#Ragging_To_Loving__2
#পর্বঃ- ৩২
#রিধিরা_নূর
রিহান নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না। রিহানের মুখের উপর পুষ্পর হাত মাঝখানে ভ্যানিলা ক্রিমি কেক। মুখের উপর কেক থাকার ফলে চেনার উপায় নেই। পুষ্প হাত সরিয়ে তড়িঘড়ি পিছিয়ে এলো। কেক রিহানের মুখে আটকে আছে। আস্তে আস্তে পিছলে মুখ থেকে বুকে বেয়ে পকাৎ করে মেঝেতে পড়ল। লম্বা চওড়া তরুণ দাঁড়িয়ে আছে।
আলিফা — নূর ছেলে হয়ে গেল কি করে?
সিমা — চুপ কর।
রিহান আঙুল দিয়ে মুখের উপর থেকে ক্রিম মুছে চোখ বন্ধ করে আছে। আমরিন টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিল।
আমরিন — টিস্যু।
রিহানের হাতে টিস্যু ধরিয়ে দিল। মুখ মুছতেই সবার চোখ চড়কগাছ।
.
আফরান নূরকে সুইমিংপুলে ধাক্কা দিয়েছিল। আলো আসতেই দেখে নূর পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। নূরকে দেখে সবাই থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে নূরের ডুবুডুবু অবস্থা। সবাই চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আফরান তড়িঘড়ি পানিতে ঝাপ দেয়। নূরকে টেনে কাছে নিয়ে এলো। কারো স্পর্শ অনুভব করে নূর তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। ভয়ে পানিতে দম আটকে আসছিল৷ প্রায় কেঁদেই দিয়েছে। গুনগুন শব্দে আফরান বুঝতে পারল নূর ভয় পেয়েছে। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এতে নূর আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
আফরান — শশশ….কিছু হয়নি। নূর শান্ত হও। চোখ খুলে দেখ পানির গভীরতা কম। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ।
নূর — না..না… আমি ডুব..বে যাব। (কাঁপা গলায় বলে নড়েচড়ে আঁকড়ে ধরল)
আফরান — নূর। আমি আছি তো। আমি থাকতে কি তোমার কিছু হতে পারে? বিশ্বাস রাখ আমার উপর। তোমার কিছু হতে দিব না।
আফরানের কথায় নূর আশ্বাস পেল কিন্তু ভয় এখনো মনে গেঁথে আছে। আস্তে করে চোখ খুলে আগে পানি দেখল। আসলেই পানি কোমর অবধি। ভয়ের চোটে খেয়াল করেনি। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে চারপাশে চোখ বুলালো। ছেলেরা সবাই থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট আর গেঞ্জি পরিধান করে আছে। সামনে তাকিয়ে দেখে আফরানেরও একই অবস্থা। কান চেপে ধরে সজোরে চিৎকার করে উঠল। “আয়ায়ায়ায়ায়া”। নূরের চিৎকারে ওয়াসিমও প্যাএএএএএ করে লম্বা সুর টেনে ভেপু বাঁশি বাজালো। চিৎকারে পুরো ঘর কেঁপে উঠল। ছাদে পর্যন্ত নূরের উচ্চস্বর পৌঁছাল।
পুষ্প — নূর?
