#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২০
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“এই ডিভোর্স পেপারে সই করে দাও মাহতাব!”
বুকের মাঝে অসীম কষ্ট চাপা রেখে বাইরে থেকে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রেখে আজ নিজের নামের পাশে ডিভোর্সি তকমা লাগাতে চলেছে সিরাত। মেয়েকে কোলের মাঝে আগলে নিয়ে সোফার এক কোণে বসে আছে সে। গতকাল সেই লাইভের পর সবাই এক এক করে সিরাতের বাসায় এসে হাজির হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ তাকে স্বান্তনার বাণী কিংবা বাহবা দিলেও মাহতাবের মা, বোন আসার পর থেকে সিরাতকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে হয়তো সে জবাব দিত। তবে আজ বাড়তি একটা কথা বলার মতো ধৈর্য অবশিষ্ট নেই সিরাতের মাঝে। ইতোমধ্যে সিরাতের পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব সবাই চলে এসেছে। বাসার মধ্যে ছোটখাটো ল*ড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে দুই পক্ষের মাঝে। সবাইকে শান্ত হতে বলে সিরাত মাহতাবের কাছে এগিয়ে যায়।
“আমি আর কোনো ঝামেলা চাই না। আমাদের দীর্ঘদিনের সংসারের ইতি টানার সময় এসে গিয়েছে মাহতাব। দয়া করে আর কোনো তর্ক করো না। বিনাবাক্যে ডিভোর্স পেপারে সই করে দাও।”
মাহতাব লজ্জায় মা*থা নিচু করে বসে আছে। গতকাল থেকে সকলের তিক্ত কথা শুনতে শুনতে সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন সবাই জেনে গিয়েছে, মাহতাব ছেলেটা বাজে, ভীষণ বাজে!
“সিরাত নতুন করে কি সব ঠিক করা যায় না? আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমাদের মেয়ের কথা ভেবে সবকিছু নতুন করে শুরু করা যায় না? জীবনকে তো দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত বলো?”
সিরাতের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সে উত্তর দেয়,
“মেয়ের কথা ভাবলে কি আর তুমি এমন কিছু করতে পারতে? তবে আজ কেন মেয়ের বাহানা দিচ্ছ? আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। ডিভোর্সি কথাটা সহ্য করে নিতে পারব। কিন্তু এতকিছুর পরে তোমার স্ত্রী হয়ে আমি থাকতে পারব না। আর আমাদের মেয়ে তো বড়ো হয়ে সবকিছু জানবে৷ তখন ওর সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিব। মেয়ে যদি চায় তাহলে আমি কথা দিচ্ছি ওকে তোমার কাছে দিয়ে যাব। যতদিন না নাবিহা বড়ো হচ্ছে ততদিন অবধি ওও আমার কাছেই থাকবে।”
সিরাতের শাশুড়ী মারজিয়া শেখ রাগে গজগজ করতে করতে বলেন,
“আমার ছেলের মানসম্মান তো সব শেষ করে দিয়েছ। তারপরেও যে মাহতাব তোমাকে রাখতে চাইছে এটা তো তোমার সৌভাগ্য। ছেলেদের এমন একটুআধটু সমস্যা থাকেই। তাই বলে কি সংসার ভাঙতে হবে?”
“আরে মা আমার তো মনে হয় সিরাতের অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে৷ নাহলে আমার ভাইয়ের পেছনে এভাবে লাগত নাকি?”
মাহতাবের বড়ো বোন তিশার কথা শুনে সিরাতের শরীর কেঁপে ওঠে রাগে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে বলে,
“আপু আপনি যদি বয়সে আমার থেকে ছোট হতেন না? তাহলে এখানে সবার সামনে আপনার দুই গালে আমি চারটে থা*প্পড় লাগিয়ে বুঝিয়ে দিতাম কোথায় কীভাবে কথা বলতে হয়। আপনার মা আপনাকে নূন্যতম সুশিক্ষায় বড়ো করতে পারেনি। তার প্রমাণ আজ নিজেই দিয়ে দিলেন আপনি।”
“সিরাত!”
