে হাসপাতালে চলে যায়। কিন্তু তার মন খারাপ ভাব কাটে না। মন খারাপ নিয়েই সারাটাদিন হাসপাতালে কাটায় জয়।

বিকাল হয়ে গেছে। এখনও রোগী দেখছে জয়। এমন সময় কল আসে জয়ের ফোনে। স্ক্রিনে ‘প্রেয়সী’ নামটা ভাসছে। তারমানে ঐশী কল দিয়েছে। জয় বেশ অবাক হয়। ঐশী সাধারণত এসময় কল দেয় না। রোগীকে সামনে রেখে জয় কখনো কল রিসিভ করে না। তাই কলটা কেটে দেয়। একটুপর আবার কল আসলে জয় সাইলেন্ট করে রাখে। রোগী বেরিয়ে যেতেই জয় কল ব্যাক করে ঐশীকে। কল রিসিভ করে জয়ের কলিজা ধুক করে উঠে।

ঐশী কাঁদছে। তার ঐশী কাঁদছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কেন কাঁদছে তা জানে না জয়। ফোনে ঐশীর কান্না শুনেই জয়ের ভিতরটা শুকিয়ে যায়। ঐশী কাঁদতে কাঁদতে কোনোরকমে জয়কে একাডেমিতে আসতে বলে।

১১৭.

এতটা রাস্তা জয় কিভাবে এসেছে সে জানে না। সারাটা রাস্তা জয়ের ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করেছে। ঐশী খুবই শক্ত ধরনের মেয়ে। সেই মেয়ে যাকে সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। সে হয়তো কখনো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না ঐশী জয়ের কাছে কি। সেই মেয়েটা এভাবে কান্না করছে। তার ভিতরে কি ঝড় বইছে তা সে কিভাবে বুঝাবে। এমনেতেই জয় সারাটাক্ষন ঐশীকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। ঐশী তার ফ্যামিলি নিয়ে খুবই ডিপ্রেসড। ঐশীর যে ফ্যামিলি পরিস্থিতি তাতে যখন তখন যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। সে যতই শক্ত হোক, ঐশী এখনো তার পরিবারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সারাটা রাস্তা জয় মর্মে ম’রেছে।

একাডেমির সামনে এসে জয় কোনোরকমে বাইক দাঁড় করিয়ে ভিতরে চলে যায়। গিয়ে চিৎকার করে ঐশীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু ঐশীর কোনো সারা শব্দ নেই। প্রতিটা রুম, বাথরুম, কিচেন পুরো বাসা খুঁজেও ঐশীকে পায় না। জয় মাথার চুলগুলো পেছন দিকে টেনে ধরে। গেট খোলা দরজা খোলা কিন্তু তার ঐশী নেই। কোথাও নেই। কোথায় গেল তার ঐশী? কোথায় খুজঁবে সে তাকে?

#ক্রমশ…
~কারিমা দিলশাদ

#সূর্যোদয়
#পর্ব_৩৯
#কারিমা_দিলশাদ

১১৮.

জয় বারান্দাতেই ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। ভয়ে জয়ের গলা শুকিয়ে গেছে, বুকে জ্বালা করছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সে পাগলের মতো ফোন বের করে ঐশীকে ফোন দেয়। কিন্তু ঐশী ফোন রিসিভ করছে না। জয়ের চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বারবার কল করে যাচ্ছে তবুও ফোন রিসিভ করছে না ঐশী। জয় আবার কল দেয় রিং হচ্ছে কিন্তু নো রেসপন্স। জয় বিড়বিড় করে বলে,

“ প্লিজ জান পিক আপ দ্যা ফোন, প্লিজ প্লিজ প্লিজ। মরে যাব আমি, পাক্কা মরে যাব।”

“ বড় ভাই….”

আচমকা কারো ডাকে জয় মাথা তুলে তাকায়। বারান্দার দরজায় অনিক দাঁড়িয়ে আছে। জয় ঝট করে উঠে অনিকের বাহু ধরে চিৎকার করে বলে,

“ ঐশী কোথায় অনিক? আমার ঐশী কোথায়?”

