#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৫+১৬ |
আবছা অন্ধকার ঘরের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে আপনমনে ফুঁপিয়ে চলেছে রথি। তার আঁখিপল্লব অশ্রুসিক্ত! সে একমনে কাঁদছে। রথির ভাবী কিছুক্ষণ আগেই তাকে এই ঘরে বন্দি করে গেছে। রথি এখন গাজীপুরে আবিরের ফ্ল্যাটে আছে। এখানে ঘরোয়াভাবে রথি এবং আবিরের বিয়ের ব্যবস্থা করেছে চাচী আর ভাবী।
বিয়ের কথা শুনতেই রথির কেমন সব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। কোনো এক জায়গা থেকে কেউ চিৎকার করে বলছিলো এই বিয়ে করলে তুই ভালো থাকবি না, কারণ তুই অন্যকাউকে ভালোবাসিস। তাকেই তোর লাগবে। রথি অমত জানায় সে বিয়ে করবে না এবং সে এই মুহূর্তে বাড়ি চলে যাবে!
এই কথা শুনতেই ভাবী জোর করে তাকে বদ্ধ ঘরে বন্ধ করে দেয়, রথির ফোনটাও সুইচড অফ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। এই বদ্ধ ঘরে বন্দি হতেই রথি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলো তার নাশিদকে প্রয়োজন। নাশিদ তার প্রিয়জন, সে ছাড়া অন্য কাউকে কখনোই মেনে নিতে পারবে না।
জীবনটা কীভাবে যেন নতুন ঝামেলায় মোড় নেয়। একে একে বুঝতে পারলো তার ভাবী কেন একান্তই তাকে নিয়ে এই গাজীপুরে এসেছে। রথি তার ভাবীর প্রতি ঘৃণায় নাক সিটকালো। এই মানুষটাকে সে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না।
কিছুক্ষণ বাদে হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো মার্জান। রথির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে শুধুমাত্র নাশিদ এবং নাশিদের স্মৃতিগুলো ভাবতে মগ্ন। মার্জান পা ভেঙ্গে ফ্লোরে বসে খাবার এগিয়ে শক্ত গলায় বললো,
-‘খাবারটা খেয়ে নে!’
-‘খাবো না, চলে যাও এখান থেকে।’
মার্জান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেঝেতে প্লেটটা রেখে খুবই শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-‘দেখ রথি, আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি রাজি হয়ে যা। আবির ভালো ছেলে, তোকে ভালো রাখবে!’
-‘আমার তোমার ভালোর প্রয়োজন নেই? তুমি যাবে?’
চিৎকার করে বললো রথি। মার্জান আরও কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু রথি মার্জানের কোনো কথাই কানে নেয়নি। মার্জান নিরাশ হয়ে তপ্তশ্বাস ফেললো। অতঃপর খাবার রেখেই চলে গেলো। রথি এখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
তার মধ্যে চলছে চরম হাহাকার, মারাত্মক হাহাকার। কেন সে বুঝতে দেরী করলো, নাশিদকে সে একান্ত ভাবে চায়? কেন আগে উপলব্ধি করেনি? এমন হবে জানলে সে আগেই নাশিদকে তার জীবনে প্রবেশ করাতো। সব তো ঠিকই ছিলো তাহলে কেন সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো?
নাশিদের মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভাসছে আর প্রতিনিয়ত ভেতরটা পুড়ছে, ভয়াবহভাবে।
রথির কাঁদতে কাঁদতে পুরোটা দিন চলে গেলো। খাবারটা আগের জায়গাতেই পরে রইলো।
সন্ধ্যায় মার্জান যখন চাচীর কাজে হাত লাগাতে ব্যস্ত তাতান তখন চুপিচুপি রুমে গিয়ে রথির ফোনটা নিয়ে অন করলো। অতঃপর ডায়াল লিস্টে ‘পুলিশম্যান’ নামটা দেখে তাতান কিছু না ভেবেই সেই নম্বরে কল দিলো। দুই তিনবার রিং হতেই তাতান চটজলদি বলতে লাগলো,
-‘আমার ফুপ্পিকে ওরা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে, আমার ফুপ্পি অনেক কান্না করছে!’
