বামনের ঘরে চাঁদ শেষ পর্ব

0
1301

বামনের ঘরে চাঁদ

সাজিয়ানা মুনির

৩০ (অন্তিম পর্ব)

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

দীর্ঘ সময় পর চাঁদের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হলো। এই পুরোটা সময় চাঁদ হলেই ছিলো। অবশেষে ভার্সিটি জীবনের ইতি টানবে আজ। এই সবুজে ঘেরা সুন্দর ক্যাম্পাস ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। বেশ সুন্দর জামদানী শাড়ি পরে, চমৎকার সাজলো। মেঘবরণ লন্বা কেশ মেলে দিলো। আজ তার সাথে দেখা করতে একজন বিশেষ মানুষ আসছে। বিকাল চারটার সময় দিয়েছে। চাঁদ হল থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে পেছনের দিকে নিরিবিলি জায়গায় বসলো। আগন্তুকের অপেক্ষায় রইল। খানিক বাদেই ক্যাফেটেরিয়ায় প্রমি এসে ঢুকল। কেমন জানো নেতিয়ে পড়া শুষ্ক চোখমুখ তার। মলিন মুখ করে চাঁদের সামনের চেয়ারে বসলো। শান্ত আওয়াজে বলল,
‘ কেমন আছো চাঁদ? সবে পরিক্ষা শেষ হলো, দেখা করবো বলে বিরক্ত হওনি তো?’
চাঁদ মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
‘ উহু, একদম বিরক্ত হয়নি। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
প্রমি মলিন মুখ করে ধীর স্বরে উত্তর দিলো,
‘ এইতো ভালো।’
খানিক চুপ থেকে আবার বলল,
‘ আসলে কথাটা খুব ইম্পরট্যান্ট আর গোপনীয় যে তোমাকে আলাদা এভাবে দেখা করতে বললাম। আপাকে বলোনি তো?’
চাঁদ ‘না’ সূচক মাথা নাড়াল। প্রমি চাঁদের দিকে অসহায় মুখ করে চেয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ কথাটা তোমাকে কিভাবে বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। ভীষণ তিক্ত কিন্তু সত্য। আসলে.. হাসপাতালে তোমাকে আমার যেই বয়ফ্রেন্ডের কথা বলেছিলাম! সে অন্যকেউ নয় তোমার স্বামী আষাঢ়। আমাদের অনেকদিনের সম্পর্ক ছিলো। যেন-তেন সম্পর্ক নয় মাখামাখি সম্পর্ক! একে অপরকে খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু ওর ফ্যামিলি ক্রাইসিসের জন্য ওকে নিচে নামতে হয়েছে, টাকা জোগাড় করতে আমাকে রে/প করে ভিডিও বানিয়ে ব্লাকমেইল করতে চেষ্টা করে। যার জন্য আমাদের ব্রেকআপ হয়। তারপর অনেক বছর কে/টে গেল। এর মধ্যে দিয়ে তুমি জোরপূর্বক আষাঢ়ের জীবনে এলে। তোমাকে অনেকবার দূরে ঠেলে দিতে চেয়েছে তুমি শুননি। বরাবর আষাঢ়ের পেছনে পড়েছিলে। প্রথমে বিরক্ত হলেও, একটা সময় আর পাঁচজন মানুষের মত সম্পর্কটা মেনে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি দেশে ফেরার পর থেকে আষাঢ়ের আমার প্রতি পুরনো সেই দুর্বলতা জেগে উঠে আবার। রোজ কল করছে, এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার রাখতে চাইছে। অবৈধ সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। তোমার