নির্মোচন পর্ব ২৯ এর শেষ অংশ

0
279

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৯ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
[বাড়তি শেষ খণ্ড] .

ফুলে লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটো ঘোমটার আড়ালে ঢাকা। গায়ে মখমলী কাপড়ের খয়েরী নরম চাদর। নববধূর বেশে ওই নরম চাদরটুকুই সমস্ত শীত নিবারণ করে দিচ্ছে। কোত্থেকে গা শিরশির করা শীতালু কামড় এসেছে জানা নেই। ডানপায়ের উপর এখনো কাবু করতে পারছে না। ভাগ্যিস ড্রাইভ করা পুরুষটি বেশ দক্ষ এবং সচেতনতার সাথে আঁকাবাঁকা ভাঙা রাস্তা বুঝে শুনে চালাচ্ছে। এখনো ডানপাশে চোখ ঘুরানোর মতো ভয়াবহ সাহসটি হয়নি। কুণ্ঠা জড়ানো মনটা নিয়ে ভীষণ চুপটি করে বসে আছে। কানে ভেসে আসছে তীব্র বলিষ্ঠ কণ্ঠের কিছু পরোক্ষ ছোট্ট খাটো নির্দেশ—যা মূলত ইংরেজি বাক্যে ভরপুর। মুখ ফুটে বলতেও পারছে না এসির পাওয়ারটা কমিয়ে দিতে অথবা বন্ধ করে দেওয়ার কথাটা। দু-একবার কান্নাভেজা কণ্ঠে নাক টেনে নেওয়ার শব্দ করলেও পাশ থেকে ব্লুটুথে কথা চালানো ব্যক্তিটি শুনতে পেল না। শুক্রবার বলে বিকেলের ব্যস্ত সড়ক বেশ ফাঁকা ফাঁকা, যানজট নেই। পুরোটা রাস্তাজুড়ে ওভাবেই ব্যস্ত সমস্ত কড়া আদেশের ফোনালাপ চালিয়ে একরাশ বেজার মুখ নিয়ে ধানমন্ডির বাড়িতে প্রবেশ করল সাঈদ। গেটের দুই দারোয়ান সালাম ঠুকে গেট খুলে দিলে গাড়িটা ড্রাইভ-ওয়ের জায়গাটুকু অতিক্রম করে গাড়ির পার্ক দোরগোড়ায় এসে থেমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে নিজের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর পানে তাকালে হঠাৎ বুঝতে পারল ওর গায়ে থাকা খয়েরী চাদরটা ভীষণ আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে। ব্যাপারটা অনুমান করতেই সঙ্গে সঙ্গে এসির পাওয়ারটা পুরোপুরি বন্ধই করে দিল সে। স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে ঘোমটায় নীচু করে থাকা মুখটির মাথায় আলতো হাত রেখে শুধোলো,

– ঠিক আছেন?

মাথায় অনুভব করা শক্ত হাতের স্পর্শের চাইতে কণ্ঠের ওই চিন্তাটুকুই ভীষণ স্পর্শ করল ওকে। মৃদুভাবে “হ্যাঁ’ সূচকে মাথাটা নাড়িয়ে দিলে প্রাপ্ত উত্তরটুকু বুঝতে পেরে হাতটি সরিয়ে নিল সাঈদ। গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকটা আধা পাক ঘুরে বাঁদিকের দরজায় এসে ওরকম প্রশ্রয় মেশানো কণ্ঠে বলল,

– পায়ে ভর রাখতে পারেন?

একবার ভাবল পূর্বের মতোই মাথা নাড়িয়ে “না’ জবাবটুকু বুঝিয়ে দিবে। কিন্তু কী যেন ভেবে নীচু করে রাখা চোখদুটো নিঃশব্দ ভাবনা কষে কিছুটা স্তিমিত স্বরে জানাল,

