অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব ২২

0
105

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২২

“আহ্ দোস্ত আমি এখানে বিবিজান কোথায়? তাকে কেনো দেখছি না? এই আকবর বল না সবাই এভাবে চুপ করে আছে কেনো? আম্মা আপনি বলুন তো মেয়েটা হুট করে কোথায় উধাও হয়ে গেল?”

ছেলের কথায় কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না মিসেস ফেরদৌসী। মাত্রই ছেলেকে কেবিনে সিফট করা হয়েছে। জ্ঞান ফিরতেই নাজীবার কথা জিজ্ঞেস করে চলেছে। শ্বাশুড়ি-র সাথে যাওয়ার পর মেয়েটার চিহ্নটুকু আর হাসপাতালে নজরে এলো না। জনাব ইসমাইল বিরক্তসূচক গলায় বলেন,

“বাবা এখন শান্ত হও। এতো ভাবছিস কেনো? হবে হয়ত কোথাও। তুই আস্তেধীরে কথা বল এতো হাইপার হলে তোর বুকে ব্যথা লাগবে। এটা তো আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর মেহেরবানী বলে বু’লে’ট তোর বুক ভেদ করেনি। নাহলে তোর জীবন তো হু’ম’কি’র মাঝে ঝুলে যেতো। এই যে এখন সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিস না? এটাও সম্ভব হয়েছে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা পর। জানিস তোর মা আর দাদির মধ্যে কি অবস্থা হয়ে ছিল? কান্নায় তাদের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। সেখানে তুই সামান্য একটা মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে বলতে হাইপার হয়ে যাচ্ছিস। তোর কাছে মেয়েটা এখন বড় হয়ে গেল? আমাদের কি তোর চোখে পড়ে না? তোর ছোটকালেও ঐ মেয়ের কারণে জীবন সঙ্কটে পড়ে ছিল। আজ দেখ, আজ তো একদম তোকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছাড়ল সে। তোর মায়ের কথাই আমার মান্য করা উচিৎ ছিল। কিন্তু ভেবে ছিলাম তোর বউ হয়েছে আর বিপদ হবে না কোনো। এইতো দেখি মেয়েটা নিজেই বিপদ। তোর জীবনে এসে আবারো জীবন সঙ্কটে ফেলে দিল। এমন মেয়েকে তুই তালাক দিবি। আজ আমি তোর বাবা বলছি তালাক দিবি বুঝতে পেরেছিস?”

বাকরুদ্ধ হয়ে বাবার দিকে চেয়ে রইল আফরাজ। তার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। পরিবারের চোখেমুখে কোথাও তার বউয়ের জন্যে একবিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা পরিলক্ষ হচ্ছে না। যা লক্ষ হচ্ছে তা শুধুমাত্র ঘৃণা, বিরক্তি,ক্ষোভ। আকবর অসহায় চোখে বন্ধুর দিকে তাকালো। আফরাজ সকলের মুখোভঙ্গি দেখে বুঝতে পারল তারা সত্য না জেনেই মেয়েটা-কে দূরে সরিয়ে দিল। সে বুকের উপর হাত রেখে শুয়ে পড়ল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) এতক্ষণ বসে থেকে সবার কথা শুনে তার শ্বাস আঁটকে আসছে। সে কোনোমতে তার বাঁ হাত দিয়ে আকবর এর হাত চেপে ধরল। বন্ধুর হাত ধরার কারণ ভালোই বুঝতে পারল সে। আকুতিভরা দৃষ্টিতে আকবর এর দিকে তাকায় আফরাজ। তার চোখের চাহনি বলে দিচ্ছে ‘সে যেনো নাজীবা-র খোঁজ নিয়ে আসে জলদিই নাহলে সে শ্বাস আটকে মা’রা যাবে।’
আকবর সকলের চোখের আড়ালে আফরাজ কে আশ্বাস দিল। আফরাজ তার মুখ থেকে এমুহুর্তে কড়া কথা বের করতে পারছে না। কেননা নাজীবা যে নেই সেটা বাবার কথার দ্বারা বেশ বুঝতে পেরেছে। চোখ বুজে বুকের উপর হাত রেখে মনেমন বলে,

