#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৬
ইতু বসে আছে একটা দু,তলা ভবনে।ভবনটা স্কুল ঘরের মত।নিচের সেকশনে ছয়টা রুম একটা বাথরুম একটা গোসলখানা আর উপরের সেকশনেও সেম।ইতু চোখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সবটা।প্রতিটা ঘর খুব বেশি একটা বড় নয়।এক একটা ঘরে পাঁচটা সিঙ্গেল বেড।কারো কারো বেডে দুজনও শেয়ার করে থাকে। ছয়টা রুমের সামনেই একটা লম্বা করিডোর সিস্টেম বারান্দা! সেখানে মেয়েদের ভিজা কাপড়,পাপস,চাদর শুকা দেয়া।করিডোরে দাঁড়িয়েই ইতু দেখে সামনে একটা এক তলা বাড়ি।ওটায় সম্ভবত বাড়িওয়ালা থাকে।বাড়িওয়ালা মহিলা কিছুটা কটকটা স্বভাবের। ইতু একটু কথা বলেই বুঝতে পেরেছে।স্বল্প খরচে ইট সিমেন্ট আর সাদা রঙ ঘসে ভালোই পয়সা ইনকামের ব্যবস্থা।এই দু’তলা ভবনটার নাম রাদিয়া মহিলা হোস্টেল।এখানে সব চাকুরীজিবী মহিলারা থাকে।নীতু গত পাঁচদিন ধরে এখানেই আছে।এ বিষয়টা ইতু জানতো না।প্রথমে যখন শুনেছে তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে।নীতু আপার মত শান্ত শিষ্ট একটা মানুষ ঘর ছেড়ে চলে আসতে পারে এটা স্যালুট দেওয়ার মতই বিষয়। যেখানে আপা মুখ ফুটে দুটো কথা বলে না সেখানে আপা সবার বাঁধা অতিক্রম করে এই কষ্টকর হোস্টেল জীবনে দিনযাপন করছে এটা ভাবারই বিষয়!
ফর্সামত, শুকনা ছিপছিপে শরীরের একটি মেয়ে বলে ওঠে, “আপনি রুমে গিয়ে বসুন।আপনার বোন গোসলখানায় আছে।”
সময় বিকেল চারটা দশ।তারমানে গোসলের সিরিয়াল পেয়েছে এখন আপা।শুক্রবার বলেই সবাই আছে তাই ভীরও বেশি।ইতু রুমের ভিতরে যেয়ে বসে।রুমের অবস্থা জঘন্য। এখানে ওখানে কাপড় চোপড় ছড়ানো ছিটানো।রশিতে ব্রা, পেন্টি জামা, সালওয়ার সব টাঙানো। একটা মেয়ে ডিম আলু মেখে ভাত খাচ্ছে খাটে বসে।তরকারিতে যে হলুদ বেশি হয়েছে তা ইতু দূর থেকেই দেখে বুঝেছে। আর একটা খাটো মত মেয়ে অনবরত মোবাইলে কথা বলছে আর সিগারেট টানছে।ইতুর চোখ কপালে ওঠার দশা।মেয়েমানুষ ছেলেদের মত সিগারেট টানছে।আশ্চর্য! মেয়েটা কিসব কুৎসিত ভাষায় কাকে যেন গালি দিচ্ছে। ইতুর দমবন্ধ লাগছে।এখানে নীতু আপা কি করে থাকে?
নীতু রুমে এসে দেখে ইতু চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে। নীতু ইতুকে দেখে অবাক হলো না।খুবই স্বাভাবিক স্বরে বললো,” ইতু একটু অপেক্ষা কর।আমি তৈরি হয়ে নেই। তারপর একসাথে বের হবো।”
ইতু এবারো অবাক হলো নীতুর আচরণে।কেন আসলো? বা কেমন আছি কিছুই জিজ্ঞেস করলো না।নীতু একটা লাল সালওয়ার কামিজ পড়া।এটা দেখেও ইতু অবাক হলো।নীতু সবসময় হালকা রঙের পোশাক পড়ে! নীতু
দু’বেল্টের একটা ফ্লাট জুতো পড়লো।ভিজা চুল যত্ন নিয়ে আচঁড়ালো।চোখে কাজল দিলো।মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে হাতে পার্স নিয়ে ইতুকে চোখের ইশারা দিলো বের হওয়ার জন্য! একটু আগের মেয়েটা নীতুকে বের হতে দেখে প্রশ্ন করলে,”আপনি খাবেন না?”
