প্রস্থান — ৩য় পর্ব।

0
1146

প্রস্থান — ৩য় পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৫.
বিয়ের আর বেশিদিন বাকি নেই। এর মধ্যে চিত্রা আর ফিরোজের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ফিরোজকে যতটা গম্ভীর চিত্রার মনে হয়েছিল প্রথমে, আদৌ সে ততটা গম্ভীর নয়। তাঁর মধ্যে রসবোধ বিদ্যমান আছে। তবে যেকোউ সেটা ধরতে পারে না। গত পনের-বিশ দিনের ফোনালাপে ফিরোজকে অনেকটাই পড়ে ফেলেছে সে। মানুষটা আসলে চাপা স্বভাবের। চিত্রার ভাই-বোনদের মতে, সরকারি কর্মকর্তারা এই স্বভাবটা চাকরিসূত্রে অর্জন করে। ঠিক অর্জন না, অটোমেটিক তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদিও চিত্রা এসবে বিশ্বাসী নয়। মানুষ নিজের ব্যক্তিত্ব নিজেই তৈরি করে। কর্মস্থল তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি করে দেয় না। তাঁদের ফোনালাপে প্রায়ই নানান প্রসঙ্গে ওঠে আসে। এভাবেই সময় কেটে যায় অনেকটা। ফিরোজ রাতের সময়টুকুই ফ্রি থাকে। তাই ওই সময়েই কথা হয়। এছাড়া রোজ দুপুরের খাবারের আগে কখনো চিত্রা, কখনো ফিরোজ, দুজনের মধ্যে কেউ ফোন দেয়, অপরজনের কথা জিজ্ঞেস করে। প্রথমে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে খুব লজ্জাবোধ করতো চিত্রা, লজ্জায় তাঁর গালে টোল পড়তো, লাল হয়ে আসতো, ঠোঁট কাঁপতো। সারা দেহে বিদ্যুৎ বয়ে যেতো। কথা বলার সময় কখনো কখনো মনে হতো শরীরে কিছু একটা হেঁটে বেড়াচ্ছে! নরম, কোমল কিছু, যা প্রতিনিয়ত শরীরকে শিহরিত করেছে, উত্তেজিত করেছে। অনুভূতিটা আজও এমন আছে, শুধু দূরত্ব কমেছে, জড়তা দূর হয়েছে। দুই এক মিনিট নয়, এখন কথা বলতে বলতে কোথা দিয়ে ঘড়ির কাটা ঘন্টা পার করে ফেলে, তা দুজনের কেউই বুঝতে পারে না। যখন বুঝতে পারে, তখন কেউ একজন বলে, এবার রাখি; কিন্তু কেউ রাখে না। আরও কথা বলে।

চিত্রার ভাই-বোন যারা এসেছিল সেদিন, সবাই এখন নিজেদের বাড়িতে। ওদের পরিক্ষা চলছে। বিয়ের আগেই পরিক্ষা শেষ হয়ে যাবে, তখন আসবে আবার। রাতের খাবারের সময় হওয়ায় সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হলো। সবাই বলতে, চিত্রার বাবা-মা, সে নিজে এবং তাঁর কলেজ পড়ুয়া ছোট বোন-হ্যাপি। এদের দুই বোনের নামের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকার একটা বিশেষ কারণ আছে। চিত্রার নামটা রেখেছিল তাঁর দাদী। হ্যাপি যখন জন্ম নিলো, তাঁর অনেক আগেই ভদ্রমহিলা পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন, সেজন্য ছোট নাতনির নামটা আর রাখা হয়ে ওঠেনি তাঁর।