“বিবিজান প্লিজ প্লিজ ফিরে এসো।”

মিসেস ফেরদৌসীর কান্না থেমে গিয়েছে বহুক্ষণ হবে। তিনি ছেলের নিরর্থক বিরবির করা কথা শুনতে না পেলেও এতটুকু বুঝতে পেরেছেন ছেলে তার বউকে নিয়ে বিলাপ করছে। ছেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্বামীর দিকে তাকান। জনাব ইসমাইল দেখেও অদেখা করলেন। নীরবে রুম থেকে বেরিয়ে যান। মিসেস ফেরদৌসী ছেলের হাত ছুঁয়ে বলেন,

“বাবা ছাড় না এসব। একটা মেয়ের জন্যে তুই আমাদের মাঝে দেওয়াল তৈরি করছিস। ঐ মেয়ের চেয়েও বেটার একজন কে তোর স্ত্রী হিসেবে হাজির করবো আমি। তুই শুধু….।”

“আম্মু আপনি কি আব্বুকে ছাড়তে পারবেন?”

“আসতাগফিরুল্লাহ্ বাবা এই কথা মুখেও আনিস না। আমি কেন তোর বাবাকে ছাড়বো? সে কি কখনো আমাকে ঠকিয়েছে যে, আমার থেকে তাকে ছাড়তে হবে? তোর বাবাকে বিয়ের পর থেকে ভালোবেসেছি। সেই ভালোবাসা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অবধারিত থাকবে।”

কথাটি শুনে তাচ্ছিল্যের হাসল আফরাজ। চোখ খুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলে,

“আম্মু আপনি জিজ্ঞেস করছেন না কেনো আমি ঐ মেয়েটার জন্য পাগলামী করছি? ভেবে নিন আপনি আব্বুকে যে উদ্দেশ্যে ছাড়তে পারবেন না আমিও একই কারণে তাকে ছাড়তে পারব না। তবে হ্যা এক কথা অবশ্য বলতে পারি, আপনি যদি আমার বিয়ের সময় এদেশে থাকতেন,তখন ছাড়ার কথা বললেই আমি ছেড়ে দিতাম। কিন্তু এখন সে আমার প্রাণের সাথে মিশে গেছে। তার প্রতিটা পদক্ষেপে আমার কদম আবশ্যক। আপনি জানেন তার ব্যাপারে সব তথ্য আমি বের করে নিয়েছি। সেদিন রুমে আপনাকে অর্ধেক অতীত বলে ছিলাম। এবার শুনেন তার পুরো অতীত….।”

মিসেস ফেরদৌসী-কে অতীতের টানা কথা বলে দেয় আফরাজ। সবটা শুনে তিনি প্রথমেই তিরস্কার জানাল দাহাব এহসান কে। অতঃপর অনুতপ্ত কণ্ঠে ছেলের হাত আঁকড়ে ধরে বলেন,

“বাবা-রে তুই চিন্তা করিস না। সবটা তোর বাবাকে বলব। তিনি বুঝতে পারবেন।”

মায়ের কথার বিপরীতে নীরবে চোখ বুজে নেয় আফরাজ। তার শরীরে একরাশ ক্লান্তি এসে ভর করেছে। মিসেস ফেরদৌসী মুখ মলিন করে ছেলের পাশ থেকে উঠে কেবিনের বাহিরে চলে গেলো। জনাব ইসমাইল করিডোরে দাঁড়িয়ে বাহিরের দৃশ্য লক্ষ করছেন। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।

“বাবারা কী সন্তানের খারাপ চাই কখনো? আমি কি তোমার স্বামী হওয়ার যোগ্যতা রাখিনি? হয়ত আমি ছেলের চাওয়াটা অস্বীকার করছি তাই বলে এতটা ঘৃণা নিয়ে বলার তো দরকার ছিল না।”

“শুনেন আপনি মন খারাপ করিয়েন না প্লিজ। আফরাজ এর অবস্থা দেখেছেন তো। মেয়েটা আমাদের ছেলের জীবন কেড়ে নেয়নি। বরং তাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমি জানি আপনি শুনেছেন আপনার ছেলে কি কি বলেছে! আপনার ছায়া দরজার বাহিরে আড়চোখে দেখতে পেয়ে ছিলাম।”

“বউ নাজীবা-কে নিয়ে আসা উচিৎ। চলো দেখি ও কোথায়?”

