#In_The_Depths_Of_Love
#Mizuki_Aura
#Part_22
খাবার টেবিলে, সকলেই নাস্তা করছে। রেজোয়ান সাহেব বললেন “কীরে আবির? গত রাতে কখন ফিরেছিস?”
“এইতো , ২ টায়”
“কেনো এতো দেরি হলো কেনো?”
ফুপি বলে উঠলেন।
রুটির টুকরো মুখে পুরে আবির বললো “কিছু কাজ ছিল”
“তা শুনি কি এমন কাজ? যে নিজের জন্মদিন ভুলে গেলি তুই ভাইয়া” সুমি বললো।
আবিরের মুখের খাবার আটকে গেলো। গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে সুমির দিকে তাকালো “জন্মদিন!”
রাই রান্নাঘর থেকে ভাজির বাটি এনে টেবিলে রাখলো। সুমি ঢং করে বললো “লাগে জানেই না…..”
আবির অবুঝের মতো বাবার দিকে তাকালো …… ছেলের ওমন চাহনিতে রেজোয়ান সাহেব নীজেও বিরক্ত
“এমন করে তাকাচ্ছিস যেনো জানিস না”
আবির ঘুরে ফুপির দিকে তাকালো। উনি বললেন “আরে ভাই, ওর কি মনে ছিল নাকি? ভুলে গিয়েছিল বলেই তো সারপ্রাইজ দিতে পারলাম”
সুমি মুখ বাঁকিয়ে বললো “দিতে আর পারলাম কই? উনি তো রাত ২ টায় আসছে। নির্ঘাত ভাবি ও ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আমরা কত প্ল্যান করে এতো আরেঞ্জমেন্ট করলাম, দাম রইলো না ”
ওর কথায় আবির অবাক। ওর জন্মদিন ছিল কাল! ছাদে যা সাজানো ছিল সব ওর জন্য! চোখদুটো রাই এর দিকে চলে গেলো। রাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। চোখে আফসোসের ছাপ রাই এর। কি লাভ হল এতসব করে? দিনশেষে আবারো একটা ভুলবোঝাবুঝি।
রেজোয়ান সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন “তো কি প্ল্যান করলি তোরা?”
কেউই বুঝলো না আসলে উনি কি বলতে চাচ্ছেন? “ভাই কি বলছো ঠিক করে বলো….”
“আবির , রাই, তোরা যে যাবি একটা জায়গায় তো কিছু কি ঠিকঠাক করেছিস? কিছু ভেবেছিস?”
“যাবো মানে!” রাই জিজ্ঞেস করলো।
“আরে, ভুলে গেলে ভাবি?”
রেজোয়ান সাহেব সুমি কে থামিয়ে বললো “আরে, ঐখানে যাবেনা?”
রাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ঐখানে কোন খানে?
আবির রেজোয়ান সাহেব এর দিকে তাকালো । উনি এবার একটু স্পষ্টভাষী হতে চাইলেন “মানে তোমাদের হানিমুনে। ”
সভা শুদ্ধ থুক্কু টেবিল শুদ্ধ মানুষজন সব হা করে তাকালো। রেজোয়ান সাহেব তো।।।।।।।।
আবিরের মা অনেক চিমটি করতে বললেন “তোমার কথা বার্তার ধরন কী হ্যাঁ বলো তো ……”
“আব আ বা আরে,,,,, আরে এটাই তো বাস্তবতা (আরেকটা রুটি নিয়ে) এখন হানিমুনে যাবে তো এতে এতো ঢং করার কী আছে? সোজা সাপটা কথা। কোথায় যাবি তোরা ডিসাইড কর। তারপর গিয়ে ঘুরে আয় আর বাড়িটা একটু ফাঁকা কর”
আবির খেতে খেতে বললো “কেনো ফুটবল খেলতে নাকি? ”
রেজোয়ান সাহেব বাকা চোখে তাকালেন “না একটা ডুপ্লিকেট নাসা বানাবো, ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তোলাও আবশ্যক”
আবির মাথা নাড়লো”ওহ”
“আরে কি ওহ?” চেচিয়ে উঠলেন রেজোয়ান সাহেব ” যেটা বলছিলাম সেটা কর।।।।। রাই মা….”