– হাত ধরলে হাঁটতে পারব।

একপলক পায়ের অবস্থার দিকে নজর বুলিয়ে মনে মনে অন্য আরেক দুর্ভাবনা নিয়ে ভেবে চলেছে ফিহা। সিঁড়ি থেকে পরে যাওয়ার সময় কিছুটা বিপজ্জনক ভাবে আরেকটি চোট শরীরে লেগেছে। গাড়ির সীটটা ভীষণ আরামদায়ক ও নরম ছিল বলে এতোক্ষণ সেই চোটটা নিয়ে ভয়ংকর সব চিন্তা কাজ করেনি। দুঃসাহস দেখিয়ে নিজেই সীট থেকে নামার চেষ্টা করলে হঠাৎ দুটো বিপজ্জনক হাত ওর হাঁটুদ্বয়ের নীচে, ঘাড়ের কাছে প্রবেশ করে ঝট করে তুলে নিল শূন্যে। ফিহা কিছু বুঝে উঠার আগেই বুঝতে পারল ও এখন বাহুদৃঢ়তার ভেতর আঁটকা, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আগল দেওয়া ওই শক্ত সৌমর্থ বুকটার অসম্ভব কাছে, ঘোমটায় ঢেকে থাকা নিজের সলজ্জ মুখের ভীষণ নিকটে একপ্রস্থ গরম শ্বাসগুলো অনুভব করতে পারছে। চোখজোড়া এখনো খুলেনি ও। হয়ত চোখ খুলে রাখলে এটাও দেখতে পেতো অতো কাছাকাছি এসেও দোপাট্টার পর্দাটুকু যেন সহ্য করতে পারছে না সাঈদ। পরমা স্ত্রীর মুখটা এমন নির্জনে দেখার দুর্লভ লোভে লোভী হয়ে মুখ নামিয়ে ঘোমটার কাপড়টুকু দু’ঠোঁট দ্বারা চেপে ধরল সে। হাতদুটো বাঁধা না থাকলে হয়ত দুহাতেই সরিয়ে দিতো ঘোমটার আবরণটুকু। অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ অনুভব করতেই গলায় শ্বাস আঁটকানোর মতো অদ্ভুত বিহ্বলতায় কুঁকড়ে উঠল ফিহার মন। কী করতে চাইছেন উনি? এই গাড়ি পার্ক করা জায়গায় খোলা আকাশের নীচে এখনই . . ওরকম . . আকণ্ঠ কুণ্ঠায় কুণ্ঠিত হয়ে মুখে রক্ত জমলো ফিহার। অন্যদিকে এককথার জাঁদরেল লোকটা তখন দুঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরা ঘোমটাটুকু এক ঝটকায় সরিয়ে দিতেই নির্মোচন করল স্ত্রীর সলজ্জ মুখ। অনিমেষ চোখদুটো দিয়ে মন ভরে ভরে অপেক্ষমাণ প্রতিটি সময়ের ফোঁকর যেন ভরাট করল সে। দীপের বাড়ি থেকে বিদায়কালীন মূহুর্ত্তেও দেখা দেয়নি নিজেকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আকাঙ্ক্ষী মন কেমন ব্যগ্র প্রলুব্ধ হয়ে উশখুশ করছিল, তা বুঝতে দেয়নি একদণ্ড। বুকে জমাটবাঁধা কথাগুলো ছেঁকে ছেঁটে একবাক্যেই জানান দিল সে,

