অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব ২৭

0
147

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৭. (প্রথমাংশ)

রাতের শেষ প্রহর পেরিয়ে ভোর হতে চলল। খুব বেশি সময় বাকি নেই ফজরের আজান পড়তে। কোথাও কোথাও দূর মসজিদ থেকে ভেসেও আসছে আজানের ধ্বনি। রাত আধার কেটে আলোর ছটা তো প্রকাশ পাবে শীঘ্রই; সেই সাথে যেন ইরাজের ছটফটানি সম-হারে বাড়ছে। পাবলিক হাসপাতাল হওয়ায় লোক সমাগম তুলনামূলক কম। ইরাজ বারান্দায় একাধারে ছটফটে পায়ে পায়চারী করছে। পাশেই এক বেঞ্চে ভেঙে পড়া হেলাল সাহেবকে ধরে বিষণ্ন মুখে বসে রয়েছেন ইমতিয়াজ সাহেব। ইরাজ একা অস্থির নয়। আজ বড়ো আশ্চর্যজনক দৃশ্য হিসেবে চোখে পড়ার মতো ব্যপার হলো— আনতারা খানম যেন সমানতালে অস্থির ইরাজের সঙ্গে সঙ্গে। তার চোখ-মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। বারবার এগিয়ে যাচ্ছেন অবজারভেশন রুমের দ্বারের দিকে। আবার হতাশ হয়ে ফিরে আসছেন।

মেঘালয়া নাক-মুখে র ক্ত উঠে এসেছিল সঙ্গে অস্বাভাবিক পেটের ব্যথা। রাত সাড়ে তিনটার সময় নিয়ে আসা হয়েছে হাসপাতালে। তখনই মেঘালয়াকে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে অবজারভেশন রুমে। তখন থেকে ইরাজের এই অশান্ত, এলোমেলো চলন চালু আছে। চোখ-মুখ র ক্ত শূন্য, উদ্দীপনাহীন লাগছে। চেহারাটা ভাঙা, বসে যাওয়া। শারমিন আরা আজ রাতে ডিউটিতে ছিলেন না। তাকে ইরাজ ফোন করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তিনি এখনও এসে পৌঁছান নি। ইরাজের মাথা আরও গরম হয়ে উঠল।

ফজরের আজান শোনা যায়। ইরাজ একবার ভাবনা-পীড়িত দৃষ্টিতে তাকাল সেই কেবিনের দিকে– যেখানে মেঘালয়াকে অবজার্ভ করা হচ্ছে। অতঃপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল মসজিদের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই নজরে এলো শারমিন আরা নামলেন নিজস্ব গাড়ি থেকে। ইরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে দাঁড়াল এক পুরুষ। ইরাজ এগিয়ে গিয়ে দাঁত খিঁচে বলল, “ম্যাম! আপনার বিবেক ঘুনপোকায় খেয়েছে? মেঘের কিছু হলে আপনাকে আমি..

শারমিন আরা ইরাজের বাহুতে হাত রেখে সজল চোখে তাকায় ইরাজের বিক্ষুব্ধ চোখের দিকে। ইরাজ নিভে গেল একটু, থামল। শারমিন আরা ডিভোর্সী-নারী। এই শেষ রাতে একজন নারীর পক্ষে পথ পেরিয়ে হাসপাতালে আসা সহজ তো মোটেই নয়। যে ছেলেটি তাকে নামিয়ে দিতে এসেছে, শারমিন আরার ছোটো ভাই শান্ত। সেও পরিচিত ইরাজের। শারমিন আরা বললেন, “কুল, রাজ!ʼʼ

ইরাজ চলে যায় নামাজের উদ্দেশ্যে। শারমিন আরা দ্রুত প্রবেশ করলেন ভেতরে।


সকাল সাড়ে ছয়টা বাজতে চলল। ইরাজ মন্থর পায়ে প্রাণহীনের ন্যায় দরজা খুলে প্রবেশ করল কেবিনে। চোখের কাতরতা আর বুকের ধুকপুকানিতে ইরাজ বিদ্ধস্ত যানবাহনের মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে যেন! গিয়ে বসতেই শারমিন আরা বলতে শুরু করলেন,
“রাজ! আমি তো তোমাকে প্রেগন্যান্সির সেই শুরুতেই বলেছিলাম, মেঘালয়ার প্রি-একলাম্পসিয়া দেখা দিতে পারে। কারন প্রথম থেকে ওর ব্লাড-প্রাশার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আর যা ধারণা করেছিলাম, তা ঘটে গেছে। এখন..

