জনম জনমে পর্ব ৮

0
110

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৮
#ইসরাত_ইতি

[কঠোরভাবে ১৮+ সতর্কতা]

“মৃত্যুর রাতটা” জারিফ নিদ্রাহীন কাটালেও দোলা ঘুমিয়েছে। ইউরার ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে গভীর ঘুমে ঢলে পরেছে। বেশ লম্বা ঘুম। তার ঘুম ভেঙেছে হৈ হুল্লোড়ের শব্দে। তখন সকাল নয়টার কাছাকাছি। শেখ বাড়িতে ঘরোয়া ভাবে গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে বর বৌয়ের। তারপর হবে তাদের বাসর।
ব্যাকইয়ার্ডে ভোরে কেটারিংয়ের লোক এসে বিশাল বড় প্যান্ডেল সাজিয়ে দিয়েছে। একপাশে বাবুর্চিরা রান্নার তোরজোর চালাচ্ছে। মোটামুটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান। স্বল্পসংখ্যক আত্মীয় স্বজন নিমন্ত্রিত। বিয়ের রিসিপশন হবে ধুমধাম করে,তিন দিন ব্যাপী।

দোলার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো চুপচাপ। ধুপধাপ আওয়াজে সে দরজার দিকে তাকায়। বুঝতে পারলো অনেকেই আসছে তার ঘরে।

দরজা ঠেলে হুরমুর করে ঢুকে পরলো বাড়ির মহিলারা। তারা এলো দোলাকে নিতে। নতুন বৌয়ের নাস্তা খাওয়া হলেই বর বৌকে একসাথে বসিয়ে হলুদ মেখে গোসল করানো হবে।

জাহিদা আনাম অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুদিনের ছুটি নিয়েছে। জাহিনও আজ স্কুলে গেলো না, চুপচাপ ঘরে বসে রইলো। কম্পিউটারে গেমসও খেললো না, মা ভাইয়ের ফোন নিতেও চাইলো না। ঘরটা মাতিয়ে রাখা জাহিন যেখানে চুপচাপ সেখানে পুরো ঘরটা নিস্তব্ধ থাকবে স্বাভাবিক। জারিফের কামরার নিস্তব্ধতা কাটে ফোনের রিংটোনের শব্দে। একবার, দুবার, তিনবার করে বারবার বেজে চলেছে ফোনটা। জারিফ উপুর হয়েই বিছানার সাথে লেপ্টে ছিলো। আরো এক দফা ফোন বেজে উঠলে তার নির্লিপ্ততায় ভাটা পরে। মাথা না তুলেই হাতরে ফোনটা হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,“হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।”

ওপাশ থেকে নারীকন্ঠ ভেসে আসে,“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি প্রত্যাশা ব্যংক থেকে বলছিলাম,আমি কি জারিফ হোসাইনের সাথে কথা বলছি? আপনাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে…”

_সরি রং নাম্বার।

ফোন কেটে দিয়ে জারিফ ফোনটাকে দূরে ছুড়ে মেরে হাতরে একটা বালিশ তুলে নিয়ে মাথাটাকে আবারও চাপা দিয়ে রাখে।

★★★

বিয়ে বাড়ি গমগম করছে। প্রত্যেকটা স্তন্যপায়ীর মনে সে কি আনন্দ! নাচানাচি, লম্ফঝম্প আরো কত কি! দোলাকে হলুদ শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হলো, দোলার স্বামীকে ইউরার ঘরে ডেকে আনা হলো, তাকে দোলাকে কোলে করে গাঁয়ে হলুদের স্টেজে নিতে হবে। দোলা তার স্বামীর কোলে চ’ড়ে স্টেজে পৌঁছালো। ভাবী শ্রেনীর মহিলারা নবদম্পতিকে হলুদ মাখিয়ে দিলো দু’গালে। কলসী ভর্তি করে পানি ঢালা হলো দু’জনের মাথার ওপর থেকে।

