মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ২০

0
103

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২০

🍁
হতবিহ্বল নয়নে সামনের দৃশ্য দেখে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলো মীরা। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে পরখ করলো বাসার সবাই উপস্থিত এখানে৷ ফুপুজান ও চলে এসেছেন। বুঝতে আর বাকি রইলো না কিছুই।সবটাই তার সামনে পরিষ্কার। বাসার সদস্য ব্যাতিত আরো তিন জন উপস্থিত। প্রবীণ লোকটি কে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনে না, দেখেও নি সে। বসে থাকা মহিলাটাকে দেখেছে মাঝে মাঝে। মীরা এদের দুজনকে স্পষ্ট ভাবে না চিনলেও শিনা টান টান করে বসে থাকা অভ’দ্র, বেহা’য়া, দু’ষ্ট দু’ষ্ট কথার জালে ফাঁ/সানো রাইফকে সে চিনে ঠিকই। পাশে বসা মহিলাটা যে তার মা আজ এক সাথে দেখে নিশ্চিত হলো। দুজনের চেহারায় মিলও রয়েছে অনেক। মীরার রাগ হলো খানিক। যার জন্য দেড়ি করে বৃষ্টিতে ভিজে এলো জুবুথুবু হয়ে, সেই আগে ভাগে এসে বসে আছে একেবার তাদের বাসার ভেতর৷ তাও আবার অতিথি হয়ে। “যেখানে বা’ঘের ভ!য় সেখানেই সন্ধ্যা হয়” প্রবাদ টা আজ খাপে খাপ মিলে গেছে তার সাথে। এতো কিছুর ভেতর আরো আশ্চর্য হচ্ছে মীরা। এখানেই আসবে, অথচ তার ভাব ভঙ্গিতে একটুও বোঝা যায় নি। কি ধু’র’ন্ধর লোক একটা! উর্মিও কম অবাক হয়নি রাইফ এবং রাজিয়া বেগম কে দেখে। কেমন টেক্কা দিলো রাইফ তাদের! উর্মি অবশ্য খুশিও হয়েছে বেশ। যাক, ঘটনা তাহলে ঘটেছে। তার টোটকা লেগেছে জায়গা মতো। এবার দুজনের মিল হবেই হবে।
মীরার চোখ পরলো খাদিজা বেগমের চোখে। তিনি আশ্বস্ত করলেন, স্বাভাবিক হতে বললেন ঘাড় নেড়ে। ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হলো। জড়তার সহিত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল মীরা,

-‘আস সালামু আলাইকুম।’

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’

উচ্চস্বরে সালামের জবাব দিলো প্রায় সবাই। কিন্তু একজনের সালাম টা ছিলো দীর্ঘ এবং সবার থেকে একটু উচ্চ আওয়াজে। মুচকি হাসি লেপ্টে আছে তার চোখে মুখে। মীরাকে কাছে ডাকলেন ইশারায়। মীরা নজর ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাতেই উনি মাথা নাড়লেন। ছোট ছোট পা ফেলে রাজিয়া বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আর এক হাত পরিমাণ দূরেই বসে আছে রাইফ। কেমন বেহা/য়ার মতো তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। এতো মানুষের মাঝেও তার ধ্যান পুরোটুকুই মীরার উপর। রাজিয়া বেগম মীরার হাত ধরে পাশে বসাতে চাইলেন। কিন্তু মীরা কাঁচুমাচু করে বাধা দিলো, আমতা আমতা করে বলল,

-‘আমার শরীর ভেজা আন্টি। আমি বরং এখানে বসি।’

সোফার এক কোনা থেকে বেতের মোড়া টেনে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসবে তখনি রাজিয়া বেগম তার দিকে মোড়াটা টেনে কাছে আনলো। হাসি লেপ্টেই আছে তার মুখে প্রথম থেকে। ইশারায় বসতে বলল তাকে। মীরা রাজিয়া বেগমের পাশে বসলো উশখুশ করতে করতে।
মীরার বুক ধরফর করছে। স্বাভাবিক নেই তার হৃদ স্পন্দন। এ মূহুর্তে একটু বেশি তার গতি। এই যে পাশেই বসে রাইফ, খুবই নিকটে। প্রথম দিনের সেই পুরুষালী ঘ্রাণ টা আজ ও তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। এতোটা কাছাকাছি তাদের অবস্থান পরিবারের সবার সামনেই, এমনটা তো তো সে এতো দ্রুত আশাই করে নি।
রাজিয়া বেগম খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন মীরাকে। থুতনিতে স্নেহের হাত রেখে শুধালেন,

-‘কেমন আছো মীরা মা?’