“ছা…ছাদে” – অনিক আমতা আমতা করে কোনোরকমে বলে উঠে। জয় আর কিছু না শুনে দৌড়ে ছাদের দিকে চলে যায়। পিছন থেকে অনিক অবাক হয়ে তা দেখে।

জয় ছাদের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বুক ধরফর করছে তার। কি হয়েছে ঐশীর? সে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে, চাপানো দরজাটা কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে। বড় বড় করে কয়েকটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে দরজাটা ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে বেশ তীব্রকারে বোম ফাটার মতো শব্দ হয়। জয় ভয়ে চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখে সিয়াম, ফয়সাল, নিতু, রুপা, স্মৃতি, বিজয়, সৌরভ, আশা, কবিতা, প্রীতি সবাই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। সবাই হাতে বেলুন, পার্টি স্প্রে, আর ভেঁপু বাঁশি নিয়ে “ হ্যাপি বার্থডে জয়” বলে চিল্লাচ্ছে।

জয় হতবাক হয়ে যায়। তার গায়ে ততক্ষণে পার্টি স্প্রে, আর ছোট ছোট রঙিন কাগজে ভরে গেছে। জয়ের মাথা ব্ল্যাংক হয়ে গিয়েছে । সিয়াম আর ফয়সাল এসে তাকে জড়িয়ে ধরে উইশ করে। জয় এখনও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে বুঝতে তার বেশ সময় লাগে। সবাই এসে তাকে উইশ করছে। কিন্তু তার সেসবে ধ্যান নেই। সবাইকে দেখলেও সে এখনও ঐশীকে দেখতে পারে নি। সে ঐশীকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খুঁজতে খুঁজতে দেখে ঐশী ছাঁদের এক কোণায় দুহাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে আর হাসছে।

জয় সবাইকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে ঐশীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জয়কে এভাবে আসতে দেখে ঐশী নড়চড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। জয় এসেই ঐশীর মুখটা তার দু’হাতের আঁজলায় নেয়। ঐশী জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে ভীষণ উদভ্রান্ত লাগছে।

“ তু…তুমি তুমি ঠিক আছো? কি হয়েছে তোমার?”

ঐশীর মুখে কোনো কথা নেই৷ সে একদৃষ্টিতে জয়কে দেখছে। ইশশ কি অসহায় ছন্নছাড়া লাগছে লোকটাকে। খুব মায়া হয় ওর। সে কোনোরকমে মাথা দু দিকে নেড়ে বোঝায় কিছু না। জয় ঐশীর পা থেকে মাথা অবধি ভালো করে নজর বুলায়। আচমকা জয়ের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। সে খপ করে ঐশীর দুই বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ সবকিছু মজা মনে হয় তোমার তাই না? আমাকে মানুষ মনে হয় না। এতক্ষণ আমি কিভাবে ছটফট করছিলাম কোনো ধারণা আছে তোমার? মরে যাচ্ছিলাম আমি। বুঝো কিছু? মরে যাচ্ছিলাম আমি। তোমার কান্না শুনে বুকের ভিতর কি হচ্ছিল কোনো ধারণা আছে? এখানে এসে যখন তোমাকে না পাচ্ছিলাম তখন আমার ভিতরে কি হচ্ছিল তার কোনো ধারণা আছে? ইউ আর এ স্টুপিড। ইউ আর এ ইডিয়ট। গেট ওয়ে ফ্রম মি। ”

জয়ের চিৎকারে ঐশী কেঁপে উঠে। এই প্রথমবার ও জয়ের রাগের সম্মুখীন হলো। জয় রাগে নিজের মাথার চুল খামছে ধরেছে। এই মূহুর্তে জয়কে একদম অপ্রকৃতস্থ লাগছে। ঐশী আশেপাশে চোখ বুলায়। ও আর জয় ছাড়া কেউ নেই ছাঁদে। বাকিরা ওদেরকে একা রেখে হয়তো চলে গেছে। ঐশী ভয় পাচ্ছে। জয় কোমড়ে দু হাত রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কপালের দুই সাইডের আর গলার শিরাগুলো ভেসে উঠেছে। উজ্জল শ্যামলা মুখটা রাগে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। হাসপাতাল থেকে ওভাবেই চলে এসেছে বোধহয় কারণ গায়ে এখনো এপ্রোনটা জড়ানো।