– আপনাকে মিস করেছি।

চোখ বুজে রাখা পাতাদুটো মেলে চাইতেই নিঃশব্দ দৃষ্টির মাঝে ধরা দিল নাবিলা হক হয়ে। এতোখানি মিস করেছে বলেই কী সঙ্গে করে একমাসের জন্য এনে ফেলল? আর থাকতেই দিল না এ কদিনের দূর সীমানাতে? মুখের উপর ঝুঁকে থাকা ওই আবেগ বর্জিত স্থিরমুখ কিছুই তখন করল না। মুখ ঘুরিয়ে পিছু থাকা বড়ো গেটের দিকে একপলক তাকাতেই দু দুটো দারোয়ানকে দেখতে পেল যথেষ্ট কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে। যাক, এবারের দারোয়ান দুটো অতিশয় ভদ্র এবং সুশীল; প্রাইভেসি জিনিসটা দক্ষভাবেই বোঝে ও জানে। পা চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সুনশান বাড়ির আনাচে কানাচে হাঁটার পদশব্দ ছাড়া তেমন কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। এখনো ফেরেনি দ্বিতীয় গাড়িটির মানুষজন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় শরীরের ওই চোটপ্রাপ্ত স্থানে আর ব্যথা না লাগুক, তাই ডানহাত বাড়িয়ে কালো পান্ঞ্জাবীর কলারটা মুঠোয় চেপেছে ফিহা। সিঁড়ি ভেঙে যত উপরের দিকে উঠছিল, মনে মনে ততই আশ্চর্য হয়ে ভাবছিল, একদিন মেহমান হয়ে এ বাড়ির প্রতিটি ঘরে ঘুরেফিরে এসেছে, দেখেছে, কখনো কিছু কিছু ব্যাপারে হাত ছোঁয়াতে নিজে থেকেই গুটিয়ে গেছে। আর আজ এ বাড়ির একছত্র রাজশ্রী রূপে রাজার একান্ত বাহুশয্যাতেই আবদ্ধ হয়ে সুন্দর ঘরটায় অগ্রসর হচ্ছে। এই নির্জন নিস্তব্ধ শেষ বিকেলের অরুণ রাঙা রক্তিম প্রকৃতির মাঝে আসঙ্গ গ্রন্থি রচনা হবে কী? হবে কী প্রকৃতির বানানো সেই আদম থেকে আসা আদিম এক নিয়মের প্রণয়সঙ্গ? কাঠের আধ ভেজানো দরজাটা বাঁ কাঁধের আলতো ধাক্কায় খুলে ফেললে গলাটা সহসা ভয়ে শুকিয়ে এলো ফিহার। ফ্লোর ছুঁই ছুঁই পর্দা ঝুলোনো জানালায়, বার্নিশে চকচক করা বাদামী রঙের বারান্দার দরজা, শূন্য টানটান পরিচ্ছন্ন বিছানা . . এখন সবই তার। শুধুমাত্র তারই। বড়ো অদ্ভুত কারণে ঘরের ভেতরে না ঢুকেই চৌকাঠের বাইরে থেকে আবারও মুখ নীচু করল জুনায়েদ সাঈদ। কোমল কপালে থাকা গোল ওই টিকলির অলংকার ঠোঁটের দ্বারা সরিয়ে সেখানে বসিয়ে দিল দুই তপ্ত ঠোঁট। বুকের ভেতরে সপাটে আছড়ে পরা অনুভূতিগুলো ফিহার আকম্প অন্দরে এলোমেলো করে ছুটল। ছুঁয়ে থাকা ওই ওষ্ঠ স্পর্শের মাঝে পায়ে পায়ে হেঁটে সাঈদ বিছানার কাছে এসে শুইয়ে দিল বাহু আবেষ্টন রাখা শরীরটুকু। একটা হাত বালিশের উপর ভর হিসেবে রেখে মুখের উপর খানিকটা ঝুঁকে আশ্বস্ত করা কণ্ঠে বলল,

– ঘর থেকে বের হবেন না। একটু পর সবাই চলে আসবে। রেস্ট নিন।

কথাটা শুনে হঠাৎ মনে হলো সে এখন চলে যাচ্ছে। কপাল কুন্ঞ্চন করা কৌতুহল বিদ্ধ চোখে ফিহা জিজ্ঞেস করল,

– আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

– কাজ আছে।

– আজ শুক্রবার!

– অফিসে যাচ্ছি না। বাইরে কিছু কাজ আছে। সাম আনসর্টেড ওয়ার্ক। থাকুন।

এ দফায় আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না ফিহা। শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকা একজন লোক ওই শেষের কথাগুলো দ্বারা কী বোঝাল তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ওর প্রশ্ন জর্জরিত মুখের পানে চেয়ে সাঈদ চতুর একটা ইঙ্গিত ছেড়ে বলল,

– আপনি আমার সিচুয়েশন বুঝলে শুক্রবারের রেসপেক্টটা করতেন। নিজের প্রতি খেয়ালটাও রাখতেন। আপনি কোনোটাই রাখেননি। এভাবে পা ফ্র‍্যাকচারের অজুহাত দেখিয়ে আপনাকে কোলে তুলতে হতো না। যে কারণে আপনাকে এমনিই কোলে তুলে আনতাম, সেটা এতোক্ষণে আমার কাজে কর্মে ভালোভাবে বুঝে যেতেন। আই উইল কাম ব্যাক স্যুন। টেক রেস্ট।

ঝুঁকিয়ে রাখা মুখ, বাঁ হাতের ভর উঠিয়ে একপ্রস্থ মন খারাপ করা প্রশ্ন ছেড়ে সাঈদ বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে অখণ্ড নীরবতার ভেতর রেখে গেল ফিহাকে। একটুপর ফিহা শুনতে পেল গাড়ির ভুম ভুম শোরযোগে চলে যাওয়া শব্দগুলো। জানালা দিয়ে আসা দিনের ফ্যাকাশে আলোয় ম্লান হয়ে আছে সদ্য নববধূর মুখ।

.

