অটবী সুখ পর্ব ২২

0
111

অটবী সুখ

২২.
বিষণ্ণ ক্ষণ। বিষণ্ণ আকাশ। বিষণ্ণ সন্ধ্যে। বিষণ্ণ অটবীর চাপা মনটাও। বিয়ের দিন-তারিখ সব ঠিক হওয়ার পর থেকে তার সুশ্রী মুখটা মলিন রঙে ঢেকে গেছে। ভেতরটা নিদারুণ উদাসীনতায় জড়োসড়ো, আতঙ্কিত। অটবী বসে আছে ঠিক জানালার মাঝখানটায়। নির্জীব দৃষ্টি দূর গহীনে। হাতে ফোন। ফোনের স্ক্রীনে মুশফিকের নামটা গোটা গোটা অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। বিয়ের কথাবার্তা আগানো মাত্রই মুশফিক ছেলেটা কেমন যেন অদৃশ্য অধিকার দেখাচ্ছে অটবীর ওপর। এটা করো না, ওটা করো না, ফোন দিলে সাথে সাথে ধরবে– ইত্যাদি! ইত্যাদি! অটবীর ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। বিরক্ত অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু তাতেই-বা কার কি? কে তার মনের অবস্থাটুকু শুনবে? মায়ের তো ওই এক কথা! এখানেই বিয়ে করতে হবে। নয়তো আবার সেই জেদি অভিমান!
নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অটবী কলটা ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, “ফোন কই থাকে তোমার? এতক্ষণ লাগে কল ধরতে?”

সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে বদলেছে। অটবীর ক্ষেত্রে না, মুশফিকের দিক থেকে। আর এই বিষয়টাই অটবীকে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে দিচ্ছে। বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে।
সে ধীর গলায় জবাব দিলো, “ওয়াশরুমে ছিলাম।”

ওপাশ থেকে একটা ছোট্ট নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। পরপরই অনেকটা প্রেমে মাখোমাখো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এখন কি করছো? নাস্তা করেছো?”
অটবীর ছোট্ট উত্তর, “হু।”
—“আমি খেয়েছি কি-না জিজ্ঞেস করবে না?”
—“আপনি খেয়েছেন?”
প্রশ্নের ধরণটা অনেকটা দায়সারা, নির্জীব। ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটা সম্ভবত বুঝতে পারলো। একটু চুপ থেকে কিঞ্চিৎ মন খারাপ নিয়ে বললো, “তুমি কি এ বিয়েতে রাজি না, অটবী? তোমার আচরণ, কথার ধরণ, বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তোমার! বিয়ের সপিংটা পর্যন্ত আমার সাথে করতে গেলে না। এমন কেন করছো?”

অটবী এমন কেন করছে? প্রশ্নের উত্তরটা তারও জানা নেই। দুই-তিন দিন ধরে সে এই একটা প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে চলেছে। কিন্তু প্রশ্নটা বড্ড কঠিন, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধু এটুকু জানে, এই বিয়ে সে করতে চায় না। এই এলাকা ছেড়ে সে চলে যেতে চায় না। মুশফিককে চায় না। মাকে, নলীকে, পৃথাকে! কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। আর ত্রিস্তান? তাকে নিয়ে অটবীর চিন্তা ঝাপসা, অস্পষ্ট। শুধু একটুখানি অনুভূতি থেকে উপলব্ধি করে সে তার নাম দিয়েছে, “হৃদয় কামড়ানো নীল ব্যথা!”

রান্নাঘর থেকে রেবা বেগম হাঁক ছাড়ছেন। চা, পরোটা বানানো হয়ে গেছে। সবাইকে খেতে ডাকছেন। ফোনের ওপাশ থেকে মুশফিক ডাকটা শুনলো। অটবীকে কিছু বলতে না দেখে নিজেই কথা আগালো, “উত্তর দিবে না? আবারও বাহানা করে কথা কাটিয়ে দিবে?”