“না।রাতের বেলা আমার জন্য রাঁধতে নিষেধ করো।”….. বলে নীতু বের হওয়ার সময় যে মেয়েটা সিগারেট টানছিল তার ঠোঁট থেকে সিগারেট টান দিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো।মেয়েটা রক্তচক্ষু চোখে নীতুর দিকে তাকিয়ে রইলো।সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে নীতু গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে গেলো।ইতু সবটাই অবাক চোখে দেখলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নীতু বললো,” দাদাভাইর আসার কথা ছিল। আসলো কিনা?”
ইতু ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বললো,”জায়েদ ভাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।আমার সাথেই সে এসেছে।”
নীতু আর কিছুই বললো না।জায়েদ ওদের দেখে এগিয়ে আসলো।নীতুকে লাল জামায় দেখে জায়েদের কপালও খানিকটা কুঞ্চিত হলো।নীতু জায়েদকে বললো,”দাদাভাই একটা খাবার হোটেলে চলুন তো খুব খিদে পেয়েছে।”
সামনেই খুব নিম্নমানের একটা হোটেল পেয়ে নীতু সেটাতেই ঢুকে পড়লো।জায়েদ আর ইতু হতভম্ব।জায়েদ ভালো কোন রেস্টুরেন্টে নিতে চাইলো।নীতু তা শুনলো না। এতটা গম্ভীর নীতু কখনোই ছিল না।জায়েদ আর ইতু কিছুই খেলো না।টিনের ছাপড়া দেয়া একটা ছোট খাটো হোটেল।দুপরের তরকারি সব শেষ। শুধু ভাত আছে।আর সকালের কিছু পেপে ভাজি। নীতু তা দিয়েই খুবই আয়েশ করে ভাত খেলো।পুরোটা সময় ইতু হতভম্ব চোখে তাকিয়ে নীতুকে দেখছিল।এই নীতুকে সে চিনতে পারছে না।ইতু হুট করেই অনুভব করলো তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে!
খাওয়া শেষে সেখানেই বসে রইলো ওরা।দুপুরের শেষ এখন দোকানে কোন কাষ্টমার নেই।দোকানিও এক কোণের চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে! নীতু শান্ত কন্ঠে বললো,”দাদাভাই, তোমাকে বলেছিলাম আমার চাকরির ব্যপারে খোঁজ নিতে।নিয়েছিলে? দুটো টিউশনি দিয়ে হবে না আমার।যে কোন রকমের একটা চাকরি আপাতত হলেই হয়।”
জায়েদ ধীর কন্ঠে বললো,”এই হাহাকারের বাজারে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন।হুট করে কোন কিছুই সম্ভব না।আর যাও ছোট মোট কাজ আছে তা তুই পারবি না।আমার এক বন্ধুকে বলেছিলম।সে আজ দুটো কাজের কথা বলেছে।তা তুই করতে পারবি না।ওসব ছেলেদের কাজ।”
নীতু আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, “কি রকম কাজ?তুমিই বলো।আমি করবো।”
“একটা প্রাণ কম্পানির পণ্য দোকানে দোকানে ঘুরে বিক্রি করা।আর একটা হলো হক টাওয়ারের যে বড় শপিং মলটা আছে ওটায় সেলসম্যানের কাজ!”