খাবার খাওয়ার মাঝখানে চিত্রার বাবা হঠাৎ বললেন, “খালেদ সাহেব ফোন করেছিলেন।” কথাটা বলে একটু থামলেন তিনি। সবার দৃষ্টি পড়তেই তিনি আবার বললেন, “চিত্রার জন্য বিয়ের জামা কিনবে। উনি চাচ্ছেন, জামাটা যেন চিত্রার পছন্দমতো কেনা হয়। কাল দুপুরের দিকে ওই বাড়িতে যেতে বলেছেন। ওখান থেকেই মার্কেটে যাবে।”
চিত্রার মা পাশ থেকে বললেন, “বেশ তো। চিত্রা আর হ্যাপি কালকে চলে যাবে ওই বাড়িতে। ফিরোজ সাথে যাবে তো? যদি বেলা খুব গড়িয়ে যায়, তাহলে ওদের এখানে নামিয়ে দিবে।”
“হ্যাঁ, ফিরোজও সাথে থাকবে।” চিত্রার বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন।
চিত্রা চুপচাপ শুনছিল কথাগুলো। কিছুক্ষণ পর চিত্রার মা খানিক সংকোচিত হয়ে বললেন, “বিয়ের অল্প কদিন বাকি। এইসময় এভাবে হবু শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে?”
“তাতে কী হয়েছে?” হ্যাপি মায়ের কথাটির প্রতিবাদে পালটা প্রশ্ন করল। নিজেই আবার বলল, “আজকের যুগে এসেও এইসব নিয়ে ভাবছো তুমি, মা। তাছাড়া আপু একা কোথায়, আমিও তো যাচ্ছি।” দুষ্টু হাসি দিলো হ্যাপি। বলল, “আর বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়ি যাতায়াত করা খারাপ কিছু না৷ হবু বরের সাথে ঘন ঘন দেখা হলে তবেই না বিয়ের পর খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। আর ফিরোজ ভাইয়ার সাথে..।” থেমে দুষ্টু হাসি দিলো আবার।
ছোট বোনের কথা শুনে লজ্জায় খাওয়া ভুলে গেল চিত্রা। গোপনে হ্যাপির হাঁটুর উপরে চিমটি কাটল। মেয়েটা সশব্দে হেসে উঠল।
চিত্রার বাবা কেশে ওঠে, ক্ষীণ ধমক দিয়ে বললেন, “হয়েছে, এত কথা বলতে হবে না। বোনকে নিয়ে কাল দুপুরের দিকে ওই বাড়িতে চলে যেও। ফিরোজই আসতো তোদের নিতে, কিন্তু ও অফিস শেষ করে তোদের সাথে দেখা করবে। ততক্ষণে তোরা দুজন আর ফিরোজের বোন মার্কেটে চলে যাবি। এতে অনেকটা সময় বাঁচবে।”
চিত্রা আর হ্যাপি, দুজনেই ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকাল।
চিত্রার মা সহসা চিন্তান্বিত হয়ে বললেন, “আচ্ছা, তোমাদের একটা কথা বলব ভাবছি, ওই ছেলেটার কথা মনে আছে, ফিরোজের জেঠার ছেলে?”
চমক খেলো চিত্রা। মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো।
চিত্রার বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, মনে আছে। অদ্ভুত একটা ছেলে!”
“শুধু অদ্ভুতই না, একেবারে সবার থেকে ভিন্ন। উনাকে দেখে তো মনেই হয় না উনি ওই বাড়ির ছেলে।” হ্যাপি জুড়ে দিলো বাবার কথার সাথে।
চিত্রার মা বললেন, “আমার তো ছেলেটাকে দেখে কেমন ভয় ভয় করছিল। সেদিন কেমন উন্মাদের মতো আচরণ করছিল। অবস্থাটা দেখেছিলে? চুলগুলো কত বড় বড় ছিল। আর দাড়ি। জামা-কাপড়ের এমন অবস্থা ছিল, মনে হচ্ছিল এক্ষুণি কারোর সাথে মারামারি করে এসেছে। পকেটে সিগারেটের প্যাকেটও লক্ষ্য করেছিলাম আমি। ওইরকম একটা পরিবারের মধ্যে এই ছেলেকে সহজেই আলাদা করা যায়৷ একজন সরকারি অফিসার, খালেদ সাহেবও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। অথচ উনারই ভাইয়ের ছেলের কী হাল! আর উনারাও কেমন পুরো ব্যাপারটা গোপন রেখেছিল আমাদের কাছে। সেদিন দেখা না হলে তো জানতামই না ওই বাড়িতে এইরকম অদ্ভুত কিসিমের একটা ছেলে থাকে। বয়সও তো কম না; ৪০ এর কাছাকাছি হবে। বিয়ে-শাদি করেনি নাকি?” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শেষের প্রশ্নের জবাবের আশায় সবার দিকে তাকালেন চিত্রার মা। ভাবান্তর ভঙ্গিতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে সবাই।
চিত্রার বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, “আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি; সেটা হলো, ওই বাড়ির কেউ ছেলেটাকে তেমন পছন্দ করে না। ফিরোজ বা ওর মা-ও না।”
চিত্রা হঠাৎ বলল, “কিন্তু আঙ্কেল উনাকে পছন্দ করে। সেদিনই বুঝেছিলাম আমি।”
“হুম।” চিত্রার বাবা সহমত জানালেন। এরপর বললেন, “আচ্ছা, তুই এর মধ্যে ছেলেটার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলি ফিরোজের কাছে?”
“অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি৷ কিন্তু প্রতিবারই উনি এড়িয়ে গেছেন। কাজের বাহানা দিয়ে ফোন কেটে দিতেন। উনার প্রসঙ্গ উঠলেই ওই বাড়ির সবাই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়। ফিরোজ সাহেবের বোনও উনাকে পছন্দ করে না খুব একটা।”
চিত্রার মা আরও চিন্তিত হয়ে, মলিন সুরে বললেন, “আমরা কোনো ভুল করছি না তো?” চিত্রার মায়ের বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার জর্জরিত হয়ে আছেন তিনি। আরও বললেন, “আমাদের কী আরও খোঁজখবর নেওয়া উচিত না? বড্ড তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল।”
“ধুর! এত ভেবো না তো। আল্লাহ যা করবেন, ভালোর জন্য করবেন। তাছাড়া সমস্যাটা হয়তো ওই ছেলের মধ্যেই। বাবা-মা নেই। হয়তো ঠিক মতো মানুষ হতে পারেনি। বেয়াদব হয়েছে একটা। দেখলে না, সেদিন খালেদ সাহেবের সাথে কীভাবে কথা বলেছিল?”
“বেয়াদব” শব্দটা মেনে নিতে পারল না চিত্রা। তাঁর সরল মন অকস্মাৎ প্রতিবাদ করতে চাইল। বলতে ইচ্ছে করল, “সুব্রত ভাইকে খুব ভালো মনে হয়েছে আমার।” কিন্তু বলতে পারল না সে। এভাবে আসলে বলা যায় না। আর বলা যায় না বলেই যত সমস্যা। এভাবেই শুরু হয় হৃদয়ের সাথে মানুষের লড়াই!
খাবার টেবিলে আর কেউ কোনো কথাই বলল না।

