মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ১৭

0
70

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১৭

🍁
স্নিগ্ধ বিকেল। তাপমাত্রা সহনীয়। খুব একটা গরম নেয় আজ। ছেলে পক্ষের মানুষজন এসেছে অনেকক্ষণ হলো। দেখা দেখি এবং খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। বিদায়ের মূহুর্ত, চলে যাবে তারা। খোলামেলা আলোচনায় শওকত রহমানকে ছেলের বাবা সরাসরি জানিয়েছেন মীরাকে তাদের পছন্দ হয়েছে। তারা তার এবং মীরার জবাব শুনতে উন্মুখ হয়ে আছেন। শওকত রহমান জ্ঞানী-গুণী বিচক্ষণ মানুষ। যেকোনো কাজে পরিবার কে প্রাধান্য দেন একটু বেশি। আজকেও তার ব্যাতিক্রম নয়। স্ত্রী এবং বোনের মুখে হাসি ফুটলেও মেয়ের শুকনো ফ্যাকাসে মুখটা দৃষ্টিগোচর হয়েছে ঠিকই। তার মন বলছে এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। আরেক বার কথা বলা উচিত মেয়ের সাথে। দুপুরের কথাটাও ভাবাচ্ছে তাকে। উর্মি যখন ধুমধাম করে রুমে এসেই বলে বসল, ‘মামু, এই সমন্ধ আমার পছন্দ হয় নি, আপনি ক্যান্সেল করে দেন। মীরাকে যদি বিয়ে দিতেই হয় ওতো দূর কেনো দিবেন? কাছে কূলেই দেন না। একটা মেয়ে আপনার, চোখের সামনে রাখেন মামুজান।’
তখন নেহাত উর্মিকে ধমকে বিদায় করে দিলেও পর মূহুর্তে ঠিকই তাকে একটু ভাবনাতেই ফেলেছে । এক দিকে আদরের কন্যাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে ভেবেই তার মনটা দুম/রে মুচ/রে শেষ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে উর্মীর গরগর করে বলা কথাটা।
আরেকবার মীরার দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন শওকত রহমান। নিরবতায় ছেঁয়ে গেলো পুরো রুম। উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে সবাই তার সিদ্ধান্ত শোনার জন্য। শওকত রহমান সময় নিয়ে রাশভারী কন্ঠে জবাব দিলেন ছেলের বাবাকে। মীরার নিচু করে রাখা বিষন্ন মুখটা শওকত রহমানের একটা বাক্যে থমকে গেলো। জ্ব/লজ্ব/ল করে বড় বড় হয়ে গেলো চোখ জোড়া। বিষ্ময় তার চোখে মুখে ঠিকরে পরছে। টিপটিপ করে তাকালো আব্বাজানের দিকে। চোখে চোখ পরতেই মুচকি হাসলেন তিনি। মীরা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে উনার কথা। হ্যাঁ, তাই তো বলল কিছুক্ষণ আগে। শওকত রহমান মেয়ের সাথে আরেকবার কথা বলতে চেয়েছেন, সময় চেয়েছেন তাদের থেকে। মীরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে ভুললো না। অপরদিকে মামুজানের কথাতে মুখ হা হয়েছে উর্মির ও। মিনিট দশেক হলো সানজিদা বেগম জোর করে টেনে এনে বসিয়েছেন এখানে। তখন থেকেই ওর গা জ্ব*লে যাচ্ছে। না পারছে বলতে না পারছে সহ্য করতে। শক্ত হয়ে বসে আছে। হাসির কথাতেও হাসছে না, কষ্টের কথাতেও আফসোস করছে না। লাগছে তো তার বিরক্ত, সেটাও প্রকাশ করতে পারছে না পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে। এ মূহুর্তে উর্মিকে রোবট এর সহিত তুলনা করলেও বোধহয় ভুল হবে না। বিরক্তি আর রাগে অনুভূতি প্রকাশ করতেও যেনো ভুলে গেছে সে। সে ঠিক শুনছে কি না তা বুঝতে মীরার দিকে তাকাল। মীরার মুখটাও কেমন হতভম্ব অবস্থা। ওমা!একি কি করছে মীরা? নিজের হাতে নিজে চিমটি কা’টছে। উর্মিরও মনে হলো স্বপ্ন না তো? যা ভাবা তাই কাজ, পরখ করে দেখা যাক। মীরার দেখাদেখি উর্মিও চিমটি কাটল নিজের হাতে। ইয়া আল্লাহ!! একটুও ব্যাথা পাচ্ছে না, তার মানে কি এটা স্বপ্ন? না না, এটা যেনো স্বপ্ন না হয়। এবার একটু জোরে চিমটি দিলো বেশ শক্তি দিয়ে। সানজিদা বেগম সাথে সাথেই সবার অগোচরে চড় বসালেন উর্মির পিঠে। ভাইজানের কথায় তার অবস্থা এমনিতেই করুণ তার উপর উর্মির চিমটি খেয়ে মাথায় আ/গুন ধরে গেছে। র/ক্তচক্ষু করে তাকিয়ে হুশিয়ার করে দিলো উর্মিকে। কিন্তু উর্মি কে কি আর আঁটকে রাখা যায়। রাগে, দুঃখে এতো এতো সুস্বাদু খাবার না খেয়ে ছিলো এতো ক্ষণ। এখন কেনো উপস থাকবে? ক্ষুধায় চো চো করছে পেট। দ্রুত উঠে ডাইনিং এ বসে গেলো খাওয়ার জন্য। উর্মির উদ্ভট কান্ডকারখানা দেখে সানজিদা বেগম এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। মেয়ের পিছু পিছু গিয়ে কটমট দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিলেন চুপ করে সোফায় গিয়ে বসে থাকতে। কিন্তু উর্মির তো এখন আনন্দের সীমা নেয়। গায়েই লাগছে না মায়ের বকুনি। কিন্তু মানুষজন আছে বলে নিজের ক্ষুধাকে পেটের মাঝেই চা/পা দিয়ে বসলো মীরার পাশে।