বাকি কথা বলার আগেই তাতান তার মায়ের আসার শব্দ পেলো। সে জলদি কল কেটে ফোন বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিলো।
রাতে ভাবী আরেক দফা খাবার দিতে এসে দেখে রথি আগের খাবারই খায়নি। ভাবী তপ্তশ্বাস ফেলে খাবারটা দিয়েই চলে গেলো। আগের খাবারটা সে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। রথি খাবারের দিকে একমনে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আপনমনে বলে উঠলো,
-‘যেখানে মনের সুখ নেই সেখানে এই খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না গো ভাবী! নাশিদ আপনি কোথায়? আমার কথা কী একটু মনে পরছে না? একটু আমার বাসায় গিয়ে আমার খবরটা নিয়ে আসুন। পারছি না আর! পুরো একটা দিন কেটে গেলো! এর মানে কী আবিরকে আমার…’
আর ভাবতে পারলো না রথি, কেঁদে উঠলো। আজ যদি বাবা থাকতো তাহলে হয়তো এমন কিছু হতো না। বাবা থাকলে হয়তো কারো এসব করার স্পর্ধাও হতো না। এসব ভেবে কাঁদতে কাঁদতেই রথি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেলো।
মাঝরাতে হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দ পেলো। সেই শব্দতেই রথির ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। পিটপিট করে তাকাতেই কোনো মানুষের অবয়ব দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গেই রথির ঘুম পুরোপুরিভাবে কেটে গেলো। রথি চোখ গোলগোল করে অবয়বটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। অবয়বটি ধীরে ধীরে রথির দিকে এগিয়ে আসছে। রথি যেই চিৎকার দিবে অবয়বটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘চেঁচাবেন না। আমি আবির!’
কন্ঠস্বর শুনে রথি শান্ত হলেও পরবর্তীতে দ্বিধা তৈরি হলো তার। আবির এতো রাতে এই রুমে কেন এসেছে? আবিরের খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই তো? রথি কাঁপা গলায় বলে,
-‘কেন এসেছেন এই অসময়ে?’
-‘ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি!’
-‘সাহায্য? কিসের?’
আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। অতঃপর থমথমে গলায় বলা শুরু করলো,
-‘দেখুন কোনো এক সময় আপনাকে পছন্দ করলেও এখন একজনকে ভালোবাসি। তখন হয়তো ভালোবাসা এবং পছন্দের পার্থক্য বুঝতাম না। তবে এখন বুঝি, উপলব্ধি করি। আমি আপনার বান্ধুবিকে ভালোবাসি রথি তাই আমিও এই বিয়ে করতে চাই না। মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন।’
-‘তাহলে এখন উপায়? এই বিয়ে হলে দুটো জীবন চোখ বুজে শেষ হয়ে যাবে!’
-‘আমি তো সেজন্যই এলাম। আমি আপনাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। আপনি চলে যান, মায়েরা এখন ঘুমাচ্ছে। এখনই সুযোগ। আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি, আপনি খুব শীঘ্রই মেইন রোডে যেতে পারবেন। আর কিছু টাকাও..’
-‘টাকার চিন্তা করতে হবে না। আপনি শুধু আমায় এখান থেকে বের করুন!’
আবির মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং রথিকেও উঠতে বললো। রথি উঠে দাঁড়ালেও ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যেতে নেয় তবে সে নিজেকে সামলে নেয়। সারাদিন এভাবে না খেয়ে, কান্না করে কাটানোর ফলই হয়তো এটা! রথি কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে আবিরের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। নিচে নামতেই আবির পথ বুঝিয়ে দিলো এবং রথির মোবাইলটাও এগিয়ে দিলো।
-‘আমি আগে ভাগেই তাতানকে দিয়ে আপনার ফোনটা নিজের কাছে রেখেছিলাম। আপনি এটা নিয়ে যান!’
রথি ফোনটা নিয়ে আবিরকে ধন্যবাদ জানালো। এই আবির না থাকলে সে যে এভাবে পালাতে পারতো না। রথি আবিরকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো। আর আবির নাফিসাকে কল করলো।
-‘রথিকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি নাফিসা, এখন আল্লাহ ভরসা!’