থেকে পিছু ছাড়াতে চাইছে পারছে না। ফ্যামিলি প্রেসারে পড়েছে। আষাঢ়ের প্রতি আমারও যে একটা দুর্বলতা আছে আমি তা অস্বীকার করবো না। হ্যাঁ আমি আজও আষাঢ়কে ভালোবাসি। ওকে চাই। কিন্তু তৃতীয় কেউ হয়ে না। আইনগত ভাবে সকল অধিকার নিয়ে। এই সম্পর্কের ভেতর তুমি কোনো দিন ভালো থাকবে না। চিরকাল আমি পিছুটান হয়ে থাকবো আষাঢ়ের। তারচেয়ে বরং তুমি আমাদের জীবন থেকে চলে যাও। আষাঢ় তোমাকে কখনো কিছু বলবে না। তোমার প্রতি দয়া জন্মেছে ওর। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা একলা একটা মেয়ে। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই এই সম্পর্কটা মানবে আষাঢ়। কিন্তু সত্যি তো এটা যে ওর মন আমার কাছে পড়ে থাকবে। তোমার আড়ালে আমাদের একটা সম্পর্ক চলবে, তা জেনে নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে না! তাই আমি আশা করবো তুমি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাও। আষাঢ়কে তালাক দেও। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। হলে থেকেই মাস্টার্স কমপ্লিট করে নিজের গন্তব্য ঠিক করো। এটা আমার সাজেশন! বাকিটা তুমি বুদ্ধিমতী, আত্মসম্মানী মেয়ে ভালো জানো।’
কথা শেষ করে প্রমি চাঁদের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো। অভিনয় কি ঠিকঠাক হলো!
চাঁদ ভাবলেশহীন বসে। চোখমুখ বড্ড বেশি স্বাভাবিক। চেহারা পড়ে মনের খবর ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। প্রমি উত্তরের অপেক্ষায় রইল। চাঁদ মুখ খুলল বলল,
‘ তোমার সাথে আষাঢ়ের যেই সম্পর্ক থাকুক, তাতে আমার কিছু আসেযায় না। আমি আষাঢ়কে ছাড়ছি না। আমি তার বিবাহিতা বউ। বাহিরে যাই করুক, দিনশেষে বাড়িতেই ফিরবে।’
মুহূর্তেই প্রমির আশার নৌকা মাঝ সমুদ্রে ডুবল। চাঁদের এমন উত্তর আশা করেনি সে।ভেবেছিল এসব শুনে রেগে গিয়ে আষাঢ় থেকে ছাড়াছাড়ির কথা বলবে চাঁদ। কিন্তু… চাঁদের এমন অতি স্বাভাবিক আচরণে প্রমির মেজাজ খারাপ হলো। ক্রোধে তিড়বিড় করে উঠলো। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার স্বামীর অন্য মেয়ের সাথে অ/বৈধ সম্পর্ক থাকবে এতে তোমার কোনো সমস্যা নেই? দিনশেষে বাড়ি ফিরলেই হলো! ছি, এত নিম্ন চিন্তাভাবনা তোমার।’
চাঁদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বলল,
‘ লজ্জা তো তোমার থাকা দরকার। জেনেশুনে বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইছ।’
প্রমি আরো বেশি ক্ষেপে উঠলো। নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারালো। দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘ তুমি জানো এর পরিণাম কি হবে? সারাজীবন তোমাকে এর ভার বইতে হবে। তোমার কারণে আষাঢ়ও ভুগবে। কোনো জায়গায়, কোথাও ঠাই হবে না তোমাদের। আমি সেই ছাড়টুকুও দিবো না।’
