কান্নাভেজা রাত পর্ব ৩

0
444

#কান্নাভেজা_রাত
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক


আমি জানি রাতুলকে চেনা অতোটাও সহজ
না। তার মন গলিয়ে কোন তথ্য নেয়া কষ্মীনকালেও সম্ভব না। তার মায়ের থেকেও সম্ভব না।
তবে মেহেরুনের সঙ্গে যদি আরেকবার কথা বলার সুযোগ পেতাম, যদি আরেকটু খানি কথা বলতে পারতাম তবে অনেক কিছুই জেনে ফেলতে পারতাম। কিন্তু মনে হচ্ছে না এই সুযোগ আমি পাবো। আমার শাশুড়ি খুব স্বতর্ক হয়ে উঠেছে।সব সময় নজর রাখছে আমার উপর। সব সময় আমার আশে পাশেই থাকে।এটা ওটা গল্প করে।কাজ না থাকলেও কাজ খুঁজে বের করে। তারপর আমায় নিয়ে সেই কাজে লেগে পড়ে।

রাতুল আজ সারাদিন ঘরেই ছিল। সন্ধ্যা বেলায় দেখলাম হঠাৎ করেই মেহেরুনের ঘরে গিয়েছে। খানিক সময় ওখানে ছিল।ওখান থেকে বেরিয়ে এলো রাগী রাগী চোখ মুখ নিয়ে। এসে হাঁপাতে শুরু করেছে। বিছানায় বসে ঘামছে।
আমি বললাম,’ কি হয়েছে? এরকম দেখাচ্ছে কেন তোমায়? ‘
রাতুল বললো,’ কিরকম দেখাচ্ছে?’
খুব রাগ নিয়ে কথাটা বললো।আমি চুপসে গেলাম শুনে । তবুও না দমে গিয়ে বললাম,’ এভাবে ঘামছো কেন ফ্যানের নিচে বসে থাকার পরেও?’
রাতুল আমার দিকে চোখ লাল লাল করে তাকিয়ে দমের উপর দম ফেলে বললো,’ মাটি কেটে এসেছি। এই জন্য ঘামছি।’
আমি অবাক হলাম। যদিও অবাক হবার মতো কিছু ছিল না এটা।কারণ তার ব্যবহারই এরকম। একেকবার একেক রকম আচরণ করে সে। কখনো খুব মিষ্টি।কখনো সবচেয়ে বাজে পুরুষদের মতো।
আমি অভিমানী গলায় বললাম,’ এভাবে উত্তর দিচ্ছো কেন? ‘
রাতুল বসা থেকে এক ঝটকায় উঠে গিয়ে বললো,’ তো কিভাবে উত্তর দিবো? তোমাকে চু* মু খেতে খেতে!’
বলে সে রাগে ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করতে করতে কি সব বকতে বকতে যেন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম ওর বেরিয়ে যাওয়া।এতো বদ মেজাজিও মানুষ হয়!

