বিয়ে পর্ব ১

0
381

আজ অদ্রির বিয়ে। পাত্র হলো অদ্রির মায়ের ছোটবেলার বান্ধবীর একমাত্র ছেলে ইফতেখার হাসান ধ্রুব। একটু আগেই তাদের দুজনের বিয়ে পড়ানো হয়েছে। অদ্রি শক্ত হয়ে বসে আছে। চোখ জলে টলমল করছে, নাক টানছে, মুখ লাল হয়ে আছে। কিন্তু ও ঠিক করেছে ও কাঁদবে না। কোনোভাবেই না। বাবার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ একদম করতে চায় না সে। এদিকে ধ্রুবও বেশ রেগে গেছে। ক্রমেই ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে ওঠছে। ওর মা শায়লা জেদ করেছিলো ছোটবেলার বান্ধবীর বাসায় যাবে। বান্ধবী কিছুদিন আগেই মারা গেছেন, তাই ওনার মেয়েটার খোঁজখবর নিতে যাবেন। কিন্তু খোঁজ নিতে এসেই যে ওর গলায় একটা মেয়েকে ঝুলিয়ে দেবে তা বলেনি।
ধ্রুব কখনোই বিয়ে করতে চায় নি। বিয়ে মানে অনেক ঝামেলা। একজনের কাছে দায়বদ্ধ থাকা। ধ্রুব কারো কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। ভেবেছিলো কোনোভাবে একবার কানাডা ফিরে গেলে আর কখনো সে দেশে আসার নাম নেবে না। কিন্তু আজ হঠাৎই শায়লার একটা জেদ পূরণ করতে এখানে এসেছিলো সে। কিন্তু এভাবে যে ওর মা ওর সাথে বিট্রে করবে তা ভাবেনি। বিয়ের ব্যাপারটা যে তার মা-বাবা আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলো তা সে এখন বুঝতে পারছে।

এদিকে ধ্রুব’র শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। শায়লা হাসান ছেলের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এক্ষুনি না আবার কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলেন। তার শান্তশিষ্ট ছেলে রেগে গেলে মাথাখারাপ হয়ে যায়। তিনি নিচুস্বরে বললেন,
— ক্ষমা করে দাও আব্বা, আমি শুধু নিজের
একটা কথা রাখতে চেয়েছিলাম। অদ্রির অবস্থা আমি পরে বুঝিয়ে বলবো তোমায়। বিবেকবোধ থেকেই এই কাজটা করতে সায় দিয়েছে আমার মন।
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে বলল,
— এইজন্য আত্ম’হত্যার ভয় দেখিয়ে আমাকে ফাঁসিয়ে দিবে? আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না।
শায়লা হাসান অধৈর্য হয়ে বলল,
— আর কিছুক্ষণ। আমরা একেবারে অদ্রিকে নিয়েই বেরিয়ে যাবো।
ধ্রুব বলল,
— যা খুশি তাই করো, আমি যাচ্ছি।
বলেই ধ্রুব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অদ্রির বাবা জামিউল সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— কি ব্যাপার? ও চলে গেলো কেন?
ধ্রুব’র বাবা আশফাক হাসান বললেন,
— অফিসের দরকারি ফোন এসেছিলো, তাই বেরিয়ে গেছে। হুট করেই বিয়ে তো, জানতো না কেউ।
— ওহ!
শায়লা হাসান এবার হেসে বললেন,
— আচ্ছা ভাই, এবার আমার মিষ্টি মেয়েকে আমাদের হাতে তুলে দিন। আত্মীয়রা কেউ জানে না তো! অনেক কাজ বাকি।
জামিউল সাহেব কিছু বলার আগেই তার নতুন স্ত্রী সাথী বেগম গদগদ হয়ে বলে ওঠলেন,
— হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্যবস্থা করছি আমি।

