প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ১৬

0
114

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৬

সুরাইয়া রুমে অনেক্ষণ অপেক্ষা করছে আশরাফের জন্য। ভেতরে ভেতরে চিন্তা হচ্ছে। ভাবছে কী হচ্ছে ও ঘরে, এতক্ষণ কেন লাগছে! যখন দেখলো আশরাফ আসছে না তখন সে রুম থেকে বেরিয়ে শাশুড়ির রুমের সামনে এসে বলে,“আপনারা কি চা খাবেন? চা করে দেব দুজনকে দুইকাপ?

ময়না বেগম গম্ভীরস্বরে বলে ওঠে,“ দুই কাপ কেন? তিনজনের জন্য তিন কাপ নিয়ে এসো। গলা শুকিয়ে গেছে। ”

সুরাইয়া কী বলবে বুঝে পায় না। সে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে ময়না বেগম আবার বলে ওঠে,“ কী হলো? রোবট হয়ে গেলে নাকি? শোনো শাশুড়িকে দজ্জা*ল টাইপের হতে হয় নাহলে এই যে তোমরা ছেলের বউরা হাতির পায়ের মতো পাড়া দিয়ে পিষে ফেলবে। তুমি ভেবো না আমার ওপর ছড়ি ঘুরাতে চাইবে আর আমিও তা মেনে নেব। আমি যা বলব সেটাই শেষ কথা এই সংসারে।”

সুরাইয়া হ্যাঁসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাবে তখন ময়না বেগম বলে,“তবে ভালোও বাসতে পারি এসবের সাথে।”

পা থেমে যায় সুরাইয়ার। ‘ভালোবাসা’ শব্দটা কানে যেতেই সুরাইয়া যেন এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে ময়না বেগমের দিকে তাকায়৷ ভাবতে থাকে এতদিনে কি তবে তার ভাগ্যে শাশুড়ির ভালোবাসা নামক না পাওয়া জিনিসটা আসতে চলেছে!

নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। ঠিক শুনলো সে! সুরাইয়া নিজেকে সামলে নেয়। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে সোজা রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
___

এই ক’দিনে হৃদিতা নিজেকে বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়েছে। নাহার বেগম আর রাসেল সাহেব মিলে মেয়েকে একেবারে বাড়িতে নিয়ে চলে এসেছেন। নাহার বেগমের একটাই কথা তিনি মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারেন না। পুরো বাড়িটা হৃদিতাকে ছাড়া কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হৃদিতারও তো আর এখন বাহিরে থাকার প্রয়োজন নেই। রাসেল সাহেব ঠিক করেছেন মেয়েকে এবার আর কোনোকিছুতে জড়াতে দেবেন না। একটা ভালো ছেলে আর ভালো পরিবার পেলেই মেয়েকে বিয়ে দেবেন তিনি। অবশ্যই ছেলের বাড়ি তার বাড়ির কাছাকাছি হতে হবে, নইলে মেয়েকে ক’দিন পরপর আসতে বলবেন কী করে?

নাহার বেগম ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন। নিজের আর রাসেল সাহেবের জামাকাপড়গুলো ব্যাগে নেয়া হলে ব্যাগটা এক পাশে রেখে হৃদিতার রুমের দিকে চলে যান। হৃদিতা তখন বন্ধুদের সাথে গ্রুপ কলে ব্যস্ত। অনেকদিন সবার সাথে একসাথে কথা হয় না। ওই যে সেই অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে তারপর একসাথে দেখা তো দূরের কথা মুঠোফোনে যোগাযোগটুকুও হয়ে ওঠেনি।

নাহার বেগম মেয়ের ঘরের দরজায় নক করতেই হৃদিতা সেদিকে তাকায়। মাকে দেখে ফোনে বলে ওঠে,“অ্যাই তোরা কথা বল, আমি একটু কলটা কাটছি। আম্মু এসেছে।”

