#রং_তুলির_ক্যানভাস
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
আফসান, জোহার বিয়ের পর বেশ কিছু দিন পার হয়ে গিয়েছে। সবাই এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। আফসানের সাথে যেন জোহা অনেকটাই মিশে গিয়েছে। পুরোনো ক্ষ*ত ভুলে নতুন করে বাঁচতে শিখেছে সে। যার হাত ধরে এই নতুন জীবনের শুরু হলো তাকে কৃতজ্ঞতা না জানালেই নয়। এমন চিন্তা থেকেই জোহা আজ সেজে উঠেছে নতুন এক রূপে।
গাঢ় সবুজ রঙের লেহেঙ্গার সাথে লাল রঙের ওড়নার কম্বিনেশনটা ভারি পছন্দের জোহার। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে লাল টকটকে রঙের লিপস্টিক, হাতে একগুচ্ছ চুড়ি, কানে বড়ো ঝুমকা আর কপালে একখানা টিকলিতে বেশ সুন্দর লাগছে তাকে। তার সাজ সম্পূর্ণ হতেই নিধি এসে তাড়া দিয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি চল জোহা। আমি ভাইয়াকে বাগানের পাশে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
জোহা আয়নার মাঝে নিজেকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা টেনে নিধির হাত ধরে বের হয় ঘর থেকে। বাগানের পাশে গিয়ে নিধি হাত ছেড়ে দেয় জোহার। চোখের ইশারায় বোঝায়,
“এবার একা যা তুই।”
জোহা চুপচাপ সামনে এগিয়ে যায়। একপাশে আফসানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লম্বা শ্বাস ছেড়ে ডাক দেয় তাকে।
“আফসান!”
ঘুরে তাকায় আফসান। খোলা চুলে এমন সাজে জোহাকে এর আগে সেভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আফসানের। প্রথমবার তাকে এমন রূপে দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর পানে তাকিয়ে থাকে সে।
“শুধু দেখেই যাবেন আমাকে? কিছু বলবেন না?”
“তোমাকে আজ এত সুন্দর লাগছে যে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। প্রশংসা করলেও তো কম হয়ে যাবে।”
“আহা ঢং!”
“ওসব আমি পারি না। ঢং করা তো মেয়েদের কাজ।”
“তাই?”
“হুম হুম। তো আজ হঠাৎ এমন সাজ কেন?”
“আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য।”
“কৃতজ্ঞতা? কেন?”
“এই যে আপনার জন্য আমি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারলাম। নতুন করে বিশ্বাস করার মতো একজনকে পেলাম। পুরোনো স্মৃতি নিয়ে বেঁচে না থেকে নতুন স্মৃতি তৈরি করতে আগ্রহী হলাম। সবকিছু তো আপনার জন্যই।”
“আমি চেয়েছি যেন তুমি ভালো থাকো। তিশানকে হারানোর পর থেকে আমি অনেকটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। বিদেশে গিয়ে রাফানের সাথে পরিচয় হলো। ওর সাথে বন্ধুত্ব তো হয়েছিল, কিন্তু তিশানের জায়গায় আমি কাউকে বসাতে পারিনি। ওর মতো করে আমাকে আর কেউ বুঝতে পারেনি। হঠাৎ একদিন তোমাকে দেখলাম। ভালো লেগেছিল তোমাকে। পরে জানতে পারলাম তুমি নিধির বান্ধবী। ছোটবেলায় তোমাকে অবশ্য দেখেছিলাম। কিন্তু সেভাবে খেয়াল ছিল না। তোমার প্রতি একটু একটু করে জন্মানো ভালো লাগা যে কখন ভালোবাসায় পরিণত হলো সেটা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আমাকে। অবশেষে আজ তুমি আমার!”
“আফসান আপনাকে আমি কিছু বলতে চাই।”
“হ্যা বলো।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ খোলে জোহা,
“আপনি আমার অতীত সম্পর্কে সব জানেন। আমার প্রাক্তনের বিষয়েও অনেক কিছু জানেন। কিন্তু সে আসলে কে তা জানেন না। আজ আমি তার সম্পর্কে আপনাকে জানাতে চাই। কারণ সে আপনার পরিচিত।”
“আমার পরিচিত মানে?”
“আমার প্রাক্তন আর কেউ নয় আফসান, আপনার বন্ধু রাফান!”
চকিত দৃষ্টে জোহার দিকে তাকায় আফসান। কথাটা যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।
“রাফান!”
