প্রস্থান — ৪র্থ পর্ব।

0
1107

প্রস্থান — ৪র্থ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

সুব্রত ভীষণ উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি এখানে কেন?”
সুব্রতর চোখ দেখে যতটা ভয়ে কুকড়ে গিয়েছিল চিত্রা, এবার গলার আওয়াজ শুনে তাঁর থেকেও বেশি হতচকিত হলো। তাঁর দৃষ্টি কেমন আবছায়া হতে লাগল ক্রমশ; যেন আকাশে ঘন মেঘ করেছে, অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিকটা! সে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকল। ছবিটা এখনো হাতেই আছে।
জবাব না পেয়ে যেন আরও ক্ষিপ্ত হলো সুব্রত। ছবিটার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে আবার বলল, “চুপ করে আছো কেন? বলো, এই ঘরে কী করছ তুমি?”
চিত্রা তবুও নির্বাক। কথা বলা তো দূরে থাক, এখন যেন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও তাঁর শরীর থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে।
“কী হলো? কথা বলছ না কেন?” এবার চিৎকার করে উঠল সুব্রত। তাঁর চোখ জোড়া ইতোমধ্যে রক্তলাল হয়ে উঠেছে। ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে!
চিত্রা ভয়ার্ত চোখে একপলক দেখে নিলো সুব্রতকে। সাদা চোখ জোড়া কেমন লাল হয়ে উঠেছে, যেন রক্ত ঝরছে! ভয়ে আরও সিটিয়ে গেল সে। কাঁপতে লাগল এবার।
অধৈর্য হয়ে এগিয়ে গেল সুব্রত। তাঁর ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে দিতে। কিন্তু কোথাও যেন আটকাচ্ছে। মারার জন্য হাত উঠছে না। তবে সে ছবিটা ছিনিয়ে নিলো চট করে। ওদিকে ছবি হাতছাড়া হতেই আরও একদফা কেঁপে উঠল চিত্রা। তাঁর সর্বাঙ্গ দুর্বল লাগছে। সুব্রত ছবিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে আগের মতো আক্রোশে গজগজ করে বলল, “তোমার সাহস হলো কীভাবে এই ছবিতে হাত দেওয়ার? কে দিলো তোমাকে এত সাহস? তুমি জানো, এর জন্য আমি তোমার কী অবস্থা করতে পারি? আমি আজ পর্যন্ত কাউকে এই ঘরে ঢুকতে দিইনি। আর তুমি দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে গেছ। এত স্পর্ধা তোমার? ইচ্ছে করছে তোমাকে..।”
সুব্রতর কথা শেষ হওয়ার আগেই অকস্মাৎ ফুপিয়ে কেঁদে দিলো চিত্রা৷ মুখটা চেপে ধরল এক হাতে। আর অন্যহাতে সুব্রতকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। বেডরুম থেকে বেরোতেই একজনের গায়ের সাথে ধাক্কা খেলো। সে অশ্রুভেজা চোখে দেখল, মানুষটা ফিরোজ। কাঁদতে কাঁদতে ঝাপটে ধরল ওকে। বুকে মুখ লুকিয়ে হু হু করে অশ্রু ঝরাতে লাগল। অশ্রুর স্রোত এমন যে, মনে হচ্ছে বিশাল পাহাড়ের ফেটে ঝরনার ন্যায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।

শুধু কান্না নয়, চিত্রার শরীরের কাঁপুনিটাও টের পেলো ফিরোজ। আকাশ থেকে পড়ল সে! কী হলো চিত্রার? এভাবে কাঁদছে কেন মেয়েটা? সে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন ছুড়তে লাগল। “কী হয়েছে চিত্রা? কাঁদছ কেন তুমি? আর তুমি এদিকে কী করছিলে? ও কিছু করেছে তোমার সাথে? তোমার গায়ে হাত দেয়নি তো?” বলতে বলতে ক্রোধের আগুনে জ্বলতে লাগল ফিরোজ। ফুঁসতে লাগল।