__________________

গ্যারেজ থেকে বাইক নিয়ে গেট দিয়ে বের করল রাইফ। ডাক্তারের কাছে যাবে মাকে নিয়ে। রাজিয়া বেগম এগিয়ে আসলেন। ব্যাগ হাতরাচ্ছেন তিনি। কিছু খুঁজছেন বলেই মনে হচ্ছে। রাইফের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-‘রাইফ, তাড়াহুড়োয় আগের প্রেসক্রিপশন টা আনতে ভুলে গেছি।’

-‘কোথায় রাখছো আম্মা?’

-‘টেবিলের উপরেই আছে। যা তো আব্বা।’

-‘ঠিক আছে। তুমি ভেতরে এসে দাঁড়াও।’

রাইফ গাড়ি স্ট্যান্ড করেই ছুটলো প্রেসক্রিপশনের উদ্দেশ্যে। তিন তলায় গিয়ে বুঝলো মীরাদের বাসায় কেউ এসেছে। অনেক জনের কথার মৃদু আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে। আমলে নিলো না সে। দৌড়ের উপরে আছে, দ্রুত পোঁছতে হবে ডাক্তারের চেম্বারে।

____________

সদর দরজা খোলা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মীরার পরিবার। ছেলে পক্ষকে বিদায় জানাচ্ছেন সকলে। শেষ সময়ের কথা বার্তাটুকু সেরে নিচ্ছেন সবাই। রাইফ তড়িঘড়ি করে নেমে আসছে নিচে। প্রেসক্রিপশনটা খুঁজতে দেড়ি হয়ে গেছে তার। রাজিয়া বেগম টাবিলের উপর বললেও সেটা ছিলো আলমারির ভেতর। দ্রুত পদে আসলেও তিন তলার কাছাকাছি আসতেই ধীর হলো তার পায়ের গতি। দৃষ্টি সামনে রেখে এক পলকে সবাইকে দেখে নিল। মীরার পরিবারের সবাই আছে, হাস্যজ্বল মুখ তাদের। বাঁকা দৃষ্টিতে শওকত রহমান কে ভেদ করে পেছনে দাঁড়ানো বেগুনি রংয়ের ঢিলাঢুলা সালোয়ার কামিজ পরা রমণী কেও দেখে নিল। সেকেন্ডের ব্যাবধানে সুক্ষ্ণ সুক্ষ্ম বিষয় গুলোও নজর এরালো না তার। মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে গেছে এই দু দিনেই। দু একটা ব্রণ ও উঠেছে ভ্রুর এক সাইডে। দাগ বিহীন মুখটাতে লাল রংয়ের ব্রণ দুটো মীরার সৌন্দর্য কে আরো বাড়িয়ে তোলেছে। এই যে হাসছে মেয়েটি, মুচকি হাসি। এই মোহনীয় হাসিতে যে রাইফ এক জীবন দেখতে দেখতেই পার করতে পারবে তা কি জানে এই নারী?
চলে গেছেন অতিথিরা। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কি হবে। মীরা রুমের যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বেখায়লী তে রাইফের দিকে নজর গেলো, চোখাচোখি হলো দুজনের। রাইফের রাতজাগা র/ক্তি’ম চোখের দিকে আজ মীরা কিছুতেই নজর মেলাতে পারছে না। অপরাধবোধ নাকি সংকোচে জানে না সে। কেনো অপরাধবোধ কাজ করছে সেটাও বোধগম্য না মীরার। সে তো রাইফকে ভালোবাসে নি কিংবা কথাও দেয় নি। তবে? দ্রুত পদে খাদিজা বেগমের পিছু পিছু চলে গেলো ভেতরে।