শূন্য হয়ে যাওয়া ছোটোবোনের ঘরটা গুছিয়ে দিচ্ছে ফিমা। আজকের পর ওর ঘাড় থেকে একমণ টেনশনের বোঝা নামলেও কতদিন সত্যটা গোপন রাখতে পারবে জানা নেই। বাবার কান অবধি যদি ওই সত্যটা পৌঁছে যায়, তাহলে বাবা এক্ষুণি ওর গলা কেটে শীতলক্ষ্মার নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসবে। এতো বড়ো অপকর্মের পর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায় কিনা সেটাও এক প্রশ্ন। যদি ফিমা জানতো ওর একটা ভুল পদক্ষেপের জন্য পুরো জীবন ধ্বংসের মুখে পতিত হবে, তবে কক্ষনো বন্ধুদের প্ররোচনায় সাজেক ট্যুরে যেত না। বারবার ফিহার নিষেধ করা বাক্যগুলো যদি রাগ দেখিয়ে বুক চিতিয়ে দমিয়ে না দিতো, তবে হতো না এই মহা ভুল। ভয় ঘনানো দুশ্চিন্তার ভেতর বিকট শব্দযোগে বেজে উঠল ফোন। সামান্য রিংটোনে পিলে চমকে উঠার মতো কেঁপে উঠলে তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে তুলল সে। কলার নামটা দেখে বুক শুকিয়ে এলো। ঘণ্টা দুয়েক আগেই যাকে চোখের সামনে থেকে বিদায় দিয়ে এলো, সেই ব্যক্তি এখন বিবাহিতা স্ত্রী রেখে কল দিচ্ছে? তাড়াতাড়ি ঘরের দরজাটা বাড়তি সতর্কতার জন্য বন্ধ করে আবারও বিছানার কাছে এসে থামল,

– হ্যা-হ্যা-হ্যালো . . .

– নীচে নাম। তোর মাকে বলবি অমুক ফ্রেন্ড তোকে অ্যাসাইমেন্ট দেওয়ার জন্য মেইন রোডে ডেকেছে। তুই ইম্পর্ট্যান্ট অ্যাসাইমেন্ট শীটটা নেওয়ার জন্য যাচ্ছিস। ঠিক আধঘণ্টার ভেতর ব্যাক করবি। বাসায় টেনশন না করতে।

– ঠিক আছে, আমি আসছি।

– সঙ্গে করে ওর সেলফোনটাও আনবি। ওটা ভুল করে রেখে আসবি না।

– আচ্ছা ওটাও আনব।

– স্পটে এসে কল দে। আমাকে অপেক্ষা করাবি না। আমি আর্জেন্ট বাসায় ফিরব।

– ওকে ভাইয়া, লেট করব না। আমি আসছি।

কান থেকে ফোন নামিয়ে তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে নীচে যেয়ে দুগ্লাস ঢকঢক করে ঠাণ্ডা পানি খেল। তৃষ্ণা নিবারণের চাইতে ভয় নিবারণের জন্যই যেন গলাটা খাঁ খাঁ করছিল। ফিহার ফোনটা মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকায় মায়ের রুমে চুরি করে ঢুকে ড্রয়ার থেকে ফোনটা গুম করে বেরুল। বাবা বাথরুমে, হাতমুখ ধুচ্ছে। মা রান্নাঘরে এঁটো বাসনগুলো সিঙ্কে পরিষ্কার করছে। কেউ দেখেনি, বাঁচা গেল। এই ফাঁকে তোড়জোড় করে কাঁধে ওর ভার্সিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে গলা উঁচু করে বলল,

– মা? আমি আধঘণ্টার ভেতর আসছি। সামান্তা কলেজের কিছু অ্যাসাইমেন্ট এনেছে, ওগুলো নিতে গেলাম। টেনশন করার দরকার নেই।