ছবিটা ড্রয়ারে রেখে ‘স্টাডি রুম’ তালা দিলো সুব্রত। বেশ কিছুটা দূরে চলে যাওয়ায় পর হঠাৎই তাঁর মনে পড়ে, তাড়াহুড়োয় ঘর কিংবা স্টাডি রুম, কোনোটাই তালা দেয়নি সে। তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছে। এখনো রাগে তাঁর শরীর হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন শ্বাস নিতে হচ্ছে। অনেকদিন পর এতটা ক্ষুব্ধ হলো কারোর উপর। এই একটা মাত্র ঘর, যেটা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে সে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই ঘর তাকে ভীষণভাবে সঙ্গ দিয়েছিল। রুশার মৃত্যুর পর আরও গভীরভাবে এই ঘরের সাথে জড়িয়েছে সে। তাঁর একান্ত আপন তিনজন ব্যক্তির সমস্ত স্মৃতি এখানে আছে। এই ঘরকে ঘিরেই তাঁর জীবন। এই ঘরের জিনিসপত্রের মূল্য তাঁর নিজের জীবনের থেকেও বেশি। এই ঘরের প্রতিটি জিনিসপত্র কখনো তাকে কাঁদিয়েছে, কখনো আবার তাকে শান্ত করেছে, আরাম দিয়েছে। সে তীব্রভাবে যখন ভেঙে যায়, যখন জীবনকে অর্থহীন মনে হয়, আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না, তখন হঠাৎ করে মনে হয় এই ঘরের জিনিসপত্র তাকে হৃদয়ের সাথে মিশে আছে। এগুলোকে কিছুতেই একা করে চলে যেতে পারবে না সে। তখন বাঁচার শক্তি ফিরে পায় সে। ভালোবাসার মানুষগুলোর স্পর্শ অনুভব করে এই ঘরে এলেই।
ঘর পুরোপুরি ভাবে তালাবদ্ধ করে সামনে এগোতেই দেখল ফিরোজ, চিত্রা সহ বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে
একটা অল্প বয়সী মেয়ে চিত্রাকে পানি খাওয়াচ্ছে, আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে এক মুহূর্ত চিত্রাকে দেখে পাশ কাটাতে গেলে কাঁধে কারোর শক্ত হাত পড়তেই থেমে গেল। পিছনে তাকিয়ে দেখল, ফিরোজ নাক-মুখ খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে।
সুব্রতর কাঁধের শার্টটুকু মুঠো করে ফিরোজ বলল, “তুই কী করেছিস ওর সাথে?”
জবাব না দিয়ে সুব্রত হুকুমের সুরে বলল, “হাত সরা।”
হাত সরাল না ফিরোজ, চোখে চোখ রেখে বলল, “তুই যদি ভেবে থাকিস, চিত্রার সাথে তেমন আচরণ করবি, যেমন আচরণ নিজের স্ত্রীর সাথে করেছিলি, তাহলে ভুল ভাবছিস! চিত্রার দিকে চোখ তুলে তাকালে তোকে আমি আস্ত রাখব না বলে দিলাম।”
“হাত সরা।” চেঁচিয়ে ওঠে নিজেই এবার ফিরোজের হাত সরিয়ে দিলো সুব্রত। এরপর কড়া গলায় শাসাল। “তোর হবু বউকে বলে দিস, দ্বিতীয়বার আর যেন আমার ঘরে পা না রাখে।”
ফিরোজের জবাবের অপেক্ষা না করে স্থান ত্যাগ করার জন্য অগ্রসর হলো সুব্রত। সিড়ির কাছে যাওয়ার আগে শুনলো ফিরোজের মায়ের কথা। তিনি বলছেন, “আজ আসুক তোর বাবা। আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়ব। হয় ও বাড়িতে থাকবে, নয় আমরা বাড়িতে থাকবো।”

চিত্রাকে শান্ত করে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো ফিরোজ। সোফায় বসে কিছুটা রাগ করেই বলল, “তোমাকে তো অনেকবার করে বলেছিলাম ওকে নিয়ে এত কৌতূহল দেখিও না। কেন গেলে ওই ঘরে?”