কথা শেষ করতে দেয়না ইরাজ। বলে ওঠে, “এখন কী অবস্থা, ম্যাম!ʼʼ

শারমিন আরা ইতস্তত করলেন। এই ছেলের যা মেজাজ। না জানি কথাটা শুনে কিভাবে নেবে। তবুও বলতে শুরু করলেন, “মেঘালয়ার ব্লাড-প্রেশার অনিয়ন্ত্রণে। মাঝেমধ্যেই খিঁচুনি হচ্ছে। নাক-মুখে রক্ত আসছে। আর বাচ্চার গঠন সুষ্ঠুভাবে হয়নি।ʼʼ

কোনদিন কোন রোগীর কন্ডিশন জানাতে ডাক্তার হিসেবে এমন দ্বিধা কাজ করেনি তার, অথচ ইরাজের সামনে ব্যাপারটা খুলতে মুখে বাঁধছে যেন। থেমে থেমে বললেন কথাগুলো শারমিন আরা। ইরাজ শান্ত নজরে তাকিয়ে বলল, “ভনিতা না করে খুলে বলুন, এখন কী করা যায়। কী হয়েছে?ʼʼ

চরম অসভ্যের মতো শোনাল ইরাজের কথা। শারমিন আরা একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “তোমার বাচ্চা বাঁচার সম্ভাবনা টেন-পার্সেন্ট। আর যেহেতু প্রি একলাম্পসিয়া শুরু হয়েছে, প্রসবের সময় খিঁচুনি উঠবে প্রায় নিশ্চিত। আর তখন বাচ্চা ও মা দুজনের লাইফ-রিস্ক রয়েছে। যদি কোনভাবে কেউ একজন বেঁচেও যায়, সে মেঘালয়া হলে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়বে। আর বাচ্চা প্রতিবন্ধী হতে পারে। কারণ, বাচ্চার বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়নি। মেঘালয়া গর্ভধারণের শুরু থেকে শারীরিকভাবে ফিট ছিল না। আর… মেঘালয়ার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। আ’ম সিওর তোমারটা পজেটিভ। বাচ্চার বর্ধণ ও শারীরিট পরিপক্কতায় বাঁধা হয়েছে ব্যাপারটি, সঙ্গে মেঘালয়ার শারীরিক কন্ডিশনকে আরও বিগড়েছে।ʼʼ

ইরাজের বুকটা কেঁপে উঠল বোধহয়! মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল, তবুও অটল চাহনিতে জিজ্ঞেস করল, “কেন এসব হচ্ছে?ʼʼ

“হতে পারে পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে এমন। বংশগতি বোঝো তো! হার্ট ফেইলিওর বা উচ্চ রক্তচাপ রোগ গুলো বংশগতির ধারায় প্রবাহিত হওয়ার মতো ম র ন ঘা তি রোগ।ʼʼ

এই কথাটুকুর পরিপেক্ষিতে ইরাজের মাথায় হুট করে এলো, মেঘালয়ার আম্মুও মেঘালয়ার ছোটো ভাইয়ের প্রসবের সময় খিঁচুনিতে মা-ছেলে দুজনেই মারা গিয়েছিল। এ-কথা এতদিন মাথায়ই আসে নি ইরাজের। শারমিন আরা বলতে লাগলেন,

“প্রথম গর্ভধারণে প্রেশারটা অনিয়ন্ত্রিত হতে বেশির ভাগ নারীরই দেখা যায়। মেঘালয়া পঁচিশ বছরের কম সময়ে গর্ভাধারণ করেছে, এখানেও এ অবস্থা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যায়। আর তাছাড়া তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো, পরিবারে আর কারও হাইপারটেনশন আছে কিনা!ʼʼ