শুষ্ক অধর যুগল জ্বিহবার ডগার সাহায্যে ভিজিয়ে মীরা মিহি কন্ঠে বলল,

-‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম মামনি।’

-‘মাফ করবেন অপেক্ষা করানোর জন্য। জ্যাম ছিলো, তাই একটু দেড়ি হয়ে গেছে।’

রাজিয়া বেগম তার বিপরীত পাশে বসা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-‘বড় ভাই, দেখছেন। এই হলো মীরা। যার জন্য আসছি। মাশাল্লাহ, কি সুন্দর দেখতে তাই না!

প্রবীণ লোকটি রাইফের বড় চাচা। গাল ভর্তি হাসি দিয়ে ভারী গলায় বললেন,

-‘মা শা আল্লাহ!। খালাম্মার মতো দেখতে অনেকটা। তাই না শওকত ভাই।’

শওকত রহমান হাসলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-‘জ্বী ভাই। আম্মাজানের মতোই দেখতে আমার এই আম্মাজান। শুধু দেখতে না, কাজে কর্মেও অনেক মিল।’

-‘মীরাকে দেখেই আমার খালাম্মার কথা মনে পড়লো। কি স্নেহটাই করতেন আমাকে। দেখা হলেই ডেকে বলতেন, এই জয়নুল, বাসায় আসো না কেনো? আসো, একটু আলাপ করি৷’

এক কথার প্রেক্ষিতে অনেক কথায় অতীতের স্মৃতি চারণ করতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো সবাই। কিন্তু মীরার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। বোরকার নিচের অংশ টুকু জবজবে ভেজা। এই অবস্থাতে এখানে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বসা। তার উপর নিলজ্জর মতো রাইফের অবাধ্য দৃষ্টি আরো বেশি অস্বস্তি তে ফেলছে তাকে। রাইফের দিকে না তাকিয়ে ও বুঝতে পারছে তার চাওনি। কি করে পাচ্ছে এতো গুলো মানুষের সামনে এভাবে তাকিয়ে থাকতে? একটু তো লজ্জা শরম করা দরকার! আমতা আমতা করে মীরা রাজিয়া বেগমকে কিছু বলবে সে মূহুর্তে রাইফ এর কন্ঠ কানে আসলো। রাজিয়া বেগম কে বলছে সে,

-‘আম্মা, এবার ছাড়ো ওকে। ভেজা শরীরে ঠান্ডা লাগবে।’

রাইফের কথো শোনা মাত্রই মীরার কেনো যেনো জেদ হলো খুব। দেখেছে ভেজা ঠিক আছে, উনাকেই কেনো মাতব্বরি করে বলতে হবে আম্মা ওর ঠান্ডা লাগবে। ঢং! কি ভাববে সবাই। ছিহ্, মুখ ই দেখাতে পারবো না কাউকে। ইচ্ছা তো করছে এই লজ্জায় দৌড়ে চলে যেতে এখান থেকে, কিন্তু যাবে না সে। উনার কথাতেই কেনো যেতে হবে? রাজিয়া বেগম মীরার পায়ের দিকে লক্ষ্য করে তাড়াহুড়ো করে বললেন,

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভিজে গেছো তো। দেখেছো আমার কাজ। মনেই ছিলো না। যাও, চেঞ্জ করে নাও দ্রুত।’

মীরা রাইফের পানে আড়চোখে তাকালো একবার। এই লোকটা কি ঠিক হওয়ার না নাকি! এখনও কেমন ড্যাবডাব করে তাকিয়েই আছে। মীরার হালকা পাতলা জেদ এবার উঠে গেলো তুঙ্গে। রাইফ কে শোনানোর জন্য মিষ্টি মিহি কন্ঠটা একটু উঁচু করে রাজিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,

-“অস্থির হবেন না আন্টি। ঠিক আছি আমি। এতো সহজে ঠান্ডা আমার লাগবে না।’

বলতে দেড়ি, মীরার হাঁচি আসতে দেড়ি না। একবার হাঁচি দিয়েই ক্ষান্ত হলো না সে। পর পর তিনবার। রাইফ তার দমফা/টা হাসি চা;পা’লো কোনো রকমে। কিন্তু উর্মি আর সেটা পারলো না। হেসে দিলো শব্দ করে। মীরা লজ্জা পেলো, ভীষণ লজ্জা। চোখ উঁচু করে তাকালো না কারো দিকেই। ধীরে সুস্থে ওঠে হাঁটা ধরলো রুমের দিকে। মীরার মনে হচ্ছে রুমটা হাজার মাইল দূরে। এতো সময় লাগছে কেনো যেতে?

