পরাণ দিয়ে ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১৬

0
363

#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ)
#পর্বঃ১৬
#Jhorna_Islam

রাতের আকাশে তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। চারপাশ থেকে নানা ধরনের পোকা মাকড়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতা বুঝিয়ে দিচ্ছে যেনো তারা। মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক ও কানে আসছে। কেন যেনো পেঁচার ডাক টা সৌন্দর্যের ভালো লাগছে না। খুব অস্বস্তি লাগছে। শরীর টা আজ ভীষণ ক্লান্ত। এখান থেকে উঠে বাড়ি যেতে ও ইচ্ছে করছে না। এইদিকে মশা যে তাকে রাতের ডিনার বানিয়ে খেয়ে চলেছে সেইদিকে তার খেয়াল নেই।

সৌন্দর্য কে দেখে মনে হবে,,সে এখন দুনিয়ায় সব মায়া মমতা ত্যাগ করে দিয়েছে। এরমধ্যে ফোন টা খুব বিরক্ত করছে তাকে।কে বলেছে এতো সুন্দর একটা মুহূর্তে এমন ভাবে নিজের জানান দিতে? না চাইতেও ফোন টা পকেট থেকে বের করে সৌন্দর্য।

এতো রাতে ❝পরাণ❞ নামটা ফোনের স্ক্রিনে এমন ভাবে জ্বল জ্বল করবে সেটা সৌন্দর্য কল্পনা ও করেনি। ফোন রিসিভ করে সৌন্দর্য চুপ হয়ে থাকে। অপর পাশ থেকে কি বলে মূলত সেটা শোনার জন্য কিন্তু মিনিট দুয়েক শুধুই নিস্তব্ধতা তারপর হিচকি,দীর্ঘ শ্বাসের শব্দ।

কি হয়েছে পরাণ?
,,,,,,,,,,,,,,,,,,

চুপ করে আছো কেনো? প্লিজ কি হয়েছে বলো।তুমি ঠিক আছো তো?

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

নূর? প্লিজ বলবে কি হয়েছে? আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে এবার।

স-স্যার!

আমি শুনছি নূর বলো তুমি, কি হয়েছে তোমার?

-‘ আ-আমার আব্বু ভালো নেই স্যার।আমি এতোদিন কেনো তার খোঁজ নেই নি। আজ বাড়িতে এসে শুনি রাস্তায় অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। আ-আমি তার সামনে যেতে পারছি না। কোন মুখে যাবো? তার উপর আমি অন্যায় করেছি চরম অন্যায়।সবকিছু আমার খোলাখুলি আলোচনা করা দরকার ছিলো।
এখন আমি কোন মুখে গিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াবো? আমি সাহস আর শক্তি পাচ্ছি না। স্যার আপনি একটু সাহায্য করবেন আমাকে? বলে দেন প্লিজ কি করবো আমি। আমার নিজের উপর আমার খুব ঘৃণা হচ্ছে বলেই নূর শব্দ করে কেঁদে উঠে।

সৌন্দর্য চুপচাপ নূরের কথা শুনে। কিছু সময় দুই পাশই নীরব হয়ে যায়।

তুমি আগে শান্ত হও।চোখের পানি মুছে এক গ্লাস পানি পান করো।(সৌন্দর্য)

আ-আমি ঠিক আছি।(নূর)

আমি যা বলছি তা শুনো।(সৌন্দর্য)

নূর সৌন্দর্যের কথা মতো গিয়ে পানি পান করে।নিজেকে শান্ত করে ফোন কানে ধরে বসে।

লিসেন নূর উনি তোমার বাবা।বাবা মেয়ের সম্পর্কের মতো মধুর আর কিছুতে নেই। তুমি সব ভুলে কাছে গিয়ে বসে বাবা বলে ডাক দাও।তোমাকে আর কিছু করতে হবে না শুধু তুমি গিয়ে উনার হাত টা ধরে বাবা বলে ডাকো।তুমি জানো সন্তান যতোই অন্যায় করুক না কেন বাবা মায়ের সাথে বাবা মা সন্তানের মলিন মুখ দেখলে সব ভুলে যায়। তুমি তো কোনো অন্যায় করোনি সব পরিস্থিতির স্বীকার। মান অভিমান মিটিয়ে নাও নূর।এসব মান অভিমান বেশি দিন জমিয়ে রাখতে নেই। যত তারাতাড়ি এসব মিটাবে ততোই ভালো। এসব জমিয়ে রেখে পরে আফসোস করো না।

আ-আমি এখনই বাবার সাথে কথা বলবো।

-‘ এখনতো অনেক রাত নূর। আংকেল হয়তো ঘুমোচ্ছে। তুমি না বললে উনার শরীর খারাপ? তাহলে এখন ডিসটার্ব না করলেই মনে হয় ভালো।

-‘ আমি এখনই যাবো স্যার।আমি জানি আমার বাবা ঘুমায় নি।এখনও জেগে আছে।

-‘ কিন্তু?