পরদিন হ্যাপিকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল চিত্রা। যাওয়ার আগে মা বারবার সাবধান করে দিলেন। “শোন, ওই ছেলেটাকে দেখলে এড়িয়ে যাবি। ছেলেটাকে মোটেও ভালো মনে হয়নি আমার। যদি কিছু করে বসে? আমার তো বাবা বড় ভয় করে!”
একবার নয়, একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বেশ ক’বার। চিত্রা কিছু বলেনি; হ্যাপি মা-কে আশ্বাস দিয়ে বলেছে, সে সবসময় বোনের সাথে থাকবে।

ফিরোজদের বাড়িতে ঢোকার সময় একটা মেয়েকে দেখতে পেলো চিত্রা। পাশের একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, কতকগুলো বেড়ালকে খাবার দিচ্ছে। পরণে টি-শার্ট আর জিন্স। চুলগুলো বাঁধা। দেহের গড়ন পাতলা, তাঁর মতোই। গায়ের রঙ শ্যামলা। সূর্যের আলো সরাসরি মুখে এসে পড়ায় লালবর্ণ হয়েছে গাল দুটো, ঘামে চিকচিক করছে। হাতের তালু দিয়ে একটু পরপর কপালের ঘাম মুছে দিচ্ছে৷ মেয়েটাকে দেখতে দেখতে ফিরোজদের বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল তাঁরা। আর দেখা গেল না ওকে।