প্রমির হুমকি ধমকি কানে তুলল না। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বসে রইল চাঁদ। এতে প্রমির মাথা আরও গরম হলো। রাগের মাথায় আরও কিছু বলল। চাঁদ চুপচাপ শুনলো। হেলান ছাড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো। টেবিলের উপর ভর দিয়ে গম্ভীর মুখ করে বলল,
‘অনেক বলেছ, এবার আমার কথা শুনো। হাসপাতালে প্রথমদিন যখন তুমি আসার কারণে আষাঢ় আর ভাবির মুখ গম্ভীর হয়েছিল সেদিনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু তেমন গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তবে পুরোপুরি ভুলে যাইনি। তুমি তোমার অতীতের গল্প শোনানোর পর, আমি আষাঢ়ের সাথে যখন তা আলোচনা করি। আষাঢ় রেখে উঠে যায়।সেদিনই আমার সন্দেহ পাকাপোক্ত হয়। তবে এতটুকু নিশ্চিত ছিলাম যে আষাঢ় ভুল কিছু করেনি। কোথাও কিছু ভুল বা অজানা অদেখা ছিলো হয়তো। কিন্তু আমার ধারণা ছিল না, যে তুমি এমন বড় মাপের একটা সাইকো। কাউকে পাওয়ার জন্য এতটাও নিচে নামতে পারে কেউ? অফিসে সেদিন তুমি আমাকে দেখে আষাঢ়কে জড়িয়ে ধরেছিলে। আমি তা দেখেছি। হ্যাঁ, সহ্য করতে পারিনি। চোখ ভিজেছিল, অশ্রু ঝরেছিল। রাগ হয়েছিল খুব। আমি চাইলে সেখানে ঝামেলা করতে পারতাম। কিন্তু পাবলিক প্লেসে তোমার মত ক্লাসহীন নিম্নস্তরের মানুষের সাথে ঝামেলা করে আষাঢ়ের নাম ডুবানোর ইচ্ছা ছিলো না আমার। তাই ঘটনা জানতে গোড়ার খবর নিতে ভাবির সাথে দেখা করি। গেস হোয়াট! আমি ঠিক ছিলাম। আষাঢ় কোনো অ/ন্যায় করেনি। ভাবির সাথে কথা বলে জানতে পারি, এসবকিছু তুমি করেছিলে। আষাঢ়ের বারবার রিজেক্ট করার পর, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তুমি সেদিন ফাঁকা বাড়িতে তোমার প্ল্যান মোতাবেক আষাঢ়ের চায়ে ড্রা/গস মিশিয়েছিলে। এমনকি আষাঢ় চা খাওয়ার পর সতর্কতার সাথে সেই কাপ ধুয়ে রেখেছিলে, যেন ধরা না পড়ো পরবর্তীতে। তারপর এমন একটা নাটক সাজালে যেন আষাঢ় সত্যি সত্যি তোমাকে রে/প করার চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য ছিলো। কারণ আমাদের উচ্চসমাজের নিয়ম অনুযায়ী সব অ/ন্যায় অপ/রাধ দরিদ্রদের। এমন কি ধনীদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাদেরকে টানতে হয়। আষাঢ় সাধারণ ঘরের দারিদ্র পরিবারের একজন ছিল। তাহলে অবশ্যই সে লোভী, অপরাধী তাইতো বিত্তশালী পরিবারের মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে। এই যুক্তিতে বিনা তল্লাশিতে আষাঢ়কে জেলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বাঁচায় রুবেল শিকদার। কেন? বন্ধু বলে? উহু, পরিবারের যেন নাম খারাপ না