#My_First_Crush
#পর্ব-২৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
রাইয়ান গোসল করছিল। এমন সময় পানি চলে যায়। রাইয়ান অবাক হয়। হুট করে কলটা বন্ধ হয়ে গেলো কেন? ফেনায় ভুত হয়ে মগে থাকা কিছু পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে নেয়। আরো দু একবার কল বন্ধ করে, চালু করেও দেখে আর পানি পড়ছে না। এমনিতেও বাথরুমটা অনেক ছোট। গোসল করতে গেলে পুরো বাথরুমটাই পানিতে ভিজে যায়। এত ছোট কোন বাথরুম হয়! রাইয়ানের অ্যাপার্টম্যান্টের বাথরুমটা তো এই বাসার রুমের চাইতেও মনে হয় বড়। রাইয়ান একবার নাক মুখ কুঁচকে আশেপাশে তাকিয়ে তারস্বরে ডাকতে লাগলো, ‘হৃদি, হৃদি!’
হৃদি ছোট্ট একটা ইলেকট্রিক কুকারে ডিম ভাজছিল। এমন সময় সচরাচর এই বাসায় গ্যাস থাকে না। রাইয়ানের ডাক কানে যেতেই সে রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘কি হয়েছে?’
‘বাথরুমে তো আর পানি পড়ছে না। এমন কেন?’
হৃদি এবার বাথরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। বাইরে থেকেই বলল,
‘মনে হয় পানি চলে গেছে।’
রাইয়ান অবাক স্বরে বলল,
‘চলে গেছে মানে? পানি আবার কিভাবে চলে যায়?’
এমন অদ্ভুত কথা যেন প্রথম শুনলো রাইয়ান। সে ভেবেছিল বোধহয় পানির কলে কোন সমস্যা হয়েছে। কিন্তু এটা কেমন উত্তর। হৃদি বলল,
‘চলে গেছে মানে চলে গেছে। এখানে সবসময় পানি থাকে না। এতক্ষণ যে ছিল এটাই অনাকাঙ্ক্ষিত।’
‘তাহলে এখন আমি কি করবো?’
‘বেরিয়ে আসো।’
রাইয়ান আঁতকে উঠে বলল, ‘আমার পুরো শরীরে সাবান মাখা। এই অবস্থায় কিভাবে বেরিয়ে আসবো?’
হৃদি ঠোঁট টিপে হেসে বিড়বিড় করে বলল,
‘ভালো হয়েছে। আরো থাকবে এখানে?’
রাইয়ান আবারো আকুতি করে বলল,
‘প্লিজ হৃদি কিছু একটা করো। আমাকে একটু পানি দাও।’
হৃদির একবার মনে হলো না দেই। রাইয়ান অতিষ্ট হয়ে তারপর যেন চলে যায়। তবে সেই ভাবনাকে কার্যকর করলো না। রাইয়ানকে ডেকে বলল,
‘পাশের লম্বা নীল ড্রামটায় দেখো পানি রাখা আছে।’
হৃদির কথামতো নীল ড্রামটার উপরের কালো ঢাকনাটা সরিয়ে সেটা ভর্তি পানি দেখতেই রাইয়ান যেন প্রাণ ফিরে পেলো। নয়তো যে আজ কি হতো!
গোসল সেরে কোমরে শুধু একটা টাওয়েল জড়িয়ে বেরিয়ে এলো রাইয়ান। হাত দিয়ে মাথার ভেজা চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হৃদির রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। খুন্তি হাতে আনমনে রাইয়ানের দিকে চোখ পড়তেই মুখ হা হয়ে গেলো হৃদির। রাইয়ান দু হাত দু দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শাহরুখ খান স্টাইলে হৃদিকে আহ্বান জানালো। হৃদির হাত থেকে খুন্তি পড়ে গেলো। সে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো রাইয়ানকে। রাইয়ানও প্রশান্তি মনে আঁকড়ে ধরলো হৃদিকে। একটা টি শার্ট উড়ে এসে একদম মুখ বরাবর পড়লো রাইয়ানের। মুখ থেকে টি শার্ট টা সরাতেই বিভ্রম ভাঙলো তার। শুনতে পেলো হৃদির বিরক্ত স্বর,
‘বাথরুম থেকেই একেবারে জামা পরে বেরোতে পারো না। জামা পড়তেও যেন কষ্ট। এই ছেলেরা হয়ই একটু বেশরম।’
রাইয়ানের মুখ থেকে একটা আফসোসের মতো শব্দ বেরোলো। কি ভেবেছিল আর কি হলো!