“হ্যা, রাফান। বিয়ের দিন ওকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদের পর আমি মনেপ্রাণে ওকে ভুলতে চেয়েছি। ওর সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছিল না। প্রায় সময় দম বন্ধ হয়ে যেত। সেই মানুষটা যে আপনার বন্ধু এটা ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না।”
“সেদিন তুমি আমাকে এটাই বলতে চেয়েছিলে?”
“হ্যা, আমি আপনার কাছে কিছু লুকোতে চাইনি। আপনি হয়তো আমাকে ভুল বুঝবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে ঠকাইনি। ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না এতদিন।”
জোহাকে মা*থা নিচু করে থাকতে দেখে কাছে এসে তার দুই বাহুতে হাত রেখে আফসান বলে,
“তোমার তো লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আর এটা সম্পূর্ণ কাকতালীয় একটা বিষয়। রাফান আমার বন্ধু এটা সত্যি। কিন্তু তার জন্য তোমাকে ভুল বুঝব বা তোমাকে কষ্ট দিব এমন নয়।”
“আমাকে ভুল বোঝেননি তো?”
“একদমই না। কারণ আমি আগে থেকেই তোমার বিষয়ে সব জানতাম।”
“কিন্তু রাফান যে এত সহজে সবকিছু ছাড়ার পাত্র নয়। আমি জানি সে আমার সাথে যোগাযোগ করবেই।”
“চিন্তা করো না। কিছু হবে না।”
“আফসান আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?”
“বলো।”
“জেসিয়ার সাথে তো আপনার কথা হয়েছে তাই না?”
“হ্যা জেসিয়া আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে আসবে।”
“আচ্ছা সে কি এখনো রাফানকে ভালোবাসে?”
“হয়তো!”
“আমরা কি ওদের এক করে দিতে পারি না?”
“এটা সম্ভব নয় জোহা। রাফান একবার যাকে ছেড়ে দেয় তার দিকে দ্বিতীয় বার ফিরেও তাকায় না।”
“চেষ্টা করে দেখতে তো সমস্যা নেই।”
“আচ্ছা এসব কথা পরেও বলা যাবে। এখন চলো আমার সাথে।”
“কোথায় যাবেন?”
“বাইক নিয়ে যদি ফাঁকা রাস্তায় তোমাকে নিয়ে বের হই তাহলে যাবে?”
জোহা আফসানের দিকে তাকিয়ে হেসে মা*থা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
প্রিয় মানুষটার সাথে রাতের শহর ঘোরার ইচ্ছা হয়তো সব মেয়েরই থাকে। জোহারও এমন অনেক ইচ্ছা ছিল। যদিও এসব আফসানকে সে বলেনি। তবুও কীভাবে যেন ছেলেটা সব বুঝে যায়। তার মনের কথাগুলো সে বলার আগেই বুঝে যায়।
অনেকটা দূরে এসে এক চায়ের দোকানের সামনে থামে আফসান। জোহাকে নামিয়ে হাত ধরে এগিয়ে যায় সেই দোকানের দিকে।
“মামা দুই কাপ চা দিয়েন তো।”
কথাটা বলে পাশের বেঞ্চে বসে দু’জন। নভেম্বর মাস হওয়ায় রাতের বেলা বেশ ঠাণ্ডা পড়ে চারদিকে। কুয়াশারও দেখা মেলে এমন সময়ে। শীতল পরিবেশে একটুআধটু ঠাণ্ডা লাগছে জোহার। আফসান এটা বুঝতে পেরে নিজের শরীরে থাকা পাতলা একটা জ্যাকেট খুলে জোহার দিকে এগিয়ে দেয়। এর মাঝে ধোঁয়া ওঠা গরম চা চলে আসে।
আফসান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খেয়াল করে জোহা এখনো চা নিয়ে বসে আছে।
“কী হলো? চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছ কেন?”
জোহা মুখ ফুলিয়ে বলে,
“আসলে আমি গরম চায়ে চুমুক দিতে পারি না।”
“ওহ্ এই ব্যাপার!”
আফসান চায়ের কাপ নিয়ে তাতে ফুঁ দিয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা করে পুনরায় জোহার হাত দেয়।
“এবার নাও।”
আফসানের এমন যত্নশীল মনোভাব দেখে ভালো লাগে জোহার। সে আনমনে ভাবে,
“এই মানুষটাকে আমি যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ খুব কমই হয়। আমি তাকে পেয়েছি এটাই আমার স্বার্থকতা। হয়তো সঠিক মানুষটা আসবে বলেই সে চলে গিয়েছিল!”
চলবে??