।রাই কিছু না শুনেই মাথা নিচু করে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। রেজোয়ান সাহেব মুখ ঘুরলেন “বাবা আবির…..” আবির পানির গ্লাস রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের দিকে চলে গেলো।
রেজোয়ান সাহেব হতাশ কণ্ঠে বললেন “মা সুমি…..”
সুমি চোখ মুখ কুচকে বললো “মামু, আমার কিন্তু বিয়ে হয় নি”
রেজোয়ান সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন তার স্ত্রী তার দিকে রেগে তাকিয়ে আছে। বেচারা । দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলেন।
বিকেলে নিশান বাড়ি ফিরলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেমন নেশাখোর ধরনের অবস্হা। ঢুলতে ঢুলতে ঘরে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল। ড্রইং রুমে সুমি আর রাইছিল। সুমি বললো “কি হচ্ছে এই ছেলের কে জানে। আগে তো এমন ছিল না। সবসময় ই ফুরফুরে মেজাজের থাকতো।এখন দেখো। মনে হচ্ছে নেশা করে আসছে”
রাই সবজি কাটছিল “সবসময় বাহির থেকে দেখেই সব বোঝা যায়না…….”
সুমি ঘুরে তাকালো “সেটা ঠিক। তবে। …. কিছু সময় অবস্থা দেখে আন্দাজ করা সম্ভব,”
রাই সুমির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো।
“রাই…..” ভেতর থেকে আবিরের গলা ভেসে এলো।
“যাও যাও, জনাব ডাকছেন” বলে পিনচ করলো সুমি। রাই হেসে মাথা দুলাতে দুলাতে চলে গেলো।
ঘরে যেতেই আবির রাই এর ফোন রাই এর সামনে ধরলো।”কেউ কল দিচ্ছে ”
রাই ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরলো “হ্যালো কে?”
“কীরে রাই , কি খবর তোর? সেইদিন যে রাইতে আসবি বললি এর তো খবর নেই…. ঠিক আছিস তো?”
“আরে নাফিস……” রাই এর চোখ গেলো আবিরের দিকে ,,,, খুব মনোযোগ সহকারে আবির তাকিয়ে আছে। রাই দমে গেল। একটু গেম খেলাই যায় “হ্যাঁ নাফিস…. বল কি খবর?”
“দোস্ত আমি মেয়ে,,,,,” বলে নাফিসা একটু ?এমন করলো।
রাই হেসে হেসে বললো “হ্যাঁ ওই একই” বলে হাটতে লাগলো ।
“ওই মাইয়া একই মানে? কি কস একই? তুই…..”
“আচ্ছা আচ্ছা দোস্ত বাদ দে….. সরি তোকে বিয়েতে ইনভাইট করতে পারিনি” বলে রাই খাটের পাশে গেলো।
“বিয়ে?!!!!!! ” নাফিসা অবাক।
“হ্যাঁ….” ? “বিয়ে” বললো রাই।
আবিরের কেনো যেনো মনে হলো কথাটায় হতাশার চরম সীমানা পার করা হয়েছে।
“কবে করলি?”
“এইতো ….. বুঝে নে,,,,, আমি বুঝি দোস্ত বুঝি তোকে ইনভাইট করিনি। আসলে কাউকেই করিনি। ইন ফ্যাক্ট আমাকে ইনভাইট (আবিরের দিকে তাকিয়ে) করতে দেওয়া হয়নি ”
“ওহ আচ্ছা থাক। তো ভাইয়া কেমন রে?”
