#শেষ_বিকেলের_মায়া (৬)
“লুক ফারিহা আমি টাকা দিচ্ছি ভুলে যাওয়ার জন্য নয়। প্রায় ঘন্টা খানেক হয়ে গেল তুমি সামন্য ডায়লগ টুকু মুখস্থ করতে পারছ না!”
ধমকে ধমকে আরো কিছু কথা শোনাল রিহান। প্রতিটা ধমকে কেঁপে উঠছে মেয়েটি। এভাবে সিনেমার অভিনয় হয়, বাস্তবতা নয়। ওনি কি করে বলতে পারেন ওনার মম ড্যাড এর বেশি কিছু প্রশ্ন করবে না? ফারিহা নিজেকে ধাতস্থ করে বোঝাল রিহান যা বলছে তাই করতে হবে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে পর পর কয়েকবার লেখা গুলো পড়ে নিল। তারপর বলল,”স্যার হয়ে গেছে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিহান। এতক্ষণ যাবত কোন মহাকাব্য মুখস্থ করেছে তা বোঝা হয়ে গেছে ওর। রাগ বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে সময় নেই। মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো উচ্চারণ করে বলল,”লিসেন স্টুপিট গার্ল বাসায় আমাকে স্যার বলে ডাকবে না? আপনি করে বল সমস্যা নেই তবে ভুলে ও স্যার বলা যাবে না।”
“ওকে স্যার।”
“ইউ।”
“সরি আর হবে না। অভ্যাস তাই গুলিয়ে ফেলি।”
রিহান কথা বাড়ায় না। দ্রুত গতিতে গাড়ি তে উঠে বসে। ফারিহাকে নিয়ে বাতাসের গতিতে গাড়ি নিয়ে ছুটে যায় বাসার উদ্দেশ্যে। বিশাল এক বাংলোর সামনে এসে গাড়ি থেমে যায়। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় মেয়েটি। পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে। তারপরই ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে,”আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন?”
“হোয়াট কোথায় নিয়ে এসেছি মানে?”
“আমাদের তো আপনার বাসায় যাওয়ার কথা।”
“তো! এটাই তো আমার বাসা।”
দুই ঠোঁটের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে ফারিহা। এটা রিহানের বাসা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। গোল গোল করে তাকায় রিহান। চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। মুখের সামনে আঙুলের সাহায্য শব্দ করে। থতমত খেয়ে যায় মেয়েটা। নিজেকে ঠিক ঠাক করে বলে,”জি স্যার?”
“হোয়াট দ্য , স্টুপিট গার্ল কতবার বলব স্যার বলবে না। তুমি তো দেখছি পুরো ডুবিয়ে মা র বে আমায়।”
“সরি।”
রিহানের মেজাজ গরম হয়ে উঠে। কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ব্লেজার টা সামন্য উঁচু করে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়ায়। একটু নিশ্বাস নিয়ে বলে,”আমার সাথে আসো। অতিরক্তি কিছু বলার দরকার নেই।”
রিহানের পিছু পিছু যেতে থাকে ফারিহা। ভেতর থেকে আড়ষ্টতা কাজ করছে। না জানি রিহানের পরিবার কেমন ধাঁচের হয়। তারপর প্রতিটা কথাই বলতে হবে মিথ্যে। ড্রয়িং রুমে ঢোকার সময় কাঁচের মাঝে মাথা ঠুকে যায় মেয়েটির। ওর কান্ডে প্রচন্ড বিরক্ত হয় রিহান। সামনে তাকিয়ে নিজ বাবা মাকে উপস্থিত দেখেই সুর পাল্টে ফেলে। দ্রুত ফারিহার কাছে এসে বাহু টেনে ধরে যেন কেউ বুঝতে না পারে ওদের সম্পর্কটা। গলায় ব্যথাতুর ভাব এনে বলে,”ফারিহা তুমি ঠিক আছ? ইস অনেকটা ব্যথা পেয়েছ বুঝি? দ্রুত আসো আইস কিউব লাগিয়ে দিচ্ছি।”
প্রচন্ড অবাকের সহিত তাকায় ফারিহা। নিচু কণ্ঠে বলে,”আমি ঠিক আছি।”
