প্রেমোদ্দীপক। পর্ব-৩১

0
1183

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৩১)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে জায়নামাজে বসে আছে তাহিয়া। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে, কাঁপছে বুক, গলা,মুখ। কাঁপা হাতে কাঁপা স্বরে জিকির জপছে। মাথার উপর ঊর্ধ্বগতিতে ফ্যান ঘুরছে, ফ্যানের বাতাসে ওর গায়ে পরে থাকা সুতোর হিজাবটা উড়ে যাবার উপক্রম। সব বাতাস সরাসরি ওর গায়ে এসে বিধছে। এত বাতাস মাড়িয়ে কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামফোঁটা। নাকের ডগায়, কপালে ঘামের অস্তিত্ব বেশ গাঢ়। ঘামটা গরম থেকে নয় বরং চিন্তা থেকে। আজ সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট দিবে। কালই শুনেছে রেজাল্ট দেয়ার কথা। শোনার পর থেকে অযু করে জায়নামাজে বসা দিয়েছে।

ছাত্রছাত্রীরা সারাবছর ধার্মিক না থাকলেও রেজাল্ট আর পরীক্ষার আগে একবারে পরিপক্ক ধার্মিক হয়ে যায়। আযান হলে অযু ঘরে ছুটে যায়, ওয়াক্ত মতো নামাজ পড়ে। গান বাজনা কম শুনে, আল্লাহ নারাজ হয়ে আবার যদি স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেন এই ভয়ে। যথাসাধ্য চেষ্টা চলে নিজেকে হারাম কাজ থেকে বিরত রাখার। তাদের মা ছেলে/মেয়ের এই পরিবর্তনে খুশিতে আত্মহারা হন। এমনটা চেয়ে এসেছেন কত কাল ধরে! অবশেষে পূর্ণ হলো। দুঃখজনক বিষয় হলো আকস্মিক আসা ধার্মিকতা পরীক্ষা শেষ হতেই আবার আকস্মিকভাবে চলে যায়। তাকে আর দেখা যায় না। কয়েকমাস পর যখন রেজাল্টের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন আবার এসে হানা দেয়। আগের চেয়ে কঠিনরূপে। রেজাল্টের আগের কয়েকদিন তাহাজ্জুদ বাদ দেয় না। সেটা ভিন্ন ব্যাপার যে, রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে ফজর নামাজ কাযা করে। যত যাই হোক, তাহাজ্জুদ পড়া চাই। রেজাল্টের দিন সকাল থেকে জায়নামাজে বসা দেয়, সারা দিন কেটে যায় যায় নামাজে। সুখের সময় না পড়া নফল নামাজ গুলো একদিনে পড়ে ফেলে। কেউ কেউ রোযা ও রাখে। এই ধার্মিকতা একদিন থাকে। রেজাল্টের পরদিন থেকে আবার যেই সেই।

দৈবাৎ ধার্মিকতা এসে হানা দিয়েছে তাহিয়ার মাঝে ও। রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়েছে। রোযা ও রেখেছে।
সকাল হতেই অযু করে জায়নামাজে বসেছে। সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলল এখনো উঠে নি। পুরো জীবনে না পড়া নফল নামায আজ পড়ে ফেলছে। ফার্স্টক্লাস আসতেই হবে ওর। না আসলে ওর আশা স্বপ্ন সব ভেস্তে যাবে। খুশিমনেই সেদিন অভীকের অফার লুপে নিয়েছে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছে,
‘ তুমি ফ্যামিলি ম্যানেজ করো। ফার্স্টক্লাস আনার দায়িত্ব আমার। ‘

এর পর নতুন উদ্যমে পড়া শুরু করেছিল তাহিয়া রাত দিন পড়ে পরীক্ষা দিয়েছে। বেশ ভালো হয়েছে পরীক্ষা। ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট বেরিয়েছে মাস খানেক আগে। দুটো সাবজেক্টে বি গ্রেড এসেছে। রেজাল্ট পেয়ে অভীক হেসে বলেছে,
‘তুমি ভীষণ স্বার্থপর হিয়া।’

তাহিয়া এমনটা বলার কারণ জানতে চাইলে বলে,
‘আমি এত কষ্ট করলাম, পড়লে না। যখন নিজের লাভের কথা বললাম। ওমনি পড়ায় মনোযোগী হলে, আর বি গ্রেড ও নিয়ে এলে!’

তাহিয়া তখন রাগের ভান করে বলে,
‘স্বার্থপর না হওয়ার জন্য পড়ালেখা ছেড়ে দিব?’

