শেষ বিকেলের মায়া পর্ব ১৯

0
161

#শেষ_বিকেলের_মায়া (১৯)

“জীবন এভাবেও বদলায় মিস?”

“বদলায় তো।”

“সব কেমন ম্যাজিকের মতো।”

অষ্টাদশী মেয়েটির কথায় হাসল ফারিহা। সত্যিই জীবন বদলায়। নানাভাবে বদলে যাই আমরাও। জানালা ভেদ করে আলো এসে পড়েছে ওর ঘরের আঙিনা। সেটাকে মুক্ত করতেই সফেদ পর্দা গুলো সরিয়ে দিল ফারিহা। ওর সামনে বসে থাকা মেয়েটির নাম ওয়াজিহা। মেয়েটি প্রচন্ড মেধাবী। সেই সাথে ফারিহার প্রিয় ছাত্রী।

“তুমি কি চা খাবে?”

“ঠিক আছে।”

ফারিহা চা এনে দিল। ওয়াজিহা,সেটা তুলে নিয়ে ঘরে থাকা বুকশেলফে তাকাল। সেখানে হরেক রকমের বই।

“মিস,এত বই! এগুলো আপনি কিনেছেন?”

“উহু।”

“তাহলে?”

“আদীব দিয়েছেন। বিয়ের উপহার।”

আদীবের নামটি শুনে ওয়াজিহার বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। ফারিহার গল্পে থাকা দুটি পুরুষ সম্পর্কে সে জেনেছে। তবে আদীবের ব্যক্তিত্বে সে প্রায় মুগ্ধ।

“মিস, একটা প্রশ্ন করব?”

“হ্যাঁ ওয়াজিহা। তুমি যে কোনো প্রশ্ন করতে পারো।”

“আদীব স্যার খুব সুন্দর তাই না?”

এ কথায় ফারিহার মাঝে মৌনতা ভেসে ওঠল। সে ফিরে গেল অতীতে। ঠিক আজ থেকে বারো বছর পূর্বে। যখন সেও ছিল অষ্টাদশী। ঠিক ওয়াজিহার মতো। তবে তার জীবন ছিল অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম আর বেশ কিছুটা ট্রাজেডিক!

রিহানের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। সে চিন্তিত। ফারিহা নিজেকে সামলাতে পারছে না। কি করবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবল রিহানের নিকটে যাবে। আবার ভাবল,না যাবে না। এমন মনোভাব থেকে হুট করেই রিহানের নিকট উপস্থিত হলো সে। রিহান তখন সিগারেটের ধোঁয়া উড়ায়। শব্দ পেয়ে বলল,”কে?”

“আমি।”

“ফারিহা?”

“জি।”

“অন্ধকারে কি করছো?”

“আপনার কাছেই এসেছিলাম।”

“আমার কাছে?”

“হুম।”

“বলো।”

“আমার মনে হচ্ছে,আপনার পরিবারকে সমস্ত সত্য জানানো দরকার।”

“কিয়া মানবে না।”

“ম্যামের সাথে কথা বলে দেখুন। এভাবে সম্পর্ক গুলো নষ্ট হবে। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।”

রিহান কথা বলল না। সে কিছু সময় নিয়ে সিগারেট শেষ করল। তারপর উঠে এসে ড্রয়ার থেকে পাসপোর্ট বের করল। সেটা উল্টে পাল্টে দেখল ফারিহা।

“তুমি তোমার মায়ের কাছে চলে যাও।”

“কিন্তু রিহান স্যার…।”

“চলে যাও। আমি সামলে নিব।”

ফারিহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। রিহান কি ভুল বুঝল তাকে? পরদিন ই টিকেট বুক করল রিহান। তারপর পাঠিয়ে দিল ফারিহাকে। মায়ের চিকিৎসা চলল আরো দু মাস। সেখানেই অবস্থান করল সে। এই ঘটনার মাঝে কোথায় কি ঘটল ফারিহা জানে না। রিহান তাকে অনেক গুলো টাকা দিয়েছিল। সে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করল। তবে পারল না। সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন সময়ে একদিন আদীবের সাথে দেখা। আদীব কেমন করে যেন সমস্তটা জেনেছে। ফারিহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফারিহা চুপ। আদীব বলল,”ফারিহা,খালা এখন সুস্থ। এবার তো আর কোনো সমস্যা নেই।”

“আমি সে বিষয়ে কথা বলতে চাই না আদীব ভাই।”

“এমনটা কোরো না প্লিজ। আমি তোমায় ভীষণ পছন্দ করি।”

“একটা গোটা জীবন কাটানোর জন্য দুজনের ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন আদীব ভাই।”

“সত্যিই কি তাই?”

ফারিহা আবার নিশ্চুপ। আদীব ওর কাছে এল। একদম বাহুতে স্পর্শ করে বলল,”রিহান তোমাকে কোনো দায়বদ্ধতা দেয় নি ফারিহা। তুমি তার প্রয়োজনে ছিলে, আর সে তোমার প্রয়োজন মিটিয়েছে। এমনটাই তো হয়েছে তাই না?”

ফারিহা ভেবে দেখল সত্যিই এমনটা হয়েছে। আদীব তাকে আরো বুঝাল। সে কি বুঝল কে জানে। কোনো রকম মত প্রকাশের পূর্বেই দেখা গেল ফাহিমাকে। তিনি আদীবকে দেখে খুশি হলেন।

“আদীব, বাবা তুমি এখানে?”

“বিজনেসের কাজে এসেছিলাম খালা। তখনই ফারিহার সাথে দেখা।”

যদিও কথাটি মিথ্যে। ফারিহার জন্যেই এখানে এসেছে সে।

“বাসায় আসো?”