রাই চেঁচিয়ে উঠলো “আরে ঐটাই তো কপাল বইন ঐটাই তো কপাল। আমিও বুঝিনা মানুষ এমন কেনো? এতো কিসের লুকোনো…..”
“দোস্ত আর ইউ ওকে?” নাফিসার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে কথাগুলো।
“হ্যাঁ….( ড্রামা করে) আই অ্যাম ওকে”
“তো এগুলো কি বলছিস?”
“আরে হ্যাঁ নাফিস আই নো….. কিন্তু কী করবো বল, যার কপাল খারাপ তার সবই খারাপ……”
“দোস্ত তোর মাথা নস্ট হয়ে গেছে, রিলাক্স, আমরা পরে কথা বলি” বলে নাফিসা ফোন কেটে দিল।
রাই তো ??” হ্যালো… নাফিস…. কীরে রাগ করলি নাকি? আচ্ছা শোন আমরা একদিন মিট করবো বুঝলি? হ্যাঁ রাখি আজ”
রাই ও ফোনটা রেখে আফসোসের সুর ধরলো “হায়রে বন্ধু আমার…..”?
এতক্ষণ আবির সবই শুনছিল , তবে এবারে ঘুরে তাকালো। রাই ফোনটা নিয়েই বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সাথে সাথে আবির ওকে টেনে শক্ত করে ধরলো। আর ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো
“আরে কি করছেন কি? ফোন দেন”
কিন্তু রাই ধরতেও পারলো না। আবির ওই নম্বর টাতেই ফোন করলো। আর লাউড স্পিকারে রাখলো , “ফোনটা দিন বলছি। আবির….”
তখনি ফোনটা নাফিসা ধরে উঠলো “কীরে তোর মাথা কি পুরাই শেষ? বললাম না পরে কথা হবে। যা রেস্ট নে”
রাই থ মেরে গেলো। আবির চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো। আর কলটা কেটে ফোনটা খাটে ফেলে দিল।
রাই চোখ টিপটিপ করে আমতা আমতা করে বলল “আ ,হ্যা তো? ঐটা , ঐটা নাফিসের বোন ছিল”
আবির এক ভ্রু উঁচু করলো। অর্থাৎ রেয়ালি?
রাই মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
“তো চলো তোমাকে তোমার বন্ধুর কাছে দিয়ে আসি, হায়রে বন্ধু তোমার…..”
আবিরের খোটায় যদিও রাই এর গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করছে ও।
“ছাড়ুন”
আবির বললো “ধরে কোথায় রাখলাম?”
রাই তাকিয়ে দেখে আবির অনেক আগেই ওকে ছেড়ে দিয়েছে শুধু সাথে দাড়িয়েই আছে। রাই দ্রুত দূরে সরে সোজা ঘরের বাইরে চলে গেলো।
“সব বিপদ সব আমার ঘাড়েই ধুর ভাললাগেনা” নিজেকেই বকতে বকতে রাই বাইরে চলে গেলো।
পরদিন একই অবস্থা। বাড়ির সবাই উঠে পড়ে লেগেছে রাই আর আবিরের হানিমুন যাওয়া নিয়ে। যেনো মধুচন্দ্রিমা ওদের না ওনাদের। আবির বরাবরের মতই ইগনোর করে গেলো। অবশ্য আবিরের মায়ের তাতে মাথা ব্যথা নেই। বৌমাকে একপ্রকার কিঞ্চিৎ মেনেই নিয়েছেন বলা চলে। রাই নিজেও তেমন সাড়া শব্দ দিচ্ছেনা।
রাই হেঁটে মাত্রই নিশানের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তখনি হাতে হ্যাঁচকা টানে রাই ভেতরে চলে গেল।
তাকিয়ে দেখে নিশান দরজা লাগিয়ে ওর দিকে ঘুরে দাড়ালো।
“কি অসভ্যতা এসব নিশান?”