দরজা খুলে দিলো ফিরোজের বোন, কনা। চিত্রাকে দেখেই একগাল হেসে আলিঙ্গন করল।
চিত্রা বলল, “কেমন আছো, কনা?”
কনা বলল, “আমি ভালো আছি, ভাবী। তুমি কেমন আছো?”
“আমিও ভালো আছি৷” মৃদুস্বরে জবাব দিয়ে ভিতরে পা বাড়াল চিত্রা। পিছনে হ্যাপি।
কনা হ্যাপির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কেমন আছো, হ্যাপি?”
হাসিমুখে জবাব দিলো হ্যাপি, “একদম মাস্ত!” বলে সশব্দে হাসল ও।
ড্রয়িংরুমে ফিরোজের মা আর কাজের মেয়েটাকে দেখতে পেলো চিত্রা। সে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াল, মাথাটা সামান্য ঝুঁকে বিনয়ী সুরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।” আপ্লুত হয়ে জবাবটা দিলেন ফিরোজের মা, দীপালি বেগম। আবার ক্ষীণ মলিন হয়ে বললেন, “এ কেমন কথা; কনা তোমাকে ভাবী বলছে, তুমিও ওকে ননদ বলে মেনে নিছো, অথচ আমাকে এখনো ‘মা’ বললে না। আন্টি বলে ডাকছ। এটা কিন্তু মা তোমার খুব অন্যায় নির্ণয়। আমার কী ‘মা’ ডাক শোনার হক নেই?” ভদ্রমহিলার কণ্ঠে যেন আবেগ বয়ে গেল।
চিত্রা হেসে বলল, “মা আন্টি, তেমনটা নয়৷ ঠিক আছে, আমি এখন থেকেই আপনাকে ‘মা’ বলে ডাকব।”
কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন দীপালি বেগম। তাঁর চেহারায় সেটা ফুটে উঠল স্পষ্ট।
খাবার টেবিলে চোখ পড়তেই বিস্মিত হলো চিত্রা। বেশ কয়েক রকমের আইটেম সাজানো। সে অবাক হয়ে বলল, “একি! এত বেলা হয়েছে, আপনারা এখনো লাঞ্চ করেননি? প্রায় তিনটে বাজতে চলল।”
কনা বলল, “না। তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তোমরা এসেছ, এবার একসাথে লাঞ্চ করব।”
“সরি, আমাদের জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো তোমাদের।” চেয়ারে বসতে বসতে সুলতানার দিকে তাকাল চিত্রা। “তোমার নামটা কী যেন?”
নতুন বউয়ের নজর পড়তেই আনন্দে সুলতানার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। খুশি হয়ে নিজের নামটা বলল। “আমার নাম সুলতানা।”
“ওহ্। কেমন আছো তুমি?”
“ভালো আছি, ভাবী।” উল্লসিত হয়ে জবাব দিলো সুলতানা। যখন মালিকেরা এতটা বিনয়ী হয়, তখন সাধারণ কর্মচারী মানুষগুলো বড্ড খুশি হয়; যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেয়েছে! সুলতানার চোখ দুতো ঝলমলিয়ে উঠেছে। প্রবল উৎসাহে সবার পাতে খাবার বেড়ে দিতে লাগল; নতুন বউ এর পাতে একটু বেশিই দিলো যেন!