সে রাতেই এ বাড়িতে বিরাট এক কান্ড ঘটলো। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।রাতুলও আমার পাশেই।সেও ঘুমে।শেষ রাতের দিকে ঘরের দরজায় দরাম দরাম শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো আমার।ঘুম ভাঙতেই শুনি আমার শাশুড়ি দরজায় আঘাত করতে করতে ডাকছে রাতুলকে ‌।
‘ এই রাতুল? রাতুইল্যা। মরার ঘুম ঘুমাইছস নাকি? সর্বনাশ হয়ে গেছে রে হারামজাদা সর্বনাশ হয়ে গেছে!’
রাতুলের ঘুম গাঢ়।আমি তাকে ডাকলাম। অনেকক্ষণ ধরে।ও চোখ খুলতেই বললাম,’ মা ডাকছেন।’
তারপর ও উঠতে উঠতেই আমি নিজে গিয়েই ঘরের দরজা খুলে দিলাম।
তখন আমার শাশুড়ি আমায় এক ধাক্কায় ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন,’ ঘর থেকে বের হবা না। তুমি উঠলা কেন? তোমারে ডাকছি আমি? মাতাব্বরি করো! যাও খাটের উপর গিয়ে চুপচাপ শুয়ে ঘুমাও।’
বলে রাতুলের এক হাত ধরে টেনে তুললেন।ওর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বললেন,’ আয়।’
অদ্ভুত বিষয় হলো রাতুল আর তার মা ঘর থেকে বেরিয়েই বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো।
এ কোন বাড়িতে এসে আমি পড়লাম? মানুষ এরকমও হয়? এখানে কি হয়েছে এর কিছুই আমায় দেখতে দিবে না ওরা। শুনতেও দিবে না। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারছি যায় হয়েছে তা অবশ্যই মেহেরুনকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। আচ্ছা মেহেরুন কি তবে সুযোগ পেয়ে এখান থেকে পালিয়েছে? পালাতেও পারে। ওর উপর যেভাবে ওরা নজরদারি করছে। সুযোগ পেলে পালাবে না কেন?
আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোন শব্দ পাই যদি। শব্দ পাচ্ছি।ওরা মা ছেলে কি সব যেন বলাবলি করছে।এ ঘর থেকে ও ঘরে কিংবা বারান্দা থেকে ঘরে,কিচেনে খুব দৌড়ঝাঁপ করছে। দপদপ করে পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে।রাতুলের মা কেমন বিলাপ করছে। কিন্তু স্পষ্ট কিছুই শুনতে পাচ্ছি না আমি।
হঠাৎ করেই আমার চোখ পড়লো বারান্দার দিকের জানলাটার দিকে। জানলা ভেতর থেকেই বন্ধ করা।আমি তো জানলা দিয়েই দেখতে পারি আসলে কি হচ্ছে বাইরে!
যতোটুকু সম্ভব কম আওয়াজে জানলার একটা পাটার খানিকটা ফাঁক করে বাইরে চোখ রাখলাম। মেহেরুনের ঘরে আলো জ্বলছে। তার ঘরের দরজা খোলা। তবে আমার ধারণাই ঠিক।যা হচ্ছে তা ওখানেই হচ্ছে।ওর ঘরেই হচ্ছে।
খানিক পর দেখলাম ওর ঘর থেকে হন্যে হয়ে রাতুল বেরিয়ে আসছে।আমি তাড়াহুড়ো করে জানলা ভেজিয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। গায়ে কাঁথা টেনে দিলাম। রাতুল ঘরের দরজা খুলে ভেতরে এলো। বিছানা হাতড়ে তার ফোন তুলে নিলো। তারপর বেরিয়ে গিয়ে আবার বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
আমি আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।চোখ রাখলাম বাইরে। রাতুল বারান্দায়ই আছে। মেহেরুনের ঘরে যায়নি।ওখান থেকে ফোন করছে কার সাথে যেন। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝলাম কোনো একজন ডাক্তারের সঙ্গে। রাতুল জোরে জোরেই কথা বলছে।বলছে,’ ভাই, কাইন্ডলি একটু আসেন না। আপনার যতো খরচা লাগে আমি দিবো।যতো চান ততোই দিবো ভাই। আপনি না এলে ও বাঁচবে না।ম*রে যাবে। তার কন্ডিশন ভালো না।’
কথা বলতে বলতে সে বারান্দা পেরিয়ে বাসার বাইরে চলে গেল।ওর ফোনে বলা কথাগুলো শুনে আমার গা শিউরে উঠলো। তবে কি মেহেরুনের ভয়াবহ কিছু হয়েছে? কি হতে পারে ওর?
আমার ভীষণ অস্থির লাগছে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। কেমন যেন কান্না পাচ্ছে আমার। আগে মনে হতো এ বাড়িতে মেহেরুন বুঝি একাই বন্দী। এখন নিজেকেও বন্দী মনে হচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে বাবাকে ফোন করে সব বলে দেই।খুব করে কাঁদি। বাবাকে বলি, তোমার মেয়ে বড় কষ্ট আছে বাবা। বন্দীদের মতো। তুমি তাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও এসে। কিন্তু বাবাকে নিয়ে আমার যতো ভয়! বাবার এমনিতেই হার্টের সমস্যা।তাও জটিল পর্যায়ে। কদিন আগেই রিং পরানো হয়েছে। একটুও টেনশন করতে পারেননা। এমনিতেই বাঁচা মরা অবস্থা। শরীরে যন্ত্র লাগিয়ে কোনমতে টিকে আছেন। বাবা রাতুল সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো প্রশংসা শুনেই আমায় বিয়ে দিয়েছেন। এখন যদি তিনি এসব শুনেন তখন তার কি অবস্থা হবে? বাবা বাঁচবেন না এসব শুনলে। এই চাপ তিনি কিছুতেই সামলে উঠতে পারবেন না! কিছুতেই না। বাবাকে এইসব আমি কিছুতেই শুনাতে পারবো না। কিছুতেই না।