অটবী ম্লান হাসলো। দু’এক সেকেন্ডের জন্য। এরপর আস্তে করে বললো, “রাখছি।”

কল কেটে মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে রাখলো অটবী। চেয়ার থেকে ওড়না নিলো। গায়ে জড়ালো। ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো, তার দুই বোন, দুই পন্ডিত আগে থেকেই খাবার টেবিলে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। মন তাদেরও খারাপ। বোনের বিয়ে এখনই হোক, সেটা তারাও চায়নি।
অটবী নিঃশব্দে ওদের পাশের চেয়ারটাতে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো, “খাচ্ছিস না কেন? খাওয়া শুরু কর।”

নলী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে করুণ গলায় বললো, “আর মাত্র দুইদিন আপা।”
—“কিসের দুইদিন?”
প্লাস্টিকের একটা বৈয়ম থেকে বিস্কুত নিয়ে কামড় বসালো অটবী। নলী আবারও বললো, “তারপর আর তোমাকে যখন তখন জড়িয়ে ধরতে পারবো না।”

বিস্কুটের অবশিষ্ট অংশটুকু গলায় আটকে আটকে নামলো যেন। খুব রয়েসয়ে। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো। নিশ্বাস থমকালো। অটবীর কি বুক চিঁড়ে কান্না আসছে? কারো কি বুক চিঁড়ে কান্না আসে কখনো? তাহলে তার এমন লাগছে কেন? জগ থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে গিললো অটবী। কৃত্রিম ধমকের সুরে বললো, “এসব কি কথা? এমন কথা তোদের মাথায় ঢুকিয়েছে কে?”

নলী, পৃথা কিছু বললো না। কাঁদলো মাত্র। তাদের মিষ্টি চেহারায় এই বিষাদ কান্না বেমানান। বিশ্রী রকমের নিষ্ঠুর। কিন্তু অটবী তাদের কাঁদতে মানা করলো না। জোরপূর্বক চুপচাপ বিস্কুট চিবুতে লাগলো। ততক্ষণে রেবা বেগম রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে এসেছেন। মেয়েদের এমন কান্না দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই ধমকে উঠলেন, “কিরে? তোরা এভাবে মরা কান্না কাঁদছিস কেন? অটবীর সুখ কি তোদের সহ্য হয় না? মেয়েটা কি সারাজীবন তোদের জন্য ঘরে বসে থাকবে?”

তিক করে মেজাজটা চড়ে উঠলো। চাপা রাগটা সীমা অতিক্রম করতেই না চাইতেও অনেকটা উঁচু গলায় বলে ফেললো অটবী, “আশ্চর্য! ওদের বকছো কেন?”

রেবা বেগম শক্ত চোখে তাকালেন। শাসনের সুরে বললেন, “তো বকবো না? বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে তুই একদম চুপচাপ হয়ে গেছিস। এখন আবার এদের কান্না! এই বিয়েতে তোদের এত সমস্যা কেন, বলতো? মুশফিক ছেলেটা কোন দিক দিয়ে খারাপ?”
—“কোনো দিক দিয়েও না। সে ভালো। কিন্তু আমি তার জন্য পার্ফেক্ট না। আমার এখন বিয়ে করারও ইচ্ছে নেই। তুমি জোর করছো, না খেয়ে থাকছো, কথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছো! এগুলা কি মানসিক অশান্তি না?”
—“আমি এসব তোর ভালোর জন্য করছি, অটবী।”

হাহ! ভালোর জন্য! মুখে একটা তাচ্ছিল্যের রেশ ফুঁটে উঠলো অটবীর। খাওয়ার ইচ্ছে পুরোপুরি মরে গেল। চেয়ার ছেড়ে ঘরে যেতে নিলেই রেবা বেগম আবার ডেকে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছিস অটবী? খেয়ে যা!”