অভীক ওর গাল টেনে হেসে বলেছিল,
‘ কিছু সময় স্বার্থপর হতে হয়। তোমার স্বার্থে আমার শেয়ার আছে। আমি আমার শেয়ার হারাতে চাইনা। ছাড়তে হবে না, চলুক স্বার্থপরতা।’

এখন অপেক্ষা শুধু থার্ড ইয়ারের। ফার্স্টক্লাস না এলে কী হবে! আরও দু’বছর অভীকে ছাড়া থাকতে হবে! অসম্ভব। ফার্স্টক্লাস ও পাবেই। মাগরিবের আযান পড়ছে চারদিকে। বোন রোযা রেখেছে শুনে তুহিন বোনের জন্য ওর পছন্দের চিকেন ফ্রাই, বার্গার নিয়ে এসেছে বাইরে থেকে। মাহমুদা প্লেটে বেড়ে খেজুর, শরবত নিয়ে মেয়ের রুমে গেলেন। তাহিয়া রক্তশূন্য চেহারায় হাত চেপে জায়নামাযে বসে আছে। মাহমুদা হাসলেন। মেয়ের পড়ালেখার প্রতি অনুরাগী ভাব তাকে প্রতিনিয়ত অবাক করে চলেছে। ভেতরটা খুশিতে ভরে যায়, অভীককে ধন্যবাদ দিয়েছেন হাজার বার। এত বছরে কত চেয়েছেন মেয়েকে পড়ায় মনোযোগী করতে, পারলেন না। অভীক একমাসেই একবারে প্রথম শ্রেনীর ছাত্রীতে রূপ দিল! কিভাবে এই অসাধ্য সাধন হলো তা আজোও রহস্য। দুজনের কেউ মুখে খুলে না, জিজ্ঞেস করলেই হাসে শুধু।

মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলালেন। কোমল স্বরে বললেন,
‘তুই পরীক্ষা ভালো দিয়েছিস। ফার্স্টক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস যে কোন একটা চলে আসবে। ফেইল আসার সম্ভাবনা নেই। চিন্তা করিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। আযান দিয়েছে, এখন ইফতার কর। কিছু মুখে তোল।’

তাহিয়া মাথা তুলল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক চিমটি পরিমাণ খেজুর কামড়ে নিল। পানি খেয়ে খাওয়ার পর্ব সমাপ্তি ঘোষণা করল এরপর। মাহমুদা এত চাইলেন আর কিছু মুখে দিতে পারলেন না। এত ভয়ের মাঝে গলা দিয়ে খাবার নামে? মাহমুদা হতাশ মনে চলে গেলেন।

তাহিয়া তড়িৎ উঠে নামাজে দাঁড়াল। অনেক সময় নিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ল। মোনাজাতে কান্নাকাটি ও করল। তারপর নফল নামাজ পড়ল। জিকির করল। সবশেষে কাঁপা হাতে ফোন হাতে নিল। অভীক রেজাল্ট জানানোর জন্য কল দিবে। ওর কল এলো কি না দেখাটাই উদ্দেশ্য। নাহ্, কোন কল আসে নি, আর না ম্যাসেজ। পাঁচটায় রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার কথা। এখন ছ’টা তেরো বাজে। অভীকের হাতে ওদের ক্লাসের সবার রেজাল্ট চলে আসার কথা এতক্ষণে। আসলে ওকে ফোন করে জানায়নি কেন অভীক? আবার ফেইল করে বসল না তো! আল্লাহ মাফ করো! আতঙ্ক বিরাজ করল তাহিয়ার মনে।

‘ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জালিমিন। হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল নিমাল মাওলা ওয়া নি’মান নাসির। ইন্নামা আশকু বাস্সি ওয়া,হুজনি ইলাল্লাহ।…
আতঙ্কিত মনে যা দোয়া আসছে সব পড়ে যাচ্ছে তাহিয়া। এরমাঝে কলিংবেলের বাজল। শব্দটা কানে আসতেই আবার কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামিতে মাতল তাহিয়ার শরীর। অভীক এসেছে নিশ্চিত। রেজাল্ট নিয়েই এসেছে। যদি খারাপ রেজাল্ট হয়! মুখ দেখাবে কিভাবে অভীককে, কত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছে ফার্স্টক্লাস পাবেই। না পেলে?

দরজা খুললেন মাহমুদা । শ্বাশুড়িকে দেখে অভীক বিনম্র স্বরে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছেন? ‘

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমি ভালো আছি। তুই ভালো আছিস? ‘
মাহমুদা হাসলেন। ‘আন্টি’ থেকে ‘মা’ ডাক এর পরিবর্তনটা মাহমুদাকে আনন্দ দেয়। এর পরপর উদ্ধিগ্ন স্বরে রেজাল্ট জানতে চাইলেন। অভীক রেজাল্ট জানাল। ওর দু’হাত ভর্তি প্যাকেট। ডান হাতের প্যাকেট গুলো ভেতরে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখল।
মাহমুদা অভিযোগের সুরে বললেন,
‘ রোযা রেখেছে তোর বউ। সারাদিন জায়নামাজে বসা, ইফতারটাও করল না। এক চিমটি খেজুর মুখে নিয়েছে শুধু। না খেয়ে, এত চিন্তা মাথায় নিয়ে জ্ঞান হারাবে যে কোন সময়। তুই একটু দেখ তো বাবা।’

অভীক হেসে বলল,
‘মা, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি। ‘

অভীক শ্বাশুড়ির সাথে আলাপচারিতা শেষে স্ত্রীর শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। রুমে গিয়ে তাহিয়াকে জায়নামাজেই পেল। হাত দুটো পিছু লুকিয়ে রুমের মাঝে দাঁড়াল। তাহিয়া ওর উপস্থিতি টের পেয়ে তৎক্ষনাৎ জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘ররেজ্জাল্লট..
স্বর জড়িয়ে এলো। কথা বের হলো না। ওর পুরো গা থরথর করে কাঁপছে। অভীকের মুখটাও গম্ভীর। উত্তর দিল না। দাঁড়িয়ে রইল। তাহিয়ার চিন্তা বাড়ল। কাঁপা গলায় বলল,
‘পাশ আসেনি? রেজাল্ট কী? কী এসেছে বলো না? ‘