“আমার কোন আপত্তি নেই দাদাভাই।সেলসগার্ল হতে কোন সমস্যা নেই।তুমি কথা বলো।আমার বসে থাকার কোন স্কোপ নেই।এই কাজটা করলাম পাশাপাশি ভালো কোন জবও খুঁজলাম।”
জায়েদ অধৈর্যের সাথে বলে,”তুই ওসব পারবি না নীতু।সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ।শার্ট প্যান্ট পড়তে হবে।অনবরত দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে।জেদ করিস না।সব কাজ সবার জন্য নয়।”
নীতু শক্ত কন্ঠে বলে,”আমি পারবো দাদাভাই।আমি পারবো।ওসব তুমি ভেবো না।তুমি সব কিছুর ব্যবস্থা করো।”
ইতু এতক্ষণ সবটা শুনলেও এবার মুখ ফুটে বলে উঠলো,” এসব কেন করছো আপা?এত কষ্ট কেন? তুমি তো এতটা কঠোর ছিলে না?”
“এতটা কাল যা করেছি সবটা অন্যের কথা ভেবে করেছি। কে কি মনে করবে?কি রকম ভাবে চললে লোকে পছন্দ করবে?কিভাবে হাসলে লোকে মন্দ বলবে না?কোন কাজটা করলে লোকে নিন্দে বলবে না? অনেক তো হলো। আর কত?আজ থেকে যা করবো একমাত্র নিজের কথা ভেবে। ”
ইতু কেঁদে ফেললো, “আপা ঘরে ফিরে চলো। মা চিন্তা করছে।”
নীতু থমকে যাওয়া দৃষ্টিতে ইতুর দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর পার্স হাতে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার সময় বলে গেলো,” মা আমার জন্য চিন্তা করছে না।সে চিন্তা করছে সমাজের। বিয়ের যোগ্য মেয়ে কোথায় না কোথায় থাকছে লোকে জানলে আর কোন গতি হবে না তার কালো মেয়ের।আত্মীয় স্বজন ছি! ছি! করবে মা সেই চিন্তা করছে। আর কিচ্ছু না।মাকে বলে দিস,আর কারো ভয় নীতু করে না।টিপিকাল সমাজ আমার কালো রঙ ধুয়ে মুছে উঠিয়ে ফেলতে পারবে না।”
নীতুর হাত খপ করে ধরে বসলো ইতু।নীতু দাঁড়িয়ে পড়লো।” আপা আর পনেরো দিন পড়ে সেতুর বিয়ে ঠিক হয়েছে।তুমি কি যাবে না?”
“দোয়া রইলো নতুন দম্পতির জন্য। আমার কালো ছায়া ওদের উপর না পড়াই ভালো।আসি, ভালো থাকিস।”
ইতু অনুভব করলো শেষের কথাটা বলার সময় নীতু আপার কন্ঠটা সামন্য কেঁপে ওঠেছে।ইতু আহত দৃষ্টিতে নীতুর চলে যাওয়া দেখলো।এরপরই হু হু করে কেঁদে উঠলো।জায়েদ ইতুর মাথায় হাত রেখে বললো,”নীতুকে কিছুতে বাঁধা দিসনা ইতু।ওকে ওর মত চলতে দে।ওর ভিতরের আগুনটা যতদিন থাকবে ততদিন নীতু ভালো থাকবে।তোদের চোখের জলে সে আগুন নেভাতে যাস না।তাহলে ওকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না!”
**************
অভীক এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে।অফিস থেকে ছয় মাসের জন্য সে জার্মান যাচ্ছে। আর এ খবর শুনেই অভীকের মা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। গত তিনটা দিন চোখের জলে ভাসিয়েছে।এখন এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।নাকের জলে চোখের জলে অভীকের শার্ট একাকার!অভীক অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে,”আহা মা, কি করছো বলতো?এভাবে কান্নার কি আছে?কাজ শেষ হলে তো চলেই আসবো।আমি দ্রুত ফিরার ব্যবস্থা করবো।এখন কান্না থামাও।”
“কচু ফিরবি।এ চাকরি করার কোন দরকার নেই তোর।আমাদের যা আছে তাতেই হবে।ওত দূরে যাস না।আমার মন কেমন করছে।তোকে না দেখে এতদিন কি করে থাকবো?”….. বলে অভীকের মা আবার কাঁদতে শুরু করে।
অভীক হাত দিয়ে নিজের কপাল চাপড়ায়।অনিক আর রুমিও এসেছে ঢাকা।অভীক চলে গেলে তারা মাকে নিয়ে খুলনা ফিরবে।অনিকও এসে মাকে জরিয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়।রুমি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রেখেছে।এসব টিপিকাল কান্নাকাটি পর্ব তার ভালো লাগছে না।প্রচন্ড বিরক্ত সে!