স্বামীর কথায় মাথা নাড়লেন মিসেস ফেরদৌসী। তারা দুজনে বের হতে গেলে পথ আটকে দাঁড়ান খাদিজা বেগম। তিনি ঢোক গিলে শক্ত গলায় বলেন,

“কোনো দরকার নেই সেই মেয়ের খোঁজ করার। তাকে আমি চিরজীবনের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। সে আর কখনো ফিরবে না। তার কথা ভুলে যাও।”

থমকে গেলেন জনাব ইসমাইল আর তার স্ত্রী। মায়ের কথায় প্রশ্নাতীত গলায় বলেন,

“কি বলছেন আপনি এসব আম্মা? নাজীবা আপনার পছন্দের মেয়ে,নাতবউ না? তবে হঠাৎ কী হলো যে, বলছেন দরকার নেই? বউমা-ও বা কোথায় আপনি না তাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন?”

খাদিজা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,

“তাকে তার আসল জায়গায় পাঠিয়েছি।”

ধপ করে কিছু একটার শব্দে তারা পিছু মোড়ে তাকায়। আফরাজ-কে চোখ বড়বড় করে স্তদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তারা ভয় পেয়ে যান। তার চেয়েও বিবশ দৃশ্য হলো আফরাজ এর বুকের দিকে ব্যান্ডেজ লাল হয়ে ভিজে যাচ্ছে। সে মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময়ে নীরব হয়ে মাটিতে বসে গিয়েছে।
ছেলের এরূপ দেখে মনেমন আতংকিত বোধ করছেন জনাব ইসমাইল আর তার স্ত্রী। খাদিজা বেগম নাতির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, এই কি সেই ছেলে যে বিয়ে করিয়েছি বলে তার দাদির সাথে কথা অব্দি বলতে চাইনি‌। আর এখন? তিনি নিজে দূরে করতে চাইছেন। তাতে বাঁধা দিচ্ছে সে স্বয়ং তার নাতি।
তিনি নাতির কাছে যেতে গেলে ভাঙচুরের শব্দে এক কোণায় দাঁড়িয়ে যান। আফরাজ এর শরীরে যেনো কোনো অশরীরী ভর করেছে। ছেলেটা উম্মাদের মত আশপাশের জিনিস ভাঙচুর করছে। তার আগুন চোখ দেখে ডক্টর নার্স ভয়ে পিছিয়ে আছে। আকবর বাহিরে গিয়ে ছিল ওষুধপত্র আনতে। কিন্তু আফরাজ এর বরাদ্দকৃত কেবিনের বাহির থেকে ভাঙচুর এর শব্দে সে থমকে যায়। তৎক্ষণাৎ ছুটে বন্ধুর কাছে গেল। ওষুধপত্র নার্স এর হাতে দিয়ে তার কাছ থেকে ঘুমের একটা ইনজেকশন রেডি করে দিতে বলে। নার্স তার কথামত রেডি করে আকবর এর হাতে দিল। আফরাজ চিল্লিয়ে বারংবার বলে যাচ্ছে তার বিবিজান-কে এনে দিতে। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। জনাব ইসমাইল কে আঁকড়ে ধরে রইলেন মিসেস ফেরদৌসী। তিনি ছেলের পরিণতি দেখে ফুঁপাচ্ছেন। খাদিজা বেগম মাথায় হাত ধরে বসে আছেন সিটের মধ্যে। তিনি বুঝতে পেরেছেন নাতবউ কে দূরে সরানো মোটেও উচিৎ হয়নি। আকবর ইনজেকশন কোনোমতে আফরাজ এর কাঁধে চুবিয়ে দেয়। আফরাজ এর হাত-পা ক্রমশ অচল হয়ে পড়ে। ঢলে পড়ে আকবরের কাঁধে। সে তার বন্ধুর ভার ধরে কেবিনের বেডে শুয়ে দিল। নার্স এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

“কতঘণ্টার জন্য রেস্টে থাকবে?”

