বামনের ঘরে চাঁদ পর্ব ২৭

0
776

বামনের ঘরে চাঁদ

সাজিয়ানা মুনির

২৭.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

কাঠফাটা রোদ, বাহিরে প্রচণ্ড গরম। দুপুর মাড়িয়ে বিকালের শুরু, টিউশনি পড়িয়ে সবেই হলে ফিরেছে চাঁদ। গোসল সেরে চায়ের কাপ হাতে খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। চারিদিকে উত্তপ্ত গরমে অতিষ্ঠ সবাই। কিন্তু কিছু মানুষ ব্যতিক্রম আছে, যাদের চায়ের তৃষ্ণার সামনে এমন হাজারো গরম হার মানে। চাঁদও তাদের একজন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সারাবছর তিনবেলা চা চাই। চা ছাড়া যেন চলেই না তার। আগে এই অভ্যাস তার ছিল না। হলে উঠার পর বাজে ভাবে এই অভ্যাসে আসক্ত হয়েছে। পুরুষ মানুষ যেমন সিগারেট জ্বা/লিয়ে টেনশন কমায়, তেমনি চাঁদ চা খেয়ে টেনশন কমায়। হলে উঠার পর প্রথমে পড়াশোনা, টিউশন, মাসের খরচা সবমিলিয়ে যখন চিন্তায় মাথাব্যথা করতো তার, তখন চা খেয়ে শান্ত করতো। কিন্তু ধীরেধীরে এমন ভাবে রপ্ত হয়েছে যে, এখন তিনবেলা চা খাওয়া তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাহিরে তাকালো সে, কথাকুঞ্জে মেয়েদের আনাগোনা। হলে জুনিয়র উঠেছে। নতুন অজানা অনেক মুখ। এখানে বসে অনেক সন্ধ্যা, বিকেল পাড় করেছে। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে কত রাত কথাকুঞ্জের বেঞ্চে বসে গভীর ধ্যানে পাড় করেছে। স্মিত হাসলো চাঁদ। নতুন আসবে পুরাতন বিদায় হবে এটাই তো দুনিয়ার নিয়ম। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে, ফোনের ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকল। ফোন স্ক্রল করতেই, চোখের সামনে একটা নিউজ আটকালো। হেডলাইনে দেওয়া আছে, ‘ভণ্ড পীরের পর্দা ফাঁস’। ছবিতে শিকদার সাহেবের পীরকে দেখা যাচ্ছে। লিংক ক্লিক করে বিস্তারিত পড়তেই জানলো, ভণ্ডামি, অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ, সন্ত্রা/সী, নারী নি/র্যাতন, রে/প তার বিরুদ্ধে আরো নানারকম অভিযোগ। তার পীরশালায় ঘটা নানারকম অপক/র্মের ফুটেজ ফাঁস হয়েছে। যার সমর্থন,
সহায়তার পেছনে বড়সড় লোকেদের হাত আছে যার মধ্যে শিকদার সাহেবের নাম সবার উপরে। দুজনের একত্রে বিভিন্ন জায়াগার ছবি ফাঁস হয়েছে। সাথে রুবেলের নামটাও উঠেছে। ঘন্টা দুএকের ভেতরে হাজার হাজার লাইক কমেন্ট। শিকদার সাহেব এসব অপ/কর্মে জড়িত না থাকলেও, পীরকে প্রভুর আসনে বসিয়েছে। তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তার এই অতিভক্তি তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কে করেছে? যে করেছে বেশ ভালো করেছে! এই অপকর্মের রাজ্যের পতন হওয়া জরুরী ছিলো।
হ্ঠাৎ চাঁদের মাথার টনক নড়ে উঠলো। এসব কে করেছে সে জানে। চোখ বুজে ফোঁস করে হতাশার নিশ্বাস ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,’আষাঢ়!’