বলেই ওনি জামিউল সাহেবকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অদ্রির পাশে শায়লা হাসান বসে আছেন। ওর মনের অবস্থা তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। সৎ মায়ের সংসারে মেয়েটি যে ভালো নেই, তা তিনি ছাড়া আর কে বুঝবেন? ছোটবেলায় রুবিনা আর তিনি ঠিক করেছিলেন নিজের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিবেন। এই কথা রাখতেই তো তিনি আজ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজের মেয়ে নেই বলে অদ্রিকে সে পুতুলের মতো গোছানো একটা জীবন দিতে চায়। কিন্তু তার ছেলেটা যে বাড়ি ফিরে কি করে তা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তায় আছেন। পাশে বসা অদ্রি তখনো মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরেও ও জানতো না আজ ওর বিয়ে। অথচ ওর বাবা আর তার স্ত্রী কি সুন্দর করে ওর বিয়েটা দিয়ে দিলো! ওদের বোধহয় ঘাড় থেকে বোঝা নামলো। কিন্তু এই নতুন পরিবারের তেমন কাউকেই অদ্রি চেনে না। মায়ের কাছে প্রায়ই তার প্রিয় বান্ধবী শায়লার গল্প শুনতো অদ্রি। স্বামীর চাকুরীর সুবাদে যিনি বিয়ের কয়েক বছর পরই সন্তানসহ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাই নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব না হলেও কালভদ্রে খোঁজখবর পাওয়া যেতো। ওদের সমন্ধে এর বেশিকিছুই অদ্রি জানে না।

কিন্তু অদ্রির জীবনটা যে আচমকা এভাবে পাল্টে যাবে তা ও কখনোই ভাবেনি। স্ট্রোক করে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অদ্রির মা রুবিনা। তারপর অবস্থার এতই অবনতি হলো যে এ জীবনের বেশিকিছুই আর তিনি দেখে যেতে পারলেন না। মায়ের মৃত্যুর এই ধাক্কা সামলানোর আগেই অদ্রির বাবা জামিউল সাহেব বিয়ে করে নিলেন তার অফিস কলিগের ডিভোর্সি এক বোনকে। সেই সাথী বেগম অদ্রিকে দেখলেই মুখটা কালো করে রাখতো, বিভিন্নভাবে বোঝাতে চাইতো সে অদ্রিকে পছন্দ করছে না। কে-ই বা করবে? যে স্বামীর আগের পক্ষে আঠারো বছরের
একটা মেয়ে আছে তাকে কি করেই বা মানবে? এটা উটকো ঝামেলা ছাড়া আর কি! অদ্রি শুধু তার বাবার পরিবর্তন দেখে। নতুন স্ত্রীকে নিয়ে সে বেজায় খুশি। ঘুরতে যাচ্ছে, শপিং করছে, আনন্দ করছে। অদ্রি ভেবে অবাক হয় তার
বাবা-মায়ের তো প্রেমের বিয়ে ছিলো। তাহলে কীভাবে বাবা এমনটা করতে পারলো? পুরুষ মানুষ কি আসলে এমনই হয়? সেদিনের পর থেকে বাবার জন্য মন থেকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু আসে না অদ্রির। বাবাও আর ডাকে না। মা ছিলো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর থেকে ও একদম চুপ হয়ে গেছে। আগের চঞ্চলতাটা হুট করেই হারিয়ে গেছে কোথাও!