রান্নাঘর থেকে নাজনীন পুরো কথাটা শুনতে শুনতেই ভ্রুঁ খিঁচিয়ে “কোথায় বেরুচ্ছিস? এখন সন্ধ্যা . . ” বাকি কথাগুলো আর কর্ণগোচর হলো না ফিমার। ত্রস্তপায়ে বাড়ির বাইরে এসে অস্থিরপায়ে মেইনরোডের দিকে পা বাড়াল সে। যদি দশ মিনিটের মাঝে একমিনিটও দেরি করে পৌঁছয়, তাহলে আরেক স্তবক ঝাঁজালো ধমকানি শুনতে হবে ওর। এতোদিন চোখের এতোটা সামনে থাকা সত্ত্বেও নূন্যতম ভয় কাজ করেনি, বরং দুর্মর সাহসের মাত্রা যেন তিরতির করে বেড়েই গেছে। আর এখন কিনা অসুরের মতো ভয় লাগে তার আসল রূপটা দেখার পর। প্রচণ্ড ভয়! পাক্কা দশমিনিটের মাথায় মেইনরোডের উলটোপাশে একসাইডে পার্ক করে রাখা কালো গাড়িটা দেখতে পেল ফিমা। ব্যস্ত রাস্তার দুদিকে খেয়াল করতেই এবার দ্রুতবেগে রাস্তা ক্রস করে গাড়ির ড্রাইভিং সীটের পাশের দরজাটা খুলতে চাইল। কিন্তু তার আগেই একজোড়া অপলক চোখ শান্ত ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে পেছনে গিয়ে বসতে। পাশে নয়। অর্ধেক খুলে ফেলা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে পেছনের ব্যাকসীটে উঠে বসলো ফিমা। ব্যাগ থেকে তড়িঘড়ি করে বের দিল ফিহার স্মার্টফোন। বাইরে সন্ধ্যে ঘনিয়ে প্রতিটি মসজিদের মাইকে মাইকে মাগরিবের সুরেলা আযান শুরু হয়েছে। জানা নেই কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এই লোক। এই সন্ধ্যা, অন্ধকার নামা অবস্থায় গাড়ির ভেতরে থাকা লাইটটা জ্বালিয়ে দিতেই সামনের ওই চারকোণা আয়নায় দৃষ্টি আঁটকালো ফিমার। একহাতে স্টিয়ারিং সামলে কালো শেরওয়ানি পড়া কট্টর সুদর্শন লোকটা নীচের ঠোঁট কামড়ে আছে। কপালে তাঁর মৃদু কুন্ঞ্চন। কিছু যে একটা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ছকে চলেছে তা অনুমান করা সম্ভব। গাড়িটা কিছুদূর এগিয়ে ডানে মোড় নিয়ে বিসিক এরিয়ার পরিত্যক্ত একটা ফ্যাক্টরির সামনে থামল। চারপাশে কঠিন নীরবতা, আযান শেষ হয়ে সন্ধ্যের আঁচল আকাশের বুকটা ঢেকে দিয়েছে। দুটো শ্বাপদ চক্ষুর মতো জ্বলজ্বল করতে থাকা হেডলাইটের আলোয় সামনে যা দেখতে পেল, তা দেখে রক্ত হিম হয়ে গেল ফিমার! অপ্রত্যাশিত ঘটনার মোড়ে চোখ বড়ো বড়ো করে চমকানো চাহনিতে মুখ হাঁ করে ফেলল। কখন যে ভয়াবহ শ্বাসকষ্টের মতো জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করেছে সে হুঁশটুকুও নেই। কানে আদেশসূচকে সাঈদের সেই আসলরূপী কণ্ঠটা শুনতে পেল ফিমা,

– ডোন্ট ট্রায় টু ওয়েস্ট মাই টাইম ফিমা। আই হেভ টু গো!

ফিমা গাড়ি থেকে বের হতেই কিছুটা দূরে দেখতে পেল একটা র‍্যাবের গাড়ি। গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এলো র‍্যাবের অফিশিয়াল পোশাক পড়া একজন কর্মকর্তা। মাথায় কালো টুপি। বুকের ডানদিকে ছোট্ট নেমপ্লেটে লেখা “ইয়ামিন”। সাঈদ সেই কর্মকর্তার সাথে প্রোফেশনাল ভঙ্গিতে হ্যান্ডশেক করতেই চোখের নিমিষে চরম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল সেই র‍্যাব,

– বাটপার শা° লা! কই ভাবছি ধুমধাম করে বিয়ে খাব। তুই তো শা° লা নো বলে একা ছক্কা হাঁকায় বসে আছস! ‘

কথাগুলো বলতে বলতেই সটানে বুকে জড়িয়ে ধরল বন্ধু বর সাঈদকে। বহুদিন পর সাক্ষাৎ পাওয়া বন্ধু ইয়ামিন আদিবকে গম্ভীরতা নিয়েই প্রত্যুত্তর করল জুনায়েদ সাঈদ,

