কালো হরিণ চোখ (পর্ব ৪)

0
131

#কালো_হরিণ_চোখ (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা

প্রকৃতির যুদ্ধংদেহী মূর্তিতে খানিকটা ভড়কে গেছে প্রিয়ম। সে বরাবরই শান্ত ছেলে। ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলে। তবে এই মেয়ে কেন যেন সুযোগ পেলেই দুটো বাঁকা কথা শুনিয়ে দেয়। নির্ঘাত মাথায় গণ্ডগোল আছে। সে-ও যে চুপচাপ হজম করে ফেলে ব্যাপারটা তেমন নয়। কথার পিঠে কথা তো কিছু চলেই আসে।

“আপনি ইচ্ছে করে করেছেন, তাই না?”

“আমি কেন খামাখা ইচ্ছে করে ভাঙতে যাব? এভাবে রাস্তার মাঝখানে এসব রাখার মানেটা কী? আর কোনো জায়গা ছিল না?”

“এটা রাস্তার মাঝে? আপনি চোখে দেখেন না? এর আগে একবার ইচ্ছে করে আমার গাছের অনেকগুলো ফুল ছিঁড়েছিলেন। এবার যে তা করেননি কে বলবে?”

প্রিয়মের মনে পড়ল তখন সে টেনে পড়ে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পাড়ায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেবার। ওর উপর দায়িত্ব পড়েছিল ফুলের। বড়রা ওদের পাত্তা দেয়নি বলে কিশোর সাঙ্গপাঙ্গ মিলে আলাদা আয়োজন করেছিল। যেহেতু স্কুলে পড়ত, স্বাভাবিকভাবেই অত টাকাপয়সা হাতে কারোরই ছিল না। যেটুকু কিছু টাকা উঠল, তা খাওয়া দাওয়া, পটকা, এসব আয়োজনের বাজেটেই টানাটানি পড়ে গিয়েছিল। তাই ফুলের জন্য বাজেট ছিল না। অগত্যা ওই ছাদের বাগনটাই হয়ে উঠে ভরসা। বন্ধুদের মধ্যে নিজের প্রেস্টিজ রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে ফুলগুলো সরিয়েছিল প্রিয়ম।

তখন এখানে এত গাছ ছিল না। অল্প কিছু ফুল গাছ ছিল। যখন প্রকৃতি দেখেছিল, সে এক কাণ্ড হয়েছিল বটে! ওইটুকু মেয়ে ছিল তখন, সেভেনে পড়ত। সে কী রাগ। নেহায়েত সবিতা আন্টি মেয়েকে ধরে রাখলেন বলে রক্ষা, তবুও ওর চুল খাবলে ধরেছিল সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। সেদিন অল্পে চুলগুলো রক্ষা পেয়েছিল। তবে তার প্রতিশোধ প্রকৃতি নিয়েছিল অন্যভাবে। তবে সময় নিয়েছিল বছর ঘোরার।

প্রিয়মের এক বন্ধু ছিল, জুবায়ের। এক ক্লাস উপরের, তবুও বেশ বন্ধুত্ব ছিল। নাম ধরেই ডাকত পরস্পরকে। সে পছন্দ করত সুপ্তি নামের একজনকে। যে প্রকৃতিদের স্কুলে নাইনে পড়ত। জুবায়ের সেসময় ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছিল এবং প্রিয়মকে ধরেছিল, সুপ্তির কাছে চিঠিটা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে। নইলে নাকি হারপিক বা ডেটল কিছু একটা খেয়ে সুইসাইড করবে।

সুপ্তির ছোট বোন তৃপ্তি প্রকৃতির খুব ভালো বন্ধু ছিল, প্রিয়ম জানত। সেই সূত্রে সুপ্তির সাথেও ওর ভালো খাতির ছিল।

প্রিয়ম প্রকৃতিকে ডেকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করিয়েছিল, আর বলেছিল “কাউকে বলবে না কিন্তু।”

“ঠিক আছে। কাউকে বলব না।” কথাটা বললেও সে চিঠিটা সুন্দর করে নিয়ে সযত্নে পৌঁছে দিয়েছিল মায়ের কাছে। পিঠ রক্ষা করা যায়নি। দুমদুম কয়েকটা কিল জুটেছিল ডাকপিয়ন হবার অপরাধে। কানমলা খেয়ে কানে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।

আর ওই অভব্য মেয়ে প্রিয়মেরই টেবিলে, তারই ফিজিক্সের নোট খাতার সবার উপরের পৃষ্ঠায় লিখে এসেছিল,

“ফুল এর উপর ফুলের প্রতিশোধ” যেখানে প্রথম শব্দ ফুল এর বানান ছিল ‘এফ ডাবল ও এল’।

প্রিয়মের ভীষণ গায়ে লেগেছিল ব্যাপারটা। মায়ের কানমলার চাইতে এটা নিঃসন্দেহে বেশি লজ্জার বিষয় ছিল। সেবার জুবায়েরকে নিজ গরজে একটা হারপিক ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল।

পাল্টা শোধবোধ সে-ও করেছিল। এরপর ওদিক থেকেও। টম এন্ড জেরির চলমান শোধবোধ খেলা ভালোই চলত প্রকৃতি আর প্রিয়মের মধ্যে। তারপর আস্তে আস্তে পড়াশোনায় ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। ওদের মধ্যে একটা দূরত্বও তৈরি হয়। ওর এডমিশন টেস্ট ছিল, ওদিকে প্রকৃতির এসএসসি পরীক্ষার প্রিপারেশন। সব মিলিয়ে কোথায় যেন একটা বড় গ্যাপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

“সেটা অনেক আগের কথা। এখন আমি কোন সুখে এসব করব?”