টি শার্ট আর ট্রাউজার্স পরে ঠিকঠাক হয়ে খেতে আসলো রাইয়ান। ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের গোলাকার টেবিল। চেয়ারগুলোও প্লাস্টিকের। একপাশে হৃদি বসা। অপরদিকে রাইয়ান। খাবারের মেন্যু খুবই সিম্পল। ডাল ভুনা, ডিম ভাজা, ছোট মাছের চচ্চড়ি। ডিমটা শুধু মাত্র ভেজেছে আর বাকিগুলো সকালেই রান্না করা। গরম করে এনেছে হৃদি। রাইয়ান নিজের প্লেটে ভাত নিতে নিতে বলল,
‘এখানে এর থেকে কি আর কোন ভালো বড় বাসা নেই?’
হৃদি সুর দিয়ে বলল, ‘আছে। কিন্তু সেই ভালো বড় বাসার ভাড়া গুলোও অনেক…. বড় ! আমার স্যালারিতে এই এলাকায় এমন বাসাটাই আমি এফোর্ড করতে পারি। এই ভাড়ায় আরো ভালো বাসা চাইলে আরো ভিতরে ঢুকতে হবে। কিন্তু আমার তো এনজিওর কাছাকাছি লোকেশনেরটাই নিতে হবে তাই না!’
‘তুমি স্যালারি কত পাও?’
হৃদি নিরস গলায় ভাত খেতে খেতে উত্তর দিল,
‘বিশ হাজার।’
রাইয়ান বলে উঠলো, ‘তাহলে তো অনেক।’
হৃদি খাওয়া বন্ধ করে রাইয়ানের দিকে তাকালো। প্রথম ধাক্কাতেই ডলার আর টাকার হিসেবটা ধরতে পারলো না রাইয়ান। তারপর কিছু খেয়াল হওয়ায় সে ফোন বের করে গুগলে কিছু একটা হিসেব করে চমকে উঠে হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এতো কম স্যালারি! দুইশো ডলারও হয় না পুরোপুরি। তোমাদের তো ল্যাবার ল’এর ভিত্তিতে অনশন করা উচিত। এত ঘন্টা খাটিয়ে মাত্র একতটুকু স্যালারি দেয়!’
হৃদির খানিক হাসি পেলো। হাসি চেপে হৃদি সিরিয়াস ভঙ্গি করেই বলল,
‘এখানে ঘন্টার হিসেব করে পেমেন্ট হয় না। আমেরিকার মতো সবদেশ তো আর এতো ধনী না। তুমি বুঝবে না। শুধু শুধু বাদ দাও।’
রাইয়ান তবুও মনে মনে কিছু একটা হিসেব করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো, তবুও এতো কম স্যালারি! সেই হিসেবে তো এই এরিয়ার মধ্যে সব থেকে ধনী ব্যক্তি দেখি আমিই হবো। এসব ভাবতে ভাবতেই রাইয়ানের নজর পড়লো একটা ছোট বাটির উপর। সেখানে লাল রঙের অদ্ভুত কিছু একটা পেস্ট এর মতো দেখতে পেলো সে। হৃদিকে জিজ্ঞেস করলো,
‘এটা কি?’
বাটিটাতে ছিল শুটকি ভর্তা। এই বাটি করে বাড়িওয়ালিকে একদিন পাস্তা রান্না করে দেওয়ায় ফেরত হিসেবে সে আজ শুটকি ভর্তা দিয়ে গেছে। রাইয়ান এতক্ষণে সেটা হাতে নিয়ে নিয়েছে। ভালো করে দেখে বলল,
‘বাহ! কালারটা সুন্দর তো!’