– সবাইকে মনে হয় না সেপারেটলি ইনভাইট করতে হবে। তোদের সবাইকে আসতে বলেছিলাম। একেকজন বিজি স্ক্যাজিউলে আঁটকা পরলে আমার এখানে কোনো দোষ নেই।

দুই বন্ধুর অবস্থা দেখে ফিমা অবাক, হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে ঢোক গিলছে। পাঁচ বন্ধুর ভেতর আরেক বন্ধু কিনা পেশায় “র‍্যাব” কর্মকর্তা! যেই র‍্যাবদের দূর থেকে দেখলে আত্মারাম বাবাজি উড়াল দেওয়ার জন্য পাঁয়তারা করতে থাকে, সেই সাক্ষাৎ যমদূত কিনা সাঈদ ভাইয়ের বন্ধু! কী ভয়ংকর চিত্র খোদা! সংক্ষিপ্ত কুশলাদি শেষ করে এবার ফিমাকে তর্জনীর ইশারায় কাছে আসতে বলল আদিব। ভয়ে ভয়ে ফিমা সামনে এসে দাঁড়াতেই আদিব পকেট থেকে প্রিন্ট করা কাগজের একটা ছবি সামনে ধরল,

– মিস ফিমা, একে চিনেন নাকি দেখেন তো। চিনলে বলেন।

ফিমা কিছু সেকেন্ড খরচ করে ছবি থেকে চোখদুটো র‍্যাবের দিকে ফেলল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতির স্বরে জানান দিল,

– চিনি।

– নামটা প্লিজ বলবেন? আপনার মুখ থেকেই শুনি। বলেন।

একপলক দৃষ্টি ঘুরিয়ে সাঈদের ভ্রুঁ কুঁচকানো মুখের দিকে চেয়ে আবারও র‍্যাবের পানে জবাব ছুঁড়ল,

– আআফিফ।

– আফিফ ইসলাম?

– হ্যাঁ।

– আপনার “ওই” ভিডিয়োটা অন এয়ারের পেছনে এই ছেলেরই হাত?

– হ-হ. .হ্যাঁ।

– কী কারণে আপনার বোনের পেছনে প্রতিশোধ তুলতে চাইছিল? সেদিন তো আপনার তখন বাসে থাকার কথা ছিল, তাই না মিস?

এই পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পরার মতো মাথা নীচু করে ফেলে ফিমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের ইডেন প্রতিষ্ঠানে যখন ভর্তি হয়, তখন থেকেই আফিফ ইসলামের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ। যোগাযোগ শুরু হওয়ার মাধ্যম সোশ্যাল সাইট হলেও পরবর্তীতে সেটা পাকাপাকি হয় দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে। আফিফ বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে তখন অধ্যয়নরত, দেশ ছেড়ে বাইরের দেশে স্যাটেল হওয়ার জন্য কষে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা কখন কীভাবে অন্য সম্পর্কে রূপ নেয় তা আজও ওর অজানা। তবে শুরু থেকেই এ সম্পর্কের ব্যাপারে ধরা পড়ে যায় ছোটোবোন ফিহার কাছে। প্রথমদিনেই ফিহা কড়ায় গণ্ডায় শক্ত গলায় জানিয়ে দিয়েছিল,

– তুমি যার সাথে রিলেশন চালানোর চেষ্টা করছ আপু, তার ব্যাপারে আরো খোঁজখবর নাও। এভাবে ঠাস করে সম্পূর্ণ অচেনা একজন ছেলের সাথে যেখানে সেখানে ঘুরতে যেয়ো না। তুমি কী জানো ওই ছেলেটার পরিবার কেমন? জিজ্ঞেস করেছ কোনোদিন? না জেনে কীভাবে প্ল্যান করছ সাজেকের ট্র‍্যাকে ওই ছেলেটার সাথে ঘুরার কথা?