চিত্রা ভেজা গলায় বলল, “আমি তো জানতাম না ওটা উনার ঘর। ভেবেছিলাম তোমার ঘর, সেজন্য একটু দেখছিলাম।”
পাশ থেকে হ্যাপি বলল, “তুমি তো আমার সাথে ছিলে কনার ঘরে। কখন বেরিয়ে গেলে? আমি ফোনে কথা শেষ করে ঘরে এসে দেখি তুমি নেই। আজব ব্যাপার!”
চিত্রা বলল, “জানি না হঠাৎ কী হলো, আমি ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। ওই ঘরের দরজা খোলা দেখে ঢুকে গেলাম।”
“এই আজকেই প্রথম এবং আজকেই শেষ, বিয়ের পর আর এইরকম বেখেয়ালি হলে চলবে না। খুব সতর্ক থাকতে হবে। ওর কাছে কোনো মেয়েই নিরাপদ না। ও একটা আসামী। একটা খুনি ও।”
চিত্রার একবার বলতে ইচ্ছে করল, ‘ভিতরে একটা মেয়ের ছবি দেখেছি আমি। ওটাই কী উনার স্ত্রী? যদি হয়ে থাকে, তাহলে উনি এখন কোথায়?’ কিন্তু কী ভেবে যেন চুপ থাকল সে। মাথা নিচু করে বসে রইল।
সোফা ছেড়ে ওঠে, বড় একটা শ্বাস ফেলে ফিরোজ বলল, “তুমি কনার সাথে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। এরপর আমরা বেরোবো।”
চিত্রার আর শপিং করতে ইচ্ছে করল না। সব ইচ্ছে মরে গেছে। সে মুখটা মলিন করে, মৃদু কণ্ঠে বলল, “আজ আর কোথাও যাব না। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”
“কিন্তু..।”
“প্লিজ। জোর করো না আমায়। আমি এখন বাড়ি যাব।”
হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরোজ বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। চলো তোমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসি।”
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো চিত্রা। ফিরোজের গাড়িতে করে তাঁরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। যেতে যেতে সে হ্যাপিকে বারবার সতর্ক করল এটা বলে, কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার বিন্দুমাত্র যেন বাবা-মা জানতে না পারে। চিত্রা বলল বটে, কিন্তু হ্যাপির মুখ দেখে মনে হলো না এতবড় ঘটনা সে নিজের বাবা-মায়ের কাছে গোপন রাখতে পারবে। পুরো রাস্তাটাই সবাই মুখ ভার করে থাকল। ফিরোজের মধ্যেও কোনোরকম আগ্রহ দেখা গেল না চিত্রার মন ভালো করার। সে-ও নির্লিপ্ত!

রাতে খালেদ সাহেব বাড়িতে আসতেই দীপালী বেগম স্বামীকে পুরো ব্যাপারটা জানালেন। খুব শক্ত গলায় নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন, সুব্রত এই বাড়িতে থাকলে তিনি শীঘ্রই এই বাড়ি ত্যাগ করবেন। এইসব শুনে ভীষণ আহত হলেন খালেদ সাহেব। নিরুপায় হয়ে শুধু ভাবলেন তিনি। এমন অসহায়বোধ হওয়া তাঁর জন্য এই প্রথম নয়!

৬.
