—“খুকি, ভয় পাচ্ছো? এত রাতে বাহিরে কি? দেখি, এদিকে আসো।”
হঠাৎ ডাকে অটবী দাঁড়িয়ে গেল। কালো, লম্বা করে লোক। দেখতে অনেকটা ব’খাটে ধরণের। গলায় আর হাতে চ্যান, ব্রেসলেট ঝুলানো। বাইকে পা ছড়িয়ে বসে, সিগারেটের একেকটা সুখটান দিচ্ছে। আশেপাশে আরও তিনটা বাইক, পাঁচছয়জন ছেলেপেলে। অটবী মনে মনে ভয়ে সিটিয়ে গেল। বুকের কাছের ওড়না এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে যথেষ্ট ক’ঠি’ন গলায় বললো, “ঔষধ কিনতে বেরিয়েছি।”
—“কেমন ঔষধ খুকি? খারাপ ঔষধ?” বলেই লোকটা হো হো করে হেসে দিলো। বাকি ছেলেরাও তাই। শুধু দুইজন হাসছে না। একজনকে অটবী চেনে। সরোজ নাম। ভালো পরিবারের ছেলে। বয়সের ভুলে এদের সাথে মেলামেশা শুরু করে গোল্লায় চলে যাচ্ছে। অন্যজন এলাকায় নতুন এসেছে বোধহয়। আগে দু’একবার দেখেছে। অন্যান্য বখাটেদের মতো কখনো মেয়েদের বিরক্ত করে না। চুপচাপ বাইকে বসে সিগারেট খায়। এখনও তাই করছে। তবে পার্থক্য শুধু এটুকুই, তার শান্ত চোখজোড়া এমুহুর্তে ঘুরঘুর করে পর্যবেক্ষণ করছে অটবীকে।
অটবী লজ্জা, অস্বস্তি আর রাগে একাকার হয়ে বললো, “বাজে কথা বকবেন না, রহিম ভাই। মা অসুস্থ।”
—“তাই নাকি? কি হইছে চাচির?”
অটবী একটু নমনীয় হলো এবার। আস্তে করে বললো, “জানি নাহ্। সকাল থেকে বমি করছে। প্রেশার লো। একটু আগে মাথা ঘুরে পরে গেছে। বাসায় ঔষুধও নেই। বাধ্য হয়ে এখন বের হয়েছি। ফার্মেসীর দোকান খোলা পাচ্ছি না।”
কণ্ঠ বুঝি একটু কেঁপে কেঁপে উঠলো? মায়ের অবস্থা আসলেই ভালো না। ঘর থেকে বের হওয়ার আগেও দেখেছে, বিছানায় নিথর হয়ে পরেছিল। একূলে মা আর দুইবোন ছাড়া অটবীর কেউ নেই। মায়ের কিছু হয়ে গেলে সে কিভাবে থাকবে? আচমকা এলাকায় নতুন আসা ছেলেটা এগিয়ে আসলো অটবীর দিকে। ভয়ে অটবী দুকদম পেছালো। ছেলেটা বললো, “এত রাতে কোনো ফার্মেসী খোলা পাবে না। কি ঔষুধ আনতে হবে বলো, আমি নিয়ে আসছি।”
পাশ থেকে রহিম বললো, “ত্রিস্তান ভাই, আপনে কষ্ট করবেন ক্যান? অন্য কাউরে পাঠাই?”