তাহিয়ার চেহারা রক্তশূন্য। ওর অবস্থা অনুযায়ী, যে কোন সময় উচ্চ রক্তচাপের জ্ঞান হারাবে। অভীক রহস্যজাল বাড়াল না। তবে সরাসরি উত্তর ও দিল না। লুকানো হাতে দুটো প্যাকেট। একটা শপিং ব্যাগ। শপিং ব্যাগ হাতড়ে কিছু একটা নিল। তারপর ব্যাগগুলো মেঝেতে রাখল। হাতে নেয়া জিনিসটা সামনে আনল। লাল টুকটুক জামদানী শাড়ি।

শাড়িটার ভাজ খুলে তাহিয়ার মাথায় ঘোমটা টেনে বলল,
‘ বিয়েতে বেনারসি পরতে হবে কথা নেই। এই শাড়ি হালকা আছে, পরতে আরাম হবে। তোমার অস্বস্তিবোধ হবে না। তুমি এই শাড়িটা পরবে। বউ আমার, আমার কাছে লাগলেই হবে। আর কারো কাছে লাগতে হবে না। ‘

তাহিয়া উত্তর দেয়ার অবস্থায় নেই। ও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনা বুঝে উঠতে পারছে না ও। একবার অভীকের দিকে তাকাচ্ছে, একবার শাড়ির দিকে। না বুঝে প্রশ্ন করল,
‘রেজাল্ট কী বলো না? আমি কি ফার্স্টক্লাস পাইনি?’

অভীক হেসে বলল,
‘না পেলে বিয়ের কথা আসছে কোথা থেকে?’

তাহিয়া অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। চোখ মুখে আনন্দ চিকচিক করছে, ‘সত্যি!’

অভীক মুখ বাঁকাল,
‘ তুমি মহিলাটা সুবিধার না। মানলাম, বরকে ভালোবাসা, চোখে হারাও, তার সংসারে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছো। থাকতেই পারো, তোমারই সংসার। তুমি যাবে না কি যাবে না তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তার জন্য তুমি আমাকে যেই ধাক্কাটা দিলে, তাতে আমি তো অক্কা পেয়ে বসেছিলাম। হায়াত ছিল বলে বেঁচে ফিরেছি। এখন বলো আমার দোষটা কী ছিল?’ আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল অভীক। তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল,
‘কী করেছি আমি?’

‘কী করোনি সেটা বলো। স্বামীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে একবারে ডিপার্টমেন্ট টপ করে গেলে! থ্রী পয়েন্ট সিক্স ফাইভ! রেজাল্ট দেখে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম। বিশ্বাস হয়নি, দ্বিতীয়বার চেইক করে তারপর বিশ্বাস হলো। কী সাংঘাতিক কান্ড বাধিয়েছো হিয়া!’

অভীকের স্বরে মুগ্ধতা। তাহিয়ার নিজের ও বিশ্বাস হলো না। ইংরেজিটা সে ভালো পারে, রাত দিন এক করে পড়েছে। বলতে গেলে সারাদিন পড়ায় ডুবে ছিল। অভীক ও দিন রাত ওকে গাইড করেছে। তবুও এত ভালো রেজাল্ট আশা করেনি! ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘তুমি মজা করছো না তো!’

‘মজা করব কেন পাগলী! সত্যি বলছি।’ অভীক মার্কসিট দেখাল। এ পর্যায়ে বিশ্বাস হলো তাহিয়ার। অভীক ওর কপালে ঘাম মুছে অধর ছুঁয়ে বলল,
‘আই প্রাউড অফ ইউ হিয়ারানী।’

তাহিয়ার কপাল থেকে চিন্তার ভাজ সরল। কাঁপুনি বন্ধ হলো, বিন্দু ঘামের আগমন রুখে গেল। তার পরিবর্তে চেহারায় খেলে গেল উৎফুল্লতা। রাজ্যের খুশি হানা দিল, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে ও। খুশিতে অভীককে জড়িয়ে ধরল। বিজয়ী স্বরে বলল,
‘আমি পেরেছি।’

অভীক হাসল,
‘একজন পরাজিত সৈন্য কখনো জয়ের আনন্দ অনুভব করতে পারেনা। নিজেকে জয়ী স্থানে দেখার যে আনন্দ, এটা কেবল জয়ী মানুষই জানে। অমনোযোগী হলে এই আনন্দ পেতে কোথায়? আজ চেষ্টা করেছো বলেই পেরেছো। এভাবে জীবনের প্রতিটা পথ পাড়ি দিবে, আত্মবিশ্বাসের সাথে। আমাকে সবসময় পাশে পাবে।’

তাহিয়া কৃতজ্ঞ স্বরে বলল,
‘তোমার মতো সঙ্গী থাকলে আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ ও বিশ্বজয় করতে পারে। আমার সফলতার অনেকটাই ভাগিদার তুমি। অনেক ধন্যবাদ অভী।’

অভীকের মনে হচ্ছে, রেজাল্ট ওর দিয়েছে, ওই ডিপার্টমেন্ট টপ করেছে। এত আনন্দ লাগছে। প্রিয়জনের সফলতার টান বুঝি এমনই হয়। আনন্দে তাহিয়ার চেহারা যেমন রাঙিয়েছে, অভিকের চেহারাটা যেন তার চেয়ে বেশি রাঙানো। অভীক হাসল আবার। প্রশংসা গায়ে মাখানো যায় না, উড়িয়ে দিতে হয়।
ও প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘হিয়া, তোমার খুশির কারণ ডিপার্টমেন্ট টপ করা না কি শ্বশুরবাসায় যাওয়ার সুযোগ পাওয়া। কোনটা?’