মেঘালয়ার গোটা পরিবারটাই হাইপারটেনশনের রোগী। হেলাল সাহেবের হাই-প্রেশার আছে, মেঘালয়ার মা তো জীবনটাই দিয়ে গেলেন। এ-কথা মাথায় আসতেই ইরাজ উদ্ভ্রান্তের মতো বলে ওঠে, “আমার বাচ্চা লাগবে না। আপনি মেঘালয়াকে ঠিক করুন। বাচ্চা দরকার নেই তো, ম্যাম! আমার জন্যই হয়েছে সব। আমিই করেছি এসব। মেঘের গর্ভধারণে আমি শালা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম। বুঝেই উঠতে পারিনি আমার এক খুশির জন্য আমার জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বনকে কোরবানী করতে হবে। শালা, বোকা ইরাজ! জীবনে তোর হারানোর শেষ নেই। আর তার কারণগুলো তুই নিজেই।ʼʼ

পাগলের মতো ছটফট করতে করতে এসব প্রলাপ বকতে শুরু করল ইরাজ। উঠে দাঁড়াল, কেবিন থেকে বেরিয়ে একদৌঁড়ে গেল মেঘালয়ার কেবিনের দিকে। ওয়ার্ডবয় ওর উত্তেজনা দেখে বাঁধা দিতে আসলে এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। মেঘালয়া প্রায় অচেতন পড়ে আছে বেডে। ইরাজ গিয়ে দাঁড়াল মেঘালয়ার বেডের পাশে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল মেঘালয়ার অচঞ্চল, অর্ধবোজা চোখের দিকে। মেঘালয়ার হাতটা মৃদূ নড়ে ওঠে। ইরাজ তা চেপে ধরে বসে পড়ল চেয়ারে। মেঘালয়ার মুখে কাতর হাসি। মলিন চোখদুটো চেয়ে আছে ইরাজের দিকে, মুখে হাসি লেপ্টে আছে তার। ইরাজের বুকের ভেতর সূঁচাল ব্যথা অনূভূত হয়। হৃদযন্ত্রটা লাফিয়ে উঠল ধকধক করে। চোখ লাল হয়ে উঠল। নির্নিমেষ চেয়ে রইল মেঘালয়ার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে। কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা বুঝে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষারত রয় ইরাজ।

চলবে..

[
#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৭ (বর্ধিতাংশ).

“আমার বাচ্চা ঠিক আছে?ʼʼ

মেঘালয়ার ক্ষীণ স্বরে বলা কথাটা ইরাজকে কঠিন এক ধাক্কা মারে। তা হয়ত বোঝা গেল না তার উদ্দীপনাহীন চেহারায় তাকিয়ে। কোন জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ইরাজ মেঘালয়ার শুকনো মুখটার দিকে। ওই মুখটাকে সজীব দেখতে ইরাজ এরকম হাজার বাচ্চার মায়া ত্যাগ করবে নির্দ্বিধায়; তা হয়ত জানবে কেউ কোনদিন! হঠাৎ-ই এমন কিছু বলে ওঠে ইরাজের ভেতরে আন্দোলিত মস্তিষ্কটা। একটা ঢোক গিলল ইরাজ। ইরাজের এই পরিশ্রান্ত, কাতর চাহনি! মেঘালয়ার ভেতরে ঝড় তুলছে। অথচ মেয়েটার শরীর সায় দিচ্ছে না। মেঘালয়ার চোখের কোণায় জলের ফোঁটা চিকচিক করে ওঠে। আস্তে করে বলল, “ডাক্তার যাই বলুক,আমার বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে নিন। পাঁচটা মাস ধরে ধারণ করেছি ওকে, হারাতে পারব না..ʼʼ

ইরাজ দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠল বোধহয়, “আর আমি যে তোকে ছয়- সাতটা বছর ধরে ধারণ করে আসছি! খু ন করে ফেলব একদম! আবেগ দেখাচ্ছিস? শালা, স্বার্থপর রে! সব স্বার্থপর! এই এই, এই মেঘ, এই! তোদের আমাকে পাথর মনে হয়? আমি শিলাখন্ড? আমার মায়া নেই, হারানোর ভয় নেই, আমার ব্যথা লাগে না, তাই না?ʼʼ