মানুষের হৃদয় যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন সে কিছু সময়ের জন্য নির্বোধ হয়ে যায়। উচিত-অনুচিত বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকে না। তখন মানুষ মনে করে, আবেগের প্ররোচনায় সে যে কর্ম করছে, কোনো না কোনোভাবে সেটা ঠিক। কেউ তাঁর ভাবনার বিরোধিতা করলে সে যেন তখন আরও উস্কে যায়। নিভে যাওয়া কয়লায় ফু দিলে যেমন আগুন জেগে ওঠে, তাঁর নির্বোধ মস্তিষ্ক তখন আরও জেগে ওঠে, অনুচিত কাজ করতে।
রশ্মির ইদানীং তা-ই হয়েছে। ইতোমধ্যে সে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। তাঁর কিছু সংখ্যক বন্ধুর ধারণা ছিল, কষ্টের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয় শুধুমাত্র নেশা করলেই। সুখবোধ হয়। সিগারেট দিয়েই শুরু করল সে। ইদানীং এই নেশা তাকে বড্ড পেয়ে বসেছে। সারাটাদিন ঘরে একা থাকে, রাতেও; আর সিগারেট টানে আপনমনে। লুকিয়েই কাজটি করতো প্রথমে দিকে, কিন্তু একদিন হঠাৎ মায়ের কাছে ধরা খেলো।
তখন সন্ধ্যে হয়েছিল কেবলমাত্র। মা ওভারটাইম এর জন্য তখনও বাড়িতে উপস্থিত হয়নি। কখন আসবে সে জানে না। তাঁর মনে হয়েছিল, ওইসব ওভারটাইম আসলে বাহানা। ওই লোকের সাথে সময় কাটানোর জন্যই এমন মিথ্যে বলেছিলেন তিনি। সেজন্য অনেকটা কষ্ট বুকে জমা হয়েছিল তাঁর! সিগারেটের ধোঁয়া যেন এক ধরনের এন্টিভাইরাস, আর কষ্ট ভয়াবহ এক ধরনের ভাইরাস, এরূপ একটা ধারণা নিয়েই বোধহয় ঘরের দরজা খোলা রেখেই সিগারেটের ধোঁয়া সেবন করছিল। ঘর অন্ধকার ছিল। কখন যে মা নিজের কাছে থাকা চাবিটা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে, তাঁর ঘরে এসে লাইটটা জ্বালিয়ে ছিল, সে টেরই পায়নি। যখন পেলো, সে শুধু দেখল সারা ঘরে সিগারেটের ধোঁয়া, আর সেই ধোঁয়া মধ্যেই তাঁর মায়ের মুখ ভেসে ওঠেছে। ভদ্রমহিলা বোধহয় খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিলেন; যেন কারোর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, এ জীবনে মেয়ের গায়ে হাত তুলবেন না তিনি। শাসন করার জন্যও না। সে শুধু দেখল, মা আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে ঘর ত্যাগ করলেন। সেদিন কীভাবে যেন ঈষৎ অপরাধবোধ হয়েছিল তাঁর। একবার ভেবেছিল, আর সিগারেট খাবে না। কিন্তু পরদিন সকালেই যখন চুপি চুপি মোড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়াল, তখন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখল সে! লোকটা সেই সাদা রঙের গাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মা-কে দেখে দরজাটা খুলে দিলো। আর তাঁর মা-ও যেন সাগ্রহে ঢুকে গেল গাড়ির ভিতরে। ব্যাস, ভিতরের কয়লাটা আবার আগুনে রূপ নিলো। রাগে, হিংসায় জর্জরিত হলো সে, জ্বলতে লাগল তাঁর সারা দেহ। তখন মনে হলো, এই জ্বালা মেটানোর জন্য এক্ষুণি সিগারেট প্রয়োজন। আস্তে আস্তে এই অবৈধ নেশা প্রয়োজন থেকে অভ্যাসে পরিণত হলো। মাঝে মাঝে তো তাঁর মনে হতো, মা আসলে অফিস করেন না। হয়তো তাঁর আরও একটি সংসার আছে, ওই লোকটার সাথে। সারাদিন সেখানে থাকেন। মাস শেষে যে টাকাটা বেতন হিসেবে দেখান, সেটা আসলে ওই লোকের দেওয়া। নেশায় বুধ হলে মা-কে নিয়ে আরও নোংরা চিন্তা তাঁর মাথায় আসে! সারারাত এইসবই চিন্তা করে সে। ঘুম হয় না। চোখের নিচে কালো রং হয়েছে। শ্যামলা চেহারার মুখটি মাঝে মাঝে ভয়ংকর দেখায়। আয়নার সম্মুখীন হপে নিজেই ঘাবড়ে যায়!