হৃদির দেখাদেখি সেও ভাতের সাথে মেখে নিলো ভর্তাটা। হৃদি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাইয়ান মুখে পুরে নিলো। ভাত চিবোতে চিবোতেই হঠাৎ থেমে গেলো রাইয়ানের মুখ। হৃদি চোখ সংকুচিত করে তাকিয়ে রইলো রাইয়ানের দিকে। রাইয়ান একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। এতো ঝাল! রাইয়ানের মনে হলো মুখের মধ্যে আগুন পুরে নিয়েছে। ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছিল হৃদি। আমেরিকার তুলনায় এখানে ঝাল একটু বেশি খাওয়া হয়। অনেক বছর বাংলাদেশে কাটিয়ে যাবার পরেও প্রথম প্রথম ফিরে এসে হৃদিরও এই ঝালে মানিয়ে নিতে একটু সময় লেগেছিল। সেদিকে রাইয়ান তো একদম নতুন ট্রাই করছে এখানকার খাবার। তার উপর শুঁটকি ভর্তায় তো একটু বেশিই ঝাল দেওয়া হয়। রাইয়ান মুখ ফোঁপাতে লাগলো। মাথার মধ্যে মনে হচ্ছে ঝিম ধরে আছে। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়েই ভরে ফেললো পেট। ঠোঁট, নাক, চোখ একদম লাল টকটকে হয়ে গেলো। খানিকবাদে একটু সুস্থির হলো রাইয়ান। সোফার উপর বসে বসে ফোনে গেমস খেলে সময় পার করার চেষ্টা করলো। এত্ত যে মশা! পারলে রাইয়ানকে কোলে করে নিয়ে যায়। হৃদি তখন রান্নাঘরে বাসন কোসন ধুয়ে রাখছিল। রাইয়ানের মাথার কাছে সোফার গায়ে বসেছিল মিঁয়ো। রাইয়ান সেদিকে আনমনে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মিঁয়োকে বলতে লাগলো, ‘তোমাকে কি মশা কামড়ায় না? কি জানি! আমার রক্তেই কোন ইয়াম্মি ইনগ্রেডিয়েন্টসের সন্ধান পেয়েছে।’
সেই সময় পাশে চোখ পড়তেই রাইয়ান দেখলো হৃদি রুমে যাচ্ছে। রাইয়ানও খুশি হয়ে রুমে যেতে নিলো। দরজা মুখেই আটকে ফেললো হৃদি। প্রশ্ন করলো,
‘কি?’
রাইয়ান হেসে বলল, ‘ভেতরে যাবো।’
‘কেন?’
‘ঘুমাবো না!’
হৃদি বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে রাইয়ানের দিকে ছুঁড়ে মারলো। বালিশ ক্যাচ করে হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রাইয়ান। হৃদি মুখে নকল হাসি টেনে বলল, ‘সরি! আমার কারো সাথে বেড শেয়ার করার অভ্যাস নেই।’
রাইয়ানের আর বুঝতে বাকি রইলো না হৃদি যে তাকে ঐ সোফায় ঘুমাতে বলছে। রাইয়ানের কথা কত সুন্দর রাইয়ানকেই ফিরিয়ে দিলো হৃদি। মিঁয়োকে কোলে নিয়ে মুখের উপর রুমের দরজা হৃদি বন্ধ করে দিলো। রাইয়ান সোফার কাছে গিয়ে মুখটা ভোঁতা করে বলল,
‘কিন্তু এখানে তো অনেক মশা হৃদি।’
রুম থেকে হৃদিও উত্তর দিলো, ‘কয়েল জালিয়ে নাও।’
রাইয়ান নিজের উপর নিজেই একটা বিরক্তসূচক শব্দ করলো। বিড়বিড় করে বলল,
‘এর থেকে তো দেখি বিড়াল হলেই ভালো হতো। সোফায় না ঘুমিয়ে কত সুন্দর কোলের মধ্যে ঘুমাতে পারতাম। এক্সট্রা আদরও জুটতো কপালে। আর এখন!’