“ধরেন তিনঘণ্টা। তারপর হয়ত উনি আবারো হাইপার হয়ে ভাঙচুর করতে পারেন।”

নার্স আফরাজ এর পরিবারের সবার দিকে তাকিয়ে পুনরায় কিছু বলতে নিলেই ডক্টর হাঁপাতে থেকে বলেন,

“দেখুন স্যারের ওয়াইফ কোথায়? প্লিজ তাকে এখানে হাজির করুন। নাহলে দেখবেন স্যারের মেন্টাল কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল হয়ে পড়বে। প্লিজ ম্যামকে নিয়ে আসুন।”

মিসেস ফেরদৌসী শ্বাশুড়ি-র হাত ধরে কান্নাময় গলায় বলেন,

“আম্মা মেয়েটা কোথায়? আপনি তাকে কোথায় পাঠিয়েছেন? প্লিজ বলে দিন না। দেখেন আমার ছেলেটার পাগলামী দশা শুরু করে দিয়েছে। প্লিজ আম্মা বলুন না কিছু।”

খাদিজা বেগম চোখে ঝাপসা দেখছেন। জীবনে দুদিক এর প্যাচালে পরে তিনি দিকবেদিক ভুলে বংশধরা রক্ষার স্বার্থে নাতবউকে এমন স্থানে পাঠিয়েছেন। যেখান থেকে তার ফেরা অসম্ভব। নাতবউও টর্চার এর ভুক্তভোগী হবে অথবা হচ্ছেও বোধ হয়। সেই ধারণা খাদিজা বেগম এর মস্তিষ্ককে প্রচন্ড অনুশোচনার অনলে পুড়িয়ে ছাড়ল। বউ-মাকে কিছু বলার পূর্বেই তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) আম্মাকে অজ্ঞান হতে দেখে জোরে ‘আম্মা’ বলে ডাক দেয় জনাব ইসমাইল। তৎক্ষণাৎ মা-কে জড়িয়ে ধরে ডক্টর নার্স ডাকলেন। আকবর পুরো পরিবারের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত দশা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কুসুমার অবস্থা কি সেটাও জানার সময় সুযোগ পাচ্ছে না। আফরাজ কে হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময় কুসুমা উপস্থিত থাকলেও পরিবেশ পরিচিতি বিবেচনায় তাকে কাজের মেয়ের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ছিল। ফোন হাতে নিয়ে কুসুমা কে কল দেয়। সে ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিল। ভাবছে একবার কল করে জানার চেষ্টা করবে। আশানুরূপ স্বামীর কল পেয়ে খুশি হলো। উত্তরে কিছু বলার সুযোগ পেল না। আকবর সবটা খুলে বলে। শুনে কুসুমাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। নাজীবা ভাবী কে কোথায় পাঠাতে পারে তাও তার ধারণাতীত।
আকবর বউকে সাবধানে থাকতে বলে নাজীবা ভাবীর খোঁজ লাগাতে গার্ড’স লাগিয়ে দেয়। আফরাজ এর কাছ থেকে ভাবীর অতীত সম্পর্কে জানলেও ভাবী যে হাসপাতালে ভর্তি ছিল এর নাম অজানা রয়ে গেল। খোঁজতে কষ্ট হলেও সে বন্ধুর সুস্থতার খাতিরে হলেও নাজীবা-কে খোঁজে বের করবে।

অন্যথায়, নাজীবা হাত-পা ছড়িয়ে চিৎকার করে বলছে,
“প্লিজ এই ইনজেকশন আমাকে দিয়েন না। আমি অসুস্থ ,পাগল নয়। প্লিজ আমাকে যেতে দিন প্লিজ! আমার আফরাজ অসুস্থ তার কাছে যেতে দিন। না না প্লিজজজ আহহহহহ।”

চলবে…..
(বিঃদ্রঃ-ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন প্লিজ। ভার্সি শুরু হওয়ায় একটু ব্যস্ত গলায় লেখছি। তাই বানান ভুলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here