পীরের বেশ বড়সড় বিত্তশালী মানুষজনের সাথে ওঠাবসা। তাদের মধ্যে অনেকে রাজনীতি, চিত্রজগতের সাথে জড়িত। তাদের নাম এভাবে এমন বাজে একটা স্ক্যান্ডালে সামনে এসেছে, নিশ্চয়ই হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবে না তারা। যে করেছে খুঁজে বের করে, বদলা নিতে চাইবে। তড়িঘড়ি করে আষাঢ়ের নাম্বারে ফোন করল। ফোন রিসিভ হতেই ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি এটা কি করেছেন? জানেন এর ফল কি হতে পারে? এতক্ষণে বোধহয় ওরা খবর পেয়ে গেছে। আপনাকে খুঁজতে শুরু করেছে। এসব করার আগে একবার মায়ের কথা বিজনেসের কথা ভাববেন না? মাত্র সব ঠিক হয়েছে। যদি ওরা আপনাকে বা মাকে কিছু করে! পোস্ট প্ল্যান কি আপনার? হ্যালো! আষাঢ়, আপনি শুনছেন?’
অপর পাশ হতে আষাঢ়ের অসার আওয়াজ,
‘ দুইদিন আগে আইমানের সাথে দেখা করেছিলে?’

আবারও হতাশ নিশ্বাস ফেলল চাঁদ। সে বলছে কি? আর তাকে উত্তর দিচ্ছে কি! এতবড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে এমন গাছাড়া হয়ে কেউ কি করে থাকে। চিন্তায় মাথা ফাটছে। রাগ চেপে শান্ত কণ্ঠে বলল সে,
‘ আমার উপর নজর রাখছেন?’
‘ রাখতে হচ্ছে, চারিদিকে কুকুরদের মাঝে আমার বউ একা আছে। নজর রাখবো না?’
‘ গত চার বছর যাবৎ আমি একাই থাকছি, এখন অবধি কিছু হয়নি।’
‘ সামনে কিছু ঘটবে না, এই অনিশ্চিত মন ভুলানো কথায় আমি ক্ষান্ত থাকতে পারছি না।ওই শালা বেয়াদবকে কেন ডেকেছিলে?’
‘ আপনি কি ফাইজলামো করার মুডে আছেন? ‘
অপর পাশ হতে আষাঢ়ের অকপট আওয়াজ,
‘ আমি সিরিয়াস চাঁদ। ওই বেয়াদবটা কেন এসেছিলো?’
চাঁদ বেশ ভালো করে জানে উত্তর না জেনে আষাঢ় ক্ষান্ত হবে না। কথা না বাড়িয়ে বলল,
‘ আমার রুমমেট তটিনীর বয়ফ্রেন্ড উনার বোনের বাড়িতে থাকে, কয়েক মাস যাবৎ বেকার। আমার জেদ বেচারার উপর ঢালছে এই মাসে সকল বকেয়া মিটিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেছে।বেচারা বেকার সব পাওনা মেটানোর সামর্থ্য আপাতত নেই, তাই উনাকে ডেকে সমাধান করছিলাম।’
‘ আমাকেও বললে পারতে।’
চাঁদের রাগ চাপা আওয়াজ,
‘ আচ্ছা, তারপর! কি হতো? আরেক রাউন্ড মা/রামা/রি? আমি মাঝে রেফারি হয়ে বাঁশি ফু দিতাম!’
‘ রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘ কারণ আপনি রাগাচ্ছেন! এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে আপনি কি করে ক্ষান্ত আছেন? কোনো পোস্ট প্ল্যান নেই? যদি ওরা আপনার কোনো ক্ষতি করে!’
আষাঢ় ঠোঁট মেলে মৃদু হাসলো। বলল,
‘ তোমার চিন্তা হচ্ছে?’
চাঁদের সহজ স্বীকারোক্তি,
‘ হ্যাঁ হচ্ছে। এমনটা কেন করলেন আষাঢ়? ‘
আষাঢ়ের নিমিষ আওয়াজ,
‘ কারণ ওরা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, শা/স্তি পাওয়াটা জরুরী ছিলো!’
আচমকা কথার ঝোঁকে বলে ফেলল চাঁদ,
‘ আপনিও তো কষ্ট দিয়েছিলেন!’
‘ হ্যাঁ, মানছি। যার শা/স্তি চারবছর যাবৎ ভোগ করছি।’
হ্ঠাৎ পিনপতন নীরবতা। দুজনে চুপচাপ। চাঁদ একটু চুপ থেকে আবারও বলল,
‘ আমার চিন্তা হচ্ছে!’
আষাঢ়ের আশ্বস্ত আওয়াজে বলল,
‘ কাউকে কিছু হতে দিবো না আমি।’
‘ আর আপনি?’
‘ ভয় নেই, আমার কিছু হবে না চাঁদ।’
চাঁদ উত্তর দিলো না। নিশ্চুপ হয়ে অপর পাশের মানুষটার নিশ্বাস অনুভব করলো।