হয়! রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে যেন কোনো প্রভাব না পড়ে সেই কারণে। তাছাড়া আরও একটা কারণ ছিল! রুবেল শিকদার জানতো তুমি ড্রাগস নেও। কেসটা কোড অবধি গেলে নানারকম তথ্য ফাঁস হবে। সেই সাথে এটাও যে এসব কিছু মিথ্যা ছিলো। তাই রুবেল শিকদার চুপ থাকাটাকে উত্তম মনে করলো। এক ঢিলে দুই পাখি মা/রলো। আষাঢ়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে বশ করে নিলো। ইলেকশনে তাকে দিয়ে খুব সহজে তাঁতিবাজারের ভোট গুলো নিজেদের পার্টির নামে করে নিলো। কারণ রুবেল শিকদার জানতো, সেখানকার লোকজন আষাঢ়কে বেশ মানে। তার কথায় খুব সহজেই সেখানকার ভোট নিজেদের নামে করে নিতে পারবে। প্রথমদিকে ভাবির এসব সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিলো না। বোন প্রীতিতে অন্ধ ছিল। কিন্তু ধীরেধীরে সব কিছু খোলাসা হলো, যখন জানলো, তার আদরের ছোটবোন দেশের বাহিরে লিভিং -এ থাকছে। পুরোপুরি নেশার জগতে ডুবে। সবকিছু শান্ত হয়েছে। মিটমাট হয়ে গেছে ভেবে, সবটা জেনেও চুপ থাকে। আমাকে জানায়নি কারণ অতীত টেনে বর্তমান নষ্ট করতে চায়নি। কিন্তু ভাবি কি জানতো? তার নিলজ্জ বোন এখনো আমার স্বামীর পেছনে পড়ে। আমার সংসার ভাঙতে উঠে পড়ে লেগেছে! তাই সেদিন আমাকে সবটা জানিয়েছে।’
মানুষ অতিরিক্ত ক্রোধে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের বশে আক্রোশে সত্যি মিথ্যা সবটা বেরিয়ে আসে। প্রমির ক্ষেত্রেও তাই হয়। প্রচন্ড রাগে গড়গড় করে বলে,
‘ হ্যাঁ, আমি সব করেছি। আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি। আমিই আষাঢ়কে ড্রাগস দিয়ে সবার সামনে নিজেকে ভিক্টিম দেখিয়েছি। সবকিছু যখন তোর ভাইয়ের সামনে খোলাসা হলো, সে আমাকে সাহায্য করলো, ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে, কেস বন্ধ করলো। ভেবেছিলাম দেশ ছাড়লে হয়তো আষাঢ়ের ভূত মাথা থেকে নামবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম, আমি আজও আষাঢ়কে চাই। এতবছর পর যখন জানলাম, আষাঢ় বিয়ে করেছে! তাও তোকে! আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ঝটপট দেশে ফিরলাম, আষাঢ়কে ফিরে পেতে চেষ্টা চালালাম!’
‘ এতকিছু যেহেতু স্বীকার করেছ, তাহলে এটাও স্বীকার করো যে, আমার এক্সিডেন্ট তুমি তোমার ড্রাইভারকে দিয়ে করিয়েছ।যেন দেশে ফেরার পর পরই আমার মৃ/ত্যু সংবাদ শুনতে পাও। আর আষাঢ়কে নিজের করে নিতে আরেকটা সুযোগ পাও! কি ভাবছ এতকিছু আমি জানলাম কি করে? তোমার ড্রাইভার যে আমার উপর নজর রাখছিল। আমার তাতে চোখ এড়ায়নি। এক্সিডেন্টের সময় ও তাকে দেখেছিলাম গাড়িতে।’