“সে তো যাব,তবে মা আপনাদের খুব মিস করছে। দেশে ফিরবেন কবে?”

“চিকিৎসার কি যেন বাকি আছে। সেটা শেষ হলেই।”

“ওহ। আমি ও আছি কিছু দিন।”

কথোপকথন হতে থাকল। এদিকে ফারিহা একেবারে অনুভূতিহীন। সে রিহানের নিকট কৃতজ্ঞ। অথচ মানুষটা তার সাথে একেবারেই যোগাযোগ রাখল না! কেন এমন করল এই নিয়ে ভেতরটা কেমন করে ওঠল। অথচ এর কোনো উত্তর মিলল না।

পরের সপ্তাহেই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এল ওরা। আদীবের মায়ের সাথে ফাহিমার আগেই কথা হয়েছিল। সেই জন্যেই কী না বিয়েটা একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেল। ফারিহা নিষেধ করল না। আবার হ্যাঁ ও করল না। ওর যেন নিজস্ব মতামত ই নেই। তবে দেশে ফিরেই গেল রিহানদের বাড়িতে। যেখানে রিহান ছিল না। এমনকি ওর পরিবারের কেউ ই ছিল না। এদিকে আদীবের সফলতার ছড়াছড়ি চলছে। ছেলেটা অনেক টাকা উপার্জন করে ফেলল কিছু সময়েই। ফারিহার জীবন বদলাতে লাগল। বিয়ের শপিং করতে নিয়ে আসল আদীব। বড়ো বড়ো ব্র্যান্ড এর জিনিস পত্র কিনে দিল। সময় বদলাতে শুরু করেছে। কিন্তু ভাগ্য বদলাল না। এক সন্ধ্যায় প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে গেলেন ফাহিমা। ফারিহা নামক ছোট্ট মেয়েটিকে এতিম করে দিয়ে চলে গেলেন তিনি। মেয়েটি প্রায় তখন পাগল। এরই মধ্যে একটি নিউজ এল। রিহান জোয়ার্দার মাহাদী এই নামটা যেমন খুব দ্রুত সফল হয়েছিল ঠিক তেমনই ভে ঙে গেল। শত শত কোটি টাকার ব্যবসা মাত্র কিছু মাসেই মিলিয়ে গেল। তার এই অবনতির কারণ নেশা পানি। বিগত মাস গুলো বিদেশে ছিল। আজ দেশে ফিরবে। সেই জন্যেই এয়ারপোর্টের সামনে খুব ভীড় জমেছে। চাকরি হারানো মানুষ গুলো ভীষণ ক্ষিপ্ত। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। লাইভ নিউজ দেখে ফারিহা থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে মাত্রই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। আদীব পুনরায় বিয়ের আয়োজনে হাত দিয়েছে। সে নতুন করে কিছু গহনা এনেছে। সেগুলো ফারিহার সামনে রেখে বলল,”দেখো তো কোন গুলো ভালো লাগে। আমার কাছে সব গুলোই সুন্দর লাগছে। তুমি সব গুলোই রাখো। জাস্ট বিয়ের জন্য সিলেক্ট করে দাও।”

আদীব হয়ত আরো অনেক কিছুই বলল। তবে সেসব ফারিহার কানে গেল না। সে পাথরের ন্যায় টিভির দিকে তাকিয়ে। চারপাশ থেকে উপচে পড়েছে মানুষের ভীড়। তার চোখে ভাসে কিছু মাস পূর্বের রিহানকে। যে পুরুষটি হয়ত হাজারো নারীর স্বপ্নপুরুষ।

হাতে সিগারেট। পোশাকের অবস্থা ও এলোমেলো। দেখলেই মনে হয় বিগড়ে যাওয়া পুরুষ। অবশ্য সে বিগড়েই গিয়েছে। জীবন তাকে শেষ করে দিয়েছে। ফারিহা রিহানকে দেখতে পেয়েছে। ওর ভেতরটা হু হু করছে। ও প্রায় চিল্লিয়ে ডাকল।

“রিহান স্যার, রিহান স্যার।”

এত ভীড়ের মাঝে সে ডাক কি শোনা যায়? রিহানের কপালে বেয়ে আছে এক গাছি চুল। ফারিহা পেছন পেছন এসেছে আদীব ও। মেয়েটি যখন এ পথে ছুটে এল তখন আদীবের হৃদয়ের গতি হয়ত সব থেকে নিষ্ঠুর ছিল।

“ফারিহা, যেও না ওদিকে। লোকজনের ভীড়ে যেও না।”

আদীবের কণ্ঠ শুনেও হয়ত ফারিহা পাত্তা দিল না। আদীব গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল। ভীড় থেকে প্রায় টেনে বের করল ওকে।

“আদীব, রিহান স্যারের কাছে যেতে হবে আমায়।”

“তুমি ওখানে গিয়ে কি করবে?”

“আরে, ওনার অবস্থা দেখছেন না? দেখছেন, লোকজন কি পরিমাণে জড়ো হয়েছে।”

“কিন্তু তুমি কি করবে ওখানে?”

“কি করব মানে?”

তারপরই চুপ হয়ে গেল মেয়েটি। সত্যিই তো। সে ওখানে কি করবে? এত সময় পর মস্তিষ্ক বিষয়টা ধরতে পারল। রিহানের সামনে গিয়েই বা কি হবে? আদীব ওকে দু হাতে আগলে ধরল। মেয়েটি মা হারানোর পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে। সামান্য জটলা দেখলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কখন কি করে বুঝে উঠে না। ফারিহার মাথাটা আদীব তার বুকে চেপে ধরল। মেয়েটি ওভাবেই কান পেতে রইল। শুনতে পেল, ধীরে ধীরে স্থির হচ্ছে আদীবের হৃদয়ের গতি।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here