‘ভণ্ড পীরের পর্দা ফাঁস’ বর্তমানে সারাদেশে খবরটা বেশ ভাইরাল। সবার জন্য আহামরি কোনো বিষয় না হলেও, পৃথার জীবনে বেশ বড়সড় একটা সুযোগ এনেছে। এই অনিচ্ছাকৃত, মৃ/ত সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাবার একটা রাস্তা পেয়েছে। ভণ্ড পীরের স্ক্যান্ডালে শিকদার সাহেব বেশ বাজে চাবে ফেঁসেছে। তার ফাঁসার কারণে রাজনৈতিক দলের নাম খারাপ হচ্ছে। জনগণ বহিষ্কার করার স্লোগান দিচ্ছে, ফেসবুকে বেশ প্রতিবাদ চলছে। সেই কারণে শিকদার সাহেবকে দল থেকে বহিস্কার করেছে। কথায় আছে পাপ বাপকে ছাড়ে না। মানুষের সামান্য পাপও সুদেআসলে একদিন বেশ বড় প্রায়শ্চিত্ত হয়ে দাঁড়ায়। অপ/রাধ যার সাথেই হোক, উপরওয়ালা কাউকে ছেড়ে দেয় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠিক সেই অপ/রাধের ফল ভোগ করায়। পৃথার জীবনে এই সম্পর্কটা কাটার মত বেঁধে আছে। না গিলতে পারছে, না উপরে ফেলতে পারছে। পারিবারিক কারণে তাকে না চাইলেও এই সম্পর্কের বাঁধনে আটকা পড়ে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু রুবেল থেকে ডিভোর্স নিতে এখন আর কোনো বাঁধা নেই পৃথার। রাজনৈতিক কিংবা ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে এখন তাকে আর এই মৃ/ত সম্পর্কের বোজা টানতে হবে না। বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, এক্ষুনি ফ্লাইট ধরে বাবা বাংলাদেশে আসতে বলছে। শিকদার সাহেবের অখ্যাতি পরিবারের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক রাখতে চায় না তারা। তড়িঘড়ি দেশে ফিরে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করতে বলছে। পৃথা আগামীকালকের ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসছে। ফোনে চাঁদের সাথে কথা হয়েছে। চাঁদ পৃথার জন্য বেশ খুশি। যেখানে নারীর সম্মান নেই, সেখানে বসতি গড়ার প্রয়োজন নেই।