ঐশী কিছু বলবে তার আগেই জয় আবার তারদিকে তেড়ে আসে। ঐশী আবার দু পা পিছাতেই ছাঁদের রেলিঙের সাথে আটকে যায়। জয় একহাতে ঐশীর কোমর প্যাঁচিয়ে আরেকহাতে ঐশীর পিছনের চুলগুলো মুঠি করে ধরে। ঐশী ব্যাথায় আহ্ করে উঠে।

“ পরীক্ষা নিচ্ছিস হুম। পরীক্ষা? তোর জন্য আমি মরতে পারি কি না সেই পরীক্ষা নিচ্ছিস। তাহলে মার মার, এখনই মেরে দে আমাকে। আমি আর এভাবে পারছি না।
এভাবে ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়া যায় না ঐশী। ভালোবাসার প্রমাণ সময়ই দিয়ে দিবে। আমার ভালোবাসার গভীরতা জানতে হলে, আমাকে বুঝতে হলে তোমাকে এক পা এক পা করে আগাতে হবে। তুমি এক পা আগাও বাকি পথ আমি তোমার হাত ধরে নিয়ে যাব। কিন্তু এভাবে চলে না৷ এসব পরীক্ষা করে ভালোবাসার সত্যি মিথ্যে যাচাই করা যায় না। প্লিজ ট্রাস্ট মি। তুমি আমার কি তা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। সারাটাক্ষন আমার ধ্যান জ্ঞান কেবল তুমি। আমি জানি মানুষ খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয়, বিয়ের পর প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে সেই ভালোবাসা থাকে না। বাট সবাইকে একসাথে গুলালে তো চলবে না।”

জয় ঐশীর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে নরম ভাঙা স্বরে বলে,

“ আই এম এডিক্টেড অন ইউ। লোকে বলে কারো রুপের প্রেমে পড়লে সেই প্রেম একসময় কেটে যায়। টাকার প্রেমে পড়লে সেটাও একসময় কেটে যায়। কিন্তু ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়লে সেই প্রেম থেকে কখনো উঠা যায় না। আমি তোমার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছি ঐশী। এই প্রেম থেকে আমি কখনো উঠতে পারব না। আর আমি উঠতে চাইও না। তোমার হাত ধরে জীবনের শেষ পর্যন্ত যেতে চাই, তোমার কোলে মাথা রেখে মরতে চাই ঐশী। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ এ লট। প্লিজ লাভ মি, প্লিজ ট্রাস্ট মি।”

ঐশীর চোখ জলে টলমল করছে। শ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে। হাত পা কাঁপছে। বুকের মাঝে তুফান চলছে। জয়ের প্রতিটা কথা কেবল তার বুকেই ঝড় তুলে নি তার সারা শরীরেও এক অন্যরকম আবেশে ছেয়ে গেছে। এক অন্যরকম শান্তিবোধ হচ্ছে। এমন সব অনুভূতির সাথে ঐশী মোটেও পরিচিত নয়। সে নিজেকে সামলাতে নিজেরই অজান্তে জয়ের বলিষ্ঠ বাহুতে হাত রাখে। দু’জনেই জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। জয় ঐশীর কপাল থেকে কপাল সরিয়ে ঐশীর মাথার চুলে চুমু খায়। ঐশীকে ছেড়ে ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর একটা শব্দ ভেসে আসে।

“ সরি।”

কিন্তু জয় তারদিকে তাকায় না। সে একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে।

“ এমন আর করবো না। আসলে আমি তো জানতাম না আজকে আপনার জন্মদিন।”

এবার জয় ঝট করে ঐশীর দিকে ফিরে। ঐশী জয়ের তাকানো দেখে মুখটা কাচুমাচু করে এক কানে ধরে সরি বলে। এত্তো কিউট লাগে তখন মেয়েটাকে। এতক্ষণের সব আক্রোশ, অস্থিরতা, অভিযোগ, অভিমান সব যেন শেষ হয়ে যায় ঐশীর ওই মুখভঙ্গিতে। কিন্তু জয় বাইরে থেকে নির্লিপ্ত থাকে। জয়ের এবার বোধ আসে ঐশী তো সত্যিই ওর জন্মদিন জানতো না।