অভীক মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,” শুনো মা এত চিন্তা কেন করছো?বড়ো আছে তো তোমার কাছে।আমিই খুব দ্রুতই চলে আসবো।আর এতদিনে আমার জন্য বউ খুঁজে রেখো তুমি।বুঝেছো?এসেই ব্যাচেলর লাইফের কোরবানি দিবো!এবার একটু হাসি মুখে বিদায় দাও তো।”
অভীকের মা অনেক কষ্টে নিজের কান্না থামান।অভীক মায়ের কপালে চুমু খায়।মাও ছেলের কপালে চুমু দিয়ে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে দেন।অভীক অনিককে মায়ের দিকে বারবার খেয়াল রাখতে বলে। এরপর রুমির উদ্দেশ্যে বলে,” আসি ভাবি।সবাই মিলেমিশে ভালো থেকো।”
রুমি বলে,”তুমিও। আর যা লিষ্ট দিয়েছি মনে করে এনো।”
“অবশ্যই।!” বলে অভীক বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে পড়ে।
অভীক চলে যেতেই অভীকের মা কান্নারত অবস্থায় মনে মনে নিজের পুত্রবধুকে গালাগালি দিতে থাকেন।রুমি জীবনও আসতো না তাকে নিতে।অভীক জার্মান যাচ্ছে শুনে এসেছে।মূলত তার কসমেটিক আর বিলাসী পন্যের লিষ্ট দিতে আসা।নতুবা কখনো তাকে নিতে আসতো না। বউ শাশুড়ী দুজনেই দুজনকে ভেংচি কেটে গাড়িতে উঠে বসলে।আর তা দেখে অনিক নিজের কপাল চাপড়ালো।এই ছয়টা মাস তার জীবন তেজপাতা! এটা নিশ্চিত!
************
রাত তিনটা। নীতু হোস্টেলের খোলা বারান্দায় বসে আছে।দৃষ্টি অন্ধকার আকাশের দিকে।রিশা বাদে পুরো হোস্টেল ঘুমিয়ে আছে।নীতু অন্ধকারেই বুঝতে পারে করিডোর বারান্দার শেষ মাথায় রিশা বসে আছে।সিগারেটের আগুনের অনবরত ওঠানামা দেখে বুঝতে পারলো।নীতু ভেবে পায় না কি এমন কষ্ট মেয়েটার?যে তাকে অনবরত সিগারেট খেতে হয়।ছোট ছোট চুল কেটে,জিন্স শার্ট পড়ে ঘুরে সারাদিন মেয়েটা।অনেকটা পাগল টাইপের!
হাতের মুঠোয় ফোনের ভাইব্রেটের শব্দে নীতুর ধ্যান ভাঙে। স্ক্রিনে তাজ লেখা নামটা জ্বলজ্বল করছে।এত রাতে কেন কল করছে জানতে মন চাইলো না নীতুর।শুধু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে।কল আসতেই রইলো।একটা, দুটো,তিনটা করতে করতে বাজতে থাকলো।নীতু কল ধরলো না। শুধু বিড়বিড় করে তাজ নামটা একবার উচ্চারণ করলো।
দূর থেকেই রিশা দেখতে পেলো ফোনের লাইটের আলোয় নীতু নামের মেয়েটার চোখে জল।নিঃশব্দ রোদন! রিশার মনে হলো,এই পৃথিবীতে কোন মেয়েই কষ্ট ছাড়া নেই।প্রতিটা মেয়েরই নিজস্ব দুঃখ, কষ্ট থাকে।ছোট বড় সকল কষ্ট মেয়েরা আজন্ম বুকে লালন করে গুপ্তধনের মত!
রিশা বিড়বিড় করে বলে,”বালের জীবন!খ্যাতা পুড়ি এই জীবনের!ওয়াক থু!”
চলবে,
রিশা আমার ফেবারিট চরিত্র। অবশ্য তার ভূমিকা এই গল্পে কম।