প্রমির ভয়/ঙ্কর পাগলামো ভরা চোখ। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ করেছি, তো? আবার করবো! ওইবার ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছিস। এবার নিশ্চিত মৃ/ত্যু! আষাঢ় শুধু আমার। শুধুই আমার! ‘
চাঁদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। প্রমির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এটাকে ভালোবাসা না স্বার্থপরতা বলে! তোমার কুকীর্তির ভার আজও আষাঢ় বয়। নিজেকে অপরা/ধী মনে করে। অসচ্ছ এক অস্থিরতা তাকে বেকাবু করে, অশান্তিতে ভোগে! এটাকে ভালোবাসা না পাগলামো বলে। যদি ভালোবাসতে তাহলে অন্তত তার সম্মানের কথা ভাবতে!’
প্রমি ক্ষেপে উঠলো। চেয়ার ছেড়ে চাঁদের দিকে আক্রোশে এগিয়ে যেতে যেতে তিড়বিড় করে বলল,
‘ তোর থেকে আমার শিখতে হবে? হুহ? তোকে তো..’
প্রমিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পানির গ্লাস তুলে তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। প্রমি চাঁদের উপর আক্রমণ করতে চাইলো। আশেপাশের টেবিলের চেয়ার থেকে তটিনী বন্যা আর চার পাঁচজন ছেলে মেয়ে উঠে এদিকে এলো। সবার চোখমুখ গম্ভীর, প্রমির দিকে তাকিয়ে। প্রমি ঘাবড়ে গেল। চাঁদ তার হাত মুড়িয়ে ধরে বলল,
‘ অনেক হয়েছে। এবার আমার কথা শুনো, তুমি এতক্ষণ যাযা বলেছ এসব কিছু রেকর্ড হয়েছে। তোমার মুখের স্বীকারোক্তি তোমাকে জেলে নিয়ে ফেলবে! বাড়ি ছাড়ার সময় আষাঢ়কে কথা দিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে সব দূরত্ব মিটিয়ে দিবো এবার।’
প্রমি হতভম্ব! রেগে তিড়বিড় করে বলল,
‘ আমার সাথে এখানে দেখা করা, ডেকে আনা সবকিছু ট্রেপ ছিলো? ‘
চাঁদ ঠোঁট মেলে হাসলো। বলল,
‘ হ্যাঁ, ট্রেপ ছিলো। যেই মানুষটার জন্য আমি আমার অস্তিত্ব, পরিচয় সব ত্যাগ করেছি। শুধুমাত্র তাকে পাওয়ার জন্য! সেই মানুষটার কি করে ক্ষ/তি হতে দিতাম? আষাঢ় আমার! শুধুই আমার। আমার ভালো রূপ দেখেছ। ভালোবাসার জন্য পাগলামি দেখোনি। তুমি আষাঢ়কে পাওয়ার জন্য এতটুকু নিচে নামতে পারলে, ভাবো আমি তাকে বাঁচানোর জন্য কতটা নামতে পারবো! ইচ্ছে করছে গলা টিপে তোমাকে মেরে ফেলতে। কিন্তু তোমাকে শাস্তি আমি না, আষাঢ় দিবে। দুনিয়ার যেই কোণায় লুকাবে, আষাঢ় খুঁজে বের করবে!’
প্রমির ভীতু মুখ। ঘাবড়ে গেল সে! ব্যাগ কাঁধে তুলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। চাঁদ আটকালো না। কথায় আছে, পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে প্রান্তিক গেটে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদ। এতদিনের এই প্রিয় জায়গাটাকে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে। ক্যাম্পাসের কোণায় কোণায় হাজার স্মৃতি, মায়ার সম্পর্কগুলো ছড়ানো। হয়তো আবারও কোনো চাঁদ আসবে, এখান থেকেই নিজের স্বপ্ন পূরণের রাস্তা ধরবে। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে পেছন পানে একপলক চেয়ে মিষ্টি হাসলো চাঁদ। ফিসফিস করে বলল, ‘ ভালোবাসি, আমার প্রিয় ক্যাম্পাস।’