টপ করে আরেক ফোঁটা জল ছিটকে পড়ে ইরাজ নামক কঠিন ছেলের চোখের কোণ পেরিয়ে। মেঘালয়া বিভ্রান্ত হয়ে চেয়ে রয় সেদিকে! তার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থামল, আবার শুরু হলো ধুকপুক করে। ইরাজকে পাগলের মতো লাগছে। যেন তার শরীরে জলন্ত কয়লার সেঁক দেওয়ার হচ্ছে, ওভাবে ছটফট করতে থাকল ইরাজ। আকষ্মিক ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসল ইরাজের বিক্ষুব্ধতা। শীতল চোখে চেয়ে শান্ত আওয়াজে প্রশ্ন করে, “আমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে হয় না তোর, তাই না? এজন্য চলে যেতেও ভয় নেই।ʼʼ

আবার ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠল। মেঘালয়ার হাতটা ঝারা মেরে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিদ্ধস্ত পাগলাটে ভাবে বলতে থাকে,

“আরে তোরা তো পারিস, বাল। ইরাজ পারে না। ইরাজ বারবার আটকে পড়ে একই জালে। শালা ইরাজ ভয় পায়, ইরাজরা সবকিছুর ওপরে তোদের মতো মেঘেদের নিজের সাথে চেপে ধরে ক’দিন বাঁচতে চায়! ইরাজ হারাতে চায় না, কিন্তু তোদের হারিয়ে যেতে কত আয়োজন!ʼʼ

চিৎকার শুনে শারমিন আরা এসে দাঁড়ালেন কেবিনে। ইরাজের বাহুতে হাত রাখতেই ছিটকে সরিয়ে দেয় ইরাজ হাতটা। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মেঘালয়ার দিকে চেয়ে।
মেঘালয়া ফুঁপিয়ে উঠল, হাতটা প্রসারিত করল ইরাজের দিকে। শব্দ করে শ্বাস নিল। ইরাজের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে মুহূর্তের মাঝে। দৌঁড়ে গিয়ে মেঘালয়ার হাতটা চেপে ধরে। আচমকা মেঘালয়া ক্যানোলা লাগানো হাতটা ব্যথা লাগা সত্ত্বেও তুলে ইরাজের শার্টের কলার চেপে ধরে মৃদূ টান দেয়। ইরাজ আরও খানিক ঝুঁকে যায় মেঘালয়ার দিকে। ইরাজের চোখের স্থির চাহনি। অথচ মেঘালয়ার চোখ কাঁপছে। চোখে টলমলে পানি, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকায় তা ছিটকে পড়ছে মুখের চারদিকে। ইরাজের চোখের দিকে চোখ রেখে ভাঙা স্বরে বলে, “এসব কেন বলছেন? আমি দেখেছিলাম ইরাজের চোখে বাবা হবার আনন্দটুকু।ʼʼ

পরস্পরের মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া দুটো রুহুর বিচ্ছেদের পূর্বক্ষণ বোধহয় এমনই বিপর্যস্ত হয়! এমনই গুমোট যন্ত্রণারা বোধহয় ধোঁয়ার কুণ্ডলি হয়ে বাতাসে বিষাদ ছড়ায়! কেবিনে যে শারমিন আরা দাঁড়ানো তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই এক সম্ভাব্য বিদায়ী পথযাত্রী ও আরেক বিদ্ধস্ত, সর্বস্বান্ত পুরুষ! ইরাজ মলিন হাসল, “মেঘ! তুই বোকা, অন্ধ নাকি স্বার্থপর? সবসময়ই স্বার্থপর! ইরাজের বাপ হওয়ার আনন্দটুকু না দেখে বরং ইরাজকে দেখলে আজ তোর বুক কাঁপতো হয়ত চলে যাওয়ার কথা ভাবলে। বাপ হওয়ার আনন্দের কথা ভাবছিস? আমি ভাবছি, কেউ আমায় রেখে চলে যাবে, অথচ তার সাথে থাকার ছিল আমার, সে অনুযায়ী আমার তো পরপারের নেশা ধরে যাবে রে, মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া ডুকরে কেঁদে ওঠে, বুক চেপে ধরে হাঁপানীর মতো করে শ্বাস নেয়। থেমে থেমে বলে, “আমার কিছু হবে না। আপনি..

ইরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল আবার, ইরাজের ধমক গর্জনের মতো শোনায়, “আমি কী? কী করব আমি? তোর বাচ্চা সাথে নিয়ে সরাজীবন তোর মুখটা মনে করতে করতে জীবন পার করব? পাগলে ** আমায়? ইরাজের এত খারাপ দিন আসেনি, বাল। ইরাজ সবসময় সুখী ছিল, থাকবে। তোর ওসব ঝোলা টেনে নিয়ে বেড়ানোর মধ্যে নেই ইরাজ..

আনতারা খানম এলেন সেখানে। দৃশ্যটা তার বুকের ভেতরে নাড়িয়ে তোলে। তার ছেলের কী হবে— এই মেয়েটার সঙ্গে খারাপ কিছু হলে! ইরাজকে টেনে একটু পিছিয়ে নিয়ে গেলেন। ইরাজের বুকের উঠা-নামা আর সর্বস্বান্ত চোখের চাহনি! আনতারা করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের দিকে। গিয়ে মেঘালয়ার পাশে বসে অর্ধসিক্ত চোখে চেয়ে মেঘালয়ার মাথা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ইরাজ সরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। শারমিন আরা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। কপট রাগ দেখিয়ে ধমকে বললেন, “রাজ! এ কেমন অসভ্যের মতো আচরণ? ব্যাড-টেমপার হলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? আমরা দেখব কী করা যায়! তুমি শান্ত হও।ʼʼ

ইরাজ মুখটা বিকৃত করে উগ্র হয়ে তাকাল শারমিন আরার দিকে, “কী দেখবেন? হেলাল আকবরের মেয়ের আমাকে ছেড়ে পালানোর অনুষ্ঠান দেখবেন? রিপোর্ট দেখিনি আমি? আমি নাহয় বোকা শালা, মূর্খ তো না! প্রেশার ১৮০/১৩০। দুইশো ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? হেলাল আকবরের মেয়ের র ক্তে মাখা থেমে যাওয়া দেহ থেকে বাচ্চা বের করে ইরাজের হাত দেবেন? পরিকল্পনা কী আপনার?ʼʼ

ইরাজকে উন্মাদের মতো লাগে। এক একটা প্রশ্নে কেবিন কেঁপে উঠছে। হেলাল সাহেব এগিয়ে আসে, পেছনে ইমতিয়াজ সাহেব। ছেলেকে বাঁধা দিলেন না। ক্লান্ত চোখে চেয়ে দেখলেন ছেলেকে। ইরাজ আবার পাগলের মতো করতে শুরু করে, ম্যাম! কখন সার্জারী শুরু হবে? জলদি করুন তো!ʼʼ

পাগলের মতো মাথা দুলিয়ে, হাত নাড়ায়, “যান যান, ব্যবস্থা করুন। এখানে দাড়িয়ে থাকবেন না। যান তো, বাল!সময় যাচ্ছে শুধুশুধু।ʼʼ

ডাক্তার কেবিনে প্রবেশ করে। ইরাজকে বলল,এভাবে এবোর্শোন করানো অনৈতিক। আপনি ধৈর্য্য ধরুন। সবে পাঁচ-মাস শেষের দিকে।

ইরাজ বকে ওঠে, “এ শালা ডাক্তাররা তো আইনের লোকের থেকে বড়ো বা** হয়ে গেছে। রিপোর্ট লিখাতে গেলে আগে আঘাত দেখাতে হয়। আঘাত পাওয়ার আগে ব্যবস্থা নেই! তো মরলে তারপর প্রমাণ হাতে নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন? শালা তোর ডাক্তারীর ..