দৌড়ে গেল। তার পিছে পিছে বাকিরাও গেল। রিহান থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
রিহান — নূর? এখানে? এখন প্রশ্ন করার সময় নেই। গিয়ে দেখি।
সবাই গিয়ে সুইমিংপুলের কাছে উপস্থিত হলো। একে অপরকে দেখে সবাই অবাক। ছেলেদের চোখ ছানাবড়া হয়ে আছে। নিষ্পলক চোখে মেয়েদের মাথা থেকে পা অবধি দেখতে লাগলো। মেয়েদের চাইল্ডহুড থিম পার্টি করেছে। সবাই ছোটবেলার মতো জামা পরিধান করেছে।
আমরিন ফ্রক পরা, দুই কাঁধে বিনুনি ঝুলানো, সু পরা। আমরিন লজ্জায় লাল গোলাপি হয়ে মাথা নিচু করে আছে। আহিল হা হয়ে তাকিয়ে আছে।
সিমা জিন্স, গোলাপি টি-শার্ট পরল, উঁচু করে ঝুটি বাঁধা। ওয়াসিম চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।
আলিফা স্কুল ড্রেস পরল, উঁচু করে দু’টি ঝুটি বাঁধা, মুখে ললিপপ। না চাওয়া স্বত্তেও আরিফ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।
মেহের ফ্রক পরল, চুলে হেয়ারব্যান্ড দেওয়া। ইয়াশ ভ্রু কুচকে তাকাল। এটা কি সত্যি মেহের? অবাক হয়ে আছে।
রিহান — নূর? আফরান? তোরা সবাই এখানে? পুষ্প….
থমকে গেল। এতক্ষণ অন্ধকারে সে পুষ্পকে খেয়াল করেনি। এখন যেন মুখটা আপনা আপনি হা হয়ে গেল। পুষ্প ঢিলা শার্ট আর থ্রী-কোয়াটার স্কার্ট পরল। এলোমেলো চুল কোপা করা।
.
আফরান — চুউউপপপপ। (নূরের মুখ চেপে ধরে।) উফফ কানটা বোধহয় গেল। ঝিনঝিন করছে কানের ভেতর। গলা নাকি ফাঁটা বাঁশ? এতো জোরে চিল্লানোর মানে কি? (রেগে)
চোখ বন্ধ করে আঙুল আরিফদের দিকে তাক করল। সবাই তাদের দিকে তাকাল। ছেলেরা নিজের দিকে তাকাল পরক্ষণে একে অপরের দিকে তাকাল। মেয়েরা হা হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে আছে।
আফরানের হাত কাঁপছে। সামনে তাকিয়ে দেখে তার হাত নূরের কোমরে। বরঞ্চ নূর থরথর কাঁপছে। আফরান নূরকে নিয়ে পানি থেকে উঠে গেল। চশমা পানির মধ্যেই পড়ে গিয়েছে। পুষ্প নূরকে নিয়ে গেল। আফরান ভেজা জামা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওয়াসিম — আমাদের পুল পার্টি ভেস্তে গেল।
সিমা — তোমরা মানুষ নাকি গন্ডার। এই রাতের বেলায় পানির মধ্যে পার্টি করবে? চল ছাদে চল। ওখানেই নূরির বার্থডে সেলিব্রেট করব।
আরিফ — নূরের বার্থডে? (অবাক হয়ে)
আলিফা — হ্যাঁ! বাই দ্যা ওয়ে আপনারা এখানে কীসের পার্টি করছেন?
আরিফ — রিহানের বার্থডে পার্টি।
সবাই চমকে একে অপরের দিকে তাকাল। রিহান আর নূরের বার্থডে একদিনে? হাউ? কীভাবে?