কলেজের ক্লাস নিয়ে সবে মালা বেগম বেরিয়েছে। এ বয়সে এসে চাকরি করার বিষয়টি নিয়ে ছেলেমেয়ে দুইটার বেশ আপত্তি আছে। শরীরের কথা চিন্তা করে অনেক বার চাকরি ছাড়ার আর্জি করেছে। মালা বেগম তাদের আর্জি শুনেনি। কলেজে পড়ানো যেন তার র/ক্তের সাথে মিশে গেছে। এতবছরের চাকরি জীবন, অভ্যাস কি করে ছাড়ে? দুঃখ, টানাপোড়েনের জীবনের সঙ্গী ছিল যে! তাই ছেলেমেয়েদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, মৃ/ত্যুর আগ মুহূর্ত অবধি চাকরি ছাড়বে না সে। আজকাল মালা বেগম দুশ্চিন্তায় দিন পাড় করছে। চারিদিকের হাজারো চিন্তা যেন তাকে ঘাপটি মে/রে ধরেছে। আষাঢ়ের তেমন কোনো বড়সড় ক্ষমতাবান আত্মীয় বা সংযোগ নেই। শূন্য থেকে একটু একটু করে আজ এতবড় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। এই দেশ ক্ষমতার ভাষায় চলে। যার ক্ষমতা নেই, তার কিছু নেই। বাড়িতে হু/মকি ধমকির নানারকম চিঠি ফোন আসছে আজকাল। যেনতেন হু/মকি নয়, আষাঢ়কে খু/ন করা, গুম করার হু/মকি। অবশ্য এসব শুনে আষাঢ়ও ক্ষান্ত হয়নি। আইন প্রশাসনের আশ্রয় নিয়েছে। থানায় জিডি করিয়েছে, আরো নানারকম কুটকাচালিতে দৌড়াদৌড়ি করছে। পীরের নিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা করছে। মালা বেগম হাজার বুঝিয়েছে। আষাঢ় শুনতে নারাজ! আষাঢ়ের ভাষ্যমতে, আজ চাঁদের সাথে এমন হয়েছে, দুদিন পর আরো দশজনের সাথে হবে। তাছাড়া ভণ্ড পীরের অপরা/ধের শেষ নেই। এদের ছেড়ে দিলে দুদিন পর এই দুনিয়ায় অন্যা/য়ের রাজত্ব চলবে। তাছাড়া ওই পীরকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত ক্ষো/ভ আছে। ক্ষো/ভটা যে চাঁদকে নিয়ে তা বুঝতে বাকি রইল না মালা বেগমের। তাই এর সুরাহা করতে চাঁদের কাছেই যাবে। একটা সময় সন্তান যখন বড় হয়ে যায়, তখন বাবা মায়ের আয়ত্তের বাহিরে চলে যায়। তখন কেবল তার ভালোবাসার মানুষই তাকে আয়ত্তে আনতে পারে। পীরের সাথে আষাঢ়ের ক্ষো/ভ চাঁদকে নিয়ে। যদি চাঁদ বুঝায় নিশ্চয়ই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না আষাঢ়! মানতে বাধ্য হবে। তাই আজ কলেজ শেষে চাঁদের সাথে পাশের রেস্তোরাঁয় দেখা করবে। আসতে বলেছে। ড্রাইভারকে আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। যেন আষাঢ় ঘুনাক্ষরে টের না পায়।

ঠিক দুইটায় চাঁদ কলেজ গেটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় জ্যামে আটকা পড়ায় একটু দেরি হয়ে গেছে। রাস্তার অপর পাশে মালা বেগমকে দেখে তার ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি এসে আটকায়। তড়িঘড়ি করে যেই রাস্তা পাড় হতে যায়, অমনি সামনে থেকে এক গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়। ভারী আওয়াজ! এক মূহুর্তেই থমকে যায় সব। চারিদিক যেন স্তব্ধ। গাড়ির ধাক্কায় রাস্তার অপর পাশে যেয়ে পড়ে চাঁদ। নাক মুখ মাথা থেকে অনর্গল র/ক্ত পড়ছে। কালো রাস্তাটা লাল টকটকে রক্/তে ভিজে। এক মুহূর্তেই যেন শেষ হয়ে গেল সব। মালা বেগম রাস্তার অপর পাশ হতে পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছে। চোখ ছোট ছোট হয়ে আসছে চাঁদের। অসার ব্যথাতুর শরীরটা ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ধীরেধীরে সবকিছু অন্ধকারে বিলীন হচ্ছে। নিকষ কালো রঙে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে সব।

চলবে…….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here