‘অবশ্যই রেজাল্ট। শ্বশুরবাসায় যাওয়ার জন্য মুখিয়ে নেই আমি।’ মাথা উঠিয়ে ভেংচি কাটল তাহিয়া।

অভীক ভ্রু নাড়াল,
‘ ভেবেছিলাম আজ দুই মায়ের সাথে আলাপে বসব। এখন দেখছি সেটা বাতিল করতে হবে। বউ তো যেতে মুখিয়ে নেই, বলে কী হবে!’

তাহিয়া চোখ রাঙাল, ‘ একদম না। আমি আমার সংসারে যাব। তুমি বাধা দেয়ার কে? ‘

অভীক অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কেউ না!’
তাহিয়া ভুবনমোহিনী হেসে বলল,
‘তুমিই তো সব। আজই কথা বলো প্লিজ! আমি এক বছর যাবত দিন গুনছি, কবে আসবে এইদিন। অবশেষে এসেছে। ভাবতেই খুশি লাগছে।’

তাহিয়ার কথায় না কি হাসিতে কে জানে অভীকের হাসি গাঢ় হলো। দিন তো সেও গুনছিল। প্রতিটা নামাযে দোয়া করেছে প্রিয়তমা যাতে ফার্স্টক্লাস পেয়ে যায়। ঘরের বউ ঘরে ফিরুক, দুটো মন পাশাপাশি থাকুক। এভাবে দৌড়াদৌড়ি আর কত! হুট করেই মনটা ছুটেছে অন্য পথে। মনের এই ছোটাছুটিটা সাংঘাতিক। দিনের ওই এক দুই ঘন্টার দেখাদেখি কী আর পুষে? মনটা সারাক্ষণ চায় প্রেয়সীকে। মেয়েটা থাকুক সামনে, এক কাপ চায়ে রাত বিরাতে আলাপ হোক, বুকের মাঝখানটা মেয়েটার রাতের বালিশ হোক, সকালে চোখ খুলতেই শ্যামাঙ্গিনীর মুখটা সামনে পড়ুক, ফোনালাপটা মুখোমুখি আলাপনে রূপ নিক, হিয়া ওর বৃষ্টিভেজার সঙ্গী হোক, ছুটির দিনটায় অনাড়ী হাতে রান্না করুক দুজন, রাতে দেরিতে বাড়ি ফিরলে মা বাবার সাথে সাথে একটা চিন্তিত মুখ চোখে পড়ুক। শেষ রাতে কাউকে জাগিয়ে বলা যাক, চলো আজকের সূর্যোদয় দেখি পাশাপাশি বসে। আজকাল মনটা এমন হাজার আবদার করে বসে। আবদার পূরণের জন্য হলেও তাহিয়াকে যেতে হবে ওদের ঘরে, সংসারে, বাকি জীবনের আপন নীড়ে। প্রতিদিন সকালে উঠেই ক্যালেন্ডারের চোখ বুলাত একবার। সময়টা এগুচ্ছে না কেন? তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাক। রেজাল্ট পাওয়ার পর থেকে খুশিতে আত্মহারা অভীক।
মেয়েরা সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু ছেলেরা পারে না। ওদের যেন অন্যকে মন খুলে দেখানো নিষেধ। এই যে মনে চলা শত উৎফুল্লতা অভীক মুখ অবধি নিয়ে আসতে পারছে না। সরাসরি বলতে পারছে না,
‘আমি ও অপেক্ষার প্রহর গুনেছি প্রতি নিয়ত।’

ওকে কথায় নয়, একটা হাসিতে প্রকাশ করতে হচ্ছে মনের ভাব। অভীক হাসল প্রাণবন্ত। তাহিয়াকে অন্তর্ভেদী চাহনিতে পরখ করল। কোমল স্বরে পরোক্ষভাবে উত্তর দিল,
‘ এই শাড়িটায় তোমার দারুণ মানিয়েছে হিয়া। বউ বউ একটা ভাব চলে এসেছে। বউ বউ ভাব যেহেতু এসে গেছে তাহলে দেরি কেন, তুমি এখনই চলো আমার সংসারে।’

তাহিয়া কি সত্যিই ভেবে নিল? আনন্দিত গলায় বলল,
‘ দাঁড়াও, আমি শাড়িটা পরে আসি। তুমি বরং মাকে গিয়ে বলো।’

অভীক শব্দ করে হেসে বলল,
‘মজা করছি পাগলি। আমি তোমাকে লুকিয়ে নয়, বর সেজে লোক জানিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাব আমার ঘরে। জীবনে এই একটাই বিয়ে, একটু স্মৃতি না রাখলে হয়!’