নিজের ডেস্কে বসে, মাথাটা দুই হাতের মাঝে লুকিয়ে শুয়ে আছেন রুমানা বেগম। মেয়ের কথাই ভাবছে সে। মেয়েটা তাঁর ধ্বংসের মুখে চলে গেছে। ফেরানোর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। কলিগের ডাকে তাঁর ভাবনা ভঙ্গ হলো। মাথা তুলে দেখলেন, পাশের ডেস্কের মিসেস আজিম তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। সে ব্যস্ত হয়ে আঁচল দিয়ে চোখ-মুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে মৃদু হাসল।
মিসেস আজিম বললেন, “কী ব্যাপার মিসেস রুমানা, এই অসময়ে মাথা ঝাঁকে শুয়ে আছেন যে? শরীর খারাপ?”
‘না’ সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে রুমানা বেগম বললেন, “সেরকম কোনো ব্যাপার না। ক্লান্ত লাগছিল, তাই একটু মাথাটা রেখেছিলাম টেবিলের উপর। তাতেই চোখ লেগে এসেছিল। আপনি কোথায় গেছিলেন?”
মিসেস আজিম চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “ম্যানেজার সাহেব ডেকেছিল। একটা জরুরি কাজ দিলো। কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে।” আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলেন, উপর মহলের কোনো কর্তা আছে কী না। না-ই দেখে তিনি চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ করে বললেন, “আসার সময় শুনলাম, আমাদের মজিবর স্যার ফোনে চেয়ারম্যান স্যারকে আমাদের ব্যাপারে কী যেন বলছেন।”
এটুকু শুনে ভুরু কুঁচকালেন রুমানা বেগম। মিসেস আজিম বলতে লাগলেন, “মনে হয় এই অফিসে আমাদের হায়াত আর বেশিদিন নেই। স্যার বলছিল, আমাদের নাকি কাজের গতি কমে গেছে। কাজ কম, সংসার নিয়েই নাকি আমরা বেশি চিন্তিত এখন। সেজন্য আমাদের ছাটাই করে কিছু ইয়াং লেডি কাজে নিবে।”
“তাই নাকি?” চমক খেলেন রুমানা বেগম। তিনি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন, মিসেস আজিম এর কথাটা যারাই শুনেছে, তাঁদের মতো মধ্য বয়স্ক মহিলারা বেশ নড়েচড়ে উঠেছে। একটা চাপা গুঞ্জনও হল রুমটাতে বিরাজমান হলো।
একজন খুব রাগ করে বলল, “ছাটাই করবে, বললেই হলো নাকি? এত বছর ধরে এদের এখানে কাজ করছি, তাঁর কোনো মূল্য নেই?”
আর একজন খুব ব্যথিত গলায় বলল, “ছাটাই করলেই বা আমাদের কী করার আছে? অফিস উনাদের তো ক্ষমতা উনাদের। আমরা তো সাধারন কর্মচারী। কাজের লোক এই অফিসের।”
মহিলাটার কথা শেষ হতেই রুমানা বেগম বললেন, “এই বয়সে চাকরি হারালে তো না খেয়ে মরতে হবে। এখন আর কে দিবে চাকরি?”