“ দুপুরের আগে আগে স্মৃতি ফোন করে বলে আজ আপনার জন্মদিন। আর আপনার মুড অফ তাই একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করতে চেয়েছিলাম। তবে আমি মানছি আমার ওভাবে ফোন করা উচিত হয় নি। আই এম সরি। আপনাকে হার্ট করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না।”

জয় আস্তে আস্তে ঐশীর সামনে এসে দাঁড়ায়। এরপর ঝট করে ঐশীর কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। ঐশী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই অবস্থায় ঐশী বলে,

“ আপনি আর রাগ করে থাকবেন না। সবাই অনেক এক্সাইটেড বিষয়টা নিয়ে। এর আগে আমি কোনদিন এসব সারপ্রাইজ প্ল্যান করি নি। ওদের সাহায্যেই সবটা করেছি। সারাদিন ওরা সবাই অনেক পরিশ্রমও করেছে। সিয়াম ভাইয়া নিতু আপুরা কত কষ্ট করে ছুটি ম্যানেজ করে এসব করেছে জানেন! এত অল্প সময়ে বুঝতেই তো পারছেন। আপনি রাগ করে থাকলে সবার আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে, পরিশ্রম বৃথা যাবে।”

“ সবকিছু এত সহজে? আমি যে এতোক্ষণ কষ্ট পেলাম?”

“ সরি বললাম তো। এখন আনন্দ করে শোধবোধ করে নিন।”

“ শাস্তি পেতে হবে যে।”

“ কিসের শাস্তি?” – ঐশী অবাক হয়ে বলে।

জয় এবার ঐশীর কানে ফিসফিস করে বলে,

“ আজকেরটা তো আছেই। তার সাথে আমাকে এতটা ছটফট করানোর জন্য, আমার রাতের ঘুম হারাম করার জন্য, আমার আমিটাকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য, একবুক জ্বালা দেওয়ার জন্য, আমার ব্যক্তিত্বকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য, আমাকে প্রতিটা ক্ষণ প্রতিটা মূহুর্ত তড়পানোর জন্য। সবকিছুর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।”

জয়ের এমন জবাবে ঐশী থতমত খেয়ে গেলেও। জয়কে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে,

“ সব তুলে রাখুন। এখন আগে নিচে চলুন। এটা পড়েই থাকবেন নাকি? ফ্রেশ হয়ে নিন আগে। পরে বাকি কাজ। চলুন।”

বলে তড়িঘড়ি করে নিচে চলে যায়। জয় ঐশীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে ফেলে।

১১৯.

জয় ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই ফয়সাল তাকে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়।

“ নে এটা পড়ে নে।”

“ কি আছে এটাতে?”

“ তোর ম্যাডাম দিছে। কি আছে তুই দেখ।”

ঐশী দিয়েছে! জয় অবাক হয় সাথে বেশ খুশিও হয়। সে আর কিছু না ভেবে খুশি মনে ব্যাগটা খুলে। দেখে এক সেট সাদা পাঞ্জাবী পাজামা, এক জোড়া জুতা, কয়েকটা পারফিউম, আর একটা হ্যান্ডওয়াচ। জয়ের ঘড়ি আর পারফিউম খুবই পছন্দের। বিশেষ করে পারফিউম। এগুলো কালেক্ট করা তার একরম নেশা। জয় অবাক হয়ে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে ফয়সালের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই কোনো কথা না বলে সে সাথে সাথে পাঞ্জাবীটা পড়ে নেয়। জয় বারবার পাঞ্জাবিটাতে হাত ছোঁয়াচ্ছে। যেন এটা কোনো সাত রাজার ধন, মহাদামী কোনোকিছু।

ফয়সালের সাথে ততক্ষণে সিয়ামও এসে দাড়িয়েছে। দু’জনে দাঁড়িয়ে বন্ধুর পাগলামি দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। জয় আনমনেই পাঞ্জাবিটায় হাত ছোঁয়াতে ছোঁয়াতেই বলে,

“ একদম ঠিকঠাক হয়েছে। ও আমার সাইজ জানলো কেমন করে বলতো?”