তাহিয়া ভেংচি কাটল,
‘এভাবে যাচ্ছে কে? আমি তো মজা করেছি।’

তাহিয়াকে বললে তাহিয়া এভাবে এখনই চলে যাবে, এটা অজানা নয় অভীকের। পাকড়াও করা সত্যটা প্রকাশ করল না। কিছু সত্য গোপনই সুন্দর। হেসে বলল,
‘ আর মাত্র সপ্তাহখানেক। তারপর তুমি আমার ঘরে, আমার স্ত্রী হয়ে থাকবে সারাক্ষণ, সারাজীবন। তুমি কি প্রস্তুত? ‘

‘ ভীষণভাবে প্রস্তুত। ‘
‘তা কোন কোনভাবে প্রস্তুতি তুমি?’ অভীকের ঠোঁটে অর্থবহ হাসি। তাহিয়া কিল বসাল বুকে,
‘অভদ্র। ‘

অভীক তাহিয়ার মাথার পেছু হাত রাখল। টেনে আনল কাছে, অনেক কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, গভীর স্বরে,

‘ শ্যামাঙ্গিনীর আমন্ত্রণ পড়েছে আমার ঘরে,
খেয়ালরা উপচে পড়ছে তার রূপের ঝলকে।
সে চলুক আমার সনে,
বসত করুক আমার ঘরে,আমার মনে
আজ, কাল, পরসু এবং সারাজীবন।
খেয়ালরা ঠিকানা পাক, নিয়ন্ত্রণহারা হোক
সম্পর্ক গড়াক সংসারে,
প্রিয়তমা ফিরুক তার নীড়ে।
মিষ্টি ঝগড়া হোক মাঝেসাঝে,
রাগ ঝরুক প্রেমের আভাসে,
আলতো স্পর্শে, প্রেমোদ্দীপকে।

সংসারটা হিয়ারই, সামলানোর দায়িত্বটাও।
আমি মানুষটাও বা পর কিসের?
সংসারের সাথে অভদ্র আমিটাকে ও সামলে নিও না হয়!
কখনো রাগার ভান করে,
কখনো লাজুক হেসে।
হাজার ছবিহীনা ফ্রেম আটকে আছে আমার সংসারের দেয়ালে,
চলো আমার সংসারে,
স্মৃতিরা উঠুক ফ্রেমে, পূর্ণতা আসুক পরিবারে।
খুব কি ক্ষতি হবে?
আমার সনে আমাদের ঘরে গেলে? ‘
[©আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা]

অভীকের স্বরটা এমনিতেই গভীর। তার উপর যখন মুখে ছন্দ টানে তখন স্বরের গভীরতা ঠিকানাহীন হয়ে যায়। স্বরটা কান হয়ে সোজা চলে যায় হৃদপিন্ডে। স্পন্দন বেড়ে যায়, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে, লাজুকলতা ছুঁয়ে যায় গাল। মন হারায় ভালো লাগায়। প্রতিবারই এমন হয়। লোকটা চমৎকার, তার সবকিছুই চমৎকার। এই যে এখন সংসারে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব রাখল, এর ধরণ ও কতটা চমৎকার, প্রেমোদ্দীপক। এমনভাবে বললে কে না করবে? কার এত সাধ্য? ওর তো নেই, একবারেই নেই। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসার বাতাস গায়ে মাখিয়ে তাহিয়া হাসল, প্রাণবন্ত, লাজুক।
কোমল স্বরে বলল,
‘ক্ষতি নয়, লাভ হবে। লাভটা একটু বেশিই। আমার বারণ কিংবা আপত্তি নেই। মনের সায় আছে নিঃসন্দেহে। ‘

‘সামলে নিও অভদ্র হলে। খেয়ালের মানচিত্র পড়ার দায়িত্ব এবং দায়ী দুটোই কিন্তু তোমার কাধে। ‘ সেই হাসি। তাহিয়াও কপট রেগে চোখ রাঙাল। খুনসুটি চলল, চলতে থাকল। কিছুক্ষণ, বহুক্ষণ। মাঝে অভীকের আনা কেক খাওয়াও হলো। প্রেমে হোক না অন্ধ, প্রিয়তমার খেয়াল রাখা বাদ যাবে কেন?

লাল শাড়িতে টুকটুক বউ হেটে যাচ্ছে লাল গালিজা বিছানো পথ ধরে। গন্তব্য কনভেনশন হলের স্টেজ। সেখানে পাতানো সোফায় বসে আছে মেরুন শেরওয়ানিতে এক হলদেটে যুবক। মাথায় পাগড়ি, বুকে ব্রুজ, ঠোঁটে হাসি। দৃষ্টি তার দিকে হেটে আসা নারীর পানে। মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। রূপে বাষ্প হচ্ছে ও। চোখ ধাঁধানো সুন্দর। সে উঠে দাঁড়াল, পা বাড়াল সামনে। প্রিয়তমা তখন স্টেজের সিড়ির কাছে। কয়েক কদম এগিয়ে হাত বাড়াল প্রেয়সীর পানে। আলতো গলায় বলল,
‘হাতে হাত রেখে উঠে এসো হিয়ারানী।’

কনেটা বরাবরই সুবিধাবাদী। তার দিকে আসা কোন সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করেনা, তড়িৎ লুফে নেয়। এই যে এখন সুযোগটা লুফে নিল। বরটা আলতো স্পর্শে প্রিয়তমাকে সিড়ি দিয়ে উঠাল, হাঁটা ধরল স্টেজের দিকে।