অটবী শোনে নি। দাঁড়ায়নি। চোখের পলকে ঘরে চলে গেছে। রেবা বেগম তার ছোট মেয়ে দুটোর দিকে তাকালেন এবার। ওদের মুখশ্রীতেও স্পষ্ট অসন্তুষ্টি। অথচ মেয়েগুলো বুঝতে পারছে না কেন? মা কি কখনো সন্তানের খারাপ চায়? মেয়ের বয়স হয়েছে। আর কত নিজের প্রয়োজনে, নিজের স্বার্থে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখবেন? পাড়া প্রতিবেশীরাও কম কথা শোনাচ্ছে না। মুশফিক ছেলেটা ভালো। টাকাপয়সা মোটামোটি আছে। অটবী সুখে থাকবে। তাহলে কেন তিনি এই বিয়ে চাইবেন না?

রাত তখন বারোটা। নলী, পৃথা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে বহু আগে। অটবীর চোখে ঘুম নেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একাধারে দেখছে নিশ্চল, নিস্তব্ধ রাতটাকে। রাত যত বাড়ছে মনের শঙ্কা, ভয় ততই বেড়ে চলেছে তার। কাল বাদে পরশু বিয়ে। ছোটখাটো, ঘরোয়া অনুষ্ঠান। শুধুমাত্র পাত্রপক্ষদের কয়েকজন আত্মীয় আর রেবা বেগমের পরিচিত কিছু প্রতিবেশী থাকবেন। বিয়ে পরানোর পরপরই অটবীকে নিয়ে যাওয়া হবে অচেনা, অজানা জায়গায়।

মুশফিক দু’দিন আগে বিয়ের যাবতীয় গহনা, শাড়ি নিয়ে এসেছিল। আলমারিতে সেগুলো সে থেকেই পরে আছে। অটবী ছুঁয়ে দেখেনি। তার আগ্রহই জাগে নি কখনো। আজকাল সব আগ্রহ মিছে হয়ে যাচ্ছে। ধূলিসাৎ হয়ে কোথায় যে উড়ে যাচ্ছে! সরব, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলে গেল। রেবা বেগম এসেছেন। অটবী সেদিকে একবার তাকালো মাত্র। এর পরপরই নজর ফিরিয়ে নিলো।
রেবা বেগম কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “রাত ক’টা বাজে, অটবী? এখনো ঘুমাস নি কেন?”

অটবী উত্তর দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তিনি এবার গলার জোর আরেকটু বাড়ালেন, “কি বলেছি তোকে? ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন?”

বোধহয় কাজ হলো। অটবী চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। নলীর পাশে। টু শব্দটিও করলো না। রেবা বেগম এগিয়ে এসে মেয়ের মাথার কাছে বসলেন। আলতো হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন দু’চার মিনিট। সস্নেহে, অতি আদরে। তারপর শান্ত গলায় সুধালেন, “ঘুমিয়ে গেছিস, অটবী?”

অটবী এবারও জবাব দিলো না। রেবা বেগম একটা সুদীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “অটবী… তুই আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছিস। অনেক! তোর বাবা দেখলে হয়তো বলতো, ‘আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে!’ অবশ্য সে জীবিত থাকলে তোকে এতো কষ্টও করতে হতো না। শুন মা, আমি তোর ভালো চাই। তোকে প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতে দেখলে কষ্ট পাই। তুই যখন রাতে দেড়ি করে ফিরিস, ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যায়। আমি চাই না আমাদের জন্য তোর জীবনটা এমন পরিশ্রমে পরিশ্রমে শেষ হয়ে যাক। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর বাবা থাকলে হয়তো এতদিনে বিয়েটাও হয়ে যেত।”

একটু থেমে আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, “মুশফিক ছেলেটা ভালো। ব্যবহার সুন্দর। আশেপাশের মানুষ থেকেও খারাপ কিছু শুনিনি। সবচে’ বড় কথা, ছেলেটা তোকে নিয়ে অনেক ভাবে। নিজ থেকেই নলী আর পৃথার দায়িত্বও নিবে বলেছে। তুই তো এমন কিছুই চেয়েছিলি। তাহলে এই বিয়ে নিয়ে এত রাগ, নিষেধাজ্ঞা কেন? বিয়েটা খুশি মনে করে নে মা। তুই, আমি, আমরা সবাই ভালো থাকবো।”