এগিয়ে যায় ইরাজ ডাক্তারের দিকে তেড়ে। ইরাজের বিশ্বাস, এভাবে এই আবেগী কথোপকথনের মাঝে খারাপ কিছু ঘটবে মেঘালয়ার সঙ্গে। ও মোটেই আলাপ বাড়াতে চায় না। হেলাল সাহেব এসে ইরাজকে সামলাতে চেষ্টা করে। ইরাজ অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে ওঠে ডাক্তারটিকে। পুরো কেবিনে এলোমেলো এক অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়।

অথচ শারমিন আরা স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। এরকম কত কেইস প্রতিনিয়ত হেন্ড্যল করতে হয়। অথচ এতটা অস্থির লাগে নি কখনও ভেতরে। আসলে ইরাজের মতো জটিলতম অনুভূতিতে মাখা, পাগল পুরুষের দেখা পায়নি যে! যার কথার মর্ম উদ্ধার করতে গেলে সে কথার মাঝে ডুবে যেতে হয়। হুট করে শারমিন আরা নিজ মনেই নিজের ভাগ্যের ওপর হেসে উঠলেন। এক মেয়ে মৃ ত্যুপথযাত্রী। তার অর্ধাঙ্গ যেন খোদার কাছ থেকেও মেয়েটাকে ছিনিয়ে আনতে যুদ্ধ করতে চায়! সে নিজেও তো নারী, তবে সে জীবিত থাকতে কেন তাকে স্বামী নামক পুরুষটা কাছে রাখেনি এভাবে ধরে! পুরুষ বৈচিত্র জাত। একই জাতের মাঝে কতরকম বিভেদ! তবে ইরাজ যেন একটু বেশিই ব্যতিক্রম সত্তার। যার সবকিছুতে ভাবার বা বোঝার মতো কিছু লুকায়িত।

মেঘালয়া হঠাৎ-ই কেঁদে ওঠে। অতঃপর আস্তে করে চোখটা উল্টে ঝাপসা চোখে চোখটা বুজে নেয়। আনতারা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, “আল্লাহ!ʼʼ

ইরাজের বিশ্বাস বাস্তবে রূপ নিল বোধহয়! ইরাজ ধপ করে নিভে যায়। শান্ত হয়ে উঠল একদম! শরীরের ভর ছেড়ে দাঁড়াল। হেললা সাহেব ইরাজকে ছেড়ে চমকিত হয়ে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার ব্লিডিং শুরু হয়েছে। শারমিন আরা সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড়ে গেলেন সেদিকে। মেঘালয়ার কব্জিতে হাত রাখলেন। কয়েক মিলি সেকেন্ড পালস রেট না পেয়ে ডাক্তারী ভুলে একজন সাধারণ মানুষের মতো তার কলিজাটাও ছলাৎ করে ওঠে। কেন! হয়ত ওই-যে এগিয়ে না এসে বরং প্রাণহীনের ন্যায় পিছিয়ে গিয়ে উদ্ভ্রান্ত নজরে তাকিয়ে থাকা তেজী পুরুষটার কথা ভেবে? আবার পেলেন পালস রেট। তবে খুবই ধীর গতিতে চলছে তা। রক্তক্ষরণ চলছে, মেঘালয়া অচেতন। তিনি তাকালেন ডাক্তারটির দিকে। চোখের ইশারায় কথা বিনিময় হয় এক মুহূর্ত। জরুরী ভিত্তিতে সার্জারীতে নিতে ডাক্তারটা বেরিয়ে যায় হন্তদন্ত পায়ে ব্যবস্থাপনার কাজে।