এমন সময়ই গাড়ি এসে থামলো। ঘাড় ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই চাঁদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে এলো। আষাঢ় তার সামনে দাঁড়িয়ে। যেন হাজার বছরের অপেক্ষা আজ সমাপ্ত হলো। আজ তাদের মাঝে না আছে কোনো দ্বিধা, না আছে কোনো সংশয়। চাঁদ আজ সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারে, ‘এই মানুষটা শুধু আমার। তার উপর সম্পূর্ন অধিকার শুধুই আমার।’
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। প্রকৃতি আজ স্নিগ্ধ। আশেপাশে লোকজন নেই। নির্জন হয়ে আছে সব। হাতের ব্যাগ ফেলে আষাঢ়ের দিকে ছুটে গেল চাঁদ। ঝাপটিয়ে ধরে বুকের গহীনে মিশে রইল। গত চারবছরের শতশত অনুভূতিরা যেন আজ পাখা মেলল। আষাঢ়ের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে মিশে চোখ বুজে ফিসফিস করে বলল,
‘ ভালোবাসি আষাঢ়।’
মূহুর্তেই আষাঢ়ের চোখমুখের উৎফুল্লতা আরো বেড়ে গেল। চাঁদকে বুকের গভীরে জড়িয়ে নিলো। কণ্ঠে মুগ্ধতা জড়িয়ে বলল,
‘ ভালোবাসি আমার অমূল্য চাঁদ।’
বুকে মাথা রেখেই চাঁদ বলল,
‘ কথা দিয়েছিলাম, এবার বাড়ি ফিরে সব দুরত্ব মিটিয়ে নিবো। নতুন করে সব শুরু করবো। চারবছর আগে যা আমার কারণে অগোছালো এলোমেলো হয়েছিলো তা গুছিয়ে নিবো। আপনার সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব আঁধার কাটিয়ে, সুন্দর ভোরের আলোয় সাজাবো। সেদিন আপনার কোনো দোষ ছিল না। সবটাই প্রমির নাটক ছিল, এমনকি রে/পের ব্যাপারটাও। এই ফোনে প্রমির স্বীকারোক্তির ভিডিও আছে। আজ থেকে আপনি মিথ্যা অন্যা/য়ের অনুতাপ থেকে মুক্ত আষাঢ়। আপনি স্বাধীন।’
আষাঢ় হতভম্ব, বিমূঢ়! তবে কি চাঁদ আগে থেকেই জানতো সব? দুপুরের দিকে প্রমির ম্যাসেজ পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিল আষাঢ়। স্পষ্ট ভাষায় প্রমি জানিয়েছে চাঁদের সাথে দেখা করে। তাদের সম্পর্কের একটা বিহিত করবে। একপ্রকার অফিস থেকে ছুটে বেরিয়েছে আষাঢ়।
চাঁদের দুগালে হাত রেখে বুক থেকে মাথা তুলল আষাঢ়। আষাঢ়ের চোখেমুখে এখনো হতভম্ব ছড়িয়ে। চাঁদ মিষ্টি হাসলো, বলল,
‘ কি ভেবেছিলেন? সত্যি জানালে ভুল বুঝবো আপনায়? উহু, আপনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কোনো দিন মেনে নিবো না। এমন হাজার প্রমি আসলেও আপনার থেকে আমাকে কিঞ্চিৎ দূরে সরাতে পারবে না। আপনি আমার। আমার অস্তিত্বের সবটা জুড়ে শুধুই আপনার।’
আষাঢ়ের অশ্রুসিক্ত চোখ। নিগূঢ় সুরে বলল,
‘ সত্যি তুমি অমূল্য। এই দারিদ্র বামনের ঘর আলো করা অমূল্য চাঁদ।’