সেদিন ঠাস করে ছোটোবোনের ডান চোয়ালে চড় মেরেছিল ফিমা। কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে সেই চড়টাই যেন উলটো সপাটে নিজের গালে ফিমার পরেছে। যদি বুঝতো, ওই ছেলে আবেগ অনুভূতির মিঠে মিঠে বুলি দ্বারা অন্যকোনো প্রপন্ঞ্চ করতে ব্যস্ত, তবে ওই পা° ষা ণটা পোশাক বদলানো ভিডিয়োটা কক্ষনো ধারণ করতে পারতো না।

– মিস ফিমা, আপনি থম মেরে শুধু শুধু সাঈদের সময়টা নষ্ট করছেন। ও কিন্তু আপনার মতো খালি হাত-পা নিয়ে বসে নেই। আপনার এই জবানবন্দ তামাশা শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চিন্তা করেন। বলেন এখন।

এতোক্ষণ পুরোনো ভাবনার খোলস থেকে বের হয়ে গলা খাকারি দিল ফিমা। পুনরায় চোখ তুলে স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে বলল,

– আমাকে অনেকদিন ধরেই শাষাচ্ছিল। একদিন রাতের বেলা পড়তে বসেছি, তখনও আমাকে কল দিয়ে ইচ্ছেমতো কথা শোনাতে শুরু করে। আমার বোন আমার পাশেই ছিল। ওর একটা বাজে ধরণের সমস্যা আছে। একবার ও চটে গেলে সামনে কে আছে ওটা কখনো বাছ বিচার করে না।

এতটুকু বলতেই স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য কিছুটা থামল ফিমা। গলা ভিজিয়ে আবারও কথাগুলো প্রস্তুত করতে থাকলে সাঈদের মনে তখন একটা কথা গভীরভাবে আঁচড় কাটল। বারবার, অগণিতবার ওই বাক্যটা মনের ভেতরে তর্জমা করল সাঈদ। “একবার ও চটে গেলে সামনে কে আছে ওটা কখনো বাছ বিচার করে না।” এর মধ্যে আবারও ফিমা বলতে শুরু করে দিল,

– আফিফের আচরণ সেদিন মোবাইলের বাইরে থেকে এতোটা রুডলি বোঝা যাচ্ছিল যে ফিহা বুঝতে পারে আমাকে বাবা-মা তুলে গালি দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আমি আর কিছু করব বা বলব, ও আমার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে সেদিনই আফিফকে চরমভাবে অপমান করে দেয়। আমি আগেই বলে নিচ্ছি, ও কিন্তু অশালীন ভাষায় কথা বলেনি। যা বলেছে সেটা যেকোনো মানুষের পিণ্ডি চটকে দেওয়ার জন্য এনাফ ছিল। ও তখনো ভিডিয়োর ব্যাপারে কিছুই বলতে গেলে জানতো না। জানলে হয়ত সেদিন আমার পক্ষে কথা না বলে চুপই থাকতো। আর আফিফকেও কিছু শোনাতো না। আমি বাসের ওই ব্যাপারে কিছু করিনি স্যার। আমি কিছুই জানতাম না।

কণ্ঠ আর্দ্র হয়ে আর কিছুই তেমন বলতে পারল না ফিমা। নতমুখে চোখ ভিজে আসা পানিটা মুছতে থাকলে ইশারায় আদিবকে থামতে বলল সাঈদ। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারও এখন বাড়িমুখো ফিরতে হবে। হাতে আজ অফুরন্ত সময় নেই। আদিব বন্ধুর ইশারায় সমর্থন জানিয়ে ফিমাকে সেদিনের মতো ইস্তাফা জানিয়ে যেতে বলল। চোখ মুছতে মুছতে ও গাড়িতে উঠে বসলে সাঈদ আর দেরি করল না। আধঘণ্টার জায়গায় দেড়ঘণ্টা লেগে যাওয়ায় হয়ত ফিমা ছোটো আন্টির কাছে মারদাঙ্গা বকা খাবে, কিন্তু তবু ওকে বিন্দুমাত্র বাঁচানোর মতো দয়ামায়া কাজ করছে না সাঈদের। একদণ্ড নয়।

.