আফরান — আজ নূরের বার্থডে? তুই না ওর বড়। (রিহানকে উদ্দেশ্য করে)
রিহান — হ্যাঁ! চার মিনিটের বড়। আমি আর নূর জমজ। (শান্তস্বরে)
সবাই হা হয়ে আছে। আফরানও এই বিষয়ে জানতো না।
আহিল — তুই তো আমাদের বললি না।
রিহান — এতে বলার কি আছে। তোরা তখন নূরের সম্পর্কে জানতিস না। তাই বলা প্রয়োজন ছিল না।
কেউ আর কথা বাড়ালো না। আমরিন আগ বাড়িয়ে বলল,
আমরিন — রাতে ভিজলে শরীর খারাপ করবে। সবাই যখন একসাথেই আছি তাহলে চলুন ছাদে। একসাথে তাদের বার্থডে সেলিব্রেট করি।
আহিল — হ্যাঁ! হ্যাঁ! অবশ্যই। তুমি যা বলবে তাই হবে।
নম্র চোখে তাকাতেই আমরিন মাথা নিচু করে ফেললো। আহিল “উফফ লজ্জাবতী” বলে আরিফের উপর ঢলে পড়তেই আরিফ সরে যায়। আহিল গিয়ে পড়ে সুইমিংপুলে। সবাই হাসতে লাগলো। আহিল,আফরান চেঞ্জ করে সবাই ছাদে গেল।
বেশ যাক ঝমকে চারপাশে সাজানো হয়েছে। সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ছিল সবার ছোট বেলার ছবি ঝুলানো। বিশেষ করে নূরের। স্কুলের ছবি। সব বান্ধবীদের একসাথে কাটানো মূহুর্তের, তাদের দুষ্টুমি, ভালবাসা অনেক কিছু। আফরান মুগ্ধ হয়ে দেখছে ছবিগুলো। সবকিছুর মাঝে যেন কিছু একটা কমতি আছে। কিন্তু কি? কিছু একটা মনে পড়তেই তড়িঘড়ি নিচে গেল।
কেউ আর চেঞ্জ করেনি। রিহানও ঘরের জামা পরিধান করা। পুল পার্টির আয়োজন করেছিল। সবই তো পানিতে ভেসে গেল।
আফরান আলমারি খুলে লকারে কিছু একটা খুঁজছে। অনেকগুলো কাগজ। দেখে মনে হচ্ছে বেশ পুরাতন। অবশেষে অনেক পুরনো ড্রয়িংবুক বের করল। পৃষ্ঠা উল্টে দেখছে। অবশেষে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। “প্রাইমারি স্কুলের অনুষ্ঠানের ছবি। পিচ্চি নূর লাল শাড়ী মোড়ানো দাঁড়িয়ে আছে। তার দুইপাশে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে রিহান এবং আফরান। তাদের অনুষ্ঠানের আগ মূহুর্তে আফরানের মা ছবিটি তুলেছিলেন।” বহু বছর ধরে যত্ন সহকারে সামলে রেখেছিল ছবিটি। কিন্তু পুরনো হওয়ায় কিছুটা দাগ হয়ে গিয়েছে। আফরান ছবিটির আরেক কপি ছবি ফোনে তুলে নিল। দাগকৃত ছবিটি নিয়ে ছাদে গেল।
ছেলেরা এক কোণায় বসে আছে। মেয়েরা কেক রেডি করছে। সকলের নজরের অগোচরে আফরান ছবিটি পিন দিয়ে আটকে দিল বাকি ছবির সঙ্গে। এখন মনে হচ্ছে ছোট বেলার স্মৃতি গুলো পরিপূর্ণ হয়েছে। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধকর হাসি দিল।
পুষ্প — হেয়ার কাম দ্যা বার্থডে গার্ল। (ঘোষণা দিয়ে)
সবার নজর প্রবেশদ্বারে। নূর জিন্সের জাম্পস্যুট পরল। ফুলহাতা গেঞ্জি দিয়ে। ভেজা চুল খোলা দিয়ে দুইপাশে ফুলের হেয়ারক্লিপ লাগালো। দেখতে একেবারে কিউট পিচ্চির মতো লাগছে। আফরান নূরকে দেখেই মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেল। চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গিয়েছে। সারারাত নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেও যেন চোখ ক্লান্ত হবে না। সব আয়োজন দেখে নূর নিষ্পলক মুগ্ধতা ভরা নয়নে সব দেখছে। ঠোঁটের কোণে মুগ্ধকর মিষ্টি হাসি। আফরানের চোখ আটকে গেল সেই হাসিতে। নূর ইতস্ততভাবে সবার দিকে তাকাল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে তা দেখে অস্বস্তি লাগছে।
মেহের — ওলে কিউট পিচ্চি। (গাল টেনে)
নূর — এই সর ফকিন্নি। তোর হাত ঠান্ডা।
মেহের ভ্যাবাচেকা খেল। কত সুন্দর তারিফ করল আর সে এভাবে অপমান করল।
মেহের — তোর তারিফ করার চেয়ে এক গ্লাস পানি খাওয়া অনেক ভালো। হুহ্!