কনে প্রাণচঞ্চল গলায় বলল,
‘ তোমার ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে অভী। এতটা সুন্দর লাগা উচিত হচ্ছে না, একদমই না। কতগুলো মেয়ে চারদিকে, কিভাবে তাকিয়ে আছে! আমার রাগ লাগছে। এভাবে এত মেয়ের সামনে আসা উচিত হয়নি তোমার। আমারই নজর লেগে যাচ্ছে, বাকিদের কী নিশ্চয়তা দিব! ‘ তাহিয়ার স্বরটা হিংসা মাখানো।

অভীক প্রিয়তমাকে সোফায় বসিয়ে নিজে বসল পাশে। হাতে হাত রেখে বলল,
‘ আমার কারো নিশ্চয়তার দরকার নেই। তোমার নিশ্চয়তা পেলেই হবে, ওটাই হাজারজনের উপর ভারি পড়বে। অবৈধতায় চোখ যায়না আমার, বৈধতায় আটকে ছিল, আছে। ভীষণভাবে, ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ‘

তাহিয়ার মন মানল না। হাজার হোক স্ত্রী শ্রেনীর মানুষ। সঙ্গীকে নিয়ে ভয়ে থাকা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। তাহিয়া সূরা নাস, ফালাক, ইখলাস পড়ে ফুঁ দিল অভীকের মুখে। তিন কূল বদ নজর এড়ায়। তারপর হাফ ছেড়ে বলল,
‘এবার আল্লাহ রক্ষা করবেন। জামাই সুন্দর হওয়া মানেই বউদের চিন্তার পাহাড় নিয়ে ঘুরা। এই বুঝি নজর লেগে গেল! ছেলেদের এত রং রূপ ভালো না। কম হওয়া ভালো। এত চিন্তা নিয়ে ঘুরা যায় নাকি! এই যে বউ সেজে বসে ছবির চিন্তা না করে বরের চিন্তা করছি আমি! ‘

অভীক তাহিয়ার পাগলামো দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল। বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘পাগলী! কীসব ভাবছে। ও তো জানে না, আমি হিয়াতে কতটা আটকে আছি। বের হতে পারলেই তো কারো নজরে নজর দিতে পারব। এ জীবনে বের হওয়ার কোন সম্ভবনা তো দেখছিনা। ‘

কোমল স্বরে বলল,
‘ সুন্দর লাগছে তোমায়, যতটা আমার ভাবনায় ছিল না। মাশা আল্লাহ। ‘

তাহিয়া হেসে বলল,
‘আমার সৌন্দর্য সার্থক। এবার আমার দিকেই তাকিয়ে থাকো।’

ফটোসেশান শুরু হলো। প্রথমে কাপল তারপর আত্মীয় স্বজন এলো। পরিবারের পর তাহিয়া তার দুই বান্ধবীকে ডাকল। মীরা শৈলী যেতে নারাজ। অভীকের পাশে বসে ছবি তুলবে! অসম্ভব! তাহিয়াও নাছোড়বান্দা। বান্ধবীদের সাথে ছবি তুলেই ছাড়বে। নিজে স্টেজ থেকে নেমে এলো। ধরে নিয়ে গেল দুই বান্ধবীকে। মীরা বসেছে অভীকের পাশের সোফায়। বসে বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়ল। ফটোগ্রাফার হাসতে বলল। এত অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে হাসি আসে? ওর আসল না। কোনমতে কয়েকটা ছবি তুলে উঠে গেল।

তাহিয়ার পিছনে গিয়ে কানেকানে বলল,
‘তোর বিচার করবে আল্লাহ। আর পাত্র পেলি না, এই জাঁদরেল স্যারকেই বিয়ে করতে হলো তোর। ভয়ে গেটে যেতে পারিনি। যেন ফিতা ধরতে গেলে, ধমকে উঠবে। বিশ হাজার টাকার একটা টাকাও আমি পাইনি। তোর কারণে। বেয়াদব! কত আশা ছিল তোর বিয়েতে রঙ ঢং করে ছবি তুলব। তা আর হতে দিলি কই? এক জাঁদরেলকে বিয়ে করেছিস। আমাকে দিয়েছিস পাশে বসতে। বসে আমার অন্তরাত্মা কাঁপছে এখনো। মনে হচ্ছিল এই বুঝি সিংহী অবতার নিয়ে বলে উঠবে, ‘স্যান্ড আপ। এই অফ হোয়াইট শাড়ি পরা, আপনি। দাঁড়ান বলছি। ম্যানারস শিখেননি? শিক্ষকদের দেখে যে সালাম দিতে হয় জানেন না? শিক্ষকদের পাশে বসতে হয়না জানেন না? বিশ্বাস কর, ভয়ে বুক কাঁপছিল। আমার একটা ছবি ও ভালো আসবে না। তোর কারণে, বেয়াদব। তোর বরকে আমাদের কলেজে শিক্ষকতা না করলে কী হতো। সব আনন্দ মাটি। ধ্যাৎ! তোর মতো বান্ধবী শত্রুর ও না হোক। বেয়াদব।’

তাহিয়া হেসে উঠল খিলখিল করে। বলল,
‘তোর না স্যারের প্রতি টান আসছে। এই তার প্রমাণ!’