কল কেটে দুই পা ভাজ করে বিছানার মাঝে বসে। নাহার বেগম এদিক ওদিক হৃদিতার ব্যাগ খুঁজতে থাকেন কিন্তু পান না। অতঃপর বিছানার এক পাশে এসে বসে। মেয়েকে বলেন,

“ কী হলো? ব্যাগ গুছিয়ে নিবি কখন? বের হতে হবে তো, মা!”
হৃদিতা মায়ের দিকে এগিয়ে এসে কোলে মাথা রেখে শোয়। নাহার বেগম হৃদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,“ আসরিফ কিন্তু রাগ করবে। কাল ওর গায়ে হলুদ আজ তো তাড়াতাড়ি যেতেই হবে।”

হৃদিতা চোখ বন্ধ করে নেয়। বলে,“ তোমার বোনের ছেলের রাগ তো নাকের ডগায় এসেই থাকে। সে যাক গে আমার বেশি সময় লাগবে না। তুমি শুধু বল কোন কোন ড্রেসগুলো নিব।”
“সেগুলোও আমার ঠিক করে দিতে হবে?”
“জি ম্যাম। আপনি যেগুলো ঠিক করে দেবেন, আমি ওগুলোই নেব। ওখানে ওগুলোই পরব।”

নাহার বেগম মুচকি হেসে হৃদিতার মাথা নামিয়ে রেখে আলমারির দিকে উঠে যায়। দেখে দেখে হলুদ, লাল আর সবুজ তিনটা রঙের তিনটা শাড়ি বের করে বিছানায় রাখেন। সাদা, হালকা গোলাপি আর কালো রঙের তিনটা ড্রেস বের করে দেন।

হৃদিতার দিকে এগিয়ে এসে বলেন,“এগুলো অনুষ্ঠানগুলোতে বেছে বেছে পরবি আর তোর খালামনি বলেছে তোকে কয়েকদিন রেখে দেবে। থাকবি?”

হৃদিতা চুলে খোপা করতে করতে বলে,“আমি তো ফ্রি আছি। আর কোনো ঝামেলা নেই। থাকব, সমস্যা নেই। তাছাড়া নতুন ভাবি আসবে, তার সাথে সময় কাটাতে ভালোই লাগবে।”
“তাহলে আরও নরম কাপড়ের জামা দিয়ে দেই। ”
“ঠিক আছে।”

বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে দিতে বিকেল হয়ে যায়। দুই ঘণ্টার পথ। ট্রেনে যেতে হবে। রেলস্টেশনটা খুব বেশি দূরে নয়। রাসেল সাহেব একটা গাড়ি ডেকে এনেছেন। নিজেদের ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলে দিয়ে নাহার বেগম এবং হৃদিতাকে ডাক দেন। নাহার বেগম বাহিরে এসে দাঁড়ায়। হৃদিতা সুরাইয়াদের বাড়িতে ঢুকে ময়না বেগম এবং সুরাইয়াকে বলে বেরিয়ে আসে।

তিনজন রওয়ানা দিয়ে দেয়। স্টেশনে পৌঁছানোর পনেরো মিনিটের মাথায় ট্রেনও চলে আসে। রাসেল সাহেব একজন কুলিকে ডেকে ব্যাগগুলো নিজেদের সিটের কাছে নিয়ে আসেন। তিনজনের সিট পাশাপাশিই পড়েছে৷ রাসেল সাহেব কুলিকে টাকা দিয়ে বিদায় দিয়ে নিজেদের সিটে এসে বসেন। নাহার বেগম এং রাসেল সাহেবের সিট পাশাপাশি। হৃদিতার সিট তাদের পিছনেই। রাসেল সাহেব হৃদিতাকে তার মায়ের সাথে বসতে বললে হৃদিতা পিছনেই জানালার পাশে বসবে বলে জানায়৷ রাসেল সাহেবও জোর করেন না।

তিনি নিজের সিটে বসে হৃদিতাকে ডেকে বলেন,“কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো, হৃদি?”

