#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৭+১৮ |
খাওয়ার টেবিলে মনিকা কিছুক্ষণ পর পর এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন চোখ দিয়েই সে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে। রথিও পরেছে এক অস্বস্তিকর অবস্থায়! কিছু বলতেই পারছে আবার খাবারও গলা দিয়ে নামছে না। রথিকে খাবার নাড়তে দেখে মনিকা থমথমে গলায় বললো,
-‘খাচ্ছো না কেন, রথি?’
মায়ের কথায় নাফিসা খাওয়া ছেড়ে রথির দিকে তাকালো। নেওয়াজ এবং বাবা আগেই খেয়ে বেরিয়ে গেছে। এখন শুধু মেয়েরা মানে নাফিসা, মনিকা, রথি আর ভাবী নাস্তা করছে। নাফিসার থেকে রথির ঘটনা শুনলেও সে তেমন একটা ফ্রি-লি কথা বলতে পারছে না মনিকার সঙ্গে। হয়তো সময় লাগবে। তবে মনিকার কোনো সমস্যা নেই রথির এবাড়ি থাকা নিয়ে। ভাবী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
-‘নতুন পরিবেশ মা, তাই হয়তো কিছুটা বিধ্বস্ত।’
মনিকা আর কথা বাড়ায় না। দ্রুত খেয়ে চলে গেলো। উনি চলে যেতেই ভাবী রথির সঙ্গে কথা বলতে লাগলো,
-‘তোমার নামটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে, সাথে তুমিও মিষ্টি একটা মেয়ে।’
ভাবীর কথায় রথি ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করলো। মৃদু সুরে বললো,
-‘ধন্যবাদ ভাবী!’
-‘ভাবী বলবে না, আপু ডাকবে!’
-‘কেন?’
-‘তোমার মিষ্টি কন্ঠে আপু ডাকটা ভালো লাগে!’
রথি হাসলো এবং খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। অবশেষে খাওয়া শেষ করলো। অতঃপর তিনজন মিলে নাফিসার ঘরে গিয়ে আড্ডা দেয়। আড্ডায় রথি ছিলো নিরব দর্শক। সে নিশ্চুপ হয়ে দেখছিলো। হুট করে ভাবীর কল আসায় সে চলে গেলো। নাফিসা তৎক্ষনাৎ রথিকে চেপে ধরলো।
-‘ভালোই তো দোস্ত! আমার ভাই এক্কেবারে রথ অবধি পৌঁছে গেছে, ভাবা যায়? কী সুন্দর করে বললো “রথের খেয়াল রাখবি” হায়! বুকে গিয়ে বিঁধিলো মেরি ঝাণ!’
-‘ঢং কম কর!’
-‘আরে না। সত্যি করে বল না, লাইন কী ক্লিয়ার?’
রথি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও মুচকি হাসি দিলো। এই হাসিতেই নাফিসা তার উত্তর পেয়ে যায়। নাফিসা রথিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো,
-‘আলহামদুলিল্লাহ, রথি!!! তুই আমার ভাবী হবি! কী মজা!’
রথির ঠোঁটে তখনো হাসি। হঠাৎ কী মনে হতেই রথি নিজেকে ছাড়িয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
-‘তুই তো আরও বড় শেয়ানা! আবিরের সাথে তোর যোগাযোগ কেমনে?’
নাফিসা লাল হয়ে মাথা চুলকানো ভঙ্গিতে বলে,
-‘একচুয়ালি আবির আমায় প্রপোজ করেছিলো। তোদের খবরের আগেই এক্সেপ্ট করে নিলাম!’
-‘ও আচ্ছা। তলে তলে এতকিছু? বাহ গ্রেট! কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করে না!’
-‘রাগ করিস না প্লিজ। তোকে বলতাম বাট সেই সুযোগ হলো কই? আবিরকে এক্সেপ্ট করেছি কারণ ওর ব্যবহার ভালো, দেখ না এখনো আমায় আপনি করে সম্বোধন করে৷ আই থিংক তোকেও….’