সিয়াম উত্তর দেয়,

“ আমি গিয়েছিলাম ওর সাথে। হাসপাতালে ছিলাম। হঠাৎ ঐশী ফোন করে বলে আজকে তোর জন্মদিন সে জানতো না। তাই ও তোর জন্য স্পেশাল কিছু করতে চায়, আমাদেরও ইমিডিয়েটলি ছুটি নিয়ে আসতে বললো। তারপর সব কিছু নিজেই প্ল্যান করলো। তবে ওভাবে ভয় দেখিয়ে ফোন করার ব্যাপারটা আমাদের আইডিয়া ছিল দোস্ত। ওর উপর রাগ করিস না।”

জয় এবার একটু মেজাজ নিয়ে আয়নায় চেয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলে,

“ হ্যা তোদের মাথায় তো এমন থার্ডক্লাশ আইডিয়াই আসবে। ভালো কিছু তোদের দ্বারা কখনো হয়েছে? স্টুপিড। জানিস কি অবস্থা হয়েছিল আমার!”

“ তা হবে না? তুমি তো ভাই পুরা দিওয়ানি মাস্তানী হয়ে গেছো। Mashur tere ishq ki kaahani ho geyi…”

জয় রাগে চিরুনিটা ফয়সালের দিকে ছুড়ে দেয়।একপর্যায়ে আবার ফয়সাল বলে,
“ তবে এরমধ্যে একটা সুখবর আছে দোস্ত।”

জয় পারফিউম শরীরে স্প্রে করতে করতে কি জিজ্ঞেস করে। ফয়সাল বলে,

“ আই থিংক সি ইজ ইন লাভ উইথ ইউ।” – জয়ের হাত থেমে যায়। সে আয়নার ভিতর দিয়েই ফয়সালের দিকে তাকায়। ফয়সাল আবার বলে,

“ আই এম সিরিয়াস। দেখ ঐশীকে আমাদের এখন বেশ জানাশোনা আছে। ও এসব ফর্মালিটি, কারো মন রক্ষা, মেয়েলি কর্মকাণ্ডের সাথে একদমই যায় না। অলওয়েজ ডোন্ট কেয়ার। ভীষণ প্র্যাক্টিক্যাল একজন মানুষ। আর বিয়ে, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সে কেমন তা তো তোর জানাই আছে। ইভেন এই বিয়েটা নিয়েও সে খুব একটা খুশি না তোরই ভাষ্য। তো সেই মেয়ে তোর জন্য এতো স্পেশাল প্ল্যান করলো এটা বেশ পজিটিভ সাইন দোস্ত। এরমানে সে তোর জন্য ভাবে,কিছু ফিল করে।”

“ এক্সাক্টলি। প্রেম না হলেও ঐশী তোকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। অন্ততপক্ষে বিয়েটা আর এই সম্পর্কটাকে মেনে নিচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা তোকে ও ওর লাইফে প্রায়োরিটি দিচ্ছে। নাহলে তো আর আমাদের ফোন করে এত ঝক্কি ঝামেলা করতো না। ইটস এন গুড থিং।”

সবটা শুনে ও ভেবে জয়ের মুখে এক অপার্থিব হাসি ফুটে উঠে। মনের ভিতর রীতিমতো লাড্ডু ফুটছে তার। সারাটাদিন যতটা বিষাদময় ছিল এখনকার সময়টা তারকাছে ততটাই মধুর মনে হচ্ছে। এরমধ্যেই সৌরভ এসে তাদের ডেকে যায়। সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

তিন বন্ধু তাদের আলাপচারিতা সেখানেই স্থগিত করে ছাঁদের দিকে যায়।

১২০.

ওদিকে,

ঐশী নিজে রান্না করেছে আবার কিছু খাবারও অর্ডার করে রেখেছে। অনিক সেগুলো মাত্রই নিয়ে আসলো। ঐশীর সাথে হাতে হাতে কাজ করতে করতে অনিক ঐশীর উদ্দেশ্য বলে,

“ দোস্ত?”