রথি দ্রুত ছুটতে লাগলো। সে এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে নাশিদের কাছে যেতে চায়। প্রাণপণে ছুটছে সে। মাঝেমধ্যে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলেও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। দিনের চেয়ে এই মাঝরাতটা পুরোই জনমানবশূন্য। সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন আর রথি নিজেকে বাঁচাতে ছুটতে ব্যস্ত। রাস্তা-ঘাট পুরো শূন্য। একটি গাড়ির চিহ্ন অবধি নেই। সেই রাস্তার মাঝে দিয়ে দৌড়ে চলেছে রথি। তার বারবার মনে হচ্ছে সে এই শহর ছাড়তে না পারলে ভাবী তাকে খুঁজে বের করে সত্যি সত্যিই আবিরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন সে আফসোস করবে কেন এই রাতে সে দ্রুত পালালো না। সারাজীবন আফসোস করার চেয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটে চলা ঢের ভালো। মাঝেমধ্যে রিস্ক না নিলে জীবনে অনেককিছুই খোয়াতে হয়, অনেককিছু।
রথির চোখের সামনে তার মায়ের চেহারাটা ভেসে উঠছে। ভাসছে তাদের সুখের সংসারের এক চিত্র। যেখানে বাবা-মা, ভাইয়া, রথি সবাই।
এসব ভাবতে ভাবতেই রথি যখন অদূরে মেইন রাস্তা দেখতে পেলো তখন খানিক থেমে হাঁপিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। অতঃপর আবার ছুটতে লাগলো। যখনই সে মেইন রাস্তায় উঠবে তখনই বাম পাশ থেকে একটা গাড়ি এদিকে আসতে লাগলো। গাড়িটি রথির খুব কাছে, খুব। রথি ভয়ে চিৎকার দিয়ে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো।
নাশিদ দৌড়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো। তার সঙ্গে নয়নও নামলো। রথির গায়ে লাগার আগেই নয়ন গাড়ি থামিয়ে ফেলেছিলো। নাশিদ ছুটে রথির সামনে আসতেই রথিকে বুকে টেনে নিলো এবং রথির গালে আলতো চড় দিতে লাগলো।
-‘এই রথি, রথি? এই? কী হলো? কথা বলছো না কেন? নয়ন! ও কেন কথা বলছে না?’ বিচলিত হয়ে বললো নাশিদ।
-‘স্যার শান্ত হোন। ম্যাম জ্ঞান হারিয়েছে, তাকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।’
নাশিদ আর ভাবতে পারলো না। রথিকে কোলে নিয়ে সে পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। নয়নও দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সারা রাস্তাতেই নাশিদ রথিকে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলো কিন্তু রথি কোনো সাড়াই দিলো না।
—————————-
-‘দেখুন মি. নাশিদ, উনি ভয় পাওয়ার কারণে জ্ঞান হারালেও মানসিকভাবে উনি অনেকটা দুর্বল। আই থিংক পেশেন্টের উপর অনেক মানসিক চাপ তৈরি করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কোনোটাই উনি ঠিকমতো করেননি।’
নাশিদ চুপ করে শুনলো কিছু বলার উত্তর পেলো না।
-‘এখন করণীয় কী ডক্টর?’
-‘আপাতত ওনার স্যালাইন করছে আর উনি এখন ঘুমাচ্ছে। ওনাকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে, কোনোরকম চাপ বা হতাশা থেকে বিরত রাখতে হবে। এই ধরণের মেন্টালি স্ট্রিস কোনো মানুষের জন্যই কল্যাণকর নয়।’
নাশিদ তপ্তশ্বাস ফেলে উঁকি দিয়ে রথিকে দেখলো। রথি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।
হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৬ |
রথি একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নাশিদ তার পাশেই বসা। নয়ন ড্রাইভ করছে। রথির কনুইয়ের কাছে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ। সে একমনে গত দিনগুলোর কথা ভাবছে। ওরা এখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। রথি নাশিদকে সামনে পেয়েও কোনরকম রিয়েকশন করেনি৷ নাশিদও ওকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। কারণ, রথির ফ্যাকাসে মুখটা দেখলেই বোঝা যায় কী পরিমাণ চাপের মধ্যে গেছে। ডাক্তার তাকে বারণ করেছে কোনো ব্যাপারে চাপ দিতে। তাই নাশিদ এখনো গতদিনের প্রশ্নগুলো করতে পারেনি। রথির রিফ্রেশ হওয়া দরকার, আপাতত নাশিদ সেই ব্যবস্থাই করবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওরা গুলশানে পৌঁছে গেলো। ভোর হওয়ায় রাস্তায় জ্যাম তেমন একটা নেই। নাশিদ ফিসফিস করে বলে,
-‘চা খাবে?’