___________________________

পৃথা ডিভোর্সের সকল কাজ সম্পূর্ণ করে আমেরিকা ফিরে গিয়েছে। পৃথা মন থেকে মানে, যেখানে সম্মান নেই, সেখানে সংসার হয় না কখনো। এই দেশে তার জন্য কোনো কিছু নেই আর। না আছে কোনো পিছুটান। দেশের মানুষ তিক্ত লাগে বড্ড। রুবেল নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করছে। শিকদার সাহেবের বাড়ি নিলামে উঠেছে। খুব শীঘ্রই ব্যবসাবাণিজ্য সকল কিছু হারিয়ে পথে বসবে। বিত্তশালী হওয়ার অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে প্রমি জেলে আছে। চাঁদের এ/ক্সিডেন্ট, এটেম টু মা/র্ডার কেসে।প্রমির বাবার টাকাপয়সা, রাজনৈতিক জোর কাজে লাগেনি। আষাঢ় বেশ শক্তপোক্ত কেস করেছে। ২০ বছর কারাবাসের রায় হয়েছে। মানুষ তার কর্ম দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করে, যেমন অতীতে করে তেমনটাই ভবিষ্যতে ভোগ করে।

_________________________

গভীর রাত। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। যার উজ্জ্বল আলো ভুবন ছুঁয়েছে। দূর উঁচু পাহাড়ে ঘেরা রিসোর্টের সুইমিংপুলে পা ভিজিয়ে আষাঢ়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছে চাঁদ। চারিদিকে গহীন অন্ধকার। মৃদু আলো জ্বলছে টিমটিম করে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে প্রেমিক যুগল মিশে আছে নিবিড়। হিম হাওয়া যেন মৃসুর তুলেছে। গুনগুন করে গান গাইছে। চারিদিকে প্রেম প্রহেলিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সময়টা যেন থমকে গেছে। সবকিছু যেন স্বর্গীয়। সবকিছু এত মনমুগ্ধকর কেন? ভালোবাসার মানুষটা পাশে আছে বলেই কি? হুম,হয়তো!
চাঁদ আষাঢ়ের বুকে মাথা রেখেই বলল,
‘ পাহাড়ের চূড়ায় ভেসে থাকা চাঁদ বেশি সুন্দর? নাকি ইটপাথরের আঁধার ঘেরা শহরে আলো ছড়ানো চাঁদ?’
আষাঢ় হাসলো। চাঁদের চিবুক উঁচিয়ে ঠোঁটে গভীর করে চুমু এঁকে দিলো। চাঁদের কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে গভীর, নিগূঢ় সুরে বলল,
‘ ওই কলঙ্কিত চাঁদ অর্থহীন। এইযে এই বামনের বুকে চাঁদ অমূল্য, মনোহর, স্নিগ্ধ, সুন্দর।’
চাঁদ লাজুক হাসলো। চোখ নামিয়ে নিলো। খানিকক্ষণ এভাবে কা/টলো। আষাঢ় ধীরে ধীরে আলতো করে চাঁদের চোখ, মুখ ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। অনুভূতিতে, ভালোলাগায় কেঁপে কেঁপে উঠছে চাঁদ। এতদিন দুজন এক সাথে, এখনো আষাঢ়ের স্পর্শ সেই প্রথমদিনের মতই চাঁদের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। অনুভূতিতে কাঁপে।
হ্ঠাৎ দুজনের চোখ মিলল। চাঁদ বিমূঢ়, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। আফসোসের সুরে বলল,
‘ আমার একটা ভুল আমাদের জীবন থেকে চারটা বছর ছিনিয়ে নিলো!’
আষাঢ় আদুরে হাতে চাঁদকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘মিলনের পেছনে যদি কোনো উদ্দেশ্য না থাকে, সেই মিলন পরিপূর্ণ হয় কিকরে? এইযে প্রেম, বিচ্ছেদ আবার প্রেম অনন্তকালের প্রতিজ্ঞা এটাই তো ভালোবাসার গভীরতা। কথা দিলাম আর কোনোদিন দূরে যেতে দিবো না তোমায়।’
চাঁদ চোখ বুজে নিলো। তার শখের পুরুষের বুকে স্বর্গীয় সুখটাকে গভীরভাবে অনুভব করলো।

(সমাপ্ত)

সারসংক্ষেপ : ‘বামনের ঘরে চাঁদ’ মূলত একজন বিত্তশালী ঘরের একরোখা জেদি মেয়ে চাঁদকে ঘিরে।কোনো এক বর্ষণের দিনে, চাঁদ তার শখের পুরুষের জন্য নিজের আরাম-আয়েশের বিলাসী জীবন পায়ে ঠেলে দারিদ্র আষাঢ়ের ঘরে এসে উঠে। নানা ঝামেলার মধ্যে দিয়ে দুজন দুজনার লিখিত হয়। কিন্তু এত সহজে কি দ্বিধার দেয়াল মাড়ানো যায়? নানারকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব, তারপর এক দীর্ঘসময়ের অপেক্ষা, পরিস্থিতি পাল্টায়, মান অভিমান গাঢ় হয়। দুরত্বে দেয়াল মাড়িয়ে দুজন কি আদৌ এক হয়?

লেখিকার কথা: সবাইকে অনেক অনেক ভালোবাসা আর ধন্যবাদ। এত ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। ‘বামনের ঘরে চাঁদ’ লিখতে গিয়ে নানারকম সমস্যায় পড়েছি। রাইটিং ব্লক, ব্যাক্তিগত সমস্যা আরো নানারকম ব্যস্ততা। সবাইকে ধন্যবাদ এতটা সাপোর্ট আর ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য। ভালোবাসা❤️

চেক করা হয়নি, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here