এক দুপুরে জামিউল সাহেব অদ্রির ঘরে এলেন। ঘরটা ঘুরেফিরে অদ্রিকে আগাগোড়া দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
— অদ্রি তুমি আজকাল ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছো না কেন? সকালেও নাকি খাওনি?
অদ্রি টেবিলে মুখ গুঁজে বই পড়ছিলো। ওর আজকাল বাবাকে বেশ অচেনা মনে হয়। শান্তভাবে বলল,
— আমার পছন্দের খাবার তৈরি হয়না, তাই।
আজকে চিংড়ীর মালাইকারি হয়েছে যাতে
আমার এলার্জি। তুমি কি ভুলে গেছো?
জামিউল সাহেব মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন,
— না ভুলিনি। তবে খেয়াল ছিলো না। কিন্তু তোমার নতুন মা খেতে চাইলো তাই বাজার থেকে নিয়ে এসেছি। বুয়া রান্না করলো ভালোই। সাথী এমন জোর করলো যে আমাকেও খেতে হলো।
কথাটা শুনে অদ্রির এত খারাপ লাগলো যে চোখদুটো জলে ভরে ওঠলো। নিজেকে সামলে প্রশ্ন করল,
— কেন তোমার নতুন বউ কি রান্না করতে জানেন না?
জামিউল সাহেব বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
— ওর নাকি রান্না করতে ভালো লাগে না। তা-ই এখন থেকে বিলকিসই সব কাজ করবে। আজ দেখলাম চিংড়ীটা বেশ ভালোই রেঁধেছে, কোথা থেকে শিখলো বল তো!
অদ্রি ভাবলেশহীন স্বরে উত্তর দিল,
— মায়ের কাছ থেকে শিখেছে। মাও কিন্তু চিংড়ী খুব ভালোবাসতো৷ কিন্তু তুমি পছন্দ করতে না বলে মা তোমার জন্য কখনো খেতো না। সেই তুমি আজ মা’কে ছাড়া চিংড়ী খাচ্ছো? বিলকিসের রান্না তুমি কখনো খাও? কাজের লোকের হাতের রান্না নাকি তুমি ম’রে গেলেও খেতে না, এমনটাই তো চিরকাল শুনে এসেছি। এটাই তো তোমার অভ্যাস।
অদ্রিকে অবাক করে ওর বাবা বলল,
— অভ্যাসগুলো বাজে ছিল, এখন আস্তে আস্তে বদলে নিচ্ছি নিজেকে। আর শুনো অদ্রি, আমার নতুন বউ তোমার মা হয়।। অনুরোধ করছি, “মা” বলে ডাকবে এখন থেকে।
অদ্রি কাঠ কাঠ হয়ে বলল,
— এমন অনুরোধ কক্ষনো করবে না। করলেও লাভ হবে না। আমার একটাই মা ছিলো, আছে আর থাকবে। মাকে তুমি ভুলে যেতে পারো, আমি নই।
জামিউল সাহেব কিছুই বললেন না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অদ্রির দিকে। এরপর বললেন,
— কতদিন বাবা বলে ডাকো না? তুমি তো আমার মেয়ে। এরকম করলে কি চলে?
অদ্রির মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু নিজেকে ভাঙলো না। যে ওর মাকে ভুলে অন্য নারীকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছে তাকে বাবা ডাকা ওর পক্ষে কষ্টসাধ্য।
— বাবা ডাক শোনানোর জন্য নতুন মেহমান তো আসছে। আমার কি আর কোনো প্রয়োজন আছে তোমার জীবনে?

জামিউল সাহেব চমকে ওঠলেন এই কথা শুনে। এরপর অদ্রির মনোভাব বুঝতে পেরে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। হয়তো ভাবছেন তার নতুন স্ত্রীর প্রেগ্ন্যাসির খবর অদ্রি কি করে জানলো! তিনি তো কাউকে অদ্রিকে খবরটা জানাতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি এটা জানেননা
এই খবর সাথী বেগমই অদ্রিকে দিয়েছে। সকালে দরজা ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙার পর অদ্রি দরজা খুলতেই সাথী বেগম জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন ওকে। অদ্রি হতভম্ব চোখে তাকাতেই সে কুটিল হেসে বলল,
— মাইয়া মানুষের এত রাগ ভালো না। তোমার বাপে তো আজকাল তোমার এই রাগের জন্য বিরক্ত। তবে চিন্তা কইরো না, নতুন ভাইবোন আসলে দেখবা আর বিরক্ত হইবো না। তখন তুমি আর রাগ দেখাইবার জায়গা পাইবা না। বাপে ভাগ হইয়া গেলো তোমার।
— মানে?
— বুঝতে পারো নাই এখনো? তোমার লগে ঝগড়া করার জন্য দুইজন ভাইবোন আসতেছে।