রাই এগোতে গেলেই নিশান উল্টো পথ আটকে দাড়ালো “রাই দাড়াও…..”
“আর কি বলার আছে তোমার?”
“রাই শোনো , তুমি তো জানোই আমি তোমাকে….”
রাই হাত উচিয়ে ওকে থামিয়ে দিল “তোমার এইসব কথা শুনতে আমি আসিনি…..”
নিশান ওকে ইগনোর করে বললো “দেখো রাই , আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসি…..”
“নিশান…..”
“রাই…. দেখো আমি তো তোমাকে সব সত্যিই বলেছিলাম। তাহলে এখনও কেনো তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? রাই….”
“নিশান চুপ করো …”
“রাই দেখো,,,, তুমি চাইলে আমি এখনও তোমাকে মেনে নিবো…. জাস্ট একবার……”
“চুপ করো (ধমক দিয়ে বললো রাই) লজ্জা করেনা এসব বলতে? আর কী বললে? মেনে নিবে? কেনো ভিক্ষা দিচ্ছ? আমাকে দানবাক্স মনে হচ্ছে? কি ?”
নিশান এগিয়ে গেলো “রাই আমি ওভাবে বলিনি…. শোনো”
“চুপ করো। কি মনে হয় তোমার? আমি কি? হ্যাঁ ,,,,,,,
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো…. হ্যাঁ তুমি সত্যিটা বলেছো ভালো কথা। ধন্যবাদ। কিন্তু তার মানে এই না আমার বিবাহিত জীবন বিচ্ছেদ করে আমি তোমার সাথে চলে যাবো….. জন্ম , মৃত্যু, বিয়ে মানুষের একবারই হয়।
আর যে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে ছিল তাকেই আমি পেয়েছি। এতে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। কি মনে হয় তোমার? আমি এই বিয়ে এখনও মেনে নেই নী? প্লিজ গো অন। আমার স্বামী ভালো হোক , খারাপ হোক আমি তারই। মাঝে যেই আসুক। এই পবিত্র বন্ধন থেকে এট লিস্ট আমি বের হচ্ছি না”
“রাই….. ভাই তো সব মিথ্যে…..”
“দেখো, কোনটা মিথ্যে কোনটা সত্যি আমি জানিনা। তবে এটুকু বোঝার সক্ষমতা আমার আছে বা আমি বুঝি অন্তত বিশ্বাসঘাতকতা আমার সাথে যায়না।তোমার থেকে ভালো এটা কেউ জানেনা….. সো সরি। দরজা থেকে সরে দাঁড়াও….”
বলে রাই নিশান কে সরিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো।
নিশান নিথর হয়ে তাকিয়ে রইল।
আজ শুক্রবার। পবিত্র জুম্মার নামাজের পর রেজোয়ান সাহেব আবির বাসায় এলো। মাত্রই সোফায় বসেছে , তখনি নিশান বাসায় ঢুকলো। কারো দিকে না তাকিয়েই নিজের ঘরে চলে গেল।
রেজোয়ান সাহেব নিজের ছোটো ছেলেকে নিয়ে প্রচন্ড চিন্তায় আছেন । কেননা ইদানিং ওর ব্যবহার আচার যে হারে পরিবর্তন হচ্ছে যে কেউই সন্দেহ করবে।
যাইহোক দুপুরে খাবার টেবিলে অবশ্য সবাই খুব হাসি মজা করলেও নিশান ছিলো খুবই শান্ত। কিছুক্ষন পরপর রাই এর দিকে তাকিয়েছে বটে। তবে সেই চাহনিতে কোনো খারাপ অনুভূতি ছিলনা। খাবার শেষে আবির একটু ঘরে গেলো। বাকিরা বাহিরেই ছিলো।
নিশান তখনি নিজের সাথে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বাইরে এলো। সবাই অবাক। ওর মা বললো “কীরে , তুই কোথাও যাচ্ছিস নাকি? ”
নিশান সবার সামনে দাড়ালো। পরনে টিশার্ট প্যান্ট আর একটা লম্বা ব্রাউন কোট। ব্যাগটা রেখে বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালো নিশান ।
“কীরে তোর কি ট্রিপ আছে নাকি? ”
ছেলে বাবার কথার তেমন প্রতিক্রিয়া করলো না। শুধু কোটের পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো। সবাই তাকিয়ে দেখে পাসপোর্ট।
ওর মা দাড়িয়ে গেলো “এই, এইটা কেনো ? কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
রাই সন্দিহান চোখে তাকিয়ে। নিশান ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল।
“বাবা আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি। ”
“মানে!” সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে। ফুপি উঠে দাড়ালো “কীরে কি বলছিস তুই এসব? বলা নেই কওয়া নেই। এগুলো কি?”