মীরা বলল, ‘সূর্যকে দূর থেকেই দেখতে সুন্দর লাগে। কাছে গেলেই ঝলসে যেতে হয়। আমার এত শখ নেই ঝলসে যাওয়ার । তুই জ্বলে পুড়ে মর। ‘

‘অভীকে বলে দিই?’ তাহিয়া মুখ চেপে হাসছে।

‘থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব। বিয়ের আনন্দ মাটি করে শান্তি হয়নি, এখন জীবন নিতে বসেছিস! ‘ চোখ রাঙাল মীরা। তাহিয়া আবার হাসল। অভীক পাশ থেকে বলল,
‘কেমন আছো শালিকা?’

মীরা তড়িৎ দাঁড়িয়ে গেল। থতমত খেয়ে উত্তর দেয়ার বদলে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
‘এখানে তোমাদের স্যার নই। স্যার ডেকোনা।’

তাহিয়া ফোঁড়ন কাটল, ‘দুলাভাই ডাকবি। দেখি ডাক তো।’

মীরা বিড়বিড় করল, ‘স্যার ডাকতেই কাঁপুনি ধরছে, আবার নাকি দুলাভাই ডাকব। অসম্ভব। ‘
মুখে বলল,
‘পরে কখনো ডাকব। এখন আসি। মা ডাকছে আমায়।’ দ্রুত নেমে গেল মীরা। শৈলী ওর পিছু নিল। স্টেজ থেকে নেমে হাফ ছাড়ল।

এরপর স্টেজে গেল রিনা। আজ মেজেন্টা লেহেঙ্গা পরেছে। সুন্দর লাগছে। দেখে বুঝার উপায় নেই ও মাহমুদার হেপিং হ্যান্ড। মাহমুদার রিনাকে এভাবেই দেখতেই ভালো লাগে। নিজে পছন্দ করে কিনেছেন। বর কনের সাথে ছবি তুলল রিনা। তারপর অভীকের উদ্দেশ্যে আবার গাইল সেই পুরনো গান,
‘দুলাভাই দুলাভাই ও আমার দুলাভাই,
চলো না সিনেমা দেখি যাই,
সিনেমার নাম না কি তোমাকে চাই দুলাভাই। ‘

থেকে অভিযোগের সুরে বলল,
‘দুলাভাই সিনেমা দেখাইতে নিয়া গেলা না। কবে নিয়া যাইবা?’

অভীক আজ বিব্রতবোধ করল না। হেসে বলল,
‘তোমার আপাকে জিজ্ঞেস করো। এই সিদ্ধান্তটা ওর।’

রিনা তাকাল তাহিয়ার দিকে। তাহিয়া বলল,
‘ খুব শীঘ্রই। তবে শর্ত হলো সাথে দুলাভাই আপা দুইজনেই যাবে। আপা কোনভাবে দুলাভাইকে একা ছাড়বে না। ‘

রিনা বেশ খুশি হলো এতে। খুশিমনে নামল স্টেজ থেকে। সময় গড়াল। এলো বিদায় মুহুর্তে। বড্ড আদর আর দুঃখ কষ্টের মাঝে একা মানুষ করা মেয়েটা আজ পরবাসী হবে। এতদিন মাহমুদার মেয়ে হিসেবে ছিল, আজ থেকে থাকবে অভীকের স্ত্রী পরিচয়ে। হলে এসেছে মাহমুদার মেয়ে হয়ে। অথচ কাল বাবার বাড়িতে আসবে অভীকের স্ত্রী হয়ে! মেয়ের উপর আর অধিকার থাকবে না। মেয়েটাকে যখন তখন চোখের সামনে পাবেন না। প্রতিদিন একসাথে খাওয়া হবে না, কেউ আর বায়না ধরবে না। ঘরটা কারো হাসিতে মেতে থাকবে না। আসবে কালে ভাদ্র, অতিথি হয়ে। গৃহস্থ হয়ে আর আসবে না। এই মেয়েকে ছেড়ে থাকতে হবে তার, অনেকদিন, অনেকমাস। কিভাবে থাকবেন! মেয়েকে কিছুক্ষণ না দেখলেই অস্থির লাগে। সেই মেয়েটাকে আজ থেকে দেখবেন না। কীভাবে থাকবেন তিনি! এত বছরে তো থাকেন নি। বুকটা পেটে যাচ্ছে মাহমুদার । গত দু’দিন ধরে মেয়ের অগোচরে কেঁদে যাচ্ছেন। আজ মেয়েকে বউ বেশে দেখেই কাঁদছেন। বিয়ে দিতে হবে বলে দেয়া, সম্ভব হলে মেয়েকে রেখেই দিতেন তিনি । বিদায় এত কষ্ট কেন? মেয়েদের কেন পর হতে হয়? আপন হয়ে বাবার বাড়িতে থাকার নিয়ম নেই কেন?