এই কথার প্রতিক্রিয়ায় একজন খুব ঠেস দিয়ে বলল, “আপনার আবার চিন্তা কী? চাকরি গেলে আমাদের যাবে। আপনি তো নিশ্চিন্ত।”
“কেন, উনি নিশ্চিন্ত হবেন কেন? আমাদের চাকরি চলে গেলে উনারটা বাঁচবে কীভাবে? উনি কী ইয়াং লেডি?” মিসেস আজিম বললেন।
“ওমা! আপনি জানেন না? উনার স্যারের সাথে যা ঢলাঢলি সম্পর্ক, তাতে উনার চাকরি যাবে বৈকি, বরং প্রমোশন হয়ে উপরে ওঠে যাবে।”
চাপা গুঞ্জনের মধ্যে থেকে কথাটা বেরিয়ে এলো। রুমানা বেগম ঠিক ধরতে পারলেন না ব্যক্তিটি কে।
মিসেস আজিম প্রতিবাদ করলেন, “কী বলছেন এইসব? আপনাদের মুখে কিছু আটকায় না দেখছি।”
“এখানে আটকানোর কী আছে শুনি? প্রায়ই দেখি স্যারের গাড়ি করে অফিসে আসে, আবার বাড়িতে যায়। এইসব তো আর এমনি এমনি না। আর আমরা বোকাও না।” হাসিনা নামের ৫০ বছরের এক মহিলা বললেন কথাটা।
রুমানা বেগম দেখলেন, উনার কথা শুনে উপস্থিত সবাই মিটমিট করে হাসছে আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। অপরাধে আর ঘৃণায় তাঁর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। দ্রুত জায়গাটা ত্যাগ করলেন তিনি। মিসেস আজিম তাঁর পিছনে পিছনে গেল।

একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালেন দুজনে। দক্ষিণের দেয়ালটা কাঁচের। এক দৃষ্টিতে রাস্তার গাড়িগুলোকে দেখতে লাগলেন রুমানা বেগম। মিসেস আজিমও গাড়ি দেখছিলেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তিনি বললেন, “কী হয়েছে বলুন তো? ক’দিন ধরেই দেখছি আপনি খুব মনমরা হয়ে অফিস করছেন।”
রুমানা বেগম কাতর গলায় বললেন, “মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ হয়ে জন্মিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। যদি কোনো জন্তু হয়ে জন্মাতাম, তাহলে হয়তো এত কষ্টে থাকতাম না।”
“কষ্টে না থাকলে তো সুখের মূল্য বোঝা যায় না। সেজন্যই খোদা সুখ-দুঃখ, দুটোই দিয়েছেন, যেন মানুষের কখনো মনে না হয়, কোনো একটা অর্থহীন।”
“আমার তো এখন নিজের জীবনটাকেই অর্থহীন মনে হচ্ছে। গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম, তবুও আজ মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকার আসলে কোনো অর্থ নেই। এতগুলোদিন অপ্রয়োজনে কাটালাম।”
“মানুষের যদি বেঁচে থাকার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে জন্মানোরও কোনো প্রয়োজন ছিল না। যখন জন্মেছি, তখন নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আজ না হোক কাল আপনি জীবনের অর্থ খুঁজে পাবেন।”
চোখের পানি মুছলেন রুমানা বেগম। মিসেস আজিম কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আপনি এদের কথায় এত কষ্ট পাচ্ছেন?”
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন রুমানা বেগম। বড় শ্বাস ফেলে বললেন, “এরা তো বাইরের লোক, সহজেই এদের উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু ঘরের লোক যখন চরিত্র নিয়ে সন্দেহের চোখে তাকায়, তখন কতটা কষ্ট হয় আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না। ওটা উপেক্ষা করা যায় না।”
“আপনি কি রশ্মির কথা বলছেন?”