সুমির বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সুমির হাতটা কেমন কেনো কাপছে “তুমি,,,,,, তুমি কি মজা করছো নাকি?”
নিশান মাথা নাড়লো “আমার পাসপোর্টের নতুন ভিসা করে এনেছি। আজই ফ্লাইট। চিন্তা করো না, স্টুডেন্ট অত খারাপ আমি না। কাজ পেয়ে যাবো”
ওর মা রেগে গেলেন “নিশান এইসব মজা আমার একটু ও ভালো লাগছে না। এসব কি বলছিস? ”
“মা আমি সত্যিই বলছি”
“নিশান , ব্যাগ রেখে যাও ঘরে যাও। আর এই ব্যাপারে পরে কথা হবে ” রেজোয়ান সাহেবের কড়া গলা উপেক্ষা করেই নিশান বললো “বাবা , এমনিতেও তো দুই একমাস পরেই আমার যাওয়ার কথা ছিলই”
“হ্যাঁ কিন্তু আজকের কথা ছিল না এভাবে হুট করে …..” রেজোয়ান সাহেব বললেন।
রাই রীতিমত বাকরুদ্ধ। মাথা কাজ করছেনা। নিশান কি সত্যিই চলে যাচ্ছে? কিন্তু কেনো? মানে এইভাবে হটাৎ! তবে কি…… কারণটা রাই অনেকখানি আন্দাজ করতে পারলো।
” না , তোমার এসব কথা শুনছি না যাও ঘরে যাও” ওর মা বললো।
কিন্তু নিশানের ভাবমূর্তির পরিবর্তন নেই। নিশান দ্দৃঢ় কণ্ঠে বললো “দেখো একটু পরেই আমার ফ্লাইট। তাই আমাকে যেতেই হচ্ছে। শেষ বিদায়টা নাহয়……”
ওর মা ওকে ইচ্ছেমত চড় মারতে লাগলেন “কি বলছিস এসব? তোর মাথা ঠিকাছে? ”
নিশান হেসে মায়ের হাতদুটো আটকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো “মা, তোমার ঠিক এই মারটাই খুব মিস করবো। আর চিন্তা করোনা। আমি কি সবসময়ের জন্যই যাচ্ছি নাকি? ” বলে মাকে ছেড়ে ফুপির কাছে গেলো “ফুপি….”
উনি জড়িয়ে নিলেন “বাবা, এখনই এভাবে ? কেনো ? কোনো সমস্যায় পরেছিস?”
নিশান মাথা নাড়লো “উহু ”
সুমির কাছে গিয়ে মাথায় একটা গাটটা দিয়ে বললো “ভালো থাকিস”
সুমি স্তব্ধ হয়ে আছে। কেনো যেনো ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পাথরের মত জমে গেছে। ও কিচ্ছুটি বলতে পারলো না।
নিশান ঘুরে ব্যাগটা হতে নিলো। সবাই অনেক কিছুই বলেছে কিন্তু ও শুনলো না। ওর মা পুরো কান্নাই করে দিয়েছে।
রাই এর দিকে এখনও তাকায়নি নিশান। হটাৎ কি মনে করে ব্যাগটা নিচে রেখে ঘুরে দাড়ালো। উদ্দেশ্য? সোজা আবিরের ঘর।
আবির মাত্রই বের হবে তখনি নিশান ঘরে এলো। আবির দাড়িয়ে পড়লো। নিশান ঘরে ঢুকে দরজা টা একটু চাপিয়ে দিলো আর ভাই এর দিকে তাকালো “বাই বলবি না?”