সিড়ি দিয়ে হনহন করে নেমে এলো সুব্রত। একটা প্রয়োজনীয় কাগজ ভুলে ফেলে গিয়েছিল বাড়িতে। অফিসে যখন কাগজটার প্রয়োজন হলো, তখন দেখল কাগজ নেই৷ সাথে সাথে মনে পড়ল, কাল রাতে স্টাডি রুমে কাগজটা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে ওঠে ওটা আর মাথায় ছিল না। সেজন্যই এখন বাড়িতে এসেছিল ওটা নিতে।
ড্রয়িংরুমের মাঝখানে আসতেই অকস্মাৎ চিত্রা ডেকে উঠল, “এই যে সুব্রত ভাই।”
থমকে দাঁড়াল সুব্রত। চশমার ভিতরের ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর, কৌতূহল নিয়ে তাকালো অচেনা মেয়েটির দিকে।
চিত্রা দাঁড়াল। সুব্রত তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। লোকটার পরণে এখন একটা সাদা শার্ট। ইন করা। হাতে কোনো ব্যাগ বা চাবি নেই, শুধু একটা কাগজ আছে। সে তাকিয়ে থেকে বলল, “কোথায় যাচ্ছেন? লাঞ্চ করে যান।”
চোখ থেকে চশমাটা সরাল সুব্রত। বলল, “আপনি কে?”
চোখগুলো দেখে খুশি হলো চিত্রা। এই রঙের চোখের মনি তাঁর ভালো লাগে। পাশ থেকে হ্যাপি বোনের জামা টানছে টেবিলের নিচ দিয়ে৷ ইশারায় বসতে বলছে। কিন্তু চিত্রা সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আমার নাম চিত্রা। আপনার ছোট ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আগামী ১৪ তারিখ আমাদের বিয়ে।”
শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না সুব্রত। চশমাটা আবার চোখে দিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
চিত্রা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। আজব লোক! আর একটা কথাও বলল না। ‘হ্যাঁঃ বলতে না পারল, ‘না’ অন্তত বলতো। কনা পাশ থেকে বলল, “কী দরকার ছিল ওকে আমাদের সাথে খেতে বলার জন্য? তুমি হয়তো জানো না, প্রায় ৬ বছর হতে চলল আমাদের পরিবারের কেউ ওর সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খায় না। আমরা তো কথাও বলি না।”
কনার কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল চিত্রা! ৬ বছর! এত দীর্ঘ সময় ধরে একটা মানুষ নিজের পরিবারের থেকে এতটা দূরে আছে৷ পরিবার থেকেও যেন নেই মানুষটার। সুব্রতর মানসিক অবস্থার কথা কল্পনা করে বড় মায়া হলো তাঁর! তীব্র কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
কনাকে কিছু বলতে না দিয়ে ওর মা বলে উঠলেন, “আহ, কনা! এত কথা বলিস কেন? চুপচাপ খা।” চিত্রার দিকে তাকালেন তিনি। “ও কিছু না, মা। আসলে ওর সাথে আমাদের তেমন বনিবনা হয় না। সেজন্য আমাদের সাথে বসে খাবার খায় না ও। বেশিরিভাগ সময় বাইরেই খায়। রাতেরবেলা মাঝেমধ্যে সুলতানা ওর ঘরে খাবার দিয়ে আসে।”
কনা আর কিছু বলল না। বাড়ির হেড যখন বিষয়টি নতুন বউয়ের কাছে গোপন রাখতে চাইছে, তখন তাঁর কী সাধ্যি এই ব্যাপারে আবার কথা বলার!

খাওয়াদাওয়া শেষে উপরে, কনার ঘরে চলে গেল সবাই। সূর্যটা আর একটু দুর্বল হলে বেরিয়ে পড়বে। ফিরোজ বলেছে, সে নিজেই বিকেলের আগে বাড়িতে আসবে। বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে এরপর সবাইকে নিয়ে বেরোবে। ঘরে বসে টিভিতে মুভি দেখছিল ওরা, হঠাৎ কনা বলল, “পপকর্ন খাবে?”
চিত্রা হেসে বলল, “মাত্রই তো এত এত খাওয়ালে। আবার পপকর্ন?”
“খালি মুখে টিভি দেখতে ভালো লাগছে না। তোমরা বসো, বেশি সময় লাগবে না, আমি সুলতানাকে বলছি রেডি করতে।”
কনা বেরিয়ে গেল। চিত্রা আর হ্যাপি টিভি দেখছিল। হঠাৎ একটা ফোন আসতেই ব্যালকনিতে গেল হ্যাপি। চিত্রা ঘরে একা। টিভি থেকে তাঁর মনোযোগ সরে গেল। কী ভাবতে ভাবতে যেন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে, হ্যাপিকে জানালোও না।
বাইরে এসে থ্রিপিস এর ওড়নার একটা অংশ হাতের মুঠোয় নিয়ে মোচড়াতে মোচড়াতে, আস্তে আস্তে হেঁটে ডান দিকে যেতে লাগল। চারটা ঘর দুতোলায়। বাঁ-দিকের শেষ ঘরটার কাছে যখন গেল, তখন দেখল দরজাটা ঈষৎ ফাঁকা। কৌতূহল বশত দরজায় ধাক্কা দিলো সে। আর খুলে গেল সাথে সাথে।