রথি বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে নাশিদের দিকে তাকালো। তার এই দৃষ্টি নির্বিকার। রথি অস্ফুট সুরে বললো,
-‘খেতে ইচ্ছে করছে না!’
-‘খেতে হবে। নয়ন, ওই টঙের পাশের গাড়ি থামাও আর দুই কাপ চা নিয়ে এসো। তুমি খেলে তুমিও নিও।’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে টঙের সামনে গাড়ি থামিয়ে চলে গেলো। নয়ন চলে যেতেই নাশিদ বললো,
-‘খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে সেন্সিটিভ হও! আমি জানি তুমি গতকাল সারাদিন কিচ্ছু খাওনি! এরকম হলে চলে বলো তো? খেতে হবে, নয়তো তোমায় এখানে ফেলেই চলে যাবো!’
নাশিদের কথা শেষ হতেই রথি নাশিদের হাত খামচে ধরলো। অতঃপর নাশিদের কাঁধে আচমকাই মাথা রাখলো। এতে নাশিদ মুহূর্তেই জমে গেলো। কী বলবে না বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রথি তার কাছাকাছি থাকলে এমন অনুভূতি হয় কেন? এই অনুভূতির নাম তার যে অজানা। তবে সব এলোমেলো লাগে। হঠাৎ নাশিদ তার কাঁধের শার্টে ভেঁজা কিছু অনুভব করলো। নাশিদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো রথি কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদলেও মাঝেমধ্যে ফোঁপানোর শব্দও হচ্ছে। নাশিদ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। রথি ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘দয়া করে আমায় ছেড়ে যাবেন না। অনেক কষ্টে আমি আপনাকে পেয়েছি, আপনি ছাড়া আমি মস্তিষ্কশূন্য হয়ে যাই। এই বিরাট পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে এক আপনি আমার ভরসার স্থান, আমার সবচেয়ে আপনজন। এতোটা নিষ্ঠুর আপনি হতে পারেন না পুলিশম্যান!’
কথার মাঝে মাঝে রথি হেঁচকি দিয়ে উঠছিলো। আর নাশিদ? তার অবস্থা নাই-বা বর্ণনা করলাম। তার চোখের কোণও সমানতালে ভিঁজে গেছে। তার ভেতরটায় কেউ যেন ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। সে মনে করতে লাগলো গতদিনটার কথা। কীভাবে তোপ্রে তোপ্রে রথিকে পাগলের মতো খুঁজেছে। রথিকে হারানোর ভয়ে অনেকটা অস্থির হয়ে গেছিলো সে। এই মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললে সে কী করে বাঁচবে? প্রিয়জনকে হারানোর ভয়টা বুঝি এতোই তীব্র? নাশিদ এবার তার অন্য হাত দিয়ে রথিকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এই মেয়েটাকে ছাড়া সে পারবে না থাকতে। কিছুতেই পারবে না। এই মেয়েটা তার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে মিশে গেছে। সব ভালোবাসা কী ছুঁয়ে অনুভব করা যায়? কিছু ভালোবাসা তো দূরত্বেই আসল চাওয়া-পাওয়া বুঝিয়ে দেয়, বুঝিয়ে ভালোবাসার মর্ম, পবিত্রতা!
নাশিদ রথির কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-‘শিসসস! আর কেঁদো না। আমি তো তোমারই কাছে, রথ! এভাবে কেঁদে নিজেকে ভাসালে হয়? আমি এসেছি তো।’
রথি নাশিদের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে হেঁচকি তুলে চোখ-মুখ লাল করে বলতে লাগে,
-‘আ..আবির যদি সময়মতো ন..না হেল্প করতো সত্যি সত্যিই আমি অন্যকারো..!!’
বলেই রথি আবার কেঁদে উঠলো। নাশিদের ভেতরটাও ধক করে উঠলো। সত্যিই তো কী হতো? নাশিদ রথির চোখ মুছে মৃদু সুরে বললো,
-‘ওসব ভুলে যাও রথ। সকলের জীবনে কোনো না কোনো কালো দিন আসেই। মনে রেখো দুঃখের পরেই সুখ। অতীত মনে রেখো না। কাল যেটা ঘটে গেছে সেটা তোমার অতীত আর এখন তোমার বর্তমান। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎটাকে উপলব্ধি করো। আল্লাহ আছেন, কোনো বিপদ হবে না আর। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ রথ!’