মিসেস আজিমকে পুরো ব্যাপারটা বললেন রুমানা বেগম। “আমি নিশ্চিত মজিবর স্যার আর আমাকে একসাথে দেখেছ ও। আমার মনে হয় সেজন্য এমন আচরণ করছে। আমি আসলে ঠিক ওকে বুঝতে পারছি না। ও যে এতটা বখে যাবে, তা কল্পনা করিনি। এখন কী করব আমি? আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।”
“মাই গড!” বিস্ময়ে মিসেস আজিমের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তিনি ঠোঁট কামড়ে, ভীষণ গম্ভীর গলায় বললেন, “জানেন তো মিসেস রুমানা, যখন আপনি কাউকে বুঝতে চেষ্টা করবেন, তখন আপনি নিজের জীবনের মূল্য উপলদ্ধি করতে পারবেন, জীবনের অর্থ খুঁজে পাবেন। কারণ যখন আপনি কাউকে বুঝবেন, তখন দেখবেন তাঁর কষ্টটা আপনার কষ্টের থেকে কম নয়। বরং বেশিই মনে হবে। আপনার জীবনে যত সমস্যা আছে, তাঁর জীবনে এর থেকেও বেশি সমস্যা আছে। আপনি তখন বাঁচার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবেন। আমার বিশ্বাস, আপনি রশ্মিকে সময় দিলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। ওকে বুঝতে চেষ্টা করুন।”
“সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস করে যখন বাড়িতে ফিরি, তখন আর আমার শরীরে জোর থাকে না। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলে আর উঠতে পারি না। আপনি তো জানেন আমার হাপানি রোগ আছে। সারারাত ঘুম হয় না।”
মিসেস আজিম সহসা বিরক্তিমাখা গলায় বললেন, “আমি বুঝতে পারছি না মিস্টার মুজিবর আপনার পিছনে পড়ছে কেন। উনার স্ত্রী-সন্তান আছে। তবুও কেন উনি আপনার পিছনে পড়েছেন?”
রুমানা বেগম কান্না জড়ানো গলায় বললেন, “আমি জানি না। কিন্তু আমি তাকে উপেক্ষাও করতে পারছি না। আমার চাকরি থাকা না থাকা এখন পুরোটাই উনার হাতে। রোজ সকালে উনি আমার বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। উনার বাড়ি নাকি ওদিকেই। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করেন, তাই আমাকে গাড়িতে উঠতে অনুরোধ করেন। আমি প্রথম প্রথম মানা করলেও এখন ভয় করে। আমার চাকরি চলে গেলে আমার মেয়ের কী হবে? ও যে একেবারে আনাড়ি। যতদিন না ওর বিয়ে দিতে পারছি, ততদিন এভাবেই সবটা সহ্য করতে হবে।”
“আচ্ছা, উনি কি ইতোমধ্যে আপনাকে কোনো প্রস্তাব দিয়েছে?”
রুমানা বেগম দৃষ্টি ধারালো করে বললেন, “না। কিন্তু উনার তাকানো, উনার সঙ্গ কখনোই আমার কাছে শোভনীয় মনে হয়নি। আমার স্বামী না থাকার সুযোগ নিয়ে উনি এমনসব কথাবার্তা আমাকে বলেন, যেগুলো একটা জানোয়ারের পক্ষেই বলা সম্ভব। কুকুরের মতো জিব বের করে মেয়েদের দেখেন উনি। আমি প্রতিবাদ করতে পারি না। পেটের দায়ে, মেয়ের কথা চিন্তা করে।”
“আপনি এইসব নিজের মেয়েকে বলছেন না কেন?”
“কীভাবে বলব ওকে? ও আমাকে কতটা নীচ ভাববে, সেটা কল্পনা করলেই ভয়ে আমার জবান বন্ধ হয়ে যায়।”
“এখন যে খুব..।”
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন মিসেস আজিম। দাঁড়িয়ে থাকলেন চুপচাপ। রুমানা বেগমও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে কাজের জায়গায় ফিরে গেলেন।

৪র্থ পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=823759891902046&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here