পুষ্প ভ্রু কুচকে রিহানের দিকে তাকাল। রিহানের কাছে গিয়ে কাঁধে থাপড়ান দিয়ে ডাকল।
পুষ্প — এই যে শোন। পার্টির থিম জানো না? চাইল্ডহুড থিম পার্টি। ছোট বেলার স্মৃতি নিয়ে ড্রেসআপ করতে হবে। ভাইয়ারা মোটামুটি ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকগুলো বাচ্চার মাঝে বুইড়া বেটা।
নূর হাসলো। রিহান ভয়ে ঢোক গিলল। নূর হাসা মানে আতঙ্ক।
নূর — রিহানের ছোট বেলা? ওর ছোট বেলা গিয়েছে আমার হাতে মার খেয়ে। আর রইলো ছোট বেলার ড্রেসআপ। হাফ প্যান্ট পরতো, ঢিলা গেঞ্জি পরতো। আর নাক দিয়ে সর্দি বেরুতো। সারাক্ষণ ভ্যায়ায়া ভ্যায়ায়া করে কাঁদতো আর আফু……
রিহান দৌড়ে গিয়ে নূরের মুখ চেপে ধরল।
রিহান — বোন আমার। আজকের দিন তো মাফ কর। আজ আমার বার্থডে। আজকের দিনে আমার ইজ্জতের ফালুদা না করলেই পারতি।
সবাই হাসতে লাগলো। রিহানের সবচেয়ে বেশি লজ্জা লাগছে পুষ্পকে দেখে। না জানি তার মনে কেমন ধারণা জন্মাবে।
পুষ্প — আজ তোমার বার্থডে হয় কি করে?
আলিফা — নূর আর রিহান ভাইয়া জমজ।
পুষ্প — কিন্তু রিহান না সিনিয়র। আর নূর জুনিয়র।
রিহান — প্রাইমারি স্কুলে নূরের দুই বছর গ্যাপ যায়। তাই ও আমার দুই বছর জুনিয়র ক্লাসে।
পুষ্প — তাহলে তো ভালোই হয়েছে। নাহলে নূর আমাদের সিনিয়র আপু হতো। আর বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে পেতাম না।
পিছন থেকে নূরকে জড়িয়ে ধরল। নূর হাসলো। সিমা কেক আনলো। “21” সংখ্যার মোম লাগানো। সিমা আগুন দিতে নিলে আফরান বাঁধা দেয়।
আফরান — জন্মদিনে আলো নিভিয়ে জীবন অন্ধকার করতে নেই। নতুন বছরের শুরু হোক আলোকময়, অন্ধকার করে নয়।
সবাই সম্মতি দিল। ওয়াসিম সবার মাঝে এসে দাঁড়াল।
ওয়াসিম — আই হেভ এ গভীর কুয়েশ্চন। আগামী মাসের ১৪ তারিখ আফরানের বার্থডে। তখন আফরানের বয়স ২১ হবে। হোওও তার মানে নূর-রিহান আফরানের ১৭ দিনের বড়। (অবাক হয়ে)
মাঝে মাঝে আফরানরা অবাক হয় ওয়াসিমের চিন্তা শক্তি দেখে। যেটা কেউ ভাবনায়ও আনে না তার উপর ওয়াসিম যুক্তি দেখায়। এখনও সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নূর দাঁত কেলিয়ে হাসি দিল।
নূর — তার মানে আপনি আমার জুনিয়র। হেই ইউ রেস্পেক্ট মি। ওকে? আজ থেকে আপনি আমাকে আপনি করে ডাকবেন। আমাকে সম্মান দিবেন।
আফরান — শখ কত। ১৭ দিনে কিছু যায় আসে না। তাছাড়া শ্রেণিতে আমি তোমার সিনিয়র। সো ইউ রেস্পেক্ট মি। ওকে?
নূর — জানেন ১৭ দিনে কয় ঘন্টা হয়?