নূরের কথা বলার মাঝখানেই রুমের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা পরে।নূর ঘাবড়ে গিয়ে দরজার দিকে তাকায়। এরমধ্যে নূরের মায়ের কন্ঠ কানে আসে নূরকে ডাকছে।

নূর এই নূর দেখ তোর বাবা কেমন করছে। নূর তূর কোথায় তোরা? তারাতাড়ি আয় দেখ কেমন করছে তোর বাবা।

নূরের মায়ের কথা শুনে নূরের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। হাত থেকে ফোন মেঝেতে পরে কয়েক খন্ড হয়ে গেছে। নূর দৌড়ে বেরিয়ে যায়।

অপর পাশ থেকে সৌন্দর্য সবই শুনতে পায়। সে ও দেরি করে না এক মুহূর্ত তারাতাড়ি গাড়ি নিয়ে নূরদের বাড়ির দিকে ছোটে।

নূরের বাবা মাথা ধরে ছটফট করে চলেছে।কিছু বলতে পারছে না শুধু গুঙিয়ে যাচ্ছে। হাত পা কেমন ঠান্ডা। নূর তারাতাড়ি গিয়ে বাবার পাশে বসে জানতে চায় কি হয়েছে কোথায় কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। নূরের মা কাঁদছে আর হাত পা মালিশ করছে কিছুই হচ্ছে না। তূর কি করবে বুঝতে পারছে না সে যেনো হ্যাং হয়ে গেছে। নূর তারাতাড়ি পানি দিতে বলে।তূর দৌড়ে পানি এনে দেয়। নূর বাবা কে খাওয়াতে চায় কিন্তু হাত কাঁপুনিতে মুখে পানি ও তুলে দিতে পারছে না।

নূরের মায়ের আহাজারি বেড়েই চলেছে।
-‘ নূর তোর বাবা এমন করছে কেন মা? কিছু কর না নূর।

বিপদের সময় কারো মাথাই ঠিক থাকে না। এতো রাতে তিনজন মেয়ে মানুষ একা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বেশি দেরি করা ঠিক হবে না নূর বুঝতে পেরে ফোন খুঁজতে থাকে। কিন্তু হায় ফোন কোথায় ফোন খুঁজে পাচ্ছে না। তূর এনে ফোন দেয় তূরের টা। নূর কাউকে ফোন দিতে থাকে কিন্তু ফোন তুলে না। এরমধ্যে কলিং বেল বেজে উঠে। নূর তূরকে বলে যেনো গিয়ে দেখে কে এসেছে। তূর দরজা খুলে দেখে সৌন্দর্য। তূর কিছু বলবে তার আগেই সৌন্দর্য দৌড়ে ভিতরে ঢুকে। নূরের বাবা কে একবার দেখে নিয়ে কাঁধে তুলে নেয়। নূর তোমরা দরজায় তালা মেরে তারাতাড়ি আসো ফাস্ট লেট করবা না একদম। নূর মাথা নেড়ে তূর আর মা কে নিয়ে তারাতাড়ি সৌন্দর্যের সাথে গাড়িতে উঠে বসে। সৌন্দর্য যতো তারাতাড়ি সম্ভব ড্রাইভ করতে থাকে। মিনিট পনেরোর মাঝে এসে হাসপাতালে উপস্থিত হয়। সৌন্দর্যের চেনা জানা আছে এখানে তাই আগেই ফোন করে বলে রেখেছিলো। ওরা আসার সাথে সাথে নূরের বাবা কে নিয়ে পরীক্ষা করানো শুরু করে।

সৌন্দর্য সব ফরমালিটি পূরণ করছে নূর তার মাকে আর তূর কে নিয়ে বসে আছে। নূর যেনো পুরো রোবট হয়ে গেছে। একটা শব্দ ও বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে।

রাত পেরিয়ে সকাল হচ্ছে। অন্ধকার কেটে আলোকিত হচ্ছে ভূবণ। কিন্তু নূরের ভূবণ যেনো আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। একগা’দা টেস্ট করাচ্ছে তার বাবার। এখন ঘুমোচ্ছে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে ডাক্তার। সৌন্দর্য হাসপাতালেই আছে নূরের সাথে। নূরের মা কে আর বোন কে জোর করে বাড়ি পাঠিয়েছে সৌন্দর্য।

