চন্দ্রাণী ৩৫

0
119

#চন্দ্রাণী (৩৫)
চন্দ্রদের বাসার সবার মন মানসিকতা ভীষণ খারাপ। এরই মধ্যে দিন দুয়েক পর কাদের খাঁন এলো চন্দ্রদের বাড়িতে।বোনের মেয়েকে এক নজর দেখার জন্য মন আনচান করছে তার।
যেই সত্য শুনেছেন তিনি তারপর নিজেকে আর আটকাতে পারছেন না।

শাহজাহান তালুকদার বাড়িতেই ছিলেন।সচরাচর কেউ তার সাথে দেখা করতে এলে কাচারিঘরে আসে।কাদের খাঁন সোজা বাড়িতে চলে গেলেন।চন্দ্র তখন শুভ্রকে বসে ভাত খাওয়াচ্ছে। গতকাল রাতে শুভ্র না খেয়ে ঘুমিয়েছিলো।
আড়মোড়া ভেঙে শর্মী এসে বললো, “আপা আমাকেও খাইয়ে দে না।ভালো লাগছে না নাশতা করতে। ”

চন্দ্র বললো, “বোস এখানে, নে খা।”

শুভ্র দুই হাত নেড়ে কিছু একটা বুঝাতেই চন্দ্র হিহিহি করে হাসতে লাগলো। শর্মী হতবাক হয়ে বললো, “কি রে আপা,হাসছিস কেনো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “শুভ্র বলতেছে তোকে যাতে না খাইয়ে দিই,তুই নাকি অলস হয়ে যাচ্ছিস।”

শর্মী হেসে ভাতের লোকমা মুখে নিলো।তারপর কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বললো, “এক সেকেন্ড আপা।শুভ্র কিভাবে জানলো আমি কি বলেছি?ও তো….!”

শর্মী কথা শেষ করতে পারে নি। চন্দ্র হেসে বললো, “এখনো অনেক কিছুই তোর কাছে স্পষ্ট না আমি জানি।শুভ্রকে আমি সাংকেতিক ভাষা শিখিয়েছি,লিপ রিড শিখিয়েছি।শুভ্র আরো বছর তিনেক আগে থেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। আমরা দুজন প্রায়ই ভিডিও কলে কথা বলি।শুভ্রর থেকেই আমি সর্বপ্রথম নিয়াজের কথা জানতে পারি।নিয়াজ যতবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলো শুভ্র দেখেছে।
তাছাড়া তুই যখন সিদ্ধান্ত নিলি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার, শুভ্রই আমাকে জানায়।শুভ্র বুঝতে পারবে না ভেবে তুই ওর কাছে গিয়ে কান্না করে মনের কষ্ট প্রকাশ করেছিলি,তোর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে শুভ্র বুঝতে পেরেছিলো তুই কি বলছিস ওকে।শুভ্রর নিরাপত্তার জন্যই ওকে আমি এই দুইটা জিনিস শিখিয়েছি।এবং ওকে বলেছি কেউ যাতে না জানে ওর এই ব্যাপার।

এমনকি আব্বা মা ও না।তাই তো বাবুল কাকা বলার আগেই আমি শুভ্রর থেকে জানতে পারি আমি যে আব্বার মেয়ে না।নিয়াজের মৃত্যুর দিনেই আব্বা আম্মা ওনাদের রুমে শুভ্রর সামনে এসব আলোচনা করে। শুভ্র সব জেনে আমাকে জানায়।”

শর্মী খেতে ভুলে গিয়েছে যেনো। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
ভাই বোনের কথার মধ্যে কাদের খাঁন এলো। গলা উঁচু করে তালুকদারকে ডাকলেন।শাহজাহান তালুকদার কাদের খাঁনকে দেখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে। চন্দ্র কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।আগের মতো নিজের কাজ করতে লাগলো।

কাদের খাঁন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কি বলবে ভেবে পেলো না। এমন এক পরিস্থিতি শব্দরা গলায় এসে জমাট বেঁধে আছে অথচ বের হতে পারছে না।শাহজাহান তালুকদার কাদের খাঁনকে ঘরে নিয়ে বসালেন।চন্দ্রকে ডেকে বললেন, “চন্দ্র মা,চা নাশতার ব্যবস্থা কর তো।আমার বন্ধু এসেছে। ”

চন্দ্র ভাই বোনকে খাইয়ে উঠে গেলো রান্নাঘরে।
কাদের খাঁন কথা বলতে পারছেন না আজ।তার বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা সামনে এলে বুঝি তিনি কথা বলতে পারবেন না।

দুজনেই চুপ করে বসে থাকা যায় না, তাই শাহজাহান তালুকদার টিভি অন করে দিলেন।
কাদের খাঁন ও মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতে লাগলো যেনো টিভি দেখতেই এই বাড়ি এসেছেন তিনি।
চন্দ্র কিছুক্ষণ পর ট্রে নিয়ে ভেতরে এলো।
চা,বিস্কুট, চানাচুর, নুডলস, নাগেটস, পানি নিয়ে এসে সালাম দিলো কাদের খাঁনকে।সালাম দিয়ে বললো, “আংকেল ভালো আছেন?”