আফরান — না।
নূর — ওহ্। আমিও জানি না। দাঁড়ান ফোনের ক্যালকুলেট করে দেখি। হ্যাঁ! ৪০৮ ঘন্টা। ২৪,৪৮০ মিনিট। এত সময় বড় আমি আপনার।
রিহান — আর আমি যে তোর থেকে ৪ মিনিট বড়। ২৪০ সেকেন্ড। তুই আজ পর্যন্ত আমাকে সম্মান দিয়েছিস?
নূর রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। আফরান তাচ্ছিল্য হাসি দিল।
সিমা — কেক কাটবি? নাকি ঘুমিয়ে পড়ব। রাত ১টা বাজতে চলল। কত সব প্লানিং করছি। সব করতে করতে সকাল হয়ে যাবে।
আর কথা না বাড়িয়ে নূর-রিহান একত্রিত হয়ে কেক কাটলো। একে একে সবাইকে খাইয়ে দিল। আফরানের কাছে আসতেই কোন রকম ভঙ্গিমা প্রকাশ করল না বরং মুচকি হেসে কেক খাইয়ে দিল। দুজনের কেউ-ই নিজ স্থান থেকে নড়লো না। দুজনেই একে অপরকে কিছু বলতে চায় তবুও মুখ ফুটে বের হচ্ছে না। পরিশেষে দ্বিধা কাটিয়ে একসাথে বলল, “সরি!” একে অপরের দিকে তাকিয়ে “কেন?” কিছু বলার পূর্বেই রিহান ধলা পাকিয়ে কেক হাতে নিল।
রিহান — এসব বাদ। আগে বল আমার মুখে কেক কে মেরেছিল? (তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে)
মেয়েরা তড়িঘড়ি পুষ্পর দিকে আঙুল তাক করল। পুষ্প কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে তাকাল। রিহান ভেবে পাচ্ছে এই মূহুর্তে কি করা উচিৎ। প্রতিশোধ নিবে নাকি এই মিষ্টি চেহারায় মন হারাবে।
নূর — আগে বল আমাকে সুইমিংপুলে কে ধাক্কা মেরেছিল। (কোমরে হাত দিয়ে রেগে বলল)
ছেলেরা দ্রুত আফরানের দিকে আঙুল তাক করল। নূর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল। আফরান চোখ পিটপিট করে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। নিষ্পাপ চেহারা বানিয়ে মিষ্টি হাসি দিল। কিন্তু নূর তো নূর। এতো সহজে সে আফরানকে ছাড়ছে না। মুটো ভরতি কেক হাতে নিতেই আফরান ভৌ-দৌড় দিল। তার পিছে কেক নিয়ে নূরও দৌড় দিল। সুযোগ বুঝে পুষ্পও দৌড় দিল। রিহানও তার পিছে ছুটলো। মাঝখানে দর্শক হয়ে বিনোদন নিচ্ছে বাকিরা।
পুষ্প — ভাইয়ায়ায়া। আমাকে বাঁচাও। (দৌড়াতে দৌড়াতে)
আফরান — বোওওনননন। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আগে নিজের জান বাঁচায়।
রিহান ধলা পাকিয়ে কেক ছুড়ে মারল। উড়ন্ত কেক পকাৎ করে গিয়ে পড়ল নূরের মুখে।
রিহান — চাচা, আপন জান বাঁচা।
সবকিছু মূহুর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পুষ্প,আফরান থেমে গেল। সবাই রিহানকে সমবেদনা দিতে লাগলো। এই বুঝি রিহান শেষ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নূর কাঁদতে লাগলো। আচমকা সবাই চমকে উঠল। সবাই দৌড়ে নূরের কাছে এলো।
রিহান — নূর আই এম সরি। আমি খেয়াল করিনি। (মুখ থেকে কেক মুছে দিল)
নূর — আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। (ক্রন্দন স্বরে)
আলিফা — নূর শান্ত হও। কিছু হয়নি। আমি মুছে দিচ্ছি তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
নূর — আমার ভয় করছে। (কেঁদে একাকার)
ভয়ে পাশে থাকা ব্যক্তির স্পর্শ পেয়ে তাকে আঁকড়ে ধরল। আফরান হাতে স্পর্শ পেয়ে সে-ও আঁকড়ে ধরল। আচমকা তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। নূরের কান্নায় তারও ভয় হতে লাগলো। মুখ মুছে দেওয়ার পর নূর চোখ খুলল।
নূর — সবকিছু ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আমার ভীষণ ভয় করছে।
কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে আফরান হুট করে নূরকে কোলে তুলে নিল। নিজেকে শূন্যে অনুভব করে নূর আফরানের জামা খামচে ধরল। কান্নায় ফোঁপাতে লাগলো। নূরের ফোঁপানিতে আফরানের বুকের ধুকপুকানি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। আফরান নিচে নামতেই একে একে সবাই নামলো।
আফরান — পুষ্প কুসুম গরম পানি আর একটি পরিষ্কার কাপড় নিয়ে আয়।
দোতলায় একটি কক্ষে নিয়ে গেল।
পুষ্প — শোন সবাই একসাথে গিয়ে হৈচৈ করলে নূরের ভয় আরও বেড়ে যাবে। রাত অনেক হয়েছে সিমা তোরা ডান পাশের রুমে যা। আর আপনারা বাম পাশের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন।
রিহান — তোমার মাথা খারাপ? আমার জন্য আমার বোনটার এই অবস্থা আর তুমি বলছ বিশ্রাম নিতে।
আমরিন — ঠিকই তো। আমরা কোথাও যাচ্ছি না। প্রয়োজনে বাইরে অপেক্ষা করব। তুই যা পানি আর কাপড় নিয়ে আয়। আমরা আছি।
সকলে সম্মতি দিল। রিহান এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে ভেতরে গেল। চুপচাপ কোণে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প পানি আর কাপড় নিয়ে আফরানকে দিল। নূর আফরানের এক হাত ধরে আছে। আফরান ছাড়াতে নিলে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।
আফরান — আমি পাশেই আছি। হাত ধরে রাখলে কাজ করতে পারব না।
নূর ছেড়ে দিল। আফরান কাপড় পানিতে ভিজিয়ে আলতো করে নূরের চোখ পরিষ্কার করছে। পুষ্প রিহানের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
রিহান — এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আমি নূরের ক্ষতি করেছি। ছোট বেলায় ব্যাটমিন্টন খেলার সময় কর্ক গাছের ডালে আটকে গিয়েছিল। তখন ইটের টুকরো দিয়ে আমরা খেলি। হঠাৎ-ই টুকরোটা নূরের চোখে পড়ে। এর জন্য চোখে সমস্যা হয় এবং চশমা পরে। তখন নূর ভীষণ ভয় পেয়েছিল। আজও একইভাবে ভয় পেয়েছে। আমি সত্যি খেয়াল করিনি। তখনও না, এখনও না।
পুষ্প — (রিহানের কাঁধে হাত রাখল) দূর্ঘটনা ছিল। যে কারো হাতে হতে পারতো। নিজেকে দোষারোপ কর না। তুমি তো ইচ্ছে করে কর নি।
রিহান — কিন্তু হয়েছে তো আমারই জন্য।
আফরান — এবার চোখ খুলে দেখ।
নূর — এখন ঠিক আছে। তবে চোখ জ্বলছে।
আফরান — বিশ্রাম নাও। সকালের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা কর না। যদি কোন রকম অস্বস্তি লাগে তাহলে জানিও ডাক্তারের পরামর্শ নিব।