আরো আধ ঘন্টা পর দেখলাম রাতুল ফিরেছে। তার সঙ্গে আরো একজন এসেছে।যে এসেছে তার হাতে স্যুটকেস।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ডাক্তার ফাক্তার কিছু একটা হবে।ডাক্তারদের এমনিতেই চেনা যায়। এদের চেহারা কেমন ফকফকা উজ্জ্বল থাকে। মিষ্টি মিষ্টি হয় চেহারা।নিশ্চয় মেহেরুনের চিকিৎসা করতে এসেছেন ইনি। আচ্ছা মেহেরুনের তবে কি হয়েছে? ওই যে সন্ধ্যা বেলায় রাতুলকে দেখলাম মেহেরুনের ঘর থেকে রেগেমেগে আগুন হয়ে বেরিয়ে এসেছিল,খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল তাকে। হাঁফাতে শুরু করেছিল বসে।
তখনই কি রাতুল ওকে কিছু করে এসেছিল? কি করেছে ওর সঙ্গে তবে? ওকে মে*রেছে কি?
এতোক্ষণ ইলেকট্রিসিটি ছিল। সিলিংয়ের পাখাগুলো ঘটঘট শব্দ করছিলো বলে ওখানের কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল।আর ওদের বলা সব কথা শুনে যা বুঝার বুঝে ফেললাম আমি।
ডাক্তার বলছে ,’ বাসুডিন বি*ষ খেয়েছে।এটা খুব মারাত্মক বি*ষ।কৃষকেরা ধান খেতে এই বি*ষ দেয় পোকামাকড় নিধনের জন্য। ভাগ্যিস তাকে বমি করানো গেছে। নয়তো বাঁচানো মুশকিল হয়ে যেতো।’
শুনে আমার গা কাঁপতে শুরু করলো। মেহেরুন বিষ খেয়েছিল তবে? কেন খেয়েছিল? কি এমন দুঃখ তার? আমার মাথায় কিচ্ছু কাজ করছে না।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে উঠছে। মেহেরুন আসলে কে? কি তার পরিচয়? সে এভাবে এখানে বন্দী কেন? তার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না কেন? আমার শাশুড়ি কেন বললেন, আমি যেন এতো কিছু জানার আগ্রহ না দেখাই। রাতুল কেন সন্ধ্যা বেলায় তার ঘর থেকে এভাবে রেগেমেগে আগুন হয়ে এলো? আর শেষে মেহেরুন কেন বি*ষই বা খেলো?
ডাক্তারের চিকিৎসা দেয়া হয়তো শেষ। দেখলাম তিনি বেরিয়ে এলেন। তার সঙ্গে রাতুলও বেরিয়েছে।ডাক্তার এবার জিজ্ঞেস করলেন,’ মেয়েটি কে? আপনার কি হয় সে? ‘
রাতুল বললো,’ আমার খালাতো বোন।’
ডাক্তার বললেন,’ কিছু মনে করবেন না! কেউ তো আর এমনি এমনি বি*ষ খাওয়ার মতো জ*ঘন্য কাজ করে না।ও কেন বি*ষ খেলো? যদিও এটা আপনাদের পারিবারিক বিষয়। এই বিষয়ে জানতে চাওয়া আমার অনুচিত। কিন্তু বলতে বাঁধা না থাকলে বলতে পারেন ।’
রাতুল বললো, ‘আপনাকে আমি পেমেন্ট করেছি তো‌। করিনি?’
ডাক্তার বললেন,’ হ্যা করেছেন।’
রাতুল এবার বললো,’ আপনার যতো ডিমান্ড ছিল এরচেয়ে বেশি পেমেন্ট করেছি তাই না?’
ডাক্তার বললেন,’ জ্বি ভাই।’
রাতুল এবার বললো,’ তাহলে দয়া করে এখন চলে যান। পারিবারিক বিষয় পরিবারের ভেতরে থাকাই ভালো।তাই না ?’
ডাক্তার হয়তো লজ্জা পেয়েছেন খুব। তিনি বললেন,’ জ্বি ভাই।ঠিক বলেছেন।’
রাতুল বললো,’ তাহলে যান। আসসালামুয়ালাইকুম।’
ডাক্তার সালামের উত্তর দিয়েছেন কি না তা শোনা গেল না। কিন্তু দেখা গেল তিনি বারান্দা পেরিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু ডাক্তার সাহেব চলে যাবার অনেকক্ষণ পরেও রাতুল ওখানে দাঁড়িয়েই রইল। তারপর আবার মেহেরুনের ঘরে ঢুকলো। ওখানে খানিক সময় থেকে তারপর ওখানে থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বারান্দায় পা ফেলতেই ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। আবার পাখা ঘুরতে শুরু করেছে। ঘটঘট করে শব্দ হচ্ছে। ততোক্ষণে তাড়াহুড়ো করে আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here