কাদের খাঁন কোনো মতে বললো, “হ্যাঁ, ভালো। তুমি?”

চন্দ্র ঘাড় নাড়িয়ে বললো, “ভালো। ”

এরপরে আর না দাঁড়িয়ে চন্দ্র চলে গেলো। কাদের খাঁন মন খারাপ করে কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আংকেল ডাকলো মেয়েটা!
মামা বলবে না বুঝি কোনো দিন ও!
কি এক অস্থিরতা, দোটানায় মন জড়িয়ে গেলো বুঝতে পারলো না কাদের খাঁন।
উঠে দাঁড়ালো বেখেয়ালে। শাহজাহান তালুকদার উঠে এসে কাদের খাঁনের হাত ধরে বললো, “তোর যখন ইচ্ছে করবে চলে আসিস।আমার মেয়েকে আমি কোথাও দিতে পারবো না কিন্তু কারো যদি আমার মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করে সে আসতে পারে। ”

কাদের খাঁন চুপ করে বের হয়ে গেলো।

বাবুল দাশকে আজ থানা থেকে জেলখানায় নেওয়া হবে।পুলিশের জীপটা বাবুল দাশকে নিয়ে বের হওয়ার মিনিট দশেক পর চন্দ্র শাহজাহান তালুকদারের সাথে থানায় এলো বাবুল দাশকে দেখতে।
বাবুল দাশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনে চন্দ্রর দুই চোখ আপনাতেই ভিজে উঠলো।
চন্দ্র জানে বাবুল দাশ খারাপ লোক,খুনী, অপরাধী। অথচ তার বেহায়া মনটা কেনো জানি এই অপরাধী লোকটাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। ওড়নার কোণা দিয়ে চন্দ্র চোখ মুছতে নিতেই একটা টিস্যু দেখতে পেলো। টগর একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়েছে তাকে।
কুণ্ঠিত হয়ে চন্দ্র টিস্যু নিতেই টগর বললো, “অপরাধীর জন্য চোখের জল ফেলতে নেই।”

চন্দ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বললো, “আপনার দৃষ্টিতে যিনি অপরাধী আমার দৃষ্টিতে তিনি আমার কাছের মানুষ। মানুষ কাছের মানুষের জন্যই কাঁদে।”

টগর মুচকি হেসে বললো, “তা ঠিক। ”

এরপর আর টগরকে কোথাও দেখলো না চন্দ্র।বাবুল কাকুর কথা ভেবে টগরের কথা মাথায় ছিলো না চন্দ্রর।
সন্ধ্যা বেলায় ফোন হাতে নিয়ে দেখলো টগর মেসেজ পাঠিয়েছে।

“পাথর কতটা ভারী,তারচেয়ে ও হাজার হাজার গুণ ভারী তোমার শীতল দৃষ্টি, তোমার ফিরিয়ে নেওয়া মুখ,তোমার নিঃশব্দে চলে যাওয়া।
আমি পাথর সরাতে পারি,তোমার উপেক্ষা পারি না।”

চন্দ্র মেসেজটা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। চন্দ্র কিছু বুঝতে পারছে না। সেই ছোট্ট বেলায় পুতুলের বিয়ে দেওয়ার মতো করে যেই বিয়ে দিয়েছিলো বাবা মায়েরা শখ করে, সেই বিয়ে কতটা কার্যকরী!
চন্দ্র কি করবে!
টগরের প্রতি তার টান,তার মনের অনুভূতি মিথ্যে না।কিন্তু এই পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করছে দূরে সরে আসতে ধীরে ধীরে।
টগরের বাবা খু//ন হলো যেখানে চন্দ্রর জন্য সেখানে চন্দ্র কিভাবে টগরের সাথে নিজের জীবন জড়াবে?
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে কি বাবার কথা মনে পড়লেই টগরের মনে হবে না যে চন্দ্রর জন্যই টগরের বাবা আজ এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে?
চন্দ্রর প্রতি এতো দিন টগরের যেই মনোভাব ছিলো এখনো কি তাই থাকবে?
বাবুল দাশকে টগর যেমন ভীষণ ঘৃণা করে চন্দ্রর জন্য তো ব্যাপারটা উল্টো। লোকটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট হতে পারে কিন্তু চন্দ্র কি তার ভালোবাসা অস্বীকার করতে পারবে?

কোন ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিবে চন্দ্র?

সাতপাঁচ ভেবে চন্দ্র টগরকে কল করে। কল দিয়ে চন্দ্র হতবাক হয়।টগর তাকে ব্লক করে দিয়েছে। সব জায়গা থেকে চন্দ্রকে ব্লক দিয়েছে টগর।
সন্তর্পণে চোখের জল মুছে নিলো চন্দ্র।হোক দূরত্ব আকাশসম,লুকায়িত থাকুক ভালোবাসারা,জিতে যাক ইগো।

চলবে
রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here