টইটুম্বর জোৎস্নার আলো ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পরেছে রাতের শান্ত শহরটায়। দূরের বিল্ডিংগুলোতে পিছলে পরেছে রূপোলি ছটা। সেখানে ফুটে আছে ধোঁয়া জড়ানো ঝাপসা দৃশ্য। যেন ফুঁ দিলেই সমস্ত ধোঁয়া উবে গিয়ে পরিষ্কার হবে জায়গাটা। সুফিয়া খালার সাহায্যে হাত ধরে ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে ফিহা। বাঁপায়ে সম্পূর্ণ ভরটা রেখে ডানপা আলগা করে রাখা। ফ্র‍্যাকচার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া পাটা আসলে হাড় ভাঙা অবস্থার মতো গুরুতর হয়নি। তবু যদ্দুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফ্র‍্যাকচার শব্দ দ্বারা বেডরেস্টের পরামর্শ দিয়েছে। এই জায়গাটা এতো অদ্ভুত ধরণের ঠাণ্ডা ও নির্জন যে প্রকৃতির মাঝে জোৎস্নার বন্দনা দেখতে দেখতে সময় গুজরে যায়। চোখ বুজে বাকি ইন্দ্রীয় দ্বারা অনুভব করতে পারল, এই মূহুর্তে একটা গাড়ি প্রবেশ করেছে এবং গাড়িটির মালিক জোরে একটা নির্দেশ ছুঁড়ে বলল,

– এই সাইডের লাইটদুটো বন্ধ করে দিন। বাড়তি আলো লাগবে না।

ঝপ ঝপ করে বারান্দা মুখোমুখি ফর্সা লাইটগুলো নিভে গেলে কেমন একটা চাপ চাপ অন্ধকারে ঢাকা পড়ল ওটা। তবু সে অন্ধকার ফুঁড়ে জায়গা করে নিল চাঁদের গা চুয়ে পড়া আলো। হঠাৎ কয়েক মূহুর্ত পেরিয়ে যেতেই দরজার নব মোচড়ানোর শব্দটুকু শুনতে পেল ফিহা। বিকেল, সন্ধ্যা, রাতের নয়টা পেরোনো সময়টায় তাঁর আসা বুঝি এখন হলো। টাস করে রুমের লাইট নেভানো শব্দটা পেতেই পায়ের তলায় যেন ঠাণ্ডা ছোবল লাগল ওর। চোখ মেলে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর অভিনয়ে আকাশ পানে নিবিষ্ট হলো চোখ। সেই সঙ্গে টের পেল ওর বাঁদিকটা দখল করে দাঁড়িয়ে পরেছে সুদীর্ঘ মূর্তি। তাঁর দিকে ফিরে না চাইলেও বুঝতে পারছে, তাঁর ঠাণ্ডা প্রলুব্ধ চোখদুটো ওর মুখের দিকে স্থির। সহসা ও অনুভব করল, ভীষণ সন্তর্পণে ওই বিপজ্জনক হাতটা বাঁদিক থেকে কোমর বেষ্টন করে ডানদিকটায় থেমেছে। লজ্জায় ডুবো ডুবো চোখটা নত করতেই দেখতে পেল, পেটের ডানদিকটায় সাড়াশির মতো হাতটা রেখে দিয়েছে। ঢোক গিলে নীচের ঠোঁটে জিভ বুলাতেই পাশ থেকে ধীরকণ্ঠে প্রশ্ন ছিঁটকে এলো,

– রেস্ট না নিয়ে ব্যালকনিতে কি করছেন?

বুজে আসা স্বরটা ধাতস্থ করে জবাব ছুঁড়ল ফিহা,

– শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছিল। এখানে এসে দাঁড়িয়েছি বেশিক্ষণ হয়নি।

– ওহ। পায়ের ব্যথা সেরে গেছে?

– সুফি খালার হাত ধরে এসেছি।

– এই রুমে কী আপনি আগেও এসেছেন?

হঠাৎ এমন বেখাপ প্রশ্নের মানেটা বুঝতে পারল না ফিহা। মুখ ঘুরিয়ে বাঁপাশে চাইতেই সাঈদের মুখ দেখে মজা, দুষ্টুমি করা বা অন্যকোনো হেতু বোঝা গেল না। ফিহা কৌতুহল নিয়ে স্বাভাবিক সুরে জবাবটা রাখল,

– জ্বী . . অল্পক্ষণের জন্য। আপনার কফিম্যাট জারটা নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছিলাম।

এবার মুখের গম্ভীর অবয়ব যেন চাপা কৌশলে বদলে গেল সাঈদের। বাঁ ভ্রুঁ উঁচু করা তীক্ষ্ম কুটিল চাহনিতে ফিহার উচ্চতা বরাবর মুখ নীচু করে শুধোল,

– কফিম্যাট জারের উপর কিছু কী ছিল নাবিলা? মনে আছে দ্যাট নোটচিট?

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা— ব্যাপারটা মনে আছে কারো? রিয়েক্ট, কমেন্ট অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here