“আপনি কোন সুখে করবেন সেটা তো আপনি জানবেন। আমি তো আপনার সুখ নিয়ে গবেষণা করতে বসিনি।”

“শোনো প্রকৃতি, এটা আমার দোষ নয়। দোষটা তোমার। এভাবে অজায়গায় টবটা রাখা একদম ঠিক হয়নি। আমার পায়ে না লাগলে অন্য কারোর পায়ে লাগত। তবে এটা ভাঙতোই।”

“আপনি কি এস্ট্রোলজার প্রিয়ম ভাই? নাকি সুপারন্যাচারাল পাওয়ার টাওয়ার কিছু আছে? ভবিষ্যত আগে থেকে দেখতে টেখতে পান নাকি?”
রূঢ়ভাষী মেয়েটার মুখে হাসি থাকলেও কথা রসকষহীন।

“এই স্বরে কথা বলছ কেন? ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখো নাই?”

“না শিখি নাই। কী করব বলেন, আমার প্রিয় খাবার চিরতার রস, আর করল্লা ভাজি। গুণাগুণ সহ জিনিসগুলো চাচির কাছে দিয়ে আসব। ঠিক আছে? করল্লা ভাজি তিনবেলা, চিরতার রস সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে।”

দৃশ্যটা চিন্তা করে গা গুলিয়ে এলো প্রিয়মের। জগতে এত সুখাদ্য থাকতে সে কেন বিষ তেতো জিনিসগুলো খাবে!

“তুমি ডাক্তারও নও, কবিরাজও নও। যে প্রেসক্রাইব করবে। যাই হোক, শুধু টবটা ভেঙ্গেছে। গাছের কোনো ক্ষতি হয়নি। তুমি চাইলে আমি টবটা কিনে দিতে পারি।”

“আমি ফকির না যে আপনার টব কেনার আশায় আমি বসে থাকব। তবে জরিমানা আপনাকে দিতে হবে।”

“কীসের জরিমানা?”

কড়া চোখে তাকাল প্রকৃতি, “আমার এক্সট্রা টব আছে। নিচে থেকে সেটা নিয়ে আসবেন এরপর সমস্ত প্রসিডিওর কমপ্লিট করে তারপর বৃক্ষরোপণ শেষ করে নিজের পথে যাবেন। তার আগে নয়।”

“যদি না করি?”

দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে সোজা প্রিয়মের চোখের দিকে তাকালো প্রকৃতি। দুষ্টু হাসি মেয়েটার মুখে। এই হাসি ভয়ংকর। কোনো বড় মতলব ঠিকই আছে মাথায়। রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না, ভাবল প্রিয়ম। ঝামেলা ভালো লাগে না ওর, তাছাড়া একটা গাছ লাগানোয় আর ঝামেলা কীসের!

“ঠিক আছে। করে দিচ্ছি।”

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শেষ হলো খানিকটা সময় নিয়েই। তবে প্রিয়মের খারাপ লাগল না। সে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছিল, যেহেতু ওর পা লেগেই ভেঙ্গেছে। সে দেখল এবার প্রকৃতির মুখে মেঘ সরেছে, সত্যিকারের হাসিতে ঝলমলে করছে।

“আচ্ছা, এসব তোমার এত ভালো লাগার কারণ কী?”

“আপনার ভালো লাগেনি?”

“লেগেছে। তবে তোমার মতো পাগলামি নেই আমার।”

আবারও মেঘ জমল খানিকটা প্রকৃতির মুখে। এরপর কিছুটা সময় নিয়ে সে বলল,

“প্রিয়ম ভাই, এই যে আমি ছোট্ট চারাগাছ লাগাই, কখনো বীজ। এরপর দীর্ঘ একটা সময় পরিচর্যা করি। ধীরে ধীরে গাছগুলো হয়। কাণ্ড, শাখা-প্রশাখায় ভরে যায়। চোখের সামনে এই যে দেখাটা, এটার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আছে। মা’য়ের কাছে যেমন তাদের সন্তান, আমার কাছেও তেমন মনে হয়। একেক সময় মনে হয়, এরা আমার সন্তান। আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে এদের সাথে।”

প্রিয়ম এভাবে ভাবেনি কোনোদিন৷ বরং প্রকৃতির এই বৃক্ষ প্রীতি তার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বলেই মনে হতো। আজ অন্য চোখে দেখে মোটেও বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। গাছগুলোকে ওরও ভীষণ ভালো লাগছে। আরেকবার ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল।

চাঁদের আলোয় ভরে গেল প্রকৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ সাথে সামনের প্রকৃতি নামের অদ্ভুত মেয়ে দু’য়ে মিলেই চাঁদের আলোর মতোই প্রিয়মকে যেন আলোকিত করল। বড় ভালো এই মুহূর্তটুকু। তাই মনে হলো ওর কাছে।
………
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here