ততক্ষনে রিহানের মা রুনা জোয়ার্দার চলে আসেন। ফারিহাকে দেখে ভীষন অবাক হোন। ঘাড় সচল করে দাঁড়ায় রিহান। মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,”মম, ও হলো ফারিহা আর ফারিহা এই যে আমার মম।”
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। রিহান ওর কথাই কি তুই…।”
“ইয়েস মম। ওর কথাই বলেছিলাম আমি। ওকেই আমি পছন্দ করি। আর ওকেই বিয়ে করতে চাই।”
ফারিহা বিনা বাক্য খরচে মাথা নিচু করে রইল। রুনা অধর কোণে হাসি রাখলেন। ফারিহাকে এক পলক দেখে রিহানের দিকে কৃতঙ্গতার চোখে তাকায়। মায়ের দৃষ্টি বুঝে যায় রিহান। ভেতরে ভেতরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
ইরফান জোয়ার্দার বেশ কিছু প্রশ্ন করল ফারিহা কে। রিহানের কথা মতোই প্রতি টা প্রশ্নের ছাঁকা জবাব দিল মেয়েটি। মুখে কিছু না বললে ও মনে মনে প্রশংসাই করল রিহান। যাক সঠিক মানুষকেই পেয়েছে সে। মোটামোটি সব কিছু ঠিক ঠাক ই হচ্ছে।
রুনা যেন ফারিহাকে নিজের মেয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। রিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,”তোর চয়েজ যে এত ভালো জানা ছিল না। যাক সুবুদ্ধি তাহলে হয়েছে।”
রিহান হাসল। ইরফান কে উদ্দেশ্যে করে বলল,”ড্যাড তুমি তো জানোই ফারিহা একা আই মিন…।”
“হুম। তাতে কি হয়েছে আমরা আছি তো? আমরাই তো ওর বাবা মা।”
কথা টা শুনে ফারিহার অন্তরে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। অজস্র ভালো লাগা কাজ করছে। বাবা শব্দ টা যেন বুকের ভেতর চিন চিন ব্যথা অনুভব করাল। মানুষ গুলো এত টা আপন করে নিল ওকে?
“একি কাঁদছিস কেন মা?”
“আসলে আন্টি আপনারা আমাকে এতটা আপন করে নিবেন আমি কল্পনা ও করি নি।”
রুনা দু হাতে জড়িয়ে ধরেন ফারিহাকে। ফারিহা এবার ডুকরে কেঁদে উঠে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রুনা বলেন,”একদম কাঁদবি না। তুই আমার মেয়ে হয়েই থাকবি।”
ফারিহা উত্তর দেয় না। রিহান বার বার পলক ফেলছে। এই সিন টা তো তার করা প্ল্যানে ছিল না। বাহ মেয়েটা তো আলোর গতিতে চলছে।
রুনার জোরাজোড়ি তে নাস্তা খেতেই হলো ফারিহাকে। নাস্তা খেয়েই বেরিয়ে পড়ল ফারিহা আর রিহান। হাতের মধ্য আঙুলি তে গাড়ির চাবি ঘোরাচ্ছে ছেলেটা। হালকা সুরে শিস ও বাজাচ্ছে। বহু দিন পরে যেন শান্তি মিলেছে।
“অভিনয় টা পারফেক্ট ছিল। ইমোশনাল হয়ে যাওয়ার অভিনয়টা বেস্ট। গুড, মাঝে মাঝে এরকম কিছু এড করে দিবে।”
“অভিনয়!”
“ইয়াহ। তুমি যে কান্নার অভিনয় করছিলে একটু ও বোঝা যায় নি। এক মুহূর্তের জন্য আমি নিজেই থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। বাই দ্য ওয়ে আজ তোমার মম কে দেখতে যাব। আর খুব তাড়াতাড়ি সিঙ্গাপুর পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
“ধন্যবাদ স্যার।”
রিহান একটু হাসল। পরক্ষনেই বলল,”ওহ হ্যাঁ ভার্সিটি তে এডমিশন নিতে হবে তোমায়। মম ড্যাড পড়াশোনার বিষয়ে অনেক হার্ড।”
ফারিহা কিছু বলল না। রিহানের পাশের সিটে উঠে বসল। হঠাৎ করে তার সামনে টাকার বান্ডেল বাড়িয়ে দিল রিহান। রিহানের দিকে না তাকিয়েই বলল,”এটা কিসের জন্য?”
“আজকে এত ভালো অভিনয় করার জন্য।”
ফারিহার বুকের ভেতর চিন চিন করে উঠল। সে অভিনয় করে নি। পুরোটাই ছিল ভীষণ সত্য। অথচ রিহান বুঝতেও পারল না। দুনিয়া বুঝি এমনি?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি