নির্মোচন পর্ব ২৯ এর ২য় অংশ

0
319

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৯ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
[বাড়তি খণ্ড ০২] .

সাংঘাতিক আর্তস্বরে গমগম করে উঠল সিঁড়ির নিঃশব্দ জায়গাটা। টব ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ল সিঁড়ির তিন তিনটে ধাপে। প্রচণ্ড চিৎকার করে কতটুকু ব্যথার জাহির করা হলো, তা অনুমান করা গেল না। হতবাক, আশ্চর্য, বিস্ফোরিত নয়নে নাজনীন ও ফিমা উদ্বেলিত চিত্তে ছুটে আসতে আসতেই ঘুটঘুটে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে গেল ফিহার স্নাযু। হাঁটুর নীচ থেকে দুর্বোধ্য এক পীড়ায় সারামুখ রক্তিম হয়ে বুজিয়ে নিল চোখ। অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা একনাগাড়ে চিৎকার চেঁচামেচির তপ্ত গলাদুটো শুনতে পেল কানে। কিন্তু শত শত মারণ যন্ত্রণার হিংস্র ছোবলে চেতনা, শক্তি, দৈহিক ভারসাম্যটুকু আর ধরে রাখতে পারল না। “ধপাস” করে রক্তমাংসের ওইটুকু শরীর যেন চোখের সমুখে লুটিয়ে পরল। কয়েক লহমায় অবর্ণনীয় এক রণ তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে গেল ওইটুকু জায়গায়। হাতের টব ফেলে দিয়ে ধরাধরি করে রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে জ্ঞান ফেরাতে লেগে পড়ল ফিমা। বেসিন থেকে মগভর্তি পানি এনে অনবরত পানির ছিটা ছিটাতে ছিটাতে জোর গলায় ডেকে চলল সে। অন্যদিকে মা নাজনীন পাগলের মতো রুম তোলপাড় করে ফেলতেই আকস্মিক দুর্ঘটনার কথা ফোন করে জানিয়ে দিলেন স্বামীকে। ভরা মার্কেটের ভেতর অসংখ্য ভারী শপিংব্যাগ হাতে স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনে চললেন নিয়াজ। মাথার ভেতরে মৌমাছির চাক যেন হুঁল ফুটাতে ভোঁ ভোঁ করছে। চতুর্দিকে মানুষের হৈচৈ করা ব্যস্তমুখর ঢলের মাঝে তিনি যেন এক প্রাণহীন কাকতাড়ুয়া। রিকশার অসহ্যকর ক্রিং ক্রিং হর্ণের আওয়াজ, অশ্রাব্য ভাষায় “…. বাচ্চা” বলে অশুদ্ধ বাণী, দোকানে দর কষাকষি লোকদের মাঝে তর্কবিতর্ক সবই উপেক্ষা করে তিনি দুর্বার ছুটলেন গন্তব্যের দিকে। পাশের বিল্ডিংয়ে থাকা দারোয়ান সালামকে ফোন করে পাঠিয়ে দিলেন একজন নিকটস্থ ডাক্তারকে এখুনি নিয়ে আসার জন্যে। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে এবং ঘটাতে বেশি সময় লাগল না। বয়োজ্যেষ্ঠ ডাক্তার এলেন দশমিনিট পর। মনোযোগ দিয়ে একটু একটু করে জ্ঞান ফিরে পাওয়া ফিহার অবস্থা দেখে ঘোষণা দিয়ে জানান, শরীরের পুরো ভরটা ডান পায়ে রেখে ওভাবেই মেয়েটা সিঁড়ি থেকে অসংলগ্ন ভাবে পরেছে। পায়ে ফ্র‍্যাকচারের লক্ষণ সুস্পষ্ট। একটা এক্স-রে করানো অতি আবশ্যক। তিনি ব্যথানাশক কিছু ট্যাবলেটের নাম লিখে দিয়ে বিদায়ের পালা চুকালেন আধঘণ্টার মাঝে। এদিকে মহা টেনশনের ভেতর হাতাপিতা করতে লাগল নাজনীন কাদির মিলা। তিনি কী বোনের কাছে ব্যাপারটা খুলে বলে কাবিনের এই দিনক্ষণ পেছাতে বলবেন? মুখ ঘুরিয়ে চিন্তা আচ্ছন্ন স্বামীর দিকে আস্তে করে শুধালেন,

– কাল জুম্মা নামাজের পর কাবিন। হাতে শুধু আজকের দিন। এই অবস্থায় কী কাবিন সম্পণ্ণ করা ঠিক হবে ফিমার বাপ?

ফিমাকে শপিংব্যাগের ঝোলাটা ঠিকঠাক মতো বুঝিয়ে দিতেই স্ত্রীকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন নিয়াজ। স্ত্রীকে এক কাপ চায়ের জন্য চুলোর পাড়ে দাঁড় করিয়ে রান্নাঘরের তাক থেকে সল্টেজ বিস্কুটের বয়ামটা তুলে বললেন,

– এখনই কিছু ভাবা ঠিক হবে না। আমরা বরং অপেক্ষা করে দেখি মেয়ের অবস্থা বিকেল পর্যন্ত কেমন দাঁড়ায়। এটা কাবিনের ডেট। ডেট পিছানোর কাজটা চট করে করা হলে আমার মনে হয় ব্যাপারটা সুন্দর দেখায় না। পরিস্থিতির উপর ছেড়ে দেখি। আর তুমি এক কাজ করো নাহয়। তাদের একটা ফোন করে মেয়ের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে রাখো। এটা ভালো হবে।

চুলায় টগবগ করতে থাকা ফুটন্ত পানির ভেতর ক’চামচ চাপাতা ছাড়লেন নাজনীন। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে স্বামীর দিকে শুধালেন,

– কী একটা দুর্ঘটনা ঘটল বলুন! আজই এটা ঘটতে হলো? আমি বারবার বলেছি সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখদুটো নীচের দিকে রাখতে, পাদুটো সাবধানে ফেলতে। একটা কথা যদি আপনার মেয়ে আমার শোনে? লজ্জা বলতে লজ্জা নেই। আমি একশোবার করে . . .

ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ মেজাজি বাক্যের মাঝে দ্রুত বাঁধ সেধে দমালেন নিয়াজ সাহেব,

– আহ! থামো তুমি। ওটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। সর্বক্ষণ একটা মানুষ সতর্কতার ভেতর থাকতে পারে? অতো সতর্কতা যদি পালন করা হয়, তাহলে এই পাদুটো মাটিতে রাখা যাবে না। ডাক্তার তো বললই পা ছাড়া অন্যকোথাও ভারি আঘাত পায়নি তাহলে অতো টেনশন করা হচ্ছে কেন? তুমি চা বানিয়ে রুমে আসো। আজ আর রুটি দিয়ো না আমাকে। বিস্কুট দুটো খেয়ে পেট ভরে গেছে।

চমকে ফিরে তাকালেন নাজনীন,

– নাস্তাই তো করলেন না সকালে? খালিমুখে মার্কেটের ওখানে চলে গেলেন। একগ্লাস পানি দুটো বিস্কুট খেয়ে পেট ভরে গেল?

আলগা করে রাখা বয়ামের ঢাকনাটা গোল গোল চাকতির মতো ঘুরিয়ে মুখটা বন্ধ করতেই উঁচু তাকে রেখে দিচ্ছিলেন নিয়াজ। হাতে মাখা বিস্কুটের গুড়োগুলো সিংকের ট্যাপে ধুয়ে নিতেই স্ত্রীর দিকে শান্তমুখে জানালেন,

– কাজের মধ্যে খাওয়া দাওয়া চলে নাকি? এখনো অনেক কাজ দেখতে হবে। তুমি উপরে গিয়ে মেয়েদুটোকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো। দেখি আমি ভাইজানকে একটা ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানাই। না জানালে স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না। কী না কী ভাবে . .

নিয়াজ সাহেব চায়ের কাপটা বুঝে নিয়ে প্রস্থান করলেও ভীতসম্ভ্রন্ত নাজনীন পৃথিবীর দুই মেরু ওলোটপালোট করে ভাবনা কষে যাচ্ছেন। কাবিনের আগেরদিন এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটা কী স্বাভাবিক কিছু? নাকি এর পেছনে কুসংস্কারগ্রস্ত যুক্তি লাগিয়ে অশুভ, অমঙ্গল কিছু একটা ভাবা দরকার? যুগ যুগ ধরে চলে আসা নানী-দাদীদের মুখে সবসময় যা শুনেছেন, তার ভিত্তিতে এই পা ভাঙার লক্ষণটা কোনোভাবেই মঙ্গলজনক ইশারা নয়। ফিহার দাদীকে এ সম্পর্কে বলাই যাবে না।

.

সাতসকালে এমন একটি সংবাদ শুনে প্রফুল্লে ভরা মুখ অপ্রসন্ন মুখে বদলে গেল। টেবিলে সাজানো হরেক রকমের নাস্তা মুখে আর রুচলো না। কান থেকে ফোনটা নামানোর পরপরই পর্বত সম গম্ভীরতা নিয়ে বসে রইলেন সোয়াদ। টেবিলের ঠিক মুখোমুখি দিকটায় মন বেজার করে দুশ্চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছেন আফসানা। ছেলে ভোরসকালে ওয়ার্কআউট করতে বেরিয়ে গেছে। এখনো বাড়ি ফেরেনি। ফেরার পর এই সংবাদ শুনলে কী ধরণের অবস্থা করে ছাড়বে আগে থেকে অনুমান করা যাচ্ছে না। ক্ষেপবে? চেঁচাবে? রাগে সুন্দর চোখদুটো ভীষণ ক্ষুদ্ধ হবে? একবার ভেবেছেন সুফিয়াকে দিয়ে রয়েসয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে তারপর ডেট পিছানোর একটা প্রসঙ্গ তুলে দিবেন। কিন্তু এই প্রথমবার সুফিয়া বোধহয় সাঈদের সামনে যেতেই মিনমিন শুরু করে দিয়েছে। কী একটা বিপর্যস্ত ব্যাপার! বুকে জমে উঠা চিন্তার বাষ্পগুলো ঠোঁট নিঃসৃত শব্দে স্বামীর দিকে বললেন,

– মেজর সাহেব, ছেলেকে যা বলার আপনি বলবেন। আমি এসবের মধ্যে থাকছি না। আপনার যত ধরণের বদ মেজাজি মুদ্রাদোষ আছে সব আপনার ছেলে পেয়েছে। আমি ওর মেজাজ দেখতে পারব না। আপনি সামলান।

এক মূহুর্ত্তের জন্য মনে হলো তার কর্মজীবি স্ত্রী যথেষ্ট স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে। আগুনের সামনে ধাক্কা দিয়ে পেছন থেকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে। কী নিষ্ঠুর মনুষ্য! সোয়াদ চোখ খাটো করে নিষ্ঠুর স্ত্রীর দিকে আরো গম্ভীর কণ্ঠে শুধোলেন,

– তুমি বলতে চাইছ সাঈদের গমগম করা মেজাজ আমার কাছ থেকে পেয়েছে?

– বলতে চাইছি না, ওটাই বোঝাচ্ছি। আপনি যে পথে হেঁটেছেন সেও এখন একই পথে হাঁটে। দুজনের মধ্যে আলাদা পার্থক্য আমি দেখছি না। উলটো এখন ভাবছি আমার বোনঝিটা আপনার পাষাণ ছেলের সাথে মানিয়ে উঠতে পারে কিনা।

এবার যেন গায়ে আগুনের হল্কা লাগল সোয়াদের। যতই ছেলের কর্মকাণ্ডে বিরূপ মনোভাব পোষণ করুক, দিনশেষে তারই রক্তকে নিয়ে পাষাণ উগ্র কটাক্ষ মন্তব্য করছে, এসব মানা যায়? তিনি বাজখাঁই স্বরে দ্বিগুণ ক্ষিপ্র মেজাজে আফসানার যুক্তিকে ফালা ফালা করতে এগুলেন, কিন্তু সেসময় ভাগ্য সারথি যেন উলটো সোয়াদকেই কলাগাছ দেখিয়ে থামিয়ে ছাড়ল। হাঁট করে খোলা সদর দরজা দিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে প্রবেশ করল সেই চিন্তার দূত। গায়ে তার জংলী সবুজ রঙা টিশার্ট, কালো ট্রাউজার। রোদ্দুরের মৃদু তাপে গলা ও মুখ ঘামে ভিজে হালকা কেমন লালচে ছাপ পরেছে। ডাইনিং টেবিলে বরফের মতো ঠাণ্ডামূর্তিতে বসে থাকা আফসানা আলুর মতো চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বারবার ছেলেকে কথাটা জানানোর জন্য চোস্ত ইশারা করতে লাগলেন। সোয়াদ আড়চোখে ছেলের আগমন দেখে সেই যে চোখদুটো ঠাণ্ডা নাস্তার দিকে নত রেখেছেন, আর সেটা তুলছেন না। একটু আগে এই নাস্তাই কিনা ভদ্রলোকের মুখে রুচছিল না। কী নাটক! আফসানা চরম অতিষ্ঠ হয়ে দ্রুত একটা কাশি দিলে এবার চোখ তুলে তাকান সোয়াদ। বুঝতে পারেন ইশারাটা। সঙ্গে সঙ্গে জোর গলাতে থামিয়ে উঠেন ছেলেকে,

– তোমার জন্য একটা সংবাদ আছে, দাঁড়াও। আমার মনে হয় সংবাদটা শোনা উচিত।

আচমকা পা থামিয়ে বাবার পানে চাইল সাঈদ,

– ওকে। সংবাদ পাঠ শুরু করুন। লাইভ টেলিকাস্ট শুনে ফ্রেশ হতে যাব।

কথার ছিরি দেখে সোয়াদ সাহেবের মেজাজ রুক্ষ রুক্ষ হলেও আফসানা বহুকষ্টে বাপ-বেটার তামাশায় হাসি আঁটকে রেখেছেন। এবার সোয়াদও ঠাণ্ডা মাথায় সুক্ষ্ম একধাপ চাল চাললেন,

– ডেট সম্ভবত পেছানো দরকার। তুমি তোমার মায়ের সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করে মিটমাট করো।

এক খাবলা চুন মাখানোর মতো ফ্যাকাশে দেখাল আফসানাকে। তিনি পারছেন না চোখের দৃষ্টিতেই ভস্ম করে দেন স্বামীকে। অন্যদিকে স্বাভাবিক ভ্রুঁ কঠিনভাবে কুঁচকে এমন উদ্ভট কথার হেতু বুঝতে পারল না সাঈদ। রান্নাঘরে থাকা সুফিয়া খানমের দিকে নজর ঘুরাতেই বেচারি সুফিয়া ভয়ে আঁতকে উঠে দুমাদুম রুটি বেলার বেলুনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সুক্ষ্ম সংকেতটা ভালো ঠেকল না। নির্ঘাত কিছু একটা বিপদ হয়েছে। মাথা ভরা প্রশ্ন নিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকল সাঈদ,

– আপনি কী সংবাদ পাঠের নামে আবারও আমার ধৈর্য পরীক্ষা করতে চাইছেন?

– তোমার ধৈর্য পরীক্ষা নেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এখানে কাবিনের ডেট পিছানো নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এটা নিয়ে খোলাখুলি বলা প্রয়োজন।

– একদিন আগে কোন অর্থে এটা আলোচনার বস্তু হয়? ডেট পিছানোর কথা এখন উঠবে কেন? যাবতীয় খোলাখুলি আলাপ গত শনিবার সন্ধ্যায় হয়নি?

– প্রশ্ন করা বন্ধ করো। যেটা নিয়ে আলোচনা করছি সেটা একটু আগে ঘটেছে। মেয়েটা ওই বাড়িতে সিঁড়ি থেকে পড়ে পাটা সম্ভবত ফ্র‍্যাকচার করে ফেলেছে। এখন তুমি কী চাও ফ্র‍্যাকচার পায়ের ব্যথাটা নিয়ে কাবিন হোক?

কুঁচকে রাখা ভ্রুঁদুটো আস্তে আস্তে আশ্চর্য রকম স্বাভাবিক হয়ে উঠল সাঈদের। যেন সে জানতো এরকম একটা কিছু অঘটন কাণ্ড তার ভাগ্যে ঘটবেই। প্রথম ক’মিনিট দুর্মনা ভাবটার সাথে খাপ খাইয়ে সচকিত হলো স্নায়ু মন। ডেট সে কিছুতেই পেছাবে না। দেখা যাক না, ভাগ্য আরো কী কী ছলাকলা দেখায়! দুর্মর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বুকভরা দম ছেড়ে জানালো,

– এটা ডেটিং ডেট হলে পোস্টপন করে দিতাম। আমার পক্ষে ওয়েডিং ডেট পেছানো সম্ভব নয়। কথাটা খারাপ শোনালেও কিছু করার নেই। আমি আমার জায়গা থেকে ভীষণ ব্যস্ত। যদি আগামীকাল না হয় তাহলে আজ হবে। আজ মানে আজই। এখন আগামীকাল ব্যাপারটা জুম্মা ওয়াক্তের পর ভালো হবে, নাকি আজ রাত আটটার সময় ঠিক হবে, সেটা মায়ের সাথে আলোচনা করে নিবেন। ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি বলা প্রয়োজন।

নিজের অকাট্য সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়চড় করল না জুনায়েদ সাঈদ। যে কথাগুলো একটু আগে সোয়াদের মুখ থেকে বেরিয়েছিল, সেগুলোই যেন যত্ন করে তার দারস্থে ফিরিয়ে দিল সে। আফসানা মজলুম জনতার মতো স্বামীর অবস্থা দেখে হাসতেও পারছেন না, আবার ছেলের অকাট্য ঠাস ঠাস বাচনভঙ্গি শুনে বেজারও হতে পারলেন না। তিনি জব্দ হওয়া ডাকাতের মতো অসহায় চোখে দূরপানে সুফিয়ার দিকে চাইলেন। সুফিয়া রান্নাঘর থেকে বত্রিশ দাঁতের ভেটকি হাসি দিয়ে খুশি খুশি ভাব বোঝাচ্ছে। সাঈদ যদি অমাবস্যার রাতে দেখে বলে “ওইযে সূর্য উঠেছে”, সুফিয়া তাতে সায় জানিয়ে বলবে “হ বাবা, রাইতের আন্ধারে কী ভালা সূর্য উঠছে!” তিনি আর ভাবাভাবির ভেতর গেলেন না। এই স্বৈরাচারী অবস্থার ভেতর দশ কদম দূরে সরে শান্তচিত্তে জানান দিলেন,

– আজ কোনো ঝামেলা করা ঠিক হবে না। তুই উপরে যা। হাতমুখ ধুয়ে নে। নাস্তা তোর সুফি খালা রুমে দিয়ে আসবে। আমি যা শোনার শুনে নিয়েছি। তোর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে এই প্রসঙ্গ এখানেই শেষ। আমি নাজুদের ফোন করে বাকিটা জানিয়ে দিচ্ছি।

– ধন্যবাদ। মাঝে মাঝে তুমি বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করো। ককর্শভাষী মেজরদের মতো খ্যানখ্যানে স্বভাবটা দেখাও না। ভালো।

গনগনে আগুনের ভেতর এক বোতল কেরোসিন ঢেলে চুপচাপ সেখান থেকে প্রস্থান করল জুনায়েদ সাঈদ। আফসানা কী যেন বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসিতে পানি পান করলে সামনে থেকে সোয়াদ ভ্রুঁযুগল খিঁচে তড়বড়িয়ে করল,

– সানা? ও কী আকারে ইঙ্গিতে আমাকে খোঁচাটা দিল? আমি কর্কশভাষী? খ্যানখ্যানে?

.

পর্দার ফাঁক গলে একচিলতে দুষ্টু রোদ কোলের উপর তাড়া করে ঘুরছে। মৃদু ভোল্টেজে চলতে থাকা ফ্যানের বাতাসে দুলছে জানালার পর্দা। পর্দার দুলকি চালে দেখা মিলল সোনালি সূর্যের দাপটে চিত্র। যেন সবটুকু তেজ ঐশ্বর্য লালন করে মধ্য আকাশে অবস্থান করছে সূর্যপিণ্ড। বাঁহাত ভরে রিনিঝিনি শব্দতরঙ্গে একঝাঁক চুড়ি পরতেই আয়নায় দৃষ্টি তুলে চাইল। কাঠের চেয়ারে বসে ফ্র‍্যাকচার পাটা নীচু একটা টুলে রাখা। একটা নরম কাপড় দিয়ে পা-টাকে বেঁধে ছোট্ট একটা কুশনের উপর রেখে গেছে মা। আয়নায় গুচ্ছ গুচ্ছ নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে গায়ের সমস্ত বর্ণিল আভরণ। নিজেকে নিয়ে ভারী দুর্ভাবনার ভেতর কুণ্ঠিত হচ্ছে মন। বিয়ের রঙ সবসময় হয় লাল। টকটক করা অরুণ রাঙা লাল। সেখানে ওই অদ্ভুত মানুষটা পছন্দ করেছে আরো অদ্ভুত রঙ। ঘিয়ে রঙের মাঝে হালকা সোনারঙ মেশানো স্বল্প ভারী শাড়ি। মাথায় শাড়ি ম্যাচিং লম্বা একটা দোপাট্টা। মাঝারি শেপে গলা, কনুই সম হাতা, ওভার সাইজ একটা ব্লাউজ। ব্লাউজটা ইচ্ছে করে আর চাপিয়ে নেওয়া হয়নি। লাজ মাখা চেহারায় হালকা মেকআপের ক্ষীণ স্পর্শ। ঠোঁটে লাল খয়েরি রঙের চিত্ত আকর্ষণ করা সৌন্দর্যটুকু, দু’চোখের পাপড়িতে মাসকারার ঘন প্রলেপ, চিকন করে টানা আইলাইনারের রেখা, আদুরে পেলব গলায় মোটা প্রশস্ত হার। কোনো এক বিশেষ কারণে চুলগুলো ছেড়ে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কপালে ঝুলে থাকা ওই গোল টিকলি, টিকলির পথ ধরে চুলের মাঝ সিঁথিতে মাথাপট্টি অলংকার, নাকে হালকা ভারের নাথনি। কানে কোনোপ্রকার অলংকার জড়াতে নির্দেশ দেয়নি। লাল বেনারসি শাড়িতে আপাদমস্তক গহনায় জড়ানো যে ছকবাঁধা নিয়মটা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে, তা যেন ফুঁ মেরে নিজের মর্জিটাই এখানে পালন করেছে ওই জাঁদরেল লোক। কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নীচতলা থেকে মায়ের সচকিত উচ্ছ্বাস। বাবার আমোদে ভরা গর্বিত কণ্ঠ। ফিমা আপুর হঠাৎ বদলে যাওয়া অন্যরকম আচরণ। কিন্তু নিজের ভেতরে টের পাচ্ছে ঝড়ো ঝড়ো অবস্থার কাঁপন। হঠাৎ টুকটুক শব্দে দরজায় মৃদু কড়াঘাত করতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল আফসানা,

– বুড়ি কী রেডি?

ভ্রম ভেঙে আয়নার মাঝে ওই প্রিয়মুখটি দেখতেই ঠোঁটে সলজ্জ হাসি ঝুলালো। উঠে দাঁড়াতে অক্ষম বলে মাথাটা নিঃশব্দে নাড়িয়ে ভেতরে আসার ইঙ্গিত বোঝাল। কিন্তু তা বোঝানোর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করল একগাদা মুরুব্বি মানুষ। সঙ্গে বাবার মলিন মুখ। পিছু পিছু মার নীচু রাখা দৃষ্টি। বারবার আঁচলের প্রান্ত টেনে ‘ “চোখে ময়লা ঢুকেছে’ কথাটা বলে চোখ মুছে নিচ্ছে। ও জানে, মায়েদের চোখে কেন হঠাৎ হঠাৎ এমন ময়লা ঢোকে। গতরাত থেকে শব্দশূন্য ঠোঁটদুটো সহসা কেঁপে নাকের আদুরে ডগায় লাল আঁচ পড়ে। ঝরঝর করে দুচোখ থেকে ঝরতে থাকে মুক্তো ফোঁটা। নত করে রাখা ওই মানবীর কাছে তিনবার জানতে চাওয়া হয় “কবুল” শব্দ। তিনবারই গলায় কাঁটার মতো আঁটকে যাওয়া স্বর নিংড়ে উচ্চারণ করে কবুল। প্রতিবার ওই একটি শব্দ শুনে হাতের রুমালটা চোখে ব্যবহার করেন নিয়াজ। মনে পড়ে যায় দু’হাতে দুটো মেয়ের হাত ধরে ধরে ঘুরার মূহুর্ত। ডানহাতে শক্তভাবে ধরা চন্ঞ্চলমতি হাতটিই তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন অন্যের দ্বারে। ছেলে সন্তানের মতো যদি মৃত্যুর শেষদিন অবধি কাছে রাখার নিয়ম হতো, তবে তিনি মেয়েদের বেলাতে তা-ই করতেন। “আলহামদুলিল্লাহ্” স্বরে বধূর রুম থেকে সবাই বেরিয়ে গেলে এবার দ্বিতীয় কার্যের জন্য ব্যস্ত হলো তারা। মসজিদ প্রাঙ্গণে বরপক্ষের কবুল পড়ানোটুকু সমাপ্ত করা হলো একইভাবে। মোহরানা ধার্য এবং অন্যান্য কুশলাদি নির্বিঘ্নতার সাথে সম্পন্ন হল অবশেষে। বিদায়কালে মায়ের হাত ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামা ফিহা একপলকের জন্য ফাহাদের পাশে চাইল। কবুল বলে গ্রহণ করা “স্বামী” নামক পুরুষটি সোফায় বসে টি টেবিলে কিছু একটা সাইন করছে। সিঁড়ির দিকটায় পিঠ দিয়ে থাকায় তাঁর আজকের মুখটি দেখতে পায়নি ও। শুধু একপলকের দেখায় বুঝতে পারছিল ওই স্বভাবসিদ্ধ কালো রঙটা আজকেও ছাড়েনি। গায়ে কালো রঙের শেরওয়ানি চড়িয়েই সে এসেছে।

গাড়ি পর্যন্ত মেয়েকে তুলে দেওয়ার কাজটুকু করে দিলেন নিয়াজ। দোপাট্টায় ঢাকা মেয়ের মুখের দিকে একবার শুধু তাকিয়ে মাথায় হাত বুলালেন নীরবে। কিছু একটা বলতে গিয়েও রুদ্ধ স্বর চিঁড়ে কিছুই বেরুলো না। অতঃপর বিদায় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দু দুটো গাড়ি প্রকৃতির কমলা রোদ মাখিয়ে যাত্রা করল। আসরের ওয়াক্ত শেষে শান্ত বিকেলের নির্জনতায় ডান হাত নেড়ে বিদায়ী সম্ভাষণ জানিয়ে দিলেন। গাড়িদুটো দৃষ্টিসীমানার বহুদূর পথে অদৃশ্য হয়ে গেলে নিজের ঘরে যান নিয়াজ। স্ত্রীকে নির্দেশ দেন এক কাপ চায়ের জন্যে। একটা প্রেশারের ঔষুধ খাওয়ার ইচ্ছায় নিজের ঔষুধের বাক্সটা খুলে ফেললে সেখানে দেখতে পান এক খাম চিঠি। চিঠি কোত্থেকে এলো এটা ভাবতে ভাবতেই খামের মুখটা ছিঁড়ে ফেললেন তিনি। টানটান করা কাগজটায় ছোটো ছোটো হস্তাক্ষর দেখে চোখে চশমা পড়লেন নিয়াজ। ঝকঝকে দৃষ্টিতে ফুটে উঠল সুন্দর মুক্তো ঝরা হস্তাক্ষর,

একজন সৎ বাবা,

জানি এটা কাবিন পরবর্তী বিয়ে। বিয়ের পর একটা মেয়ে বাবার বাড়িতে থাকে না। যেখানে আমার নিঃশ্বাস শুরু, সেখানেই আমি মেহমান। তোমার ঘরে ছেলে হয়ে জন্মাইনি বলে আমার খুব দুঃখ আছে। ছোটো থেকে দেখে এসেছি দাদী আমাকে পছন্দ করতেন না। তিনি সবসময় বলতেন আমি তোমার জন্য ঝোলাভর্তি বোঝা হয়ে এসেছি। আমার তখন কেমন লাগতো সেটা আর বলব না। কিন্তু প্রচণ্ড খারাপ লাগতো আমার। কখনো এমন কিছু করিনি যেটা দ্বারা তুমি বা মা কষ্ট পাও। আমার জন্য সত্যিই এটা দুর্ভাগ্য যে এতো বড়ো হয়ে গিয়েছি, কিন্তু করতে পারলাম না কিছুই। আমার বয়সী কোনো ছেলে থাকলে তোমার ওই ভারি কাঁধদুটোর বোঝা অনায়াসে তুলে নিতে পারতো। সেখানে আমি তোমার সর্বস্ব সম্পদ কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছি। বাবা, এই ঠুনকো সমাজের নিয়মটা যদি এমন হতো, যেখানে আজীবন একটা মেয়ে থাকবে বাবার কাছে, বাবা থাকবে মেয়ের কাছে, তাহলে চোখ বন্ধ করে আমি তা-ই করতাম। আমি জানি না শেষ বয়সে এসে কীভাবে তোমাদের দিনগুলো কাটবে। কীভাবে আমার মাকে নিয়ে একা একা নিরালার ভেতর গুজরান করবে তুমি। আমরা দুটো মেয়েই তোমাদের নিঃস্ব সর্বস্ব করে দিয়ে চলে যাব। যদি কিছু করতে পারতাম শুধু তোমার জন্য, শুধু তোমাদের মতো দুটো মানুষের জন্য, আমার এই ছোট্ট জীবনে একধাপ দুঃখগুলো বোধহয় ঘুচে যেতো . .

টিউশনির প্রথম বেতনটা তোমার আলমারির ড্রয়ারে রেখে এসেছি। মা জানে না। তাকে জানিয়ো না। ওগুলো তুমি খরচ করো। সেখানে অল্পকিছু টাকা আছে। বেশি রাখতে পারিনি। গত দু ইদে যেটুকু টাকা পেয়েছিলাম, সেটাও তোমার হিসাবের খাতায় ভাঁজ করে রাখা আছে। মা দেখার আগেই তুমি সময় করে ওগুলো বুঝে নিয়ো। কিছু কথা থাকে, যা কখনো বলা যায় না, মুখ ফুটে জানানো হয় না। সে কথাগুলো বলতে গেলে চোখ ভিজে আসে করুণভাবে। গলা আঁটকে আসে বাজেভাবে, বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে ছিঁড়ে যায়। কী অদ্ভুত এক অবস্র্থ চলে তা তো আসলে বোঝানো যায় না। আজ তোমার হাত, তোমার ছায়া, তোমারই স্নেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। বিদায় নিচ্ছি তোমার বিশ্বস্ত ছায়া কাছ থেকে। দুনিয়ায় হাজারো মানুষ আদর দিয়ে ‘ মা ‘ ডাকবে, কিন্তু তোমার মতো মধুর স্বরে কেউ কোনোদিন ডাকবে না। তোমার ক্লান্ত চোখে আজ পানি দেখলাম, তোমার জীর্ণ মুখে কষ্ট, তোমার আদরে বড়ো হয়েছি, তোমারই হাতে আজ ছিন্ন।

ভালো থেকো। জীবনের কষ্টগুলো তোমার স্বার্থক হোক। এই আমৃত্যু ঋণ চুকাতে পারব না।

ইতি,
ঋণী সন্তান,
নাবিলা হক ফিহা।

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here