______________

মীরা বসে আছে নরম বিছানায়। পিঠে ছড়িয়ে থাকা আধো ভেজা খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। বাহির থেকে গল্প গুজব, হাসি ঠাড্ডার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে। উর্মি বারান্দায় কাপড় নেড়ে দিয়ে রুমে এসে বসতেই খটখট করে মৃদু শব্দ হলো দরজায়। মীরা পেছন ঘুরে তাকিয়ে দ্রুত ওড়নাটা মাথায় টেনে নিলো। উর্মি চেঁচিয়ে বলল,

-‘খোলা। ভেতরে আসেন।’

শওকত রহমান রুমে প্রবেশ করলেন। সাথে খাদিজা বেগম ও পেছন পেছন আসলেন তার সহিত। দরজা লাগালেন নিঃশব্দে। শওকত রহমান বসলেন মেয়ের পাশে। খাদিজা বেগম চেয়ার টে’নে বসবেন সে মূহুর্তে শওকত রহমান বললেন,

-‘তুমি বসছো কেনো? যাও, পরে এসো। বাবা-মেয়ের আলাপে থাকা যাবে না।’

খাদিজা বেগম গাল ফুলালেন। তার মেয়ের সাথে কথা বলবে আর তাকেই রাখতে চাচ্ছে না? শওকত রহমান প্রিয় সহধর্মিণীর মলিন মুখটা দেখে কিঞ্চিৎ হাসলেন। খাদিজা বেগম রাগে বি/স্ফো/রণ হওয়ার আগেই বললেন,

-‘ভুল হয়ে গেছে আমার। আর গাল ফুলিয়ো না। বসো।’

খাদিজা বেগম বসলেন। এর মাঝে উর্মিও বসে পরলো মামুজানের গা ঘেষে। শওকত রহমান তাকাতেই উর্মি বলে উঠলো,

-‘আমি কি বেশি হলাম নাকি মামুজান। একটু বসি? অল্প একটু’

আগে যদিও সুন্দর মতো বসা ছিলো। যখন দেখল শওকত রহমান কিছু বলছে না, আরাম করে পা তুলে বসলো উর্মি।
শওকত রহমান ধীরে সুস্থে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-‘আপনি বুদ্ধিমতী মেয়ে আমার। উনারা কেনো এসেছেন নিশ্চয় বুঝাতে হবে না আপনাকে। রাইফ ছেলেটা দেখতে-শুনতে, আদব-কায়দায় ভালো। পাঁচ তলায় থাকে। ভালো জব ও করে। আপনার কি পছন্দ হয়? আমি কি কথা আগাবো আম্মাজান?

শওকত রহমান কথাটা শেষ করতেই উর্মি ধুমধাম হ্যাঁ বলে ফেলল মীরার আগেই। তিন জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহাম্মক হলো সে। বুঝলো সুক্ষ্ণ একটা ভুল সে করে ফেলেছে। তাই তো দ্রুত জিভ কে/টে বলল,

-‘আমার জন্য না। মীরার জন্য হ্যাঁ। ভুল বোঝেন কেনো?’

সবার দৃষ্টি আবার গেলো মীরার উপর। খাদিজা বেগম মেয়ের আরো নিকটে আসলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,

-‘তোর বাবার কথা বুঝতে পারছিস? দেখ মা, বিয়ে কিন্তু করতেই হবে। ছেলেটা আসলেই ভালো। তারপরেও তোর যদি অসুবিধা থাকে বলে দে। আমাদের কোনো সমস্যা নেই। ‘

মীরা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তবে সে বুঝতে পারছে আম্মা এবং আব্বাজানের পছন্দ হয়েছে তাদের। পছন্দ না হলে কখনও রাইফকে ভালো বলতেন না, তার হয়ে কথাও বলতেন না।
শওকত রহমান তাগদা দিলেন। বাহিরে অপেক্ষা করছে তারা। মীরা নিচু গলায় বিচক্ষণতার সহিত উত্তর দিলো,

-‘আপনার যদি পছন্দ হয় তবে আমার কোনো আপত্তি নেই আব্বাজান।’

মেয়ের আচরনে সন্তুষ্ট হলেন শওকত রহমান। মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছেন বলে ভেতর ভেতর গর্বিত অনুভব ও করলেন। কাছে টেনে চুমু আঁকলেন মেয়ের কপালে। মীরার জবাব আরেকটু পরিষ্কার ভাবে শোনার জন্য বললেন,

-‘আমি কি তবে তাদের হ্যাঁ বলে দিবো আম্মাজান?’

-‘জ্বী। দিতে পারেন।’

কন্ঠ কাঁপছে মীরার। জড়িয়ে যাচ্ছে কথা। ঢোক গিলে চোখ বুজে নোনা জল গুলো আর বাহিরে আসতে দিলো না সে। হজম করে নিলো তখনি। বাবা মাকে ছেড়ে তার চলে যাওয়ার প্রহর চলে এসেছে যে খুব নিকটে।

চলবে….

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি বেশি বেশি।
💛💛

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here