অটবীর অনুভূত হলো, রেবা বেগম কাঁদছেন। লহমায় এ-ও বুঝতে পারলো, তার বন্ধ চোখ দিয়ে একটু একটু করে অশ্রু কণা বালিশ ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। শুধু কি বালিশ? স্রোতের মতো তার জীবনটাকেও উলটপালট করে দিয়েছে।

গুমোট পরিবেশে একরাশ আচ্ছন্নতা হয়ে বারি খাচ্ছে তরঙ্গের মতো ভেসে বেড়ানো গানগুলি। হিন্দি গান, বাংলা গান, কত যে গান! কিছু কিছু গান অটবী কস্মিনকালেও শোনেনি। তার শোনার, জানার ইচ্ছেও নেই। সে আপাতত একদৃষ্টে আয়নার প্রতিবিম্বটির দিকে তাকিয়ে আছে। হলুদ বর্ণ গায়ে লাল শাড়িটা মানিয়েছে খুব। মুশফিক কোত্থেকে যেন পার্লারের মেয়ে পাঠিয়েছে। সে অতশত সাজেনি। কিন্তু তাতেও দেখতে খারাপ লাগছে না। কৃত্রিম স্বর্ণের মতো চিকচিক গহনায় বরং অপ্সরীর সঙ্গে তুলনা করা যাবে। মাথায় বড়সড় আঁচলের ঘোমটা। তাকে কি আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে? অথচ সে চেয়েছিল তাকে যেন আজকে খুব বাজে লাগে। খুব!

তখন বাজে দুপুর দুটো। বিকেল তিনটে বা চারটের দিকে বিয়ে পরানো শুরু হবে। অটবী এখন থেকেই আশেপাশের মানুষের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পাচ্ছে। আহা! কি আনন্দ তাদের! কি উল্লাস! অটবী এত আনন্দিত হতে পারছে না কেন? তার ভেতরে তো কোনো আনন্দই কাজ করছে না।

—“আপু? তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
খানিকটা ভয় ভয় কণ্ঠ। অটবী পাশ ফিরে নলীর দিকে তাকালো। মেয়েটার কপাল অস্বাভাবিক ভাবে ঘেমে আছে। ক্ষীণ তোতলাচ্ছে, দ্বিধায় ভুগছে। অটবী ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে?”
—“তুমি ত্রিস্তান ভাইয়াকে ভালোবাসো, তাই না? ভাইয়াকে ভালোবাসলে এই বিয়ে করছো কেন?”

আচমকা এহেন কথায় হতবাক হলো অটবী। তৎক্ষণাৎ পুরো রুমে একবার করে চোখ বুলালো। নাহ্! আশেপাশে কেউ নেই।
—“তুই ইদানিং এমন অদ্ভুত কথা কোত্থেকে খুঁজে আনছিস, নলী? আমি তোর ত্রিস্তান ভাইকে কেন ভালোবাসতে যাবো?”
—“মিথ্যে বলছো কেন? আমি জানি তুমি ত্রিস্তান ভাইয়াকে ভালোবাসো। সেও তোমাকে ভালোবাসে।”
—“সে আমাকে ভালোবাসে না, নলী। আমিও বাসি না।”

নলীকে অধৈর্য দেখালো। মুখের রঙ পালটে, প্রচন্ড উৎকন্ঠা হয়ে বললো, “তুমি মায়ের মতো জেদ করছো আপা! এইসময় জেদ খাটে না। তোমার কাছে মাত্র আর কয়েক ঘণ্টা আছে। এখন যদি তুমি এমন বাচ্চাদের মতো করো, তাহলে কিভাবে কি হবে? বিষয়টা বুঝতে পারছো না কেন?”