তারপর আবার ভাবতে লাগলো আগের কথা। না জানি কিসের ভূত চেপেছিল মাথায়। বিয়ের রাতে হৃদিকে ঐ কথাটা না বললে আজ তাকেও আবার সেম কথা শুনতে হতো না। এখন নিজে যখন আগে এমন করেছে তখন তাকেও তো একটু ভোগ করতে হবে।
সোফায় বসে বসে চোখ ঘুরিয়ে রাইয়ান আবারো দেখতে লাগলো হৃদির বাসা। অনেক ছোট বাসা। একটা বাথরুম। একটা কিচেন। আর একটাই বেডরুম। আর মাঝখানে হলরুমের মতো একটু ফাঁকা জায়গা। কিন্তু সেটাও খুব বেশি বড় নয়। সেই তিন সিটের সোফাতেই বসে আছে রাইয়ান। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেকেন্ড হ্যান্ডের। দেয়ালের রংগুলো জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। ভালো বার্নিশ করাও নেই। এমন জায়গায় জীবনে কখনো থাকেনি রাইয়ান। আর এতো গরম! মনে হচ্ছে আর একটু থাকলেই গায়ে ফোসকা পড়ে যাবে। তার উপরে কোন এসিও নেই। এখানে তো আরও বেশি দরকার এসি। মাথার উপর বিশ্রী ঘটঘট শব্দ করে যেই ফ্যান ঘুরছে তার থেকে আদৌ কোন বাতাস বেরোচ্ছে কিনা রাইয়ানের সন্দেহ। রাইয়ানের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। এর তুলনায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টটা স্বর্গ বলে মনে হতো লাগলো তার।
রাইয়ান টি শার্টটা নাড়িয়ে এই হাস ফাঁস ভাবটা একটু কমাতে চাইলো। বালিশ ঠিকভাবে রেখে শুতে গিয়েই মনে হলো কয়েল জ্বালানো হয়নি। আবারো উঠে সামনের সেন্টার টেবিলের নিচের তাক থেকে কয়েল নিয়ে কিচেনে গেলো। দিয়াশলাইয়ের কাঠি ধরিয়ে কয়েল জ্বালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বারবারই কাঠি নিভে যাওয়ায় কয়েল জ্বালাতেই পারছিল না। একে একে অনেকগুলো কাঠি নষ্ট করে ফেললো। একসময় কয়েল জ্বালাতে সক্ষম হলো রাইয়ান। কিন্তু এই চক্করে হাতে একটু ছেঁকাও লাগিয়ে ফেললো। কয়েল জায়গামতো রেখে আবারো সোফায় শুয়ে পড়লো সে। তারপর আবার খেয়াল হলো লাইট বন্ধ করেনি। আবার উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করলো। পুনরায় সোফায় এসে শুয়ে চোখটা একটু বন্ধ করতেই চলে গেলো কারেন্ট। এই গরমে শেষ সম্বল ঘটঘটানি ফ্যানটাও বন্ধ হয়ে গেলো। গরম কাকে বলে এবার হাড়ে হাড়ে টের পেলো রাইয়ান। রাইয়ানের এবার বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদেই ফেলতে ইচ্ছে করলো। মুখে একটা ন্যাকানো সুর তুলে মাথার নিচ থেকে বালিশটা নিয়ে অতিষ্ট ভঙ্গিতে নিজের মুখ ঢাকলো রাইয়ান।
___________________________________________________
(হৃদি)
রুমের দরজাটা মৃদু ফাঁক করে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। আমি খুব ভালোভাবেই জানি রাইয়ান কেমন মানুষ। সবকিছু একদম পারফেক্ট ভাবে না পেলে রাইয়ান স্বস্তি পায় না৷ নিজের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেও বিন্দুমাত্র একটু ধুলোও রাইয়ান সহ্য করতে পারতো না। জামা কাপড় হতে হবে ব্রান্ডেড। একদম পরিষ্কার। দু দিন পর পর বিছানার বেডশিট পাল্টানো চাই তার। যেখানের জিনিস সেখানে না থাকলে তার নাক কুঁচকে যেতো। রাইয়ানকে ভালো লাগানোর জন্যই আমি দিনভর এসব নিয়ে পরে থাকতাম। ঠিক রাখতাম সবকিছু। সেই রাইয়ান যে এমন জায়গায় থাকতে পারবে না তা খুব ভালোভাবেই জানি আমি। এতদিন বাংলাদেশের ফাইভ স্টার হোটেলে কাটিয়ে রাইয়ান আর এগুলো ধারণা করতে পেরেছে কই! সবাই তো আর সব পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না। আমি যতদূর জানি, এদিক থেকে রাইয়ানের মধ্যে মানিয়ে নেওয়া স্বভাব নেই বললেই চলে। সেখানে জন্মের পর থেকেই এতো ভালো পরিবেশে থেকে এখানে নিজেকে মানানো রাইয়ানের মতো মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আমি একদম নিশ্চিত, কাল সকাল হতেই রাইয়ান এখান থেকে কেটে পড়বে।
চলবে,