চলবে…

#আজ অদ্রির বিয়ে। পাত্র হলো অদ্রির মায়ের ছোটবেলার বান্ধবীর একমাত্র ছেলে ইফতেখার হাসান ধ্রুব। একটু আগেই তাদের দুজনের বিয়ে পড়ানো হয়েছে। অদ্রি শক্ত হয়ে বসে আছে। চোখ জলে টলমল করছে, নাক টানছে, মুখ লাল হয়ে আছে। কিন্তু ও ঠিক করেছে ও কাঁদবে না। কোনোভাবেই না। বাবার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ একদম করতে চায় না সে। এদিকে ধ্রুবও বেশ রেগে গেছে। ক্রমেই ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে ওঠছে। ওর মা শায়লা জেদ করেছিলো ছোটবেলার বান্ধবীর বাসায় যাবে। বান্ধবী কিছুদিন আগেই মারা গেছেন, তাই ওনার মেয়েটার খোঁজখবর নিতে যাবেন। কিন্তু খোঁজ নিতে এসেই যে ওর গলায় একটা মেয়েকে ঝুলিয়ে দেবে তা বলেনি।
ধ্রুব কখনোই বিয়ে করতে চায় নি। বিয়ে মানে অনেক ঝামেলা। একজনের কাছে দায়বদ্ধ থাকা। ধ্রুব কারো কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। ভেবেছিলো কোনোভাবে একবার কানাডা ফিরে গেলে আর কখনো সে দেশে আসার নাম নেবে না। কিন্তু আজ হঠাৎই শায়লার একটা জেদ পূরণ করতে এখানে এসেছিলো সে। কিন্তু এভাবে যে ওর মা ওর সাথে বিট্রে করবে তা ভাবেনি। বিয়ের ব্যাপারটা যে তার মা-বাবা আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলো তা সে এখন বুঝতে পারছে।

এদিকে ধ্রুব’র শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। শায়লা হাসান ছেলের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এক্ষুনি না আবার কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলেন। তার শান্তশিষ্ট ছেলে রেগে গেলে মাথাখারাপ হয়ে যায়। তিনি নিচুস্বরে বললেন,
— ক্ষমা করে দাও আব্বা, আমি শুধু নিজের
একটা কথা রাখতে চেয়েছিলাম। অদ্রির অবস্থা আমি পরে বুঝিয়ে বলবো তোমায়। বিবেকবোধ থেকেই এই কাজটা করতে সায় দিয়েছে আমার মন।
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে বলল,
— এইজন্য আত্ম’হত্যার ভয় দেখিয়ে আমাকে ফাঁসিয়ে দিবে? আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না।
শায়লা হাসান অধৈর্য হয়ে বলল,
— আর কিছুক্ষণ। আমরা একেবারে অদ্রিকে নিয়েই বেরিয়ে যাবো।
ধ্রুব বলল,
— যা খুশি তাই করো, আমি যাচ্ছি।
বলেই ধ্রুব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অদ্রির বাবা জামিউল সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— কি ব্যাপার? ও চলে গেলো কেন?
ধ্রুব’র বাবা আশফাক হাসান বললেন,
— অফিসের দরকারি ফোন এসেছিলো, তাই বেরিয়ে গেছে। হুট করেই বিয়ে তো, জানতো না কেউ।
— ওহ!
শায়লা হাসান এবার হেসে বললেন,
— আচ্ছা ভাই, এবার আমার মিষ্টি মেয়েকে আমাদের হাতে তুলে দিন। আত্মীয়রা কেউ জানে না তো! অনেক কাজ বাকি।
জামিউল সাহেব কিছু বলার আগেই তার নতুন স্ত্রী সাথী বেগম গদগদ হয়ে বলে ওঠলেন,
— হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্যবস্থা করছি আমি।