অটবীর অনুভূতি শূণ্য চোখজোড়া শান্ত হয়ে গেল হঠাৎ, “তুই বড়দের মতো কথা বলছিস।”
—“কারণ তুমি বাচ্চাদের মতো করছো। ভালোবাসা ছাড়া কি জীবন চলে আপা? মুশফিক লোকটার সাথে কি ভালোবাসা ছাড়া সারাজীবন থাকতে পারবা? তোমার মনে তো শুধু ত্রিস্তান ভাইয়া।”
—“তুই এত কিছু জানিস কিভাবে?”
—“জানি এক ভাবে। তুমি দ্রুত সিধান্ত নাও। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।”

দু’হাতে দশটা, দশটা করে বিশটা কাঁচের চুড়ি অটবীর। লাল রঙের। একটু ধারালো। হাতে খোঁচা লাগছে। চুড়িগুলো কোনোমতে সামলে অটবী ধীর গলায় উত্তর দিলো, “এখন অনেক দেড়ি হয়ে গেছে, নলী। আমি চাইলেও কিছু হবে না।”
—“কে বলেছে হবে না? সরোজ ভাই পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মা, পৃথা, বাকি সবাই সামনের উঠোনে। কেউ কিচ্ছু জানবে না আপা। তুমি পালিয়ে যাও।”

অটবী তৎক্ষণাৎ তাকালো। চোখে বিস্ময় নিয়ে শুধালো, “সরোজ এলো কোত্থেকে? নলী! তুই বারণ করার পরও সরোজের সাথে কথা বলেছিস?”
এপর্যায়ে নিজের বোনের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো নলী। কিসব খেজুরে আলাপ লাগিয়ে দিয়েছে! ওইদিকে মায়ের আসতে দেড়ি নেই। এক্ষুণি এসে পরবেন।
চট করে অটবীর বাম হাত টেনে দাঁড় করালো নলী। টেনে নিয়ে পেছনের দরজার দিকে আগাতে নিলেই অটবী বাঁধা দিতে চাইলো, “আমি কোথাও যাবো না নলী। এটা হয় না। মা অনেক কষ্ট পাবে। তাছাড়া… ত্রিস্তান… সে আমাকে চায় না।”
বিরক্ত সূচক শব্দ করলো নলী,
—“কে বলছে চায় না? তোমারে এমন ওকালতি করতে কে বলছে? ত্রিস্তান ভাইয়া যে তোমার বিয়ের কথা শুনে ঘরবন্দি হয়ে আছে, সেকথা জানো?”

অটবী জানে না। জানতেও চায় না। এত কষ্ট করে নিজের মনকে বুঝিয়েছিল, নলী এসে এমন ঝড় তুলছে কেন? সে পরে নিজেকে সানলাবে কিভাবে?
—“নলী, হাত ছাড়! আমি কোথাও যাবো না। আর দু’ঘণ্টা পর বিয়ে। এখন… তুই হাত ছাড়!”

নলী ছাড়তে চাইলো না। কিন্তু অটবীর ধমকের পিঠে বেশি জোড় খাটাতেও পারলো না। মনে মনে ভীষণ কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করলো ওর। তার বোন এমন কেন? সবার সুখের হিসেব রাখতে গিয়ে নিজের সুখের হিসেবটা এমন গোলমেলে করে ফেলছে কেন?
নলী থেকে হাত ছাড়িয়ে অটবী সোজা নিজের রুমে চলে গেল। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো, তাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। আগেও বিষণ্ণ লাগছিল। কিন্তু এখন কেমন যেন না পাওয়া কষ্টে, আফসোসে মৃত মানুষের মতো লাগছে। মৃত মানুষ! অটবীর ভেতরটা হঠাৎ করেই চমকে উঠলো। আধভাঙ্গা ড্রেসিংটেবিলের ওপর তার ফোনটা রাখা। মেসেজ আসায় স্ক্রীন জ্বলজ্বল করছে। ওতে লেখা, “অটবী, তোমার বউ সাজের একটা ছবি দেবে? আমি আসলে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছি না। রাস্তায় এত জ্যাম!”

মেসেজটা মুশফিকের।

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here