-‘হ্যাঁ করে। আবির ভালো ছেলে। তোর চয়েজ আছে।’
নাফিসার চোখ-মুখ চিকচিক করে উঠলো।
নাশিদ থানায় বসে পেন ঘুরাচ্ছে আর একমনে রথিকে ভাবছে। আপনমনেই বলে উঠলো,
-‘কৌতুহলও কী কখনো ভালোবাসায় রূপ নেয়?’
★
বিকালের দিকে নাশিদ বাড়ি ফিরলো। রথি ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠেছে। নানান দুনিয়া ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে পরে। নাশিদ ইউফর্ম পাল্টে শাওয়ার নিয়ে নাফিসার রুমেই গেলো। নাফিসা রুমে ছিলো না। রথি তখন তোয়াল দিয়ে মুখ মুছছিলো। মুখ থেকে তোয়াল সরিয়ে নাশিদকে দেখেই কিছুটা চমকে উঠলো। নাশিদ অবাক হয়ে রথির সদ্য ঘুম থেকে ওঠা মুখশ্রীকে দেখতে লাগলো। চোখ দুটো খানিক ফুলে যাওয়া, নাকেও হালকা লাল আভা সৃষ্টি হয়েছে। কতো মোহনীয় লাগছে এই মুখশ্রীকে। ইচ্ছে করছে তাকে খানিক ছুঁয়ে দেখতে।
নাশিদের এমন ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখে রথি চোখ নামিয়ে ফেললো লজ্জায়। নাশিদের ধ্যান ফিরলো।
-‘ঘুম হয়েছে?’
রথি মাথা নাড়ায়। নাশিদ হেসে এদিক ওদিক তাকালো। বুঝতে পারলো না পরে কী বলবে। নাশিদ আবারও বললো,
-‘খাওয়া-দাওয়া করেছো তো ঠিকমত?’
-‘না করলে আপনার কাছে খবর চলেই যেত!’
-‘তাও ঠিক।’
-‘শুনুন!’
নাশিদ রথির চোখে চোখ রেখে বললো,
-‘হু বলো!’
-‘আমি কালই বাসায় ফিরে যাবো!’
-‘কেন?’
-‘আমার মা আর ভাইয়া আছেন বাসায়। গাজীপুর তো ভাবী আর আমি-ই গিয়েছিলাম। তাইতো….’
আর কিছু বললো না রথি! নাশিদ প্রথমে অমত করলেও পরে কী ভেবে রাজি হয়। অতঃপর রুম থেকে চলে যায়! রথিও লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। এই মানুষটার সাথে কথা বলতে গেলেই কথাগুলো গলায় আটকে যায়। এখনো কেন এরকম অনুভূতি?
সন্ধ্যার পর নাশিদ নাফিসার ঘরে যাবে এমন সময়ই মনিকা নাশিদের পথ আটকে দাঁড়ায়। মনিকা থমথমে গলায় বললো,
-‘কোথায় যাচ্ছো?’
-‘রথির খবর নিতে, মা!’
-‘নাফিসা পাশে আছে, আর কোনো খবর নেয়ার দরকার নেই! তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেও!’ রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলোমনিকা। মনিকা যেন রথির খবর নেয়ার বিষয়টা মনিকাকে বিষিয়ে তুলছে।
নাশিদ একপলক সামনে নাফিসার রুমের ডোর দেখে আবারও মায়ের দিকে ফিরলো। অতঃপর মাথা নেড়ে বললো,
-‘ওকে মা।’
বলেই নাশিদ উল্টো পথে হাঁটা দেয়। মনিকা আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে নাফিসার ঘরে গিয়ে বলে আসলো ৯টায় ডিনার উপরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর বেশ ভাব নিয়ে রুম ত্যাগ করলেন। রথি নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে চুপ করে বসে রইলো। এই মনিকাকে তার কেমন গন্ডগোল লাগে। নাফিসাকেও কিছু বলতে পারে না। যতোই হোক মা তো। মা সম্পর্কে কথা বলা খুব বেশি ভালো দেখায় না।
রাত ৯ টায় ডিনার পাঠালো মনিকা। দুই বান্ধুবি খেয়ে শুয়ে পরে। নাফিসার ঘরে ২৪ ইঞ্চির একটি এলইডি টিভি আছে। নাফিসা এখনো স্টুডেন্ট বিধায় খুব বড় টিভি পায়নি। তবে সেটা দিয়ে মোটামুটি ভালোই টিভি দেখা যায়। দুই বান্ধুবি টিভি দেখছে আর নানান আলাপ করছে৷ এই সময়ের মধ্যে রথি অনেকবার দরজায় তাকিয়েছে এই আশায় যে নাশিদ আসবে। কিন্তু অনেক অপেক্ষা করেও নাশিদ আসলো না। এতে রথি খানিকটা ব্যথিত হলো। মন খারাপ করে চুপ করে শুয়ে রইলো। বড্ড মিস করছে নাশিদকে। এভাবে কোথায় হারিয়ে গেলো নাশিদ?
মাঝরাতে হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে রথির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে চোখ না খুলেই বালিশের নিচে থেকে ফোন হাতড়ে হাতে নিলো। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো নাশিদ কল করেছে। মুহূর্তেই রথির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রথির পাশেই নাফিসা ঘুমোচ্ছে। রথি বিছানা থেকে উঠে বেলকনি চলে গেলো। কেটে যাওয়ার আগেই রথি নাশিদের কল রিসিভ করলো আর ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘হ্যালো?’
-‘ঘুমিয়ে পরেছো?’
-‘তাহলে আর কী করবো?’
-‘রেগে আছো আমার উপর?’
-‘আপনার উপর রাগ কেন করতে যাবো?’
-‘ওইযে তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি!’
রথির অভিযোগ থাকলেও সে তা প্রকাশ করলো না। থমথমে গলায় বলে উঠলো,
-‘এসব বলার জন্য কল করেছেন?’
-‘কেন ডিস্টার্ব করলাম? ওকে ঘুমাও, গুড নাইট!’
বলে কট করে কেটে দিলো। এদিকে রথির কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। নাশিদ এভাবে কেটে দিলো কেন? একরোখা, হিটলার পুলিশ! এই পুলিশদের প্রেমে পরলে এই এক জ্বালা। একেক সময় এদের একেক রূপ! ভাল্লাগে এসব? রথি দাঁত কিড়মিড় করে ভেতরে চলে গেলো। আর কথা বলবে না সে, নাশিদের সঙ্গে! সারারাত তার অস্থিরতার মাঝে কাটলো। ফজরের নামাজ পড়েই রথি ঘুমিয়েছে।
সকালে নাস্তা সেরেই নাশিদ রথিকে নিয়ে বেরিয়ে পরলো রথির বাড়ির উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তায় রথি একটা কথাও বললো না নাশিদের সঙ্গে। নাশিদও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বললো না। বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই রথি বিনা বাক্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে ভেতরে চলে গেলো। মুখ ফুটে কিছুই সে বললো না। নাশিদ একপলকে কিছুক্ষণ রথির যাওয়া দেখে সেও গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো।
রথি বাসায় ফিরতেই দেখলো সোফার ঘরে রথির মা থম মেরে বসে আছে৷ মুখটাও কেমন ফ্যাকাসে। মায়ের অপজিট সিটে সাইফ তার চুলগুলো দুইহাতে চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মার্জান অদূরে তাতানকে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ মার্জানকে দেখেই রথি ঘৃণায় নাক সিটকালো। তবে এমন নীরবতার কারণ রথির জানা নেই। রথি “মা” বলে ডাকতেই উপস্থিত সকলে রথির দিকেই নজর দেয়। মা নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং এক পা এক পা করে রথির দিকে তাকালো। মার্জান ততক্ষণে তাতানকে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়।
রথি আবারও “মা” বলে যেই জড়িয়ে ধরবে তখনই মা সজোরে তাকে থাপ্পড় মারলো। সেই থাপ্পড়ে রথি সেখানেই পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। গালে পর্যন্ত রথি হাত দিলো না। রথি জলজল দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। তার চোখে স্পষ্ট আক্রোশ দেখা যাচ্ছে। রথি কিছুতেই তার মায়ের চড়টা নিতে পারছে না। কী এমন করলো যার কারণে তার মা তাকে থাপ্পড় মারলো?
রথি একপলক সাইফের দিকে তাকায়। সাইফেরও চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে কিন্তু সাইফ কিছুই বলছে না। এবার রথি নির্বিকার হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মা চোখে জল নিয়ে হুংকারের সুরে বলতে লাগলো,
-‘এই দিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম? এই দিন দেখার জন্য এই অবধি পুষেছি? কী করে এভাবে পালিয়ে গিয়ে আমার মান-সম্মান, বিশ্বাসকে তুই চুড়মার করে ফেললি? আল্লাহ! কেন তুমি আমায় এদিন দেখালে?’
বলতে বলতেই কাঁদতে লাগলো মা। রথি তখনো নির্বাক। সে যেন বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মায়ের কথার প্রতিটি অক্ষর কানে বারংবার বেজে চলেছে। স্মুক্ষ্ম সুইয়ের ন্যায় কিছু একটা বারংবার তাকে বুকে নিঁখুতভাবে আঘাত করছে। চোখের কোণ বেয়ে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরলো। রথি নির্বাক হয়ে বলে,
-‘তুমি ভুল ভাবছো মা, আমি পালাইনি আ…’
-‘চুপ কর! আর কোনোরকম নাটক করার চেষ্টা অবধি তুই করবি না! যদি পালিয়েই না থাকিস কোথায় হারিয়ে গেছিস? দুইদিন কই ছিলি? বাজে ছেলে-পুলের সাথে? তাহলে যা ওখানে, কেন এসেছিস তোর এই নিকৃষ্ট মুখটা দেখাতে? এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যা! আর কোনদিন যেন এই বাড়িতে তোকে না দেখি! কী হলো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা বলছি!’
বলেই মা আঁচলে মুখ গুঁজে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে চলে গেলো। রথি কান্নাভেজা চোখে সাইফের দিকে তাকালো। কিন্ত কোনো কিছুই হলো না। সাইফও তাকে পর করে দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। অবিশিষ্ট রইলো মার্জান, যাকে সে ঘৃণার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করে। আজ মার্জানের জন্যই তার জীবনটা নিকষ কালো রাতের ন্যায় হয়ে গেছে।
মার্জান রথির দিকে এগিয়ে গেলো। মার্জানকে দেখে রথি বেরিয়ে আসতে নিবে ওমনি মার্জান দৌড়ে এসে রথির পথ আটকে দাঁড়ায় এবং বলতে শুরু করে,
-‘আমায় ক্ষমা করিস বোন। জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য তাও ক্ষমা চাচ্ছি। বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছা করে এসব করিনি। আমি এসব করছি ওই শামুনের জন্য। শামুন ছেলেটার কারণেই তোকে দূরে নিয়ে গেছিলাম আবিরের সঙ্গে বিয়ে দিতে। ভেবেছিলাম আবিরের সঙ্গে বিয়ে হলে এবারের যাত্রায় তুই শামুনের হাত থেকে বেঁচে যাবি কিন্তু তাও হলো না। বাসার আসার সময়ও শামুনের ওই বিশ্রী হাসি সাথে বিশ্রী কথাবার্তা আমার কানকে বিষিয়ে দিচ্ছিলো। বারবার বলেছে এবার যদি তোকে ওর কাছে বিয়ে দিতে রাজি না হই তাহলে সত্যি সত্যিই বাসা থেকে তোকে তুলে নিয়ে যাবে। যদি বিয়েও না করে তাহলে তোকে এক রাতের জন্য.. তারপর তোকে মেরে ডোবায় ফেলে দিবে। বিশ্বাস কর, আমার আত্মা কেঁপে উঠছিলো। আমি জানি তোদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি ইভেন এখনো করছি। হয়তো সম্পত্তির লোভ ছিলো। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কোনোদিনও তোর খারাপ চাইনি। আমিও যে একজন মেয়ে। তাই বলছি প্লিজ তুই এই এলাকায় আর কোনোদিন আসিস না, তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি জানি তোর কেউ আছে যে কিনা তোকে আজীবন ভালোবাসবে। যদি ভালো নাই বাসতো তাহলে তোকে ওই অদূর গাজীপুর থেকে সুস্থ-সবল তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিতো না। তুই তার কাছেই ফিরে যা, আর আসিস না এই এলাকায়। কথা দিচ্ছি, মায়ের খুব খেয়াল রাখবো!’
শেষোক্ত কথাগুলো মার্জান কাঁদতে কাঁদতে বললো। রথির যেন সেদিকে খেয়াল নেই। সে নির্বিকার, অনুভূতিশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে। থমথমে গলাতেই বলে উঠলো,
-‘আমার আর কী আছে ভাবী? তুমি-ই তো সব কেড়ে নিলে!’
মার্জান এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। রথিকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই রথি শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘খবরদার আমাকে ছুঁবে না! তোমার বানানো গল্প আমি শুনবো আর তোমায় ক্ষমা করবো, সেই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো!’
বলেই রথি হনহন করে বেরিয়ে গেলো। একবার ফিরেও তাকালো না। রাস্তা দিয়ে আপনমনে হাঁটছে আর মায়ের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করছে রথি। যেই মায়ের চোখে আজীবন নিজের প্রতি আশ্বাস দেখেছে আজ সেই মায়ের চোখে অবিশ্বাস দেখেছে। এইদিন দেখার চেয়ে রথির মৃত্যুকেও সহজ লাগছিলো। রথির ভাবনার মাঝেই শামুন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। শামুন বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বলে,
-‘বাহ শিকারী দেখছি নিজেই এসে হাজির। তা মহারানী, আর ইউ রেডি ফর মিসেস শামুন?’
রথির গা শিউরে উঠলো। এমন বিশ্রী চাহনি তার গা কাঁপিয়ে তুলছে অনবরত। রথি চিৎকার দিবে তার আগেই শামুন রথির মুখ চেপে আড়ালে নিয়ে যেতে লাগলো। রথি না পেরে বারংবার হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করছে। এর মানে কী মার্জান ঠিক ছিলো? রথির চোখ বেয়ে আবারও অনবরত নোনাজল পরতে লাগলো। রথি মনে মনে চেঁচিয়ে “আল্লাহ” কে ডাকছে। কেন তাকেই কঠিন পরিস্থিতিতে জড়াতে হয়? কেন?
রথি একসময় নিস্তেজ হয়ে গেলেও আবার হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। হারলে চলবে না। কী ভাবে রথি শামুনের হাতে জোরে কামড় দিলো। শামুন আর্তনাদ করে উঠলো। রথি দৌড় দিলো আর শামুন তারই পিছে। রথি দৌড়াতে দৌড়াতে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। রথি চোখ উঠিয়ে উপরে তাকাতেই নাশিদকে দেখলো। নাশিদও খানিকটা মাথা নিচু করে রথির দিকে তাকালো। কিছু সময়ের ব্যবধানে কী হাল হয়েছে মেয়েটার। রথির ঠোঁটজোড়া মৃদু কাঁপছে। চোখও অসম্ভব লাল। সঙ্গে সঙ্গে নাশিদের ঠান্ডা মেজাজ অধিক রাগে পরিণত হলো। শামুন পুলিশ দেখে সেখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। শুকনো ঢোকও গিললো। নাশিদ রথিকে পাশে দাঁড় করিয়ে এক পা, এক পা করে শামুনের দিকে এগোতে লাগলো। শামুন উপস্থিত পরিস্থিতি সামলাতে আমতা আমতা করে বললো,
-‘দেখ! ওটা আমার শিকার। এগোচ্ছো কেন? ওহ বুঝেছি পকেট খালি তাইতো? নো প্রব্লেম মোটের অংকের মাল শীঘ্রই পৌঁছে যাবে তোর পকেটে…’
আর কিছু বলার আগেই এক নাশিদ জোরে নাক বরাবর একটা ঘুষি মারলো শামুনের নাক বরাবর। শামুন নাকে হাত দেয়ার আগেই নাশিদ এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো শামুনকে। আশেপাশে লোকজন জমে গেছে ওদের মারপিট দেখে। নাশিদ মারতে মারতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
-‘এতো সাহস তোর? আরেকবার বল তো ওরে বাজে কথা, তোর ওই জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি। সে ওনলি আমার প্রোপার্টি! তাকে স্পর্শ করার, তাকে প্রটেক্ট করার অধিকার একমাত্র আমার আছে। তুই আমার পোপার্টির দিকে চোখ দিয়েছিস তোকে আমি আজ মেরেই ফেলবো হারামজাদা!’
মারতে মারতে নাশিদ শামুনকে আধমরা করে ফেলেছে। শামুন নিজের জান বাঁচাতে কোনোরকমে পকেটে থেকে একটা ছোট ছুঁরি নিয়ে সেটা দিয়ে নাশিদের হাতের খানিকটা কেটে ফেললো। নাশিদ তার থামেনি। শামুনকে একবারে মেরেই সে ক্ষান্ত হবে। পরিস্থিতি বিগ্রে যাচ্ছে দেখে রথি দৌড়ে এগিয়ে গেলো নাশিদের কাছে। তৎক্ষনাৎ নয়ন আর বাকি কয়েকজন পুলিশ চলে আসলো। ওরাই নাশিদের থেকে শামুনকে ছাড়িয়েছে। রথি নাশিদের এক বাহু শক্ত করে চেপে ধরেছে৷ নাশিদের এমন রূপ রথি এর আগে কোনোদিন দেখেনি। আজ সে প্রমাণ পেলো ঠান্ডা মানুষের রাগ ধরা-ছোয়ার বাইরে। রথি নিজেও নাশিদের এ রূপ দেখে ভয় পেয়েছে। নাশিদ তখনো রাগে সাপের ন্যায় ফোঁসফোঁস করছে। শামুনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ই নাশিদ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
-‘শালা! আমিও দেখবো তুই কেমনে জেল থেকে বের হোস! তোকে তো আমি…’
নাশিদ আবারও শামুনের দিজে এগোবে ওমনি রথি নাশিদকে জড়িয়ে ধরলো। নাশিদ থেমে গেলেও তার অস্থিরতা কমলো না। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো। নাশিদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষ এখনো সার্কাসের আশায় দাঁড়িয়ে। নাশিদ ধমকের সুরে বললো,
-‘কী সমস্যা? আরও সার্কাস দেখবেন নাকি নিজেদের কাজে যাবেন? আর কোনো কাজ নেই? ডিসগাস্টিং!’
সকলে তৎক্ষনাৎ যে যার কাজে চলে গেলো। নয়ন আবারও ওদের কাছে ফিরে আসলো। থমথমে গলায় বললো,
-‘ছেলেটার অবস্থা অনেক খারাপ! কী করবো ওরে?’
-‘হসপিটাল নিয়ে চিকিৎসা করাও। সুস্থ হলে জেলে পুরবো!’
নয়ন আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো। অতঃপর নাশিদ রথিকে জড়িয়ে ধরে থমথমে গলায় বললো,
-‘বাড়ি চলো।’
তখনই রথি নাশিদের হাতের দিকে খেয়াল করলো!
-‘একি আপনার হাত কাটলো কী করে?’
বলেই দ্রুত হাত ধরলো। নাশিদ হাত ছাড়িয়ে রথির হাত ধরে গাড়ির দিকে চলতে লাগলো। রথি বুঝলো এই মানুষটার রাগ এখনো কমেনি। রথি অন্যহাতে চোখ মুছে চুপ করে চলতে লাগলো।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ আজ তিন পর্ব দিয়েছি। ভাবা যায়? আমারই তো বিশ্বাস হচ্ছে না। যাইহোক, কাল গল্প নাও দিতে পারি তাই আজ মিটিয়ে দিলাম। যেহেতু আজ তিনটা পার্ট দিয়েছি অবশ্যই বড় মন্তব্য চাই। কষ্ট করে লিখেছি, এইটুকু তো এক্সেপ্ট করতেই পারি পাঠকমহলের কাছে। যাইহোক রিচেক দেয়া হয়নি। তাই ভলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।