“ হুমম।”

“ তুই অনেক লাকি বুঝলি।”

“ “ আচ্ছা? তা হঠাৎ এইডা মনে হইলো কেন?”

“ তুই একটা খাঁটি হিরা পাইছস। জয় ভাই তোর লাইফের লাকি চার্ম হবো দেখিস।”

ঐশী কাজ থামিয়ে অনিকের দিকে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায়। অনিকও এবার ঐশীর দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলে,

“ আজকে সিরিয়াসলি তোরে কিছু কথা কই। তোর লাইফে অনেক সমস্যা এইটা আমরা বুঝি। তুই আমরারে কিছু না কইলেও আমরা বুঝি। তোর ফ্যামিলির আচরণ দেইখা বুঝি। তুই মনে মনে কি কষ্ট লুকায় রাখছস তা আমরা জানি না।খালি এইটুকু জানি তুই খুব কষ্টে আছস। কিন্তু তুই এমন লাইফ ডিজার্ভ করস না দোস্ত। খুব কম পুরুষ মানুষ আছে যারা নিজের সবটা দিয়া একজনরে ভালোবাসতে পারে। ভাইয়ের জীবনে আগে কি হইছে তা ভুইলা যা বইন। ভাই তোরে খুব ভালোবাসে খুব। পাগলের মতো ভালোবাসে। এইটাই সত্যি। খালি কিছুক্ষণের জন্য তোরে না পাইয়া যেই মানুষ ভাইঙ্গা পড়বার পারে, যার চোখ দিয়া পানি ঝরবার পারে। ওমন মানুষের থিকা বেশি তোরে আর কেউ কোনদিন ভালোবাসতে পারব না। মনের ভিতরে আর কোনো দ্বিধা রাখিস না দোস্ত। সব ভালো হইবো ইনশাআল্লাহ।”

ঐশী নিরবে কেবল শুনে গেল, কোনো উত্তর করলো না।

১২১.

ছাঁদে গিয়ে দেখে সবাই খুব আনন্দ করছে। বিজয় গিটার বাজিয়ে সুর তুলছে। সবাই তাদের মতো করে আলাপচারিতাই মগ্ন। আর ছাঁদ থেকে এই গোধূলি বেলাটাও অনেক সুন্দর লাগছে। আশেপাশে সব সরকারি বাসভবন হওয়ায় গাছগাছালি অনেক আছে। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সবমিলিয়ে খুব সুন্দর একটা পরিবেশ।

আর ছাদটাকেও আলাদাভাবে ডেকোরেট করা হয়েছে। সাদামাটা তবে খুব সুন্দর করে সবকিছু আয়োজন করেছে। পুরো ছাঁদটা ফেইরি লাইট আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। যদিও এগুলো এখনও জ্বালানো হয় নি। আর একটু পর হয়তো সব জ্বালানো হবে। ছাঁদের এক সাইডে দু’টো টেবিল। তাতে বুফের মতো করে বেশকিছু পাত্র রাখা। আরও কিছু সরঞ্জামাদী আছে। আর বেশ কিছু ছোট ছোট প্ল্যান্ট রাখা আছে। সবমিলিয়ে খুবই ইউনিক বাট ক্লাসি একটা ভাইব আসছে।

অন্যান্য বার্থডে সেলিব্রশনের মতো বেলুন আর ফ্লাওয়ার দিয়ে সাজানো না। ওরকম কিছু হলেই বরং জয়ের ভালো লাগতো না। ওসব বেলুন ফুল দিয়ে সাজানো বার্থডে সেলিব্রেশন করার মতো বয়সও তার না৷ ওমন কিছু তার পছন্দও না। এটাই সবদিক মিলিয়ে একদম যথার্থ।

জয়ের পর্যবেক্ষণের মাঝে সিয়াম আর ফয়সাল ততক্ষণে বাকিদের সাথে জয়েন হয়ে গেছে। পুরো ছাঁদজুড়ে তার নজর ঘুরছে। দেখতে দেখতেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে তার নজরে পড়ে যায়। নীল থ্রি পিছ পড়া কর্মরত হাস্যজ্জ্বল এক রমণী।

