#সূর্যোদয়
#পর্ব_০২
#কারিমা_দিলশাদ
৩.
ব্রহ্মপুত্র নদ। এক সময়কার সবচেয়ে খরস্রোতা নদ আজ মৃতপ্রায়। তবুও এই নদের পাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে আছে অনেক মানুষের জীবিকা, অনেক মানুষের স্বস্তি। এই গরমের মধ্যেও নদের পাড়ে অনেক বাতাস। কোলাহলহীন শান্তিময় একটা পরিবেশ। নদের ধার ঘেষেই একটা পার্ক রয়েছে। ঐশী আর জয় নদের অপর পাড়ে ঘাসের উপর বসে আছে। তখন জয় তাকে কিছু বলতে চেয়েছিল। এত্তো করুন আর অসহায়ভাবে বলল যে ঐশী আর না করে নি। তাই কিছুটা নিরিবিলি জায়গায় এসেছে। জয়ই প্রথম কথা বলল-
“ একটা গল্প শুনবেন ঐশী?”
“ শুনতেই তো এলাম এখানে। আপনি বলুন অমি শুনছি।“ মুচকি হেসে বলল সে।
জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-“ আমি একটা মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসি।” বলেই একটা মুচকি হাসল।
“ অবাক হচ্ছেন?” ঐশী মাথা নাড়িয়ে না করল। কিন্তু সেটা জয় খেয়াল করল কি না বুঝা গেল না। সে তার মতো করেই বলে চললো।
“ অবাক হওয়ারই কথা যার সাথে বিয়ের কথা চলছে সেই মেয়ের কাছে আরেক মেয়েকে ভালোবাসার কথা বলছি। বাট আই এম হেল্পলেস। আমি মেয়েটার মাঝে এতটাই ডুবে গেছি যে আর কোনো কুল কিনারা পাচ্ছি না। মেয়েটা আমার ফুপুর ভাসুরের মেয়ে। আমার ফুপিমার শশুরবাড়ি জয়েন্ট ফ্যামিলি। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার ফুপিমার খুব ক্লোজ, তাই যাওয়া আসা হতো বেশি। আমি তখন ক্লাস 2 এ পড়ি। সে বার গরমের ছুটিতে ফুপিমার বাড়িতে যেতেই, একটা ছোট্ট জীবন্ত পুতুল ফুপিমা আমার হাতে দিল। এত্তো পিচ্চি! আমি তো নিতেই ভয় পাচ্ছিলাম। পরে ফুপিমা ধরে ধরে রেখেছিল। যতদিন ওখানে ছিলাম সারাক্ষন পুতুলটার সাথেই থাকতাম। অন্যবার গেলে অন্য কাজিনদের সাথেই খেলতাম, কিন্তু ওইবার সারাক্ষন পুতুলের সাথেই থাকতাম। এটা নিয়ে ওরা খুব মজাও নিত। ছুটি শেষ হওয়ায় যেদিন ময়মনসিংহ ফিরছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে খুব কেঁদেছি জানেন।
এরপর থেকে সুযোগ পেলেই ফুপিমার কাছে চলে যেতাম। আস্তে আস্তে পিচ্চিটাও বড় হতে লাগল আর ওর প্রতি আমার ভালো লাগাও বাড়তে লাগলো। এরমধ্যে আমার এইচএসসিও শেষ হয়ে গেল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল ছোট থেকেই তাই নিজের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে লেগে পড়লাম। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে সফলও হলাম। জানেন যেদিন ঢাকা মেডিকেল এ আমার চান্স হলো মা,আমি সবাই এত্তো খুশি হয়েছিলাম। পিচ্চিটা একসময় মন খারাপ করে আমাকে বলেছিল “ জয় ভাইয়া তুমি তো ডাক্তার আংকেলের মতো ডাক্তার হয়ে গেছ, তাহলে তুমিও কি আমাকে ডাক্তার আংকেলের মতো খালি ওষুধ দিবে?”- বলেই হা হা করে হেসে দিল জয়।
তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন দৃশ্যগুলো ওর চোখে ভাসছে। এতটা সময়েও ঐশী একটা কথাও বলেনি। যদিও তার এসব শুনতে যে খুব একটা ভালো লাগছে তেমন না আবার খুব একটা খারাপ লাগছে তেমনও না। এতক্ষন ধৈর্য্য ধরে কথাশোনার মতো ধৈর্য্যশীল ব্যক্তি সে না। তবুও সে চুপ করে আছে, কথার মাঝখানে কথা বললে কথার ফ্লো নষ্ট হয়ে যায়।
জয় আবার বলতে শুরু করল-“পুতুলের প্রতি আমার ভালো লাগা ছিল ঠিকই তবে ভালোলাগাটা যে কবে ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিল জানি না। কিন্তু আমার এই ভালোলাগা আমি কখনো কাউকে বুঝতে দেইনি। হয়তো এটাই আমার ভুল ছিল। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর পড়াশোনা ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমি যখন ইন্টার্নশিপ করি, পুতুল ততদিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হয়ে গেছে। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ছুটে যেতাম ওর কাছে। ভেবেছিলাম এবার হয়তো বলার সময় এসে গেছে। তবে আমি বড্ড দেরী করে ফেলেছিলাম। ততদিনে পাখি অন্যকারো খাচাঁয় ধরা দিয়ে দিয়েছে।”- বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।
“ তো আপনি তাকে বলেননি আপনার মনের কথা?”- এতক্ষনে কথা বলল ঐশী।
“ হ্যা বলেছি। ও যে ছেলেটাকে ভালবাসে সেই ছেলেটার নাম রিয়াদ। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। ওর বাড়ি আর পুতুলদের বাড়ি পাশাপাশি। পুতুলকে একসময় প্রাইভেটও পড়াতো। সেখান থেকেই প্রেমের সূচনা। চার বছরের সম্পর্ক তাদের। আমি যখন পুতুলকে আমার ভালোবাসার কথা জানাই তখন সে স্পষ্ট বলে দিয়েছিল সে আমাকে ভাই ব্যতিত অন্যকোনো নজরে দেখে নি। “
“তারপর?”