ত্রিস্তান নামের ছেলেটা অটবীর দিকে চেয়ে থেকেই বললো, “সমস্যা নেই।”
অটবী প্রথমে এমন প্রস্তাবে রাজী হলো না। কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও নেই। ঔষধের টাকাও ছেলেটা নেয়নি। অটবী বাসায় আসতে আসতে একদফা ছেলেটার কথা ভাবলো। রহিমের দলের প্রায় ছেলেপেলেই চরম রকমের বেয়াদব। একটা তো ধ’ র্ষ’ণ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিল। তবে রহিম ভাই একটু ব্যতীক্রম আছেন। অল্পসল্প দয়ামায়া করতে মাঝে মাঝেই দেখা যায় তাকে। তাই বলে কি রহিম ভালো? মোটেও না। ওদের কেউই ভালো না। সরোজও খারাপ হয়ে গেছে। এই ত্রিস্তান ছেলেটাও হয়তো অনেক খারাপ। দেখে বোঝা যায় না শুধু। তাছাড়া ডাকাতরা আর কতই ভালো হবে? দিনে-দুপুরে পকেট মা’রা, মেয়েদের বিরক্ত করা, রাতে মানুষের বাসায় চুরি করা- এটাই তো এদের কাজ।
_____
‘অটবী’ নামটায় রাজকীয় একটা ভাব আছে। নামটা বাবা রেখেছিলেন। তার নামেই বাড়ির নাম রাখা হয়েছে, ‘অরবিন্দ অটবী’। যার অর্থ, পদ্মের অরণ্য। বাড়িটার নাম শুনে হয়তো মনে হচ্ছে, এ বোধহয় কোনো রাজপ্রাসাদ। সেই রাজপ্রাসাদের রাজকন্যা অটবী। কিন্তু মোটেও তা নয়। কল্পনা থেকে বাস্তব ভিন্ন হয়। এখানেও তাই। অটবীরা আদিকাল থেকেই নিম্নবিত্ত। নিম্নবিত্তেরও কয়েকটা ধাপ থাকে। অটবীরা মাঝারি ধাপের। আধভাঙ্গা বাড়ি, তিনটে খুপরির মতো ঘর, মোটামোটি রকমের উঠান আর উঠানে টিনের তৈরি ছোটখাটো রান্নাঘর। ঘরে তেমন আসবাবপত্রও নেই।
অটবী তাড়াতাড়ি করে মায়ের কাছে যেতেই দেখলো, রেবা বেগম বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। চোখ বন্ধ অথচ চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। মায়ের শিওরে বসে আছে অটবীর পনেরো বছরের দুইবোন। ওরা জমজ। অটবীকে দেখেই একসাথে দৌঁড়ে এসে বললো, “ওষুধ আনছো বুবু? মা অনেক কষ্ট পাইতেছে। তাড়াতাড়ি খাওয়াই দাও।”
অটবী ওদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “দুই ফাজিল এখনো ঘুমাস নাই কেন? রুমে যা। ঘুমা। মায়ের চিন্তা তোদের করতে হবে না।”
—“কিন্তু আমাদের তো ঘুম আসতাছে না বুবু। তুমি কি ওষুধ আনো নাই? মারে খাওয়াইতাছ না কেন?”
—“ঔষধ একজনকে আনতে পাঠিয়েছি। আসতে দেড়ি হবে। তোরা যা, ঘুমা। সকালে স্কুল আছে না?”
বোন দুটো বুঝলো। দৌড়ে পাশের রুমে চলে গেল। অটবী এবার আস্তে আস্তে মায়ের পায়ের কাছে বসলো। শুকিয়ে হাড্ডি গোনা যাবে, এমন অবস্থা হয়েছে রেবা বেগমের। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের পা দুটো টিপে দিতে দিতে লহু স্বরে বললো, “আর কিছুক্ষণ মা। একটু সহ্য করো।”
বলতে বলতে সে আবারও ভাবনায় পরে গেল। মস্তিষ্ক হঠাৎ বললো, এভাবে একটা ছেলেকে ঔষধ আনতে পাঠানো তার একদমই উচিত হয়নি। যতই বাসা চিনুক। বাসায় ঢোকার তো কখনো সাহস করেনি। কিন্তু এই মাঝরাতে ঔষধ দেওয়ার নাম করে যদি জোর করে ঘরে ঢুকতে চায়? খারাপ কিছু যদি করে তার সাথে? কে বাঁচাবে তখন? অটবী খুব ঘামলো। মাথার ওপরের ফ্যানটা আস্তে আস্তে চলছে। অন্যদিনের মতো গরমও নয় আজকে। কিন্তু এত হাঁসফাঁস লাগছে শরীরটা!
সরব, টিনের গেটে টোকা দেওয়ার শব্দ হলো। অটবী চমকালো। জেগে জেগে উঠলো নেতানো চিন্তা। গেট খোলার আগে পাশের রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলো। বোন দুটো ঘুমিয়ে আছে। রেবা বেগমও ব্যথা সহ্য করে একটু আগেই ঘুমিয়েছেন। বাড়িতে সে একলা সজাগ! এই ছোট্ট ভাবনাটা ভেবেও যেন অটবীর শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো। উহু! সে মোটেও এতটা দূর্বল নয়। এভাবে ভয় পেলে চলবে না। রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে হাত পেছনে রেখে বটিটা আড়াল করে দাঁড়ালো সে। ক্যাচক্যাচ শব্দে আধো গেট খুলে বললো, “কে?”