কুমারী মেয়েদের দল গানের তালে তালে কোমর দোলাচ্ছে। দোলার বাড়ি থেকে চাচা ফুপুর দল,দোলার ভাইবোনেরা এসেছে দোলার সুখ দেখতে। সবটা দেখে ওবাড়িতে ফিরে পাড়ায় দোলার শশুরবাড়ির গুনগান করতে হবে তো!
হলুদ ছোঁয়ার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে একদল মেয়ে এসে দোলাকে ইউরার ঘরে নিয়ে প্রস্তুত করাতে লাগলো। খয়েরী রঙের একটা চমৎকার বেনারসীর মোড়কে মোড়ানো হলো একটা কাঠের পুতুলকে। কি যে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো দোলাকে! সবাই অবচেতন মনেই নজর লাগিয়ে দিতে চাইলো নতুন বৌকে। চেহারায় কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া অবধি দিতে হলো না,তার আগেই ঐ সর্বনাশা রূপ সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। একটু কাজল লাগিয়ে দিলো শুধু টানা টানা ঐ পাথুরে চোখ দুটোতে।

ওদিকে দোলার জায়েরা ব্যস্ত বাসরের খাট সাজাতে। কাঁচা,তাজা ফুলের সুগন্ধে শেখ তৌসিফ আহমেদের ঘরটা আলোড়িত হয়ে গিয়েছে। বিছানায় একচিলতে যায়গা বাকি নেই যেখানে ফুলের পাপড়ি ছড়ানো হয়নি। বিছানার মাথার কাছটাও আনাড়ি হাতে প্রফেশনালদের মতো করে অর্কিড, রজনীগন্ধা,জারবেরা দিয়ে সুসজ্জিত করেছে ফারিন। আর বিছানার মাঝখানটায়, সেখানে তো গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লিখে দিয়েছে “তৌসিফ+দোলা”।

দোলার ঠোঁটে লিপস্টিক পড়ানো হলো না, এমনিতেই ঠোঁট দুটো লাল টুকটুকে। ভাবী শ্রেনীর মহিলারা মস্করা করে বললো,“লিপস্টিক পরানোর কি দরকার? তাদের দেবরের নেশা ধরে গেলে তখন যে ভারী বিপদ দোলার!”

দোলা শুনেও শুনলো না সেসব কথা। প্রতিবেশী দাদীরা মজার ছলে দোলাকে ফিসফিসিয়ে উপদেশ দিচ্ছে, শেখাচ্ছে বাসর রাতে স্ত্রীর কর্তব্য কি! এ রাতে স্বামীকে নারাজ করা যাবে না। শুধু এ রাতে কেনো? কোনো রাতেই স্বামীকে নারাজ করা যাবে না। দাদীরা দোলার কানের কাছে বলতে লাগলো,“ইস্তিরি হইতেছে স্বামীর জমি। স্বামী যেমন ভাবে ইচ্ছা সেই জমি চাষ করবে,ইস্তিরি বাঁধা দিলে হ্যারে ফেরেস্তা লানত দেয়। গজব পরে।”

দোলা শুনলো দাদীদের বানী চুপচাপ। আরো কিছুসময় তাকে শুনতে হলো তাকে আজ রাতে কি কি করতে হবে। কিভাবে স্বামীকে খুশি করতে হবে। দোলাকে সবকিছু শিখিয়ে পরিয়ে দিয়ে দাদী শাশুড়িরা ঘর ছাড়লেন। সবার মুখ চললেও হাঁটুতে বেশ ব্যথা। বেশি রাত জাগতে পারেন না তারা।

এদিকে দোলাকে সাজানো হলো,সাজানো বলতে চুল গুলো খোঁপা করে কিছু গোলাপ লাগিয়ে দেওয়া হলো, অতঃপর দোলার স্বামীর কেনা স্বর্নের গয়না গুলোতে দোলাকে মোড়ানো হলো। দোলা চকচক করছে সৌন্দর্যে। দোলার নিষ্প্রভ,মলিন মুখটা ঢাকা পরলো তার স্বামীর কেনা সাড়ে চার লাখের গয়নার নিচে।

সম্পর্কে জা ও ননদেরা দোলাকে নিয়ে বসিয়ে দিলো বাসরের খাটে। দোলার বড় বড় লাগেজ দুটো ঘরের কোণে এনে রাখা হলো। বেড সাইড টেবিলের ওপর একটা দুধের গ্লাস রেখে এক ভাবী দোলাকে বললো এটা স্বামীর হাতেই দিতে।
আর কিছু সময়, সামান্য কিছু সময় তারাও বিষাক্ত শ্বাস ফেলে দোলাকে দোলার কর্তব্য গুলো বুঝিয়ে দিয়ে ঘর ফাঁকা করলো। যাওয়ার আগে বালিশের নিচে জন্মনিরোধক ওষুধের পাতা রেখে যেতে ভুললো না।

দোলা চুপচাপ হাঁটু ভেঙে বসেই ছিলো, ঐ যে সিনেমায় নতুন বৌ যেভাবে বসে থাকে না? ঠিক সেভাবে। মেহেদী রাঙ্গা,দুই ভরি স্বর্ণের মোটা মোটা বালা পরিহিত হাত দুটো হাঁটুর উপরে রেখে। আড়চোখে একবার বিছানার মধ্যিখানে তাকাতেই দেখলো সেখানে লেখা জারিফ+দোলা। দোলা চ’ম’কে উঠলেও পুনরায় দু’চোখ বন্ধ করে ভালো করে তাকিয়ে দেখে লেখাটা “তৌসিফ+দোলা”।

বাইরে মেঘ ডাকতে শুরু করলো যেন হঠাৎ। আজ কি বৃষ্টি হবে? দোলা তবে আজ খুব বৃষ্টিতে ভিজবে। একটু পর স্বামী নামের একজন অধিকারে ঠাসা মানুষ যখন তার শরীরটা নিয়ে কিছুক্ষণ ছানাছানি করবে তারপর দোলা ছুটে যাবে ছাদে,মন ভরে ভিজিয়ে নিবে নিজেকে, বৃষ্টিতে।

দোলা অপেক্ষায়,স্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য পালনের। তার অপেক্ষা দীর্ঘ হয়না। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় সিটিকিনি লাগানোর শব্দ হয়।

★★★
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। জারিফ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিছানায় লেপ্টে থাকলেও দুপুরের পরে আর পারেনি। খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পরেছিলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে সেটা পুড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে ঘরে ঢুকেছে। জাহিদা আনাম ছেলের সকালের নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে তখনও বসে ছিলো। বাড়িতে এসেছে তার ছোট দুইবোন জেসমিন আর জবা।

দীর্ঘসময় ধরে গোসল করে জারিফ দোলার পছন্দের কালো রঙের শার্ট টা পরে নিয়েছিলো। এই শার্ট টা জারিফের ফরসা গায়ে বেশ মানায়। দোলা আড়চোখে বারে বারে তাকিয়ে দেখতো এটা গায়ে চাপালে। বাইকের চাবি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ম্লান হেসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দোলার পছন্দের পারফিউমটা গাঁয়ে মাখতে ভুললো না।

ঘরভর্তি জারিফের নানু বাড়ির লোক। অরিন নামের একুশে পা দেওয়া জারিফের খালাতো বোন,আড় চোখে জারিফকে বার কয়েক দেখেছে। সুদর্শন, সুদেহী জারিফকে দেখে বারবার তার হৃদস্পন্দন বাড়ে, তার ওপর সেদিন আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছে খালাদের মুখে,জারিফ আর তাকে নিয়ে পরিকল্পনা আছে জাহিদা আর তার ছোটো বোন জবার। সেদিন থেকে তার মনের মধ্যেও অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। তাইতো মা একবার বলাতেই চলে এসেছে খালার বাড়িতে।

ঘর থেকে বেরোনোর আগে জারিফ মাকে বলেনি কোথায় যাচ্ছে, এই যে এতো মেহমান বাড়িতে, তাদের কারো সাথেই কুশল বিনিময় করেনি। শুধু হন্তদন্ত হয়ে ঘর ছাড়ার আগে বললো,“রাত হবে ফিরতে।”

আঙিনায় বাইক স্টার্ট হবার আওয়াজ হতেই জাহিদার দু’চোখ ভরে উঠেছিলো।

জারিফ দুপুরের খাবার বিকেলে খেয়েছিলো,সে গিয়েছিলো বিশখালীর কোলঘেঁষা কুটুম বাড়ি রেস্তোরাঁয় খেতে। অর্ডার করেছিলো দোলার পছন্দের সব আইটেম, পছন্দের ডেজার্ট। ওয়েটার এসে জারিফকে যখন বললো,“আজ আপু এলো না যে?”

জারিফ মেন্যু কার্ড দেখতে দেখতে শান্ত স্বরে বলেছিলো,“আপু আর আসবে না। এখন থেকে আমি রোজ আসবো। দুইটার পরে এই কেবিনটা আমার জন্য ফাঁকা রাখবে।”

কুটুম বাড়ি থেকে বেরিয়ে জারিফ বিকেলটা স্টাফ কোয়ার্টার দিঘির পাড়ে কাটিয়েছে। বটগাছের মোটা শিকড়ের উপর বসে দিঘির জলে একের পর এক ঢিল ছুড়েছে । সেখান থেকে বেরিয়ে সার্কিট হাউস মাঠে মেলা দেখতে গিয়েছে। সেখানে বসেছে বিশাল এক মেলা। আগে হলে দোলাকে নিয়ে আসতো জারিফ। দোলা খুব উপভোগ করতো। আচ্ছা এই মেলা ক’দিন ব্যাপী? দোলার স্বামী যেন দোলাকে নিয়ে আসে এখানে, মেয়েটার মন ভালো হয়ে যাবে তবে।

রাত গভীর হয়েছে, আকাশে মেঘ ডাকছে হঠাৎ, মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে জারিফ মফস্বলের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছে। বাইকটাকে এক স্টুডেন্টের বাসার সামনে পার্ক করে রেখে হাঁটতে হাঁটতে সে ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে। গলি পুরো ফাঁকা। রাত যে খুব গভীর। দূরে শেফা ফার্মেসির সামনে কয়েকটা কুকুর দাঁড়িয়ে তাদের সাংসারিক আলাপ করছিলো। জারিফ তাদের তাড়িয়ে দেয়। ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের তিনতলার তিনশো চারের কাঁচের জানালা বন্ধ, জ্বলছে না আলো। জারিফ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

দু’দিন আগেও না মেয়েটা ওখানে ,ঐ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কানে ফোন চেপে ধরে বললো,“আর পাঁচ মিনিট থাকো।”
আজ সে কোথায়? স্বামীর ঘরে,স্বামীর বিছানায়। তাদের বাসর হয়ে গিয়েছে গতকাল। আজ নিশ্চয়ই স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।
একদিন খেই হারিয়ে দোলার গালে চুমু খেতে গিয়েছিলো জারিফ,মেয়েটা আ’তঙ্কে,রাগে দুঃখে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো।
চু’মুটা জারিফ খায়নি সেদিন, তারপর থেকে কখনই দোলার হাতটা অবধি ধরেনি। লিখিত অধিকারনামা তো ছিলো না। আজ তাকে কেউ অধিকার নিয়ে ছোবে, নিশ্চয়ই পাপ হবার ভয়ে কাঁদবে না মেয়েটা, সহাস্যে সায় দেবে স্বামীকে।

★★★

তৌসিফ ঘরের সিটকিনি তুলে দোলার দিকে ফিরে তাকায়। ঘোমটা মাথায় বসে আছে দোলা। ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়েও মাথা তুললো না। নতুন বৌয়ের লজ্জা,সংকোচ থাকা উচিত। তৌসিফ এতেও মুগ্ধ হলো। রাজধানীতে নির্লজ্জ মেয়ে দেখতে দেখতে চোখ পচে গিয়েছিলো। দোলা নামের মেয়েটি তার চক্ষু শীতল করেছিলো।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে গাঁয়ের পাঞ্জাবি পালটে একটা টি-শার্ট পরে বিছানায় দোলার কাছে এগিয়ে যায় তৌসিফ। দোলা তখনও মাথা নিচু করে বসে। তৌসিফ দোলার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে দোলার ঘোমটা টেনে সরিয়ে দেয় কিছুটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে দোলার মুখ,কাছ থেকে। দোলা চোখ নামিয়েই ছিলো। তৌসিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,“তখন বোজো তোমার ওপর ওভাবে চড়াও হয়েছিলো,ভয় পেয়েছিলে? আসলে আমাকে নিয়ে ও খুব জেলাস।”

দোলা নিশ্চুপ। তৌসিফ ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি নামিয়ে দোলার হাতে রাখে,পর পর দোলার ডান হাতটা টেনে একটা হীরের আংটি দোলার অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে বলে,“আমিও বোজোর মতোই জেলাস, তবে তোমাকে নিয়ে।”

দোলা একদৃষ্টে নিজের অনামিকা আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই আঙুলে একদিন তার বেকার প্রেমিক পাথরের আংটি পরিয়ে দিয়েছিলো মজা করে। গায়ে হলুদের সময় দোলার জা সেই আংটিটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো আঙুল থেকে। আচ্ছা এই আংটি টার দাম কত? লাখ টাকা তো হবেই। দোলার বাপের বাড়ির লোকজন দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে তাদের।

দোলার ঘোর কাটে তৌসিফের দ্বিতীয় পদক্ষেপে। দোলার ডান হাত টেনে সে হাতে একটা চেক তুলে দেয়। মোহরানার টাকা পরিশোধ করলো দোলার স্বামী। এর মানে ইশারা দিলো,তোমার প্রাপ্য তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম,এবার আমার প্রাপ্যও আমি বুঝে নিতে চাই।

দোলা চুপচাপ চেকটা বেডসাইডের টেবিলে রেখে দিলো,সাত লক্ষ টাকার ওজন সইতে পারছিলো না তার হাত।

তৌসিফ বাঁকা হেসে দোলার কাছে এগিয়ে যায়। খয়েরী বেনারসীর ঘোমটাটা পুরো সরিয়ে ফেলে দোলার থুতনিটা উঁচু করে তুলে ধরে দোলার মুখটাকে দেখে। দু’চোখ বন্ধ করে দোলা বেনারসী খামচে ধরে থাকে। কিয়ৎক্ষন যেতেই নিজের কপালে পুরুষালি উষ্ণ অধরের ছোঁয়া পেতেই দোলা শিউরে ওঠে, গুটিয়ে যায়। ঘনঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে। কোনমতে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,“আমি এখনই প্রস্তুত নই।”

তৌসিফ মৃদু হেসে ফেলে। দোলা অবাক হয়ে তাকায়, তার কাছে মনে হলো যেনো সে একটা মজার কথা বলেছে আর তাই তৌসিফ হাসছে। তৌসিফের হাসির রহস্য বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে সে তৌসিফের বুকে আবিষ্কার করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আঁতকে ওঠে দোলা, মানুষটা শান্ত তবে তার হাতের বাঁধন দৃঢ়। দোলার সাধ্য নেই নিজেকে দূরে সরানোর। তৌসিফ খুবই শান্তভাবে,এক হাতে দোলার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। দোলা আরেকবার বলে ওঠে,“প্রস্তুত নই আমি!”

তৌসিফ ঠোঁটে বক্র হাসির রেখা ফুটিয়ে দোলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,“কেউই থাকে না!”

দোলা আর কোনো কথা বাড়ায় না,বাড়ানোর প্রয়োজন বোধও করে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। বৈধ পুরুষ তার ঠোঁটের স্পর্শে দোলার কপাল,গাল,নাকের ডগা সিক্ত করে দিচ্ছে। দোলার খুব বিরক্ত লাগছে,তার এতো অযাচিত পরমস্পর্শ নিতে ইচ্ছে করছে না। তার চেঁ’চি’য়ে বলতে ইচ্ছে করছে,“আপনার যা প্রয়োজন আপনি নিয়ে নিন। আমার এসব অযাচিত আহ্লাদের স্পর্শ প্রয়োজন নেই।”
কিন্তু সে চেঁচিয়ে বলতে পারলো না,শুধু বুঝে গেলো তার চেঁ’চি’য়ে বলাতেই কিছু যাবে আসবে না।
বন্ধ দু’চোখ,কিছু শ্বাসরুদ্ধকর স্পর্শ, হঠাৎ মাথার নিচে বালিশ ঠেকে। বুক থেকে শাড়ীর আঁচল সরিয়ে নেওয়া হয়। গলার কাছে কারো অসামাল উৎপীড়ন। স্পর্শ গুলো অচেনা-অজানা, হয়তো এই স্পর্শ গুলোই নিত্যদিনের অভ্যাস হবে। এই ছোঁয়া গুলো এখন পীড়া দিচ্ছে, হয়তো সময়ের সাথে সাথে আনন্দও দেবে। মানিয়ে নেওয়া হবে,সন্তান সন্ততি হবে,আর তারপর? তারপর দোলার ভাবনা ফুরালো,নটে গাছটিও মুড়ালো।

শরীর থেকে শেষ ভূষণ-বসন অতি সন্তর্পণে খোলা হয়। হাস্যকর! এতো ভদ্রতা, সংবেদনশীলতা দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। নেই প্রয়োজন। পুরুষটার এই ভণ্ডামিতে দোলার খুব হাসি পেলো। তবে হাসার অবকাশ পেলো না, শরীরের ওপর একটা পেটানো শরীর তার অধিকার আদায়ে ব্যস্ত,তার মনোযোগ ভাঙা যাবে না,নারাজ করা যাবে না তাকে। দোলার পাপ হবে পাপ। ফেরেস্তারা লানত দেবে স্বামী মানুষটা নারাজ হলে।

স্ত্রীর কর্তব্য পালনের মুহূর্তে তীব্র যন্ত্রনায় ফুঁপিয়ে ওঠা দোলার চোখে হঠাৎ করে তার দেবদার মুখটা ভেসে উঠলো। নিজেকে নিজে দোলা ধিক্কার দিলো,“ছিঃ দোলা, ভ্রষ্টাচারী। দেবদা এখন পরপুরুষ।”

স্বামী নামের মানুষটা দোলার চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছে। দোলার প্রচন্ড বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে গেলো। এইসব কেনো? স্বামীর কাজ শুধু তার অধিকার আদায় করা। সে দোলার চোখের পানি মুছিয়ে দেবে কেন? দোলা হঠাৎ ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে মানুষটাকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু না,এতে দোলার পাপ হবে।

দু’চোখ বন্ধ করেই আকাশ কুসুম ভাবছে দোলা। আচ্ছা তার দেবদা এখন কি করছে? বা কি করবে? চন্দ্রমুখী! হ্যা একটা চন্দ্রমুখী যেন আসে তার দেবদার জীবনে। পার্মানেন্ট চন্দ্রমুখী। কখনও যেনো পারুর কথা মাথাতেই আনতে না দেয় দেবদার। কখনও যেন দেবদাকে ছুটে আসতে না হয় তার পারুর সিংহদুয়ারে।

ঘাড়ের কাছে বৈধ পুরুষের অস্থির নিঃশ্বাস। থেমে গিয়ে দোলাকে একটু বিশ্রাম দিচ্ছে নাকি? কাবিন কত টাকার ছিলো যেন? হ্যা সাত লাখ, সাত লাখ টাকা এতো তাড়াতাড়ি উসুল তো হবে না।
দোলার ধারণা সঠিক। সাত লাখ টাকা অত সহজে উসুল হয়ওনি রাতে। তবে দোলার খুব একটা কষ্ট হয়নি, দোলা তো নিজের কল্পনার জগতে বিচরণ করছিলো। একটা দোতলা বাড়ির ছাদ,পরন্ত বিকেল,তার গায়ে একটা সুতির লাল শাড়ি,জারিফের গায়ে একটা বাটিকের পাঞ্জাবি,দু কাপ চা। আরো কত কি। এসব কিছু চোখের সামনে ভাসছিলো তাই যন্ত্রনার ছিটেফোঁটাও অনুভব করেনি দোলার শরীর। শুধু মাঝে মাঝে বিরক্তি এসেছিলো যখন দোলার কপালে স্বামী বলে লোকটা ঠোঁট ছুঁইয়েছে, দরকার নেই দোলার এতো আদর কপালে। দরকার নেই।

★★★

রাতে বৃষ্টি নামলো না। দোলার ভীষণ মন খারাপই হলো। বড় সাধ করেছিলো আজ শরীর বিসর্জনের রাতে বৃষ্টিতে গা ভেজাবে বলে। দোলার কোনো সাধ পূরন হয়না,তাই এটাও হলো না। ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দোলা তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে, সারারাত দোলাকে আহ্লাদ করে বুকের সাথে লেপ্টে রেখে এখন ক্লান্ত হয়ে ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। দোলার ঠোঁটের কোণে কারণ ছাড়াই এক চিলতে হাসি। শরীরের ওপর থেকে যখন ঐ স্বামী নামের মানুষটা সরে গিয়েছিলো তখন দোলা চোখ খুলে একপলকের জন্য দেখেছিলো মানুষটার মুখে পরিপূর্ণতার হাসি,নিজেকে সার্থক পুরুষ হিসেবে দেখে। দোলা কুমারী,দোলার জীবনে সেই প্রথম পুরুষ এটা প্রমাণিত হওয়ায় লোকটা দোলাকে পুরষ্কার স্বরূপ কপালে আরো একটা চুমু দিয়েছিলো।

চাদরটা গায়ে লেপ্টে ধীরে ধীরে দোলা উঠে বসে, বৃষ্টি না হোক, শাওয়ার ছেড়ে দোলা এখন বৃষ্টি বিলাস করবে। খুলে ফেলা বেনারসী তুলে নিতে গিয়ে দেখে বেনারসীর একাংশ স্বামীর পিঠের নিচে চাপা পরেছে। দোলা শাড়িটা তোলে না। কোনোমতে চাদরে নিজের নগ্ন শরীর ঢেকে লাগেজ থেকে নতুন শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সময় গড়াতে থাকে, হঠাৎ করে দোলা না চাইতেও ফুঁপিয়ে ওঠে, তারপর বিকট আর্তনাদ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দেয়াল ঘেঁষেই মেঝেতে বসে থাকে। কান্নার আওয়াজ জোরালো থেকেও জোরালো হয়। দোলা নিজেকে নিজে থামাতে পারছে না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের গালে নিজেই চ’ড় থাপ্পড় মারছে পরপর।

ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা পরে। দোলার অনুভূতি থিতিয়ে যায়। শাওয়ার বন্ধ করে ভেজা কাপড় পাল্টে নতুন রঙিন শাড়িতে নিজেকে মুরিয়ে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলে দেয়।

তৌসিফ দোলার দিকে তাকিয়ে আছে। দোলা স্বামীর নজরে নজর না মিলিয়ে চুপচাপ হেটে বিছানায় গিয়ে বসে। তৌসিফ দোলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে হেটে তার পাশে গিয়ে বসে। এক হাতে দোলাকে আগলে নিয়ে অন্য হাতে দোলার থুতনি ধরে দোলার নাকে ডগায়,কপালে চুমু খেয়ে আহ্লাদী সুরে ফিসফিসিয়ে বলে,“ব্যাথা হচ্ছে জান?”

দোলা দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। লোকটা এতো কেনো কপালে চুমু খাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মেজাজ হারিয়ে লোকটার গলা টিপে ধরবে দোলা,তখন দাদীরা বলবে,“লানত লানত!”

তৌসিফ নিজের মতো তার বৌকে কিছুক্ষণ শুকনো আদর করে নিজের হাতে বৌকে পেইন কিলার খাইয়ে পানি খাইয়ে দেয়। তারপর দোলাকে শুইয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,“বিশ্রাম করো।”

দোলা স্বামীর বাধ্য বৌ,স্বামীকে রাতে নারাজ করেনি দোলা, তাই সে স্বামীর কথায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তার স্বামী একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে গিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দোলা দু’চোখ বন্ধ করে নেয়, আবারও জারিফের মুখটা ভেসে ওঠে। দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে অবিরত জল গড়াতে থাকে তার। দোলা তা রুখতে চায়না। ঝরুক। স্বামী যদি দেখে তবে তো বলবে,“ব্যাথা করছে জান? সেজন্য কাঁদছো?”
আর সে বলবে,“হ্যা। পেইনকিলার খেলেই কমে যাবে।”

★★★

রাতে বেশ দেরী করেই ফিরেছিলো জারিফ। এসে কোনো মতে শার্ট টা খুলে বিছানায় উপুড় হয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে আজ রাতে ভালোই ঘুম হয়েছে তার, এখনও ঘুমাচ্ছে।

অরিন এক কাপ চা নিয়ে জারিফের ঘরে ঢোকে। গতকালকের ন্যায় আজও জারিফ ঘরের দরজা খুলে রেখে ঘুমিয়ে ছিলো।

উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ফরসা, সুঠাম চওড়া পিঠ টা দেখে অরিন ঢোক গিলে নেয়। লজ্জাও লাগছিলো বেশ। সে হাতের চায়ের কাপটা জারিফের বেড সাইডের টেবিলের ওপর রেখে ঘুরে দাড়াতেই জারিফ পেছন থেকে বলে ওঠে,“এই দাড়া!”

অরিন কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। জারিফ উঠে নিজের উন্মুক্ত শরীর ঢাকতে কাঁধের ওপর একটা তোয়ালে রেখে দেয়। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে অরিনের সামনে এসে দাড়িয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে,“আমি ঘুমাচ্ছিলাম,তুই চা নিয়ে এলি কার জন্য?”

অরিন থতমত খেয়ে যায়। সে তো বাহানা দেখিয়ে ঢুকেছিল এই ঘরে,চা দিতে নয়। সে আমতা আমতা করে,“ভেবেছি তোমার ঘুম ভেঙেছে জারিফ।”

_ঐ তুই জারিফ কাকে বললি!
ধ’ম’কে ওঠে জারিফ। অরিন কেঁ’পে ওঠে।

জারিফ অরিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে অরিনের চুলের মুঠি ধরে। অরিন বিকট চিৎকার দিয়ে তার মা খালাদের ডাকতে থাকে। জারিফ চেঁ’চি’য়ে ওঠে অরিনের ওপর,“খুব চন্দ্রমুখী হওয়ার শখ জেগেছে? তুলে একটা আ’ছাড় মারবো।”

জাহিদা, জেসমিন,জবা ছুটে এসে জারিফের হাত থেকে অরিনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। জারিফ ছাড়ে না,ক্ষ্যাপা কন্ঠে চেঁ’চি’য়ে যাচ্ছে,“চন্দ্রমুখী হওয়ার শখ একেবারে ঘুচিয়ে দেবো।”

চলমান…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here