ঘরে আসবাব বলতে-ফ্রিজ, একটা ড্রেসিং টেবিল, আর একটা ওয়্যারড্রব। একটা টিভিও দেখা গেল। পশ্চিমমুখী একটা বড় বারান্দাও দেখল সে। এগিয়ে গেল সেদিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো, মেয়েটাকে এখন আর দেখা গেল না।
ভীষণ রোদ পড়েছে বারান্দায়। তাই ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সে। আবার ঘরে চলে এলো। ঘরে কোনো ছবি নেই। থাকলে বুঝতে সুবিধা হতো, ঘরটা আসলে কার। কিন্তু বাঁ-দিকে তাকাতেই আরও একটা দরজা নজরে এলো। উপরে লেখা ‘স্টাডি রুম’। লেখাটা দেখেই আনন্দে তাঁর সারা শরীর শিউরে উঠল। সে নিশ্চিন্ত হলো এটা ভেবে, আর কিছুদিনের মধ্যেই এই ঘর তাঁর হতে যাচ্ছে। এত গোছনো ঘর, সাথে লাগোয়া স্টাডিরুম, এইসব দেখে তাঁর বুঝতে বাকি নেই, ঘরটা আসলে কার!
স্টাডিরুমের দরজার ছিটকিনিতে খোলা তালা ঝুলছে। দরজাটাও লাগানো হয়নি। একবার ভিতরটা দেখতে ইচ্ছে করল তাঁর। দরজা ঢেলে ভিতরে ঢুকে দেখল, ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুক্ষণ বারান্দায় রোদে দাঁড়িয়ে থাকায় এখন যেন ঘরের কিছুই তাঁর নজরে আসছে না। গভীর অন্ধকারে যেন হারিয়ে গেল হঠাৎ করে। মোবাইলের ফ্লাশ অন করল। এরপর সুইচবোর্ড খুঁজে প্রথমেই ঘরের আলো জ্বালালো।
তবুও ঘোলাটে দেখতে লাগল সবকিছু। চোখ ডলতে ডলতে, আস্তে আস্তে পরিষ্কার মনে হলো সব। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সে। এক মুহূর্তের মধ্যে জন্য হলো, সে ভুল করে কোনো লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছে! একটা মানুষের কাছে এত বইয়ের কালেকশন থাকতে পারে, সেটা তাঁর জানা ছিল না। ক্লাস সিক্সে থেকেই বই পড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মেছিল তাঁর। বই কেনার প্রতিও তাঁর উৎসাহ ছিল খুব। ঈদে যখন বাবা নতুন জামা কিনে দিতে চাইতো, সে জামার পরিবর্তে বই চাইতো। টিউশনির পুরো টাকাই বই কিনে শেষ করতো। এখনো খুব বই কিনে সে। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে, এর চার ভাগের এক ভাগ বইও তাঁর কাছে নেই। এতদিন ধরে ফিরোজের সাথে কথা বলছে, ফিরোজ একবারও বলেনি তাঁর কাছে এত এত বই আছে, অথচ নিজের বই কেনার শখ নিয়ে ফিরোজের কাছে খুব গর্ব করেছে সে। তবুও লোকটা বলেনি এইসবের কথা।
বোধহয় বাসর রাতে চমক দিতে চেয়েছিল! যখন সে একটু অবাক হবে না, তখন ফিরোজের সব পরিকল্পনা মারা যাবে ভেবে খুব হাসি পেল তাঁর! সে ঘুরে ঘুরে বইগুলো দেখতে লাগল। বইয়ের জন্য ঘরের দেয়াল দেখার উপায় নেই। একটা বিদেশি কবিতার বই দেখে আগ্রহী হয়ে ওটা টান দিতেই হঠাৎ করে একটা ছবি বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। মেঝেতে পড়ল ছবিটা। উপর থেকে দেখল, একটা মেয়ে। অবাক হয়ে ছবিটা নিচ থেকে তুললো সে। হাসিমুখের, সুশ্রী রূপের একটা মেয়ের ছবি।
এক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল চিত্রা, হঠাৎ একটা ছায়া পড়ল ঘরে; সে আচমকা দরজার দিকে তাকাতেই ভড়কে গেল! সুব্রত ভাই ক্ষুব্ধ চেহারা করে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। ভয়ে সে বাকহারা হয়ে গেল এক মুহূর্তে! শিরদাঁড়া টানটান হয়ে গেল।

৩য় পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক প্রথম কমেন্ট এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here