শওকত রহমানের চোখে চোখ পরলে রাইফ মুচকি হাসল । সম্মানের সহিত বলল,

-‘আস সালামু আলাইকুম চাচা। ভালো আছেন?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো? এই সময় কোথায় যাচ্ছো?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। আম্মার শরীর টা একটু খারাপ। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে যাচ্ছি। পেসক্রিপশন রেখে গেছিলো, নিতে আসছিলাম।’

-‘আল্লাহ সুস্থ করুক তোমার আম্মাকে।’

-‘জ্বী চাচা, দোয়া করবেন। তো কেউ আসছিলো নাকি?’

-‘হ্যাঁ, মীরাকে দেখতে আসছিলো। চলে গেলো এই এক মিনিটও হয় নি।’

-‘মীরার কি হয়েছে? ভালোই তো দেখলাম, অসুস্থ নাকি?’

সারাদিনের ধকলে যার যার মতো রুমে চলে গেছে বিশ্রাম নিতে। রুমের ভেতর সোফায় একা বসে খাচ্ছিলো উর্মি। রাইফের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই খাবার মুখে রাখা অবস্থাতেই ফট করে উর্মি চেঁচিয়ে বলে উঠল,

-‘শুধু অসুস্থ হলেই কি দেখতে আসে রাইফ ভাইয়া? মীরু কে পাত্র পক্ষ দেখতে আসছিলো আজ। সামনের সপ্তাহে বিয়ে। দাওয়াত থাকলো আপনার, আন্টিকেও আনবেন। আপনাকেই প্রথম দাওয়াত দিলাম বুঝছেন, এজন্য সুন্দর একটা গিফট আনবেন। সাথে আমার জন্য একটা হলুদ শাড়ি আনিয়েন, আর মীরার জন্য লাল শাড়ি। ওর একটা লাল শাড়িও নায়।’

উর্মির ফটফট করে বলা কথাতে রাইফের বাহির দেখতে যতোটাই শান্ত ভেতর টা ঠিক ততোটাই এলোমেলো হলো মূহুর্তেই। ঝড় উঠেছে, কাল বৈশাখী ঝড়। ভেতরটা এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে, র/ক্তক্ষ’র’ণ হচ্ছে বক্ষে। বি’ধ্ব’স্ত অবস্থা। এই ঝড় কিভাবে থামবে জানা নেই তার। উর্মি রাইফের ভেতর টা বুঝতে পারলো বোধহয়। খাবারের শেষ লুকমাটা মুখে দিয়েই বলল,

-‘রাইফ ভাই, আন্টিকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে আপনিও একবার চেক আপ করবেন। মুখটা কেমন ফ্যাকাসে, শুনেছি হার্টের সমস্যা হলে এমন হয়।’

চলবে….

(কেমন লাগলো জানাবেন। এক ঘেয়ামি লাগছে কি? আপনাদের কি মনে হচ্ছে যে কাহিনী আগাচ্ছে না? বলবেন কেমন। ভালোবাসা নিবেন💛💛)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here