ঐশী আশার সাথে কিছু একটা নিয়ে হাসিমুখে কথা বলছিল আর প্ল্যাটগুলো মুছে রাখছিল। তখনই তার নজর যায় সৌম্যদর্শন এক পুরুষের দিকে। সাদা পাঞ্জাবিতে যাকে ভীষনই স্নিগ্ধ লাগছে। সে কি মনে করে যেন নজর সরিয়ে কাজে হাত লাগায়। কিন্তু আঁড়চোখে তার নজর ঘুরেফিরে সেই সৌম্যদর্শনের দিকেই যাচ্ছে। জয় বিষয়টা খেয়াল করে মুখ ফিরিয়ে মুচকি হাসে। এরপর ঐশীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আশার সাথে কুশল বিনিময় করে। আশাও হালকা কথাবার্তা বলে দু’জনকে স্পেস দেওয়ার জন্য বাহানা দিয়ে সরে যায়।

আশা যেতেই জয় ঐশীর মুখে ফু দেয়। এতে করে ঐশীর কানের পিছে গুঁজা খুচরো চুলগুলো ঐশীর মুখের সামনে ছড়িয়ে পড়ে। ঐশী সেগুলো আবার কানে গুঁজতে গুঁজতে জয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকায়। বিপরীতে জয় দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে। ঐশী আবার কাজে মনযোগ দেয়। জয় বলে,

“ ম্যাডাম দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে?”

ঐশী এবার জয়ের দিকে তাকায়। এরপর দুহাত বুকে জড়িয়ে জয়কে আগাগুড়া ভালো করে পরখ করে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে সুঠামদেহি জয়কে বেশ দারুন মানিয়েছে। ঐশী মাথা নাড়িয়ে বলে,

“ ভালো লাগছে।”

“ খালি ভালো?”

“ তো আরকি বলবো?”

জয় ঐশীর দিকে ঝুঁকে বলে,

“ বলবে খুব সুন্দর লাগছে একদম তোমার বর বর লাগছে।” – ঐশী কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলে। জয়ও ঐশীর সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। এই সুন্দর মূহুর্তটাই বিজয় দূর থেকে ক্যামেরা বন্দী করে ফেলে। ভালোবাসাগুলো দেখতেও ভালো লাগে।

১২২.

রাত এখন প্রায় নয়টা। হঠাৎ করেই বেশ বাতাস বইতে শুরু করেছে। ছাঁদের ফেইরি লাইট গুলো এখন জ্বলছে, মোমবাতি গুলোতেও আগুনের শিখা জ্বলছে। তবে এত বাতাসের মধ্যে অনেকগুলো মোমবাতিই নিভে গেছে। কিছু কিছু এখনোও বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে নিভু নিভু ভাবে জ্বলে যাচ্ছে।

কেক কাটা পর্ব সহ খানাপিনার পর্বও শেষ। এখন সবাই গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত। গানের কলি খেলছে সবাই। ঐশী সবার জন্য চা কফি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। হৈ-হুল্লোড়গুলো পিছনে ফেলে সে এক কাপ দুধ চা নিয়ে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে।

জয়ও আস্তে আস্তে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। ঐশী জয়ের দিকে তাকাতেই জয় মিষ্টি একটা হাসি উপহার দেয়, ঐশীও ফিরতি হাসি উপহার দেয়।বাতাসে ঐশীর চুল আর নীল উড়নাটা উড়ছে। ফেইরি লাইটটা ঐশীর মুখে পড়ছে যার কারনে এক অনাবিল সৌন্দর্যে ছেয়ে গেছে। জয় তা মুগ্ধ নয়নে দেখছে। পিছন থেকে গিটারের সুর ভেসে আসছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। পরিবেশটা এত্তো মনোরম হয়ে উঠেছে।

“ থ্যাংক্স।” -জয়ের কথায় ঐশী বলে,

“ কেন?”