“ পুরো দুনিয়া তছনছ হয়ে গিয়েছিল আমার। সারাদিন নিজেকে হয় হোস্টেলের রুমে বন্দী করে রাখতাম আর নাহয় নেশায় ডুবিয়ে রাখতাম। পড়াশেনা ততদিনে লাটে উঠেছে। মা আমার অবস্থা আমার বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে আমায় এখানে নিয়ে এসে পড়ে। আমার অবস্থা তখন খুব খারাপ। সারাক্ষণ পুতুলের জন্য পাগলামি করতাম। মা এসব সহ্য করতে না পেরে পুতুলের মা-বাবার কাছে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। পুতুলের মা-বাবা তা নির্ধিদ্বায় মেনে নেয়। বড়রা ঠিক করে কাবিন করিয়ে রাখবে আপাতত। পরে সঠিক সময় সুযোগ দেখে ধুমধাম করে বিয়ে দিবে। এসব আমি বা পুতুল কেউই জানতাম না। আমাকে মা এখান থেকে ইমার্জেন্সি বলে নিয়ে যায়,পুতুলকেও খবর দিয়ে নিয়ে আসা হলো হোস্টেল থেকে। সে এসে সবকিছু শুনে সেদিন আমাকে এবং আমার মা কে চরম অপমান করে। পুতুল ভেবেছিল সবকিছু জানার পরেও আমি হয়তো এই কাজ করেছি। আমি সেদিন কোনোভাবেই তাকে বুঝিয়ে উঠতে পারি নি।“
“ তারপর?”
“ওইদিনের পর থেকে ওইবাড়ির সাথে আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়। পুতুলের বাবা-মা আমাদের কাছে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে। তাদের তো কোনো দোষ নেই, আমরাও ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু আগের সেই আন্তরিকতাটা আর নেই। ফুফুর সাথে কথা হয়, কিন্তু তবুও কোথাও যেন একটা সুর কেটে গেছে। ওইদিনের পর আমি আরো বেশি ভেঙ্গে পড়ি। কিন্তু মা’র মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে আবার গুছিয়ে নিতে শুরু করি। কোনো মায়ের কাছেই সন্তানের এমন অবস্থা কাম্য নয়। তাও যেখানে আমার মা একা সমাজের সাথে লড়াই করেছে। তাই নিজের পড়া কমপ্লিট করি। ট্রান্সফার করে এখান এসে পড়ি।“
“ আর পুতুল?”
“ পুতুলের সাথে ওইদিনের পর থেকে আর কোনদিন যোগাযোগ হয় নি। সত্যি বলতে ইচ্ছে করে নি। ঐশী আমার মা আমার জন্য কি তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন পরেই বাবা মারা যান। তখন থেকেই মা একা হাতে সব কিছু সামলে আসছে। আমার দেখভাল, পড়াশোনা, মা’র চাকরি, সংসার সব একা হাতে সামলে আসছে। আমার জন্য আমার মায়ের সেই অপমান আমার সহ্য হয়নি। এরপর আর কখনো ওর সাথে আর দেখা করার চেষ্টা করিনি। এমন না যে ইচ্ছা করেনি। অগিণতবার চেয়েছি ওর সাথে দেখা করি কথা বলি, কিন্তু পরক্ষনেই মা কে করা ওর অপমানগুলো মনে হতো। আর তখন নিজেকেই খুব নিচ মনে হতো। ইভেন এখনো হয় জানেন। ওর কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছা করে, ওকে দেখতে ইচ্ছা করে, ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি চাই না, আমি এখন আর চাই না ওর কাছে যেতে, চাই না ওকে পেতে। আমি না পারছি মা’কে করা অপমানগুলো ভুলতে আর না পারছি ওকে ভুলতে। মা’র জোরাজোরিতে আমি বিয়ে করতে রাজি তো হয়েছি কিন্ত আমি কোনো মেয়েকে আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না। ভালোবাসতে পারব না। আমি কি করবো আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমি চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেছি ঐশী , আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি এই চোরাবালি থেকে মুক্তি পেতে চাইছি কিন্তু যত মুক্তির আশায় ছটফট করছি ততো তলিয়ে যাচ্ছি……..”
_“ তো ছটফট করা বন্ধ করে দিন।“
ক্রমশ……………………..
[ কার্টেসি ব্যতিত কপি করা নিষেধ।]
(এটা আমার লেখা প্রথম গল্প। প্রথম ২-৩ টা পর্ব বোরিং লাগতে পারে। আশা করি লেখার ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিবেন এবং গঠনমূলক কমেন্ট করবেন। ধন্যবাদ। ☺️)