নূরকে শুয়ে দিয়ে চাদর টেনে দিল। চোখ ফুলে, মুখ লাল হয়ে আছে। ইশ কতই না মায়া হচ্ছে কীভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল। ভাবতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। বুকের বাপাশে হাত দিয়ে নূরের দিকে তাকাল। অস্থির মনটা মূহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে না নূরকে একা ছেড়ে যেতে। কিন্তু থেকে গেলেও বিষয়টা খারাপ দেখা যাচ্ছে।
আফরান — পুষ্প তুই নূরের সাথে থাক। এখানে আমার ড্রয়ারে ফার্স্টএইড বক্স আছে। যদি কিছু লাগে আমাকে বলিস। পাশের রুমেই আছি। (পকেট থেকে চাবি বের দিল।) আলমারিতে কম্বল আছে। পানিতে ভিজে একাকার হয়েছে। ঠান্ডা লাগতে পারে। বের করে নিস।
রিহান — আমি আছি এখানে। তুই যা।
আফরান — পুষ্প আছে তো। চল তুই। (বাইরে গেল) নূর এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমরাও বিশ্রাম নাও।
সিমা — ভাইয়া আমরাও নূরের সাথে থাকব। আমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে আমরা বাকিরা রাত জেগে থাকি। আমাদের জন্য কোন ব্যাপার না।
আফরান — বোঝার চেষ্টা কর। আমি জানি তোমরা নূরকে ভালবাস। কিন্তু এই মূহুর্তে তার মনে ভয় আছে। সবাই এক জোট হয়ে তার কাছে থাকলে সে ভাববে তার বড় কিছু সমস্যা হয়েছে। যার জন্য সবাই তার প্রতি বেশি কেয়ার করছে। এতে তার মনের ভয় আরও প্রখর হবে। আমি বলছি তো নূর ঠিক আছে।
আলিফা — নূর এখন দেখতে পাচ্ছে তো।
আফরান — হ্যাঁ! কেকের ক্রিমে ঘি দেওয়া থাকে যার কারণে ক্রিম লেপ্টে চোখের জলের সাথে ছড়িয়ে গিয়েছে। কুসুম পানিতে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সকালের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে।
রিহান — আমার জন্য হয়েছে সব।
আফরান — তোর জন্য কিছু হয়নি। এটি একটি দূর্ঘটনা ছিল। তবে হ্যাঁ! দূর্ঘটনা অসচেতনতার কারণেই হয়। মজার ছলে এমন কিছু করা উচিৎ নয় যা অন্যের ক্ষতি করবে। কেক নিয়ে মজা করতে গিয়ে খাবারও নষ্ট হলো, পরিস্থিতিও খারাপ হলো। মজা কর,কিন্তু কোন কিছুর ক্ষতি করে বা নষ্ট করে নয়।
আহিল — জ্ঞানী বাবা আফরান। আপনি মহান। তোর মধ্যে এতো জ্ঞান এলো কি করে।
আরিফ — সিরিয়াসলি! এমন গম্ভীর পরিস্থিতিতে তোর মজা পাচ্ছে?
আহিল — পরিস্থিতি গম্ভীর বলেই তো সবার মুড ভালো করার চেষ্টা করছিলাম। (বিমর্ষ হয়ে)
আফরান — বাবা আহিল। আপনার মধ্যে এতো চিন্তা আসে কি করে?
আহিল করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। সবাই মৃদু হাসলো। আহিলও হাসলো।
পুষ্প আলমারি খুলে কম্বল নেওয়ার সময় চোখ পড়ল লকারের উপর। চাবি ঝুলানো। খুলবে নাকি খুলবে না বিভ্রান্তিতে আছে। তার ভাই বিশ্বাস করে চাবি দিল তার ব্যক্তিগত জিনিস থাকতে পারে তাই দেখল না। কম্বল নিয়ে আলমারি আটকে দিল।
.