“ এই যে এতকিছু করলে আমার জন্য তাই। যদিও এসব করার দরকার ছিল না।”

“ ইটস ওকে। কিই আর এমন করলাম। বাই দ্যা ওয়ে আপনার পছন্দ হয়েছে এসব?”

“ খুব। খুব খুব খুব। বেস্ট বার্থডে এভার। আমি কিছু কনফেস করি তোমার কাছে। আমি খুব আপসেট ছিলাম তুমি আমাকে উইশ করো নি বলে। তবে কি জানো আমি এসব বার্থডে সেলিব্রেশন একদমই পছন্দ করি না, লজ্জা করে আমার। বাট আমি চাইছিলাম তুমি আমাকে উইশ করো। এখানে এসে আমার মনে হলো তুমি তো জানোই না। আর জানো এই প্রথমবার কোনো বার্থডে এ্যারেঞ্জম্যান্ট দেখে আমার এত্তো এত্তো ভালো লাগছে। আই এম সো হ্যাপি…..”

জয়ের বাচ্চাদের মতো এতো উচ্ছ্বাস দেখে ঐশী জোরে জোরে হেসে দেয়। জয়ের মাঝে এখনও অনেক বাচ্চামি আছে। জয় যে খুশি তা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ঐশী এবার বলে,

“ আমিও আপনার কাছে একটা সিরিয়াস কথা বলি হ্যা। আমার এসব বার্থডে ফার্থডে,ডেট ফেট, নাম্বার মনে থাকে না। ইভেন আমার নিজের জন্মদিনের কথাও মনে থাকে না। আমাকে যদি আপনার বার্থডের কথা বলতেনও তবুও আমার মনে থাকতো না। ফর সিওর। সো এসব বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতেও আমার উপর কখনো রাগ করবেন না। ওকে?”

জয় হাসিমুখে হ্যা জানায়। জয় এটা ভেবেই খুশি হয় ঐশী ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। ঐশী আবার বলে,

“ ইভেন আমারও এসব বার্থডে সেলিব্রেশন একদমই পছন্দ না। বিরক্ত লাগে। হ্যা বার্থডে, তো কি হয়েছে! জন্মদিন কোনো খুশির বিষয় না। বরং একটা একটা করে জন্মদিন আসছে আর আমরা মৃত্যুর দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি। এটা নিয়ে এতো এক্সাইটেড হওয়ার কিছু নেই। বরং সেলিব্রেশন যদি করতেই হয় তাহলে এমন কিছু করা উচিত যেন সেই ব্যক্তির আমলনামায় কিছু সওয়াব যোগ হয়। ”

জয় মুচকি হাসে। সে আর অবাক হয় না, মুগ্ধ হয়। এভাবে কয়জন মানুষ ভাবে? এই মেয়ে জয়কে মুগ্ধ করার কোনো সুযোগ ছাড়ে না। জয় মনে মনে ভাবে,

“তোমার আর কত রুপ বলোতো? রুপে গুণে সবদিক দিয়ে মাশাল্লাহ। একই অঙ্গে এত রুপ রাখো কি করে তুমি!”

মুখে বলে,

“ তাহলে এই আয়োজন?”

“ আমি পছন্দ না করলেও অন্যরা তো করে। আর সিয়াম ভাইয়া বললো কারো নাকি খুব শখ তার বাবা মা, আর বন্ধু ব্যতিত স্পেশাল কারো কাছ থেকে সারপ্রাইজ পাওয়ার। তাই ভাবলাম বেচারার মনের আশাটা পূর্ণ করি।”

জয় জোরে জোরে হেসে উঠে। এভাবেই দুজনের কথা চলতে থাকে। কেউ তাদের ডিস্টার্ব করে না। তবে একটা বিষয় সবার অগোচরে থেকে যাবে যে জয়ের উছিলায় জয়ের নামে ঐশী আজ কিছু গরীব-দুঃখীদের মাঝে খাবার বিলিয়েছে।

আচ্ছা এটা কি কেবল ভালোলাগা নাকি নতুন কিছুর সূচনা?

#ক্রমশ…
( কপি করা নিষেধ। কেউ কপি করবেন না।)

[ কেমন লাগলো সবাই জানাবেন। 😊]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here