বলেই ওনি জামিউল সাহেবকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অদ্রির পাশে শায়লা হাসান বসে আছেন। ওর মনের অবস্থা তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। সৎ মায়ের সংসারে মেয়েটি যে ভালো নেই, তা তিনি ছাড়া আর কে বুঝবেন? ছোটবেলায় রুবিনা আর তিনি ঠিক করেছিলেন নিজের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিবেন। এই কথা রাখতেই তো তিনি আজ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজের মেয়ে নেই বলে অদ্রিকে সে পুতুলের মতো গোছানো একটা জীবন দিতে চায়। কিন্তু তার ছেলেটা যে বাড়ি ফিরে কি করে তা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তায় আছেন। পাশে বসা অদ্রি তখনো মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরেও ও জানতো না আজ ওর বিয়ে। অথচ ওর বাবা আর তার স্ত্রী কি সুন্দর করে ওর বিয়েটা দিয়ে দিলো! ওদের বোধহয় ঘাড় থেকে বোঝা নামলো। কিন্তু এই নতুন পরিবারের তেমন কাউকেই অদ্রি চেনে না। মায়ের কাছে প্রায়ই তার প্রিয় বান্ধবী শায়লার গল্প শুনতো অদ্রি। স্বামীর চাকুরীর সুবাদে যিনি বিয়ের কয়েক বছর পরই সন্তানসহ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাই নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব না হলেও কালভদ্রে খোঁজখবর পাওয়া যেতো। ওদের সমন্ধে এর বেশিকিছুই অদ্রি জানে না।

কিন্তু অদ্রির জীবনটা যে আচমকা এভাবে পাল্টে যাবে তা ও কখনোই ভাবেনি। স্ট্রোক করে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অদ্রির মা রুবিনা। তারপর অবস্থার এতই অবনতি হলো যে এ জীবনের বেশিকিছুই আর তিনি দেখে যেতে পারলেন না। মায়ের মৃত্যুর এই ধাক্কা সামলানোর আগেই অদ্রির বাবা জামিউল সাহেব বিয়ে করে নিলেন তার অফিস কলিগের ডিভোর্সি এক বোনকে। সেই সাথী বেগম অদ্রিকে দেখলেই মুখটা কালো করে রাখতো, বিভিন্নভাবে বোঝাতে চাইতো সে অদ্রিকে পছন্দ করছে না। কে-ই বা করবে? যে স্বামীর আগের পক্ষে আঠারো বছরের
একটা মেয়ে আছে তাকে কি করেই বা মানবে? এটা উটকো ঝামেলা ছাড়া আর কি! অদ্রি শুধু তার বাবার পরিবর্তন দেখে। নতুন স্ত্রীকে নিয়ে সে বেজায় খুশি। ঘুরতে যাচ্ছে, শপিং করছে, আনন্দ করছে। অদ্রি ভেবে অবাক হয় তার
বাবা-মায়ের তো প্রেমের বিয়ে ছিলো। তাহলে কীভাবে বাবা এমনটা করতে পারলো? পুরুষ মানুষ কি আসলে এমনই হয়? সেদিনের পর থেকে বাবার জন্য মন থেকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু আসে না অদ্রির। বাবাও আর ডাকে না। মা ছিলো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর থেকে ও একদম চুপ হয়ে গেছে। আগের চঞ্চলতাটা হুট করেই হারিয়ে গেছে কোথাও!