সৌন্দর্য দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে সে নূর কে দেখে চলেছে। সেই যে বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে একবার একটু নড়াচড়া ও করে নি।এরমধ্যে সৌন্দর্যের কাঁধে কেউ হাত রাখে।সৌন্দর্য ব্রু কোচকে তাকিয়ে দেখে তার বড় আব্বু। দুইজন চোখের ইশারায় কিছু বলে। তারপর সৌন্দর্য ঐখান থেকে সরে পরে।

‘- নূর মা।

-‘ নূর মাথা তুলে তাকায়। মি. রূপম ওয়াহিদ কে দেখে ও কোনো পতিক্রিয়া দেখায় না।

তুমি কি জানো তোমার বাবা আর আমি খুব ভালো বন্ধু। এতোটা ভালো যে দুইজন এক প্লেটে খাবার খেতাম। একই রকম ড্রেস পরে ঘুরে বেড়াতাম। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিলো।তোমরা আমাদের সম্পর্কে জানতে ও পারো নি।এর পিছনে ও বিভিন্ন কারণ আছে। কিন্তু সবচেয়ে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তোমাদের বিয়ে নিয়ে।

তোমার বাবা কিন্তু আজ অসুস্থ না।

এরকম কথা শুনে নূর মি.রুপম ওয়াহিদের দিকে তাকায়।

-‘ হ্যা আমি যা বলছি তা সত্যি। তোমার বাবা বেশ কিছু মাস যাবত অসুস্থ। এতোদিন তোমাদের কাউকে বুঝতে দেয় নি। নিজের মধ্যে চেপে রেখেছে। আমাকেও বলতে দেয় নি। আমি যখন জোর করতাম বলতে নয়তো আমি বলি কিন্তু দিতো না। ওয়াদা করিয়ে রেখেছিলো।এখন প্রশ্ন এতোদিন ওয়াদার জন্য বলিনি তাহলে এখন কেনো বলছি। আমি তোমার বাবা কে বলতাম এসব জিনিস তো লুকিয়ে রাখা যায় না একদিন না একদিন ঠিক জানতে পারবে।তখন তোমার বাবা বলতো যখন জানতে পারবে তখন বলিস কিন্তু এখন বলিস না। ওর সব কথা মেনে নিয়েছি শুধু এজন্য যে সে নিয়মিত ঔষধ খাবে নিজের যত্ন নিবে।কিন্তু দেখো কি করলো।

বিয়ে নিয়ে অনেক প্রশ্ন না তোমার? এই অসুস্থতার কথা জানতে পেরেই তোমার বাবা পাগলের মতো হয়ে গেছে। সারাদিন শুধু বলতো আমার মেয়ে দুইটার কি হবে? কে দেখবে ওদের? আমার নূর তো বাস্তব জীবন থেকে অনেক পিছিয়ে কি হবে মেয়েটার? একা কি করে সব সামলাবে? সবচেয়ে বেশি টেনশন করতো তোমাকে নিয়ে। তোমার পাশে একজন পার্ফেক্ট জীবন সঙ্গী চাইতো। তখন আমি আমার একমাত্র ভাতিজা সৌন্দর্যের কথা বলি তোমার বাবার কাছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানো? আমার এতো ভালো বন্ধু হওয়া সত্তেও তোমার বাবা কে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছি সৌন্দর্যের পিছনে গোয়েন্দা গিরি করতে। ঠিক এক সপ্তাহ পর তোমার বাবা এসে বলে,,,এই ছেলেই তার মেয়ের জামাই হবে। একজন শান্ত হলে আরেক জনকে উত্তাল ঢেউয়ের মতো হতে হয়। হ্যা মানছি আমরা ডিজিটাল যুগে এসেও বিয়ে নামক বন্ধন কে এমন ভাবে কারো উপর অনুমতি ছাড়া চাপিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু এটাতো জানো সব বাবা মা ই চায় তার সন্তান বেস্টটা পাক।ভালো থাকুক। তোমার বাবার চাওয়ায় ও কোনো ভুল নেই। যখন নিজের সন্তান হবে তখন বুঝতে পারবে।

সৌন্দর্য জীবন সঙ্গী হিসেবে খারাপ না মা। জীবন কে একবার সুযোগ দিয়ে দেখো।আর তোমার মনে হতে পারে একটা বিবাহিত ছেলে,,,, মি. ওয়াহিদ আর কিছু বলার আগেই সৌন্দর্য এসে ওখানে উপস্থিত হয়। কিসব কাগজপত্র নিয়ে কথা আছে। মি. রুপম ওয়াহিদ নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। নূর একই ভাবে বসে থাকে।

#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here