আবির সন্দিহান চোখে তাকিয়ে “ঠিক কি কারণে?”
নিশান মুচকি হাসলো “চলে যাচ্ছি। ”
আবির অবাক হয়ে তাকালো ।
“অস্ট্রেলিয়া” বলে নিশান একটা শ্বাস টেনে বুকটা কে হালকা করে নিলো।
আবির তেমন কিছু ভাবলো না “কতদিনের ট্রিপ?”
“হয়তো আজীবন…..”
এইবারে নিশানের কোথায় আবির একটু গম্ভীর হলো। নিশান জানে ওর ভাই যেচে জিজ্ঞেস করবে না কেনো। ব্যাপার না।
“উহু, রেগে বা জেদ করে যাচ্ছিনা। কিন্তু, এইখানে থাকার মতো ও কারণ নেই। ”
আবির একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো।
“রাই কে তো নিয়েই নিলি। উহু উন ফ্যাক্ট ও তো এখন তোরই। আশা করি খুশি আছিস। থাকবি…….
তবে কি বলতো? তুই রাই কে কিন্তু আমার জন্যই পেয়েছিস হ্যা? (নিশান নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসার চেষ্টা করলো) আমি না থাকলে বোধহয় পেতি না। না না অহংকার করছি না। শুধু নিজের স্মৃতি ধরে রাখার একটা কারণ দিয়ে যাচ্ছি।
সত্যিই খুব বোকা ছিলাম। দিন থাকতে মূল্য দেইনি। তবে….( কষ্টে চোখের পানি আটকে) তুই এই ভুলটা করিস না। আর হ্যাঁ আমি…. আমি অনেক দূরে চলে যাওয়ার পরে নাহয় রাই কে আমার সত্যিটা বলে দিস… তোকে যেনো ও ভুল না বোঝে। কিন্তু (নিশানের কথা আটকে এলো) আমাকে ও …. যেনো….. ঘৃণা…. না করে”
আবির অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলো।
নিশান যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়িয়ে আবারো আবিরের দিকে তাকালো
“মাঝ খানটায় তুই এসেছিলি ভাই। আমি না। তবে ফিরিয়ে দিতেও বলবো না। রইলো নাহয় তোর হয়ে। যার শুরুটায় আমি ছিলাম। ”
নিশান বেরিয়ে গেলো। আবির স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।
চৌকাঠ পেরিয়ে ও যেনো পিছুটান টা ছাড়তে পারছেনা নিশান। মায়ের ডাক বারবার ওকে থামিয়ে দিচ্ছে।
সবাই এতবোঝালো তবুও কিছুই বুঝলো না নিশান। ওর কথা ওকে যেতেই হবে। রাই অবশ্য আটকাতে চাইছিল। কিন্তু বিবেকের সাথে আত্মসম্মানের লড়াইয়ে নিজের আত্মসম্মান কেই বেছে নিলো মনটা।
শেষবারের মতো নিশান রাই এর দিকে তাকালো। তবে এই চাহনির ভাষা এক নিশান বাদে কেউ জানবে না।
“ভালো থেকো……” শুধু এটুকুই বললো চোখ দুটো।
নিশান ঘুরে দাড়িয়ে সব পিছুটান উপেক্ষা করে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাটতে শুরু করলো। সে জানে পেছনে এতগুলো মানুষের মাঝে একজোড়া চোখ তার দিকেই তাকিয়ে। তবে ঘুরে দেখার সময়টা আর রইলো না।
সুমি নিজের ঘরে মাটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। শূন্য চোখে তাকিয়ে। কেনো ? সেটা নাহয় না বলাই থাক। কিছু কিছু কথা বলে বোঝানো দুঃসাধ্য। সেক্ষেত্রে অনুভূতিই শুধু দৃশ্যমান। যদিও তা সবার বোঝার উর্ধে।
আবির একবুক উত্তেজনা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে। কিসের উত্তেজনা? সে জানেনা।
তবে কি সত্যিই একটা ভুল করে বসেছে আবির? তৃতীয় ব্যক্তিটা সে ছিল নির্দ্বিধায় সে স্বীকার করে। কিন্তু বিষয়টা কি সত্যিই তিন তিনটে জীবনের মূল্য হয়ে দাড়ালো? কানে বাজলো নিশানের বলা শেষ কথাটা “তুই রাই কে কিন্তু আমার জন্যই পেয়েছিস”……….