এক দুপুরে জামিউল সাহেব অদ্রির ঘরে এলেন। ঘরটা ঘুরেফিরে অদ্রিকে আগাগোড়া দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
— অদ্রি তুমি আজকাল ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছো না কেন? সকালেও নাকি খাওনি?
অদ্রি টেবিলে মুখ গুঁজে বই পড়ছিলো। ওর আজকাল বাবাকে বেশ অচেনা মনে হয়। শান্তভাবে বলল,
— আমার পছন্দের খাবার তৈরি হয়না, তাই।
আজকে চিংড়ীর মালাইকারি হয়েছে যাতে
আমার এলার্জি। তুমি কি ভুলে গেছো?
জামিউল সাহেব মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন,
— না ভুলিনি। তবে খেয়াল ছিলো না। কিন্তু তোমার নতুন মা খেতে চাইলো তাই বাজার থেকে নিয়ে এসেছি। বুয়া রান্না করলো ভালোই। সাথী এমন জোর করলো যে আমাকেও খেতে হলো।
কথাটা শুনে অদ্রির এত খারাপ লাগলো যে চোখদুটো জলে ভরে ওঠলো। নিজেকে সামলে প্রশ্ন করল,
— কেন তোমার নতুন বউ কি রান্না করতে জানেন না?
জামিউল সাহেব বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
— ওর নাকি রান্না করতে ভালো লাগে না। তা-ই এখন থেকে বিলকিসই সব কাজ করবে। আজ দেখলাম চিংড়ীটা বেশ ভালোই রেঁধেছে, কোথা থেকে শিখলো বল তো!
অদ্রি ভাবলেশহীন স্বরে উত্তর দিল,
— মায়ের কাছ থেকে শিখেছে। মাও কিন্তু চিংড়ী খুব ভালোবাসতো৷ কিন্তু তুমি পছন্দ করতে না বলে মা তোমার জন্য কখনো খেতো না। সেই তুমি আজ মা’কে ছাড়া চিংড়ী খাচ্ছো? বিলকিসের রান্না তুমি কখনো খাও? কাজের লোকের হাতের রান্না নাকি তুমি ম’রে গেলেও খেতে না, এমনটাই তো চিরকাল শুনে এসেছি। এটাই তো তোমার অভ্যাস।
অদ্রিকে অবাক করে ওর বাবা বলল,
— অভ্যাসগুলো বাজে ছিল, এখন আস্তে আস্তে বদলে নিচ্ছি নিজেকে। আর শুনো অদ্রি, আমার নতুন বউ তোমার মা হয়।। অনুরোধ করছি, “মা” বলে ডাকবে এখন থেকে।
অদ্রি কাঠ কাঠ হয়ে বলল,
— এমন অনুরোধ কক্ষনো করবে না। করলেও লাভ হবে না। আমার একটাই মা ছিলো, আছে আর থাকবে। মাকে তুমি ভুলে যেতে পারো, আমি নই।
জামিউল সাহেব কিছুই বললেন না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অদ্রির দিকে। এরপর বললেন,
— কতদিন বাবা বলে ডাকো না? তুমি তো আমার মেয়ে। এরকম করলে কি চলে?
অদ্রির মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু নিজেকে ভাঙলো না। যে ওর মাকে ভুলে অন্য নারীকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছে তাকে বাবা ডাকা ওর পক্ষে কষ্টসাধ্য।
— বাবা ডাক শোনানোর জন্য নতুন মেহমান তো আসছে। আমার কি আর কোনো প্রয়োজন আছে তোমার জীবনে?

জামিউল সাহেব চমকে ওঠলেন এই কথা শুনে। এরপর অদ্রির মনোভাব বুঝতে পেরে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। হয়তো ভাবছেন তার নতুন স্ত্রীর প্রেগ্ন্যাসির খবর অদ্রি কি করে জানলো! তিনি তো কাউকে অদ্রিকে খবরটা জানাতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি এটা জানেননা
এই খবর সাথী বেগমই অদ্রিকে দিয়েছে। সকালে দরজা ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙার পর অদ্রি দরজা খুলতেই সাথী বেগম জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন ওকে। অদ্রি হতভম্ব চোখে তাকাতেই সে কুটিল হেসে বলল,
— মাইয়া মানুষের এত রাগ ভালো না। তোমার বাপে তো আজকাল তোমার এই রাগের জন্য বিরক্ত। তবে চিন্তা কইরো না, নতুন ভাইবোন আসলে দেখবা আর বিরক্ত হইবো না। তখন তুমি আর রাগ দেখাইবার জায়গা পাইবা না। বাপে ভাগ হইয়া গেলো তোমার।
— মানে?
— বুঝতে পারো নাই এখনো? তোমার লগে ঝগড়া করার জন্য দুইজন ভাইবোন আসতেছে।

চলবে…

#বিয়ে
#পর্ব- ১
#লেখনীতে – ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১
#লেখনীতে – ইসরাত জাহান ফারিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here