রথি নাক টেনে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়েই মাথা নাড়ায়। নাশিদ মুচকি হাসলো। নয়ন এসে দুই কাপ চা দিলো। নাশিদ ভ্রু কুচকে বললো,
-‘দুই কাপ চা আনতে এতো সময় লাগে?’
নয়ন দাঁত কেলিয়ে বলে,
-‘আসলে হয়েছে কী স্যার আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি! তাই আপনাদের টা আনতে দেরী করে ফেলেছি!’
নাশিদ কটমট দৃষ্টিতে নয়নে পানে তাকালো। রথি নিঃশব্দে হাসলো। সেই হাসিটা নাশিদ না দেখেও উপলব্ধি করলো। অতঃপর নাশিদ চা দুটো নিয়ে নয়নের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আরেকটা পানির বোতল আনো, সেটা দিয়ে ১০ মিনিট দূরে রোদের মধ্যে দাঁড়ায় থাকবা!’
নয়ন দাঁত কেলানো বন্ধ করে বলে, ‘কেন স্যার?’
-‘চা দেরী করে আনার শাস্তি!’
নয়ন মুখ গোমড়া করে পানির বোতল আনতে চলে গেলো। আবার কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও এলো। নাশিদ আর রথি ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। পানির বোতল দিয়ে নয়ন চলে গেলো ছায়া থেকে রোদে। নাশিদ রথির দিকে বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
-‘চোখে-মুখে পানি দাও। ইচ্ছে হলে মাথায়ও হালকা পানি দাও, অস্থিরতা কমবে!’
রথি মাথা নাড়িয়ে বোতলটা নিয়ে চোখ-মুখ ধুঁয়ে নিলো। মাথার মাঝেও হালকা পানি দিলো। অতঃপর কয়েক ঢক পানি খেয়ে নাশিদকে দিলো। নাশিদও দুই ঢক খেয়ে বোতল ফেলে দিলো কারণ, পানি শেষ। রথি ওড়না দিয়ে মুখ আর মাথা মুছে নাশিদের থেকে চা টা নিলো। আস্তে ধীরে চায়ে চুমুক দিলো আর নাশিদের সাথে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। এই পাশটা খানিক নির্জন। কিছুক্ষণ বাদে বাদে দু-একটা রিকশা যাচ্ছে। চা খেতে খেতে রথি নাশিদকে বললো,
-‘ভাইয়াটাকে ওদিকে পাঠালেন কেন? বেচারা তো ঘেমে একাকার! এমনেই কতো গরম!’
-‘মাঝেমধ্যে বাঁকাকে সোজা করতে এসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়!’
-‘আমি বাঁকা হলে?’
নাশিদ মুচকি হেসে ওয়াইনটাইম কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে মৃদু সুরে বললো,
-‘আমার স্টাইলে আবার সোজা করে দিবো!’
নাশিদের রুদ্ধ দৃষ্টি রথি সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে ফেলে। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে তার মধ্যে, ভীষণ অদ্ভুত! অবশেষে রথির জন্যই নাশিদ নয়নকে ডাকলো। নয়ন রুমালে কপাল মুছতে মুছতে আসলো।
-‘রথের জন্য আজ শাস্তি কম দিলাম।’
নয়ন চোখ-মুখ চকচক করে বললো, ‘ম্যাম বলেছে?’
নাশিদ মাথা নাড়ায়। নয়ন দাঁত কেলিয়ে বলে,
-‘আপনি আসলেই অনেক ভালো, ম্যাম!’
-‘হুম হয়েছে। জলদি বাসায় চলো তোমার ম্যাম এখনো না খেয়ে আছে!’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রথি গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো,
-‘আমরা এখন কোথায় যাবো?’
-‘আমার বাসায়। দুইদিন নাফিসার সাথেই থাকবে তুমি!’
-‘কিন্তু মা….’
রথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাশিদ বললো,
-‘কোনো কথা না, চলো। তোমার মাইন্ড রিফ্রেশ হওয়া আমার জন্য বেশি জরুরি!’