ইরাজ এগিয়ে এলো না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আড়চোখে চেয়ে রইল মেঘালয়া জ্ঞানহীন মুখটার দিকে। রোবটের মতো সেই দৃষ্টি। যাতে উদ্বেগ, উদ্দীপনা, মানসিক কোন অনুভূতি দেখা গেল না। কেবল ভরাট, সজল চোখে চেয়ে রয় ইরাজ। তার পাপ-পূণ্যের ঘড়া পূর্ন হয়েছে। সে তার সমস্ত সম্পদ হারিয়ে সর্বস্বান্ত আজ। তার কাছে হারানোর মতো কিছু নেই যেখানে, তার মানে সে-ই তো সিকান্দার। সে বাদশাহ। আজ সব হিসেব মিলে গেছে যেন তার জীবনের। আর চাওয়া-পাওয়ার নেই কিছু। সব পেয়েছে সে। সব আজ তার হয়েছে। নির্বিকার, অনুভূতিহীন চাহনিকে চোখের পাতার ঝাপটায় ঢেকে ফেলে আস্তে করে চোখটা বুজে নিল ইরাজ।

ওভাবেই শান্ত হয়ে বসে পড়লেন আরেকটা মানুষ। মেয়ের জন্মদাতা। যাদের জন্য ত্যাগ নিতকর্ম মাত্র। এই-যে মেয়ের বাবা তিনি, তাই তো আজ হারানোর যন্ত্রণায় তার কাতর হওয়া চলবে না। তার অভিযোগ করার নেই। তার বিলাপ করার নেই। সে কেবল সইবে, দেখবে, আর বুকটা চেপে ধরে মাটিতে পড়ে রইবে। মেয়েদের জীবন যদি ত্যাগের আরেক রূপ হয়, তবে সেই মেয়ের জনক হয়ে তার কতখানি ত্যাগী হতে হবে তা বেশ বুঝেছেন হেলাল সাহেব। তাই তিনি আজ চেঁচাবেন না, আহাজারী করবেন না শুধু দেখবেন। তবে সবশেষে তার নিজেকে বড়ো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহীতা হিসেবে নিজের প্রতি গর্ব করতে খুব ইচ্ছে হলো, তিনি তার পাগলিকে ভুল পুরুষের হাতে দেননি। এ-ই তো মেয়ের বাবা জীবনের সার্থকতা!

আনতারা খানম বসে রইলেন ওভাবেই। মেঘালয়ার প্রতি নিজের ক্ষোভগুলো ভাঙতে শুরু করেছিল, ধীরে-ধীরে ইরাজের জীবনের খুশি ফিরতে দেখে। তিনি তো কখনও মেঘাকে খারাপ চোখে দেখতে চাননি! অথচ ছেলের বুকের হাহাকারের সামনে সব তুচ্ছ। যে মেয়েটা ছেলেকে এতো কষ্ট দিয়েছে, তাকে মেনে নিতে মা হিসেবে বুকে বেঁধেছে বারবার। আবার যখন সেই মেয়েই ছেলের জীবনের সুখগুলো একটু একটু করে ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছে, তখন মায়ের অভিমান টিকে নাকি? ইরাজের ভালো থাকার কারণ যেখানে মেঘালয়া— সেখানে মেঘালয়াকে ভালো রাখা তো আনতারার মাতৃত্যের কর্তব্য। যেদিন শুনলেন, মেঘালয়া গর্ভবতী, এ এক অনবদ্য খুশি ছিল তার জন্য।

অথচ এই-যে মেঘালয়ার গর্ভকালীন অসুস্থতা তাকে প্রতিক্ষণে পুড়াচ্ছে! এভাবেই তিনি চারটা সন্তানকে হারিয়েছেন। কেউ গর্ভপাতে, তো কেউ জন্মের পর। তবেই তো ইরাজ একা আজ! মায়ের কাছে সন্তানের নিথর শরীর! কাল রাত থেকে সেই সকল পুরোনো যন্ত্রণাগুলো তার ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। তিনি এত বছর পর মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে প্রতিবার সেই যন্ত্রণা তাজা অনুভব করছেন। তার পাগল ছেলে, তার ছেলের র ক্তে গড়া তারই একাংশ মেঘালয়া বয়ে চলেছে ভেতরে। আর সয়ে বেড়াচ্ছে, অতুলনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। বহুবছর আগের মাতৃত্য হারানোর চটা পড়া যন্ত্রণাগুলো আজ আবার তাজা হয়ে উঠেছে মেঘালয়াকে দেখে। ঝরঝর করে বেয়ে পড়ল গুমোট যন্ত্রণা গুলো জলের ধারায়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here