সকাল ৬টা বাজতে চলল। আচমকা নূরের ঘুম ভেঙে গেল। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে দেখে পুষ্প ঘুমে বিভোর। তাই নিজেও শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আসছে না। মাথাটাও ঝিম ধরে আছে। শুয়ে থাকলে মাথা আরও ভারি হয়ে আসছে। বাইরেও আঁধার কেটে এসেছে। উঠে আশেপাশে তাকিয়ে ব্যাগ খুঁজতে লাগলো। ব্যাগের মধ্যে ব্রাশ,টুথপেষ্ট এনেছিল। কিন্তু এই তো সেই রুম নয়। অন্য এক রুমে। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখে নতুন ব্রাশ। ব্রাশ করতে করতে গতরাতের কথা ভাবলো। সবাই বেশ চিন্তিত ছিল।
রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কিছুই চিনে না এখানের। সবাই ঘুমে বিভোর একা একা কি করবে? হাটতে হাটতে ছাদে গেল। গতরাতের সাজসজ্জা এখনো ঝুলছে। রাতের অন্ধকারে ছবিগুলো খুব একটা খেয়াল করেনি। শিশির ভেজা কুয়াশায় আছন্ন সকাল। হিমেল হাওয়ায় শরীরটা বারে বারে শিউরে উঠছে। কিন্তু এই শিহরণ বেশ ভালোই লাগছে। হেটে হেটে ছবিগুলো দেখতে লাগলো। স্মৃতি গুলো এখনো তরতাজা। মনে হচ্ছে কালই তো স্কুলে প্রথম পা রেখেছিল। কালই তো জীবনে মূল্যবান কিছু মানুষদের পেয়েছিল। স্মৃতি গুলো সত্যিই মধুর। সব ছবির মাঝে নজর পড়ল সেই ছবির উপর। মলিনতার মাঝেও চোখ জোড়া সেই ছবির উপর আটকে গিয়েছে। আবছা কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল চোখের সামনে। ছবিটি হাতে নিয়ে উল্টে দেখে কাঁচা হাতের লেখা #আনন্দিতা। নামটা একেবারে মনে গেঁথে গিয়েছে। হঠাৎ গুনগুন আওয়াজ কানে প্রতিধ্বনি হলো।
“আমার সকল অভিযোগে তুমি
তোমার মিষ্টি হাসিটা কি আমি?
আমার না বলা কথার ভাঁজে
তোমার গানের কত সুর ভাসে!
তোমায় নিয়ে আমার লেখা গানে
অযথা কত স্বপ্ন বোনা আছে!
আমার হাতের আঙুলের ভাঁজে
তোমাকে নিয়ে কত কাব্য রটে!
ভুলিনি তো আমি
তোমার মুখে হাসি (নূরের মুগ্ধকর হাসিটা ভেসে উঠল)
আমার গাওয়া গানে তোমাকে ভালোবাসি
আসো আবারও কাছে
হাতটা ধরে পাশে
তোমায় নিয়ে যাব আমার পৃথিবীতে
এই পৃথিবীতে……”
শুকনো পাতায় নূরের পা পড়তেই মচমচে আওয়াজ হলো। আফরান চুপ হয়ে তড়িঘড়ি পিছন ফিরে তাকাল। নূরকে দেখে বেশ অবাক হলো।
আফরান — তুমি? একটু আগেই তো দেখে এলাম ঘুমিয়ে ছিলে। উঠে এলে যে।
নূর — ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাই। মাথাটাও ঝিম ধরে আছে। তাই একটু বের হলাম। আপনি?
আফরান — ভোরে উঠার অভ্যাস আছে। তাছাড়া টেনশনে আমার ঘুম হয় না। আব…. তোমার এখন কি অবস্থা। চোখে কোন সমস্যা হচ্ছে?
নূর — না এখন ভালো আছে। চশমা ছাড়া মাথা ব্যাথা করছে। গতকাল চশমা পানিতে পড়ে গিয়েছিল।
আফরান — সরি। অন্ধকারে খেয়াল করিনি।
নূর — ইটস ওকে।
দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। সূর্যোদয়ের সোনালি রোদ উঁকি দিচ্ছে। কাঁচা হলদে আভা নূরের মুখে পড়ছে। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের বর্ণে সোনালি রোদে নূরের চেহারা স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছে। নূর চোখ বুজে মূহুর্তটা অনুভব করছে।
.
.
.
চলবে
বিঃদ্রঃ আগামী দুই দিন গল্প দিতে পারব না। তাই আজকের পর্ব বড় করে দিলাম। ?
তারপর বল কার কেমন লাগলো ?