রথি নিচের দৃষ্টি নত করে মৃদু হাসলো। এই জোর খাটানোগুলো তার ভেতর প্রতিনিয়ত ভালোবাসার খোদাই করে যাচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যেই নাশিদদের বড় গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করলো। রথির এই বাড়িতে দ্বিতীয়বার আসা। তবে বাড়িতে ঢুকবে প্রথম। পথের দু’ধারের সৌন্দর্যে রথি বরাবরের মতোই মুগ্ধ। দরজা খোলার শব্দেই রথির ধ্যান ভাঙলো। নাশিদ দরজা খুলে রথির সামনে দাঁড়িয়েই বললো,
-‘কী ম্যাডাম? সারাদিন কী গাড়িতে বসে থাকার ইচ্ছা আছে? খাওয়া দাওয়া করা লাগবে না?’
-‘আপনি এতো খাওয়া খাওয়া করেন কেন?’
-‘নামো!’
রথি ভেংচি কেটে নামলো। রথির এমন ভেংচি কাটা দেখে নাশিদ নিঃশব্দে হাসলো। এখন সকাল আটটা বাজে। নাশিদের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে রথি পুরো অবাক। এ যে পুরোই সৌখিন। শো-পিজ থেকে শুরু করে ফার্নিচার সব! রথির মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো। রথির ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটিয়ে নাশিদ বললো,
-‘চলো নাফিসার ঘরে। ওখান থেকে ফ্রেশ হয়ে ভালো ড্রেস পরে নিবা!’
বলেই রথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রথির হাত ধরে টেনে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। তখনই হাই তুলতে তুলতে মনিকা নিজের ঘর থেকে বের হলো। সদর দরজার দিকে নয়নকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনিকা বললো,
-‘কী নয়ন? সকাল সকাল স্যারকে নিতে এসেছো বুঝি?’
নয়ন কী বলবে বুঝলো না। বেকুবের মতো হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়। মনিকা আর কিছু না বলে কিচেনের দিকে চলে গেলো। নয়ন হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নাশিদ বলুক আর না বলুক এই মহিলাকে তার শ্রীময়ী ভয়ংকরী লাগে। ভাগ্যিক স্যারকে ম্যামের সাথে দেখেনি৷ নয়তো নয়নের সিক্সথ সেন্স বলছে কোনো না কোনো ঝামেলা হতোই!
নাশিদ রথিকে নিয়ে নাফিসার ঘরে এসে দেখলো নাফিসা ঘুমে কাত। নাশিদ ধমকিয়ে নাফিসাকে ঘুম থেকে উঠালো। নাশিদকে আর রথিকে দেখে নাফিসার ঘুম হারিয়ে গেলো। সে চোখ বড় বড় করে রইলো। নাশিদ রথিকে নাফিসার কাছে রেখে নিজের ঘরে চলে গেলো। নাফিসা রথিকে একটা জামা দিতেই রথি জামাটা নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো। রথির সাথে কোনো জামা-কাপড় নেই আবার এই ড্রেসে তার নিজেরও আনকনফরটেবল লাগছে। তাই উপায় না পেয়ে নাফিসার ড্রেসই পরছে। শাওয়ার নিয়ে নিজের ড্রেস ধুঁয়ে বেরিয়ে আসলো। নাফিসা তখন ঘরে ছিলো না। রথি বেলকনিতে গিয়ে জামা-গুলো মেলে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে এমনেই রোদের উত্তাপ বাড়বে, কাপড় তখন আরামসেই শুকিয়ে যাবে।
রথি বিছানায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করলো। মায়ের কথা বড্ড মনে পরছে। আর নাশিদই বা কোথায় চলে গেলো? নাশিদের কথা ভাবতে ভাবতেই নাশিদ ইউনিফর্ম পরে হাজির!
-‘আমি নয়নকে নিয়ে থানায় যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর ডাইনিং এ খাবার দিবে একসাথে খেয়ে নিও। আমি নাফিসাকে বলে যাচ্ছি, আর হ্যাঁ সবসময় নাফিসার সাথে থাকবে!’
-‘কখন ফিরবেন?’
-‘তা তো বলতে পারি না৷ তবে শীঘ্রই!’
বলেই নাশিদ চোখ টিপ দিয়ে চলে গেলো। রথির কেমন যেন লজ্জা, লজ্জা লাগছে। ওদের বিয়ে হলে বুঝি এভাবেই রথি জিজ্ঞেস করবে, নাশিদ কখন ফিরবে? নাহ রথির আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। রথি বেলকনি গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ ওইতো নাশিদের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রথি খানিক অপেক্ষা করতেই দেখলো নাশিদ বেরিয়ে গাড়িতে উঠছে। মুহূর্তেই গাড়ি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।