“চিৎকার করবেন না। নতুবা আমি ভুলে যাব আপনি আমার স্বামীর বড়ো বোন৷”
এতক্ষণ যাবত সবকিছু চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল নজরুল শেখ। অবশেষে তিনি নিজের সমস্ত নিরবতা ভেঙে বলেন,
“সিরাত তোমার মতো মেয়েকে নিজের বউমা হিসেবে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম মা। কিন্তু আমার নির্বোধ ছেলেটা আসল হিরা চিনতে পারল না৷ হিরা ভেবে এতদিন কাঁচের পেছনে ছুটেছে বলেই আজ ক্ষ*তবিক্ষ*ত হয়ে গিয়েছে। আমার তোমাকে এই সংসারে থেকে যাওয়ার কথা বলার সাহস নেই। তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তাতে আমি দ্বিমত পোষণ করব না। এমন কুলাঙ্গার ছেলের সাথে থাকার থেকে সারাজীবন একা থাকা ভালো। তুমি নতুন করে তোমার জীবন শুরু করো মা।”
এই একজনের উপর সিরাত কখনো রাগ করে থাকতে পারেনি। মানুষটা যে তাকে বড্ড ভালোবাসে। নিজের মেয়ের মতো করে এতদিন সিরাতকে ভালোবেসেছে নজরুল শেখ। কথাগুলো বলার সময় তার চোখে পানি চিকচিক করছিল তা সিরাতের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
“বাবা এই পরিবারের আর কারোর সাথে সম্পর্ক না রাখলেও আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব। আপনার মতো শ্বশুর খুব ভাগ্য করে পাওয়া যায়। আপনি কখনো আমাকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি শ্বশুর বাড়িতে। ধন্যবাদ বাবা আমাকে এভাবে ভালোবাসার জন্য।”
সিরাতকে জড়িয়ে ধরে নজরুল শেখ কাঁদেন। তার মতো শক্ত মানুষটাও কাঁদছে ভেবে অবাক হয় সবাই। মেয়েটার কষ্ট তিনি অনুভব করতে পারছেন। ফলস্বরূপ একটু একটু করে নিজের ছেলের উপর ঘৃণা তৈরি হচ্ছে তার।
“কাঁদবেন না বাবা। আমার ভাগ্যে যা ছিল সেটাই হয়েছে। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আপনি দয়া করে নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। যা হয়েছে তাতে আপনার কোনো দোষ নেই।”
চোখের পানি মুছে নজরুল শেখ নিজের ছেলের কাছে এগিয়ে যায়। ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
“তোর শরীরে আমাদের শেখ বংশের র*ক্ত বইছে সেটা ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। আমাদের পরিবারের মানসম্মান কিচ্ছু রাখলি না তুই। তোর মতো ছেলের বাবা হওয়ার থেকে সারাজীবন নিঃসন্তান থাকা ভালো ছিল।”
“বাবা!”
“বাবা বলে ডাকবি না তুই আমাকে। তোর বাবা ম*রে গিয়েছে। আমাকে বাবা বলে ডাকবি না একদম।”
শাহেদ ইসলাম মেয়ের কাছে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় জন্মের পর থেকে ভীষণ আদর করে বড়ো করেছেন তিনি মেয়েকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও মেয়ের গায়ে অভাবের আঁচ আসতে দেয়নি কখনো। সেই মেয়ের বুকভরা কষ্ট নিজের চোখে দেখতে পারছেন না তিনি।
বাবার বুকে মা*থা রেখে সিরাত বলে,
“তুমি কষ্ট পেয়ো না বাবা। আমি ঠিক আছি। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি ঠিক আমার মেয়েকে একা হাতে সামলাতে পারব। ওকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব দেখে নিয়ো তুমি।”
“আমি জানি আমার মেয়ে একটা রত্ন। আমার মেয়ে সাহসী, উদ্যমী, পরিশ্রমী। তোমার উপর আমার ভরসা আছে মা। কিন্তু আমি যদি আর একটু ভাবতাম তোমার বিয়ে নিয়ে তাহলে হয়তো তোমার জীবনটা এমন হতো না।”
“ওহ্ বাবা এসব একদম ভাববে না তুমি। যা হবে সব ভালো হবে।”
মেয়েকে নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে ইতি ইসলাম কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন,
“আমি সত্যিই রত্নগর্ভা রে মা। তোর মতো মেয়েকে জন্ম দিয়েছি বলেই হয়তো আমি পৃথিবীর সেরা মা। এমন সাহসী আর বুদ্ধিমতী মেয়ে কয়জনের হয় বল? তুই পারবি, এই সমাজে মা*থা উঁচু করে ঠিক বাঁচতে পারবি।”
“হ্যা মা আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে। শুধু মেয়ের জন্য নয়, আমাকে নিজের জন্যেও পারতে হবে।”
দীর্ঘ আলাপের পর অবশেষে সেই সময় চলেই আসে। প্রথমে সিরাত নিজেই ডিভোর্স পেপারে সই করে দেয়। এরপর সকলের চাপে মাহতাব বাধ্য হয়ে নিজেও সই করে দেয়। তারিন সেখানেই উপস্থিত ছিল। দু’জন সই করে দেওয়ার পর কাগজটা একটা ফাইলে ঢুকিয়ে নেয় সে।
নিমুকে গতকাল রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা বিশেষ ভালো না। মজার বিষয় হলো সিরাতের তেমন কিছু করতে হয়নি৷ যা করার নিমুর প্রাক্তন স্বামী আর বর্তমান স্বামীই করেছে।
সবশেষে চলে যাওয়ার সময় আসে। দীর্ঘদিনের সংসার জীবনের ইতি ঘটিয়ে নিজের হাতে গড়ে তোলা সংসার ছেড়ে আজ চলে যেতে হবে সিরাতকে। বাসার প্রতিটা দেওয়ালে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় সিরাত। তার বুকের ভেতর ভীষণ ব্যথা অনুভব করছে সে। চোখ উপচে পানি গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল। চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও সে চিৎকার করতে পারে না। চুপচাপ কান্নাগুলোকে গিলে নেয়। নিজের ঘরে গিয়ে বেলকনিতে রাখা গাছগুলোতে হাত বুলিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সিরাত। আজ তার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। এইতো সেই ঘর, সেই বেলকনি যা সে খুব যত্নে সাজিয়ে তুলেছিল। এইতো সেই গাছগুলোর চারা, যেগুলোকে ভালোবেসে বড়ো করে তুলেছিল সে। আজ সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে।
বাসার প্রতিটা দেওয়াল যেন আজ সিরাতকে বলছে,
“আমাদের ছেড়ে যেও না। তুমি আমাদের ছেড়ে গেলে যে আমরা অযত্নে, অবহেলায় রয়ে যাব। তোমার মতো করে আমাদেরকে আর কেউ ভালোবাসবে না। থেকে যাও তুমি, আমাদের সাথে রয়ে যাও!”
ঘরের প্রতিটা কোণা যেন সিরাতকে দেখে হাহাকার করে ওঠে৷ গভীর রাতে সিরাতের কান্নার সাক্ষী যে এরা!
ঘরের এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা ছোট্ট পুতুলটাও যেন বলে,
“তুমি ভালো থেকো মেয়ে৷ তোমার জীবনের সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাক৷ জীবনের নতুন অধ্যায়ে তুমি ভালো থেকো তোমার জীবন্ত পুতুলটাকে নিয়ে।”
এক পা, দুই পা করে ধীরে ধীরে ঘরের দেওয়ালগুলোতে হাত বুলিয়ে, পুরো বাসায় নিজের পায়ের চিহ্ন ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসে সিরাত। সদর দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় তার পা যেন আর চলতে চাইছিল না। পেছন ফিরে পুরো বাসাটা একবার দেখে নেয় সে। এটাই যে শেষ দেখা!
চলে যেতে যেতে সিরাতের মন চিৎকার করে করে বলে ওঠে,
“যখন থেকে এখানে আর আমার পায়ের চিহ্ন পড়বে না সেদিন তোমরা বুঝে নিয়ো, তোমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া এই আমার কাছে মৃ*ত্যু যন্ত্রণার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ও বাড়ি, তুমি মনে রেখো আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার সোনার সংসার, তুমি জেনে রেখো তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টে আমার বুক ফেটেছে বারংবার। আমার কান্নার সাক্ষী হয়ে থাকা দেওয়াল, তোমরা কখনো আমাকে ভুলে যেয়ো না। তোমাদের ছেড়ে বহুদূরে চলে যেতে আমার যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমার বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কান্নারা চিৎকার করে বলতে চাইছে, আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আমার নিয়তি বাধ্য করেছে তোমাদের ছেড়ে যেতে। তোমরা মনে রেখো, আমি তোমাদের নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। তোমরা যে আমার নিজের চেয়েও বেশি প্রিয়, আপন!”
শেষ বারের মতো বাইরে থেকে দেওয়ালগুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সিরাত। যেতে যেতে পেছন ফিরে সবকিছু দেখে নেয়। যতক্ষণ না সবকিছু দৃষ্টিগোচর হয় ততক্ষণ পর্যন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে সিরাত।
একটা সংসার গড়তে যতটা কষ্ট হয় তার থেকেও বহুগুণ বেশি কষ্ট হয় সেই সংসার ছেড়ে চলে যেতে। প্রতিটা মেয়ের জন্যই হয়তো এই কষ্টটা মৃ*ত্যু সমতুল্য!
চলবে??