কথাটা কি বিবেক বিবেচনায় সত্যিই ভুল !?
রাই নিশানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে। নিশান কি সত্যিই এতই খারাপ? নাকি শুধু একটা সহানুভূতি কাজ করছে ওর জন্য? দ্বিতীয় সুযোগটা যে সত্যিই দেওয়ার মত সুযোগ ছিল না। হায় ভাগ্য।
জনমানবহীন একটা ফাঁকা রাস্তায় নিশান দাড়িয়ে।
হেঁটে যাওয়ার শক্তিটুকুও নেই।
পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো, হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ফোন অন করতেই ওয়ালপেপার এ রাই এর হাসি মাখা মুখের একটা ছবি। নিশান ফোনটা হাতে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।
” আজকের রান্না টা সত্যিই ভালো ছিল। (ভেসে উঠলো দুপুরের দৃশ্য) লাল শাড়ীটা হয়ত অন্য কারো জন্যই পড়েছিলে। কিন্তু দেখে দারুণ লাগছিলো। ঠিক এই হাসিটাই দেখতে চেয়েছিলাম (ফোনের দিকে তাকিয়ে) হয়ত আমার সাথে।
হ্যাঁ আমি দেরি করেই বুঝেছি, কিন্তু চেয়েছিলাম তো……….. চলে যাচ্ছি। চিন্তা করো না দূরেই থাকবো। তবে তোমার স্মৃতিতে যদি কখনো চলে আসি তবে আমার দোষ দিও না। এতে আমার নিশ্চই কোনো হাত থাকবে না। ”
নিশান এর হাতদুটো মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আকাশের পানে চেয়ে কষ্ট ঝরিয়ে দিতে চিৎকার করলো নিশান “রাই…………..” চোখ দুটো অবাধে জল ছেড়ে দিল।
আজ বুকে চাপা হাজারটা কষ্ট শেষ করে দিতে চাচ্ছে নিশান। হ্যাঁ ও স্বার্থপর হয়েছে, খারাপ ও হয়েছে। কিন্তু পরিশেষে এটাও সত্য যে ও নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছে। হোক সেটা দেরিতেই বোঝা। কিন্তু ওর এক চিলতে পরিমাণ কষ্ট ও আমাদের বোঝার বাইরে।
ফোনটা পড়ে রইলো শুকনো মাটির উপরে। নিশান উঠে দাড়ালো মাথা নিচু করে। পা বাড়ালো নিজের গন্তব্যের দিকে। পেছনে রয়ে গেলো স্মৃতিটা পড়ে।
ঐ দেখ চলে যাচ্ছে নিশান। মৃতের মতো পা ফেলে ফেলে। পায়ের তলার শুকনো পাতাগুলো কি কিছু বলে? শূন্য জমিন, মেঘা আসমান…….
পেছনে ফেলে একঝাঁক,,,,,,
? পিছুটান।
চলবে…………..?????