ওপাশ থেকে ত্রিস্তানের পুরুষালি মোটা গলা, “তোমার ঔষধ এনেছি।”
অটবী আরেকটু গেট খুললো। হাত বাড়িয়ে বললো, “দিন।”
ত্রিস্তান প্রথমেই দিলো না। কয়েক সেকেন্ড ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মুখটা অস্বাভাবিক স্থির, শান্ত। একটু গম্ভীরও বটে। চেহারা-সুরত খারাপ না। এক দেখায় প্রেমে পরার মতো। পরনের পোশাকও মোটামোটি সভ্য। এত ভালো ভালো ছেলেগুলো যে কেন চু’রিচা’মা’রির মতো বাজে কাজ করে, অটবী বুঝে পায় না।
ত্রিস্তান অটবীর হাতে ছোট্ট একটা ঠোঙ্গা ধরিয়ে নির্বিবাক স্বরে প্রশ্ন করলো, “বটিটা কি আমাকে মা’রার জন্য এনেছো?”
অটবী ভড়কালো খুব। নজর তুলে তাকালো। মোটেও ঠাট্টা করছে না লোকটা। মুখ দেখে অনতত তাই মনে হচ্ছে। সে উত্তর দিতে চাইলো না। এবং তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে রহিম সুদূর থেকে ত্রিস্তানকে ডেকে উঠলো, “ত্রিস্তান ভাই? দেড়ি হইতেছে।”
ত্রিস্তান চলে যাচ্ছিল। অটবীর হঠাৎই একটা প্রশ্ন মাথায় আসলো। জিজ্ঞেস না করে সে শান্তি পাবে না।
—“আপনি কি রহিম ভাইয়ের বড়?”
ত্রিস্তান পেছন ফিরে তাকালো। কপালে অল্প ভাঁজ।
—“কেন?”
—“রহিম ভাই তার দলের কাউকে ভাই বলে ডাকে না।”
—“হ্যাঁ, বড়।”
রহিমের থেকেও বয়সে বড়? রহিমের বয়স অনুমানিক ছাব্বিশ হবে। এলাকার চোরদলের সর্দার সে। সাথের ছেলেগুলোর বয়সও কম। আটারো, বিশ হয়তো। সেই রহিম থেকেও বড় লোকটা? কত হবে? ছাব্বিশ নাকি সাতাশ? কিংবা আটাশ? দেখে এত বড় মনে হয় না। তারচেয়েও বড় কথা, রা’জনৈ’তিক নেতা ছাড়া রহিম কাউকেই এত সম্মান দিয়ে কথা বলে না।
পরেরদিন দুইবোনকে বিদ্যালয়ে নেওয়ার পথে আবারও ত্রিস্তানদের সাথে দেখা হলো অটবীর। তাদের বাসা থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব কমপক্ষে পনেরো মিনিট। মাঝখানে একটা পাঁচ মিনিটের সরু জঙ্গল পরে। জঙ্গলের একদম শেষ মাথায় বসেছে তাদের ব’খাটেদের দল। ওদের মাঝে সরোজকে দেখেই অটবীর বোন নলী ক্ষীণ চেঁচিয়ে উঠলো, “বুবু! বুবু! দেখো, সরোজ ভাইয়া।”
অটবী সাথে সাথে সামনে তাকালো। রাস্তার একপাশে চাদর বিছিয়ে গোল হয়ে বসে আছে ওরা। মাঝখানে কি রেখে যেন হিসাব করছে। একটু এগিয়েই বুঝলো, ওগুলো মানিব্যাগ আর অনেকগুলো টাকার নোট। নিশ্চই চুরি করে এনেছে? ত্রিস্তান ওদের সাথে বসেনি। কিন্তু বাইকে হেলান দিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেটে টান দিতে দিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টাকাগুলোর দিকে।
অটবী নলীর হাসিমাখা মুখের পানে চেয়ে ধমকে উঠলো, “সরোজের সাথে তোর অত কি? আমি সেদিনও তোকে ওর সাথে কথা বলতে দেখেছি। মানা করেছি না ওর সাথে মিশতে?”
নলীর জমজ বোন পৃথা বললো, “ওকে আমিও মানা করছি বুবু। নলী শুনে না।”
নলী পৃথাকে চোখ রাঙ্গালো। নির্দোষ গলায় বললো, “পৃথা বেশি বেশি বলতাছে বুবু। আমি সরোজ ভাইয়ের সাথে এতও মিশি না। কিন্তু ভাইয়ের সাথে মিশলে কি হয়? ভাই তো অনেক ভালো।”
—“ভালো কি ভালো না সেটা আমি বুঝব। তুই আর ওর সাথে কথা বলবি না।”
বলে আবারও ত্রিস্তানের দিকে তাকালো অটবী। ত্রিস্তানের তীক্ষ্ণ চোখ এবার আর টাকার ওপর নেই, অটবীর ওপর।
________________
চলবে~
অটবী সুখ
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
সূচনা পর্ব