হৃদিতা কান থেকে ইয়ারফোন নামিয়ে বলে,“বাবা, কিছু বললে?”

নাহার বেগম বলে ওঠে,“অসুবিধা হচ্ছে?”
“না, কোনো অসুবিধা নেই।”

“কোনো অসুবিধা মনে হলে আমাকে ডেকো।” বলেই রাসেল সাহেব সিটে হেলান দিলেন।

হৃদিতা আবার কানে ইয়ারফোন গুজে নেয়। ট্রেন চলতে শুরু করে। একের পর এক গান বেজে চলেছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে থাকে রবীন্দ্রনাথের কলমে ফুটে ওঠা গানটা।

আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে
নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো
আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনাবালি তীর ধরে
বহুদূর বহুদূর হেঁটে এসেছো
আমি কখনও যাইনি জলে, কখনও ভাসিনি নীলে
কখনও রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাংচিলে
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়
বলো নেবে তো আমায়??

বার বার হাতে তুড়ি মেরে ‘এই যে শুনছেন? এই যে শুনছেন?’ বলে যাচ্ছে বছর আটাশ-ত্রিশের সুঠাম দেহের এক শ্যামবর্ণের পুরুষ। হৃদিতা কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ খুলে তাকায়। ডানে তাকাতেই অপরিচিত কোনো এক পুরুষকে দেখতে পেয়ে সোজা হয়ে বসে।

ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,“জি?”
ছেলেটা ব্যাগের দিকে ইশারা করে বলে,“এটা ওপরে রাখলে আমি আমার সিটে বসতে পারতাম।”

হৃদিতা পাশের সিটে নিজের ব্যাগটা দেখে জিহ্বায় কামড় খায়। অসহায় ভঙ্গিতে বলে,“এটা আপনার সিট? স্যরি, আসলে এটা রাখার কথা মনে ছিল না আমার। আমি এখনই রেখে দিচ্ছি।”

হৃদিতা উঠবে তখনই ছেলেটা বলে ওঠে,“আপনি নাগালে পাবেন না হয়তো। আমি রেখে দেব?”

হৃদিতা একবার ওপরের তাকের দিকে তাকিয়ে আবার ছেলেটার দিকে তাকায় আর বলে,“ তাহলে উপকার হতো।”

ব্যাগ রেখে পাশে বসতেই হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,“ধন্যবাদ..”
“ অভ্র। আমার নাম অভ্র।”
হৃদিতা আবার বলে, “ধন্যবাদ, অভ্র সাহেব।”

অভ্র হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নেয়। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে ফোন দেয়। রিং বাজছে অথচ কেউ কল রিসিভ করছে না। একে একে তিনবার কল দিতে তবেই রিসিভ হলো।

শক্ত গলায় বলে উঠল,“ তোর বোনকে….”
পাশে তাকিয়ে হৃদিতার কুচকানো ভ্রু দেখে নিজেকে সামলে নেয় অভ্র। গলা খাকাড়ি দিয়ে আবার বলে,“আমি ট্রেনে উঠেছি। নিজেই এত জোর জবরদস্তি করে এখন তোরই কোনো খোঁজ খবর নাই?”

ওপাশ থেকে পুরুষালি গলায় কেউ কিছু একটা বলল, শুনতে পেল না হৃদিতা। সেদিকে নজর না দিয়ে বাহিরের দিকে তাকাল সে। অভ্রও কথা শেষ করে হৃদিতাকে ডাকল,“এই যে..”

হৃদিতা তাকাল না। দ্বিতীয়বার ডাকতেই হৃদিতা অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললে,“আমাকে ডাকছেন?”

অভ্র মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“জি।”
“এই যে, এই যে কেন করছেন? আমার নাম হৃদিতা।”
“আপনি তো আপনার নাম বলেননি।”
“আপনি জিজ্ঞেসও করেননি।”
“আচ্ছা বাদ দিন। আপনার কাছে পানি হবে?”

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here