কন্যা সম্প্রদানের জন্য মাহমুদাকে ডাকছেন ফিরোজ খান। মাহমুদা গিয়েছেন ঠিকই। মেয়ের হাত ধরেই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছেন। আবেগী তাহিয়ার চোখ ফেটে জল গড়াল। এত বছরের বাবাহারা জীবনে কষ্ট ওর ও কম না। এ কষ্ট কখনো মুক্তি পায়নি। আজ মুক্তি পেল। এই মানুষটা ওর বটবৃক্ষ। যে আগলে রেখেছে ওকে। এই মানুষটাকে ও ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের বুকে মাথা রেখে মনে হলো, এত তাড়া সংসারের যাওয়ার বায়না ধরাটা ঠিক হয়নি। মায়ের কথা ভাবা হয়নি। অন্তত আরও দুটো বছর থাকা যেত। মায়ের মেয়ে হয়ে। যখন তখন মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানো যেত।

কান্নার জন্য কিছু বলতে পারলেন না মাহমুদা। চার হাত ও এক করতে পারলেন না। চলে গেলেন স্টেজ ছেড়ে। একটা নিরিবিলি জায়গায় দরকার, একটু কাঁদার জন্য। তুহিন মাকে নিরিবিলি জায়গায় বসিয়ে এলো। স্টেজে উঠে কন্যা সম্প্রদানের দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নিল।

ছেলেরা জন্ম থেকেই দায়িত্ববান। ভাইয়েরা হাটতে শেখার আগে বোনের দায়িত্ব নিয়ে শিখে যায়। অভীক ও শিখে গেছে, হয়তো প্রকাশ্যে আনা হয়নি। আজ আনল। চার হাত এক করে অভীকের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ আমি নিশ্চিন্ত, আপনি আমার বোনটাকে ঠিক সামলে নিবেন সারাজীবন। ভীষণ সুখে রাখবেন। আমাদের ঘরের সুখতারা তুলে দিচ্ছি আপনার হাতে। খেয়াল রাখবেন। কষ্ট দিবেন না। আমি সহ্য করতে পারব না। এখন যেমন সুখী দেখছি, আমার বৃদ্ধবয়সে ও আমার বোনটাকে এমন খুশি দেখতে চাই। তবে, কখনো যদি আমার বোনকে বোঝা মনে হয়, আমার জানাবেন। আমি নিয়ে আসব। আমার বোন কখনো আমার কাছে বোঝা হবে না, পর হবে না।’

অভীক হাসল। তুহিনের হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাস দিল,
‘ লাঠি ভর দিয়ে কোন একদিন তোমার বাসায় নিয়ে যাব তোমার বোনকে। সেদিন জিজ্ঞেস করো, ওর সুখের কথা। ইনশা আল্লাহ উত্তরটা ইতিবাচকই পাবে। চিন্তা করো না। নিশ্চিন্ত আছো, থাকো।’

তুহিন হাসল। অভীকের হাত ছাড়ল। শুধু বোনের হাতদুটো ধরল। বলল,
‘ বিয়ে হয়ে গেছে মানে পর হয়ে গেছিস এমনটা ভাববি না। যখন ইচ্ছে হবে চলে আসবি, আমরা ঝগড়া করব। আগলে রাখার কেউ না থাকলে আমাকে একটা ডাক দিস। আমি সর্বদা প্রস্তুত। অনেক ভালো থাকিস। সুখে থাকিস। বাবা নেই বলে নিজেকে অসহায় ভাববি না। আমি সবসময় তোর পাশে আছি, থাকব। সুখে পাশে না রাখলেও দুঃখে পাশে রাখিস। একটা ডাক দিস। আমি হাজির হব। দু’দিন পর পর চলে আসিস। তোকে সাথে ঝগড়া না করলে ভালো লাগেনা আমার।’

স্বর কাঁপল তুহিনের। আজ কেন যেন তাহিয়ার একটু বেশি আপন মনে হলো তুহিনকে। মনে হলো বাবা থাকলে তিনিও আজ এসব বলতেন। বাবার প্রতিচ্ছবি চোখে ভাসল। ভীষণ টান কাজ করল। ভাইকে জড়িয়ে ধরে থেমে রাখা কান্না আবার ঝরাল। তুহিন আগলে নিল বোনকে। চোখ ভিজল ওর, কয়েক ফোঁটা বোনের কাধে ও পড়ল। এত আস্তর পেরিয়ে সেই অশ্রু কাধ স্পর্শ করতে পারল না, তাহিয়াও টের পেল না। তুহিন বোনের অগোচরে মুছে নিল অশ্রু বিন্দু। তাহিয়া কেঁদে কেঁদে বলল,
‘আজ থেকে তোর মুক্তির দিন। কেউ তোর সাথে ঝগড়া করবে না। রিমোট কেড়ে নিবে না, টাকায় ভাগ বসাবে না, ঘুম ভাঙিয়ে চকলেট আনতে বাইরে পাঠাবে না, মারার হুমকি দিবে না। আজ থেকে তোর শান্তি। তুই তো ভীষণ খুশি তাই না।’

তুহিন বিড়বিড় করল, ‘কিছু মুক্তিতে শান্তি মিলে না। আমার ও মিলবে না। তুই নিজেও জানিস না তোকে কত ভালোবাসি আমি। তোকে ছাড়া থাকার অভ্যাস নেই আমার। শুধু আমিই জানি , সেবার তুই যখন অভীক ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলি, তিনটা দিন কতটা কষ্টে পার করেছি আমি। ঘরটা মরুভূমির মতো লাগতো, যেন কিছুই নেই, কেউ নেই। খারাপ লাগতো। তোর সাথে ঝগড়া না করলে দিন কাটেনা আমার। সেবার তিনদিন থাকতে এত কষ্ট হয়েছে। এরপর মাসের পর মাস কিভাবে থাকব! ভীষণ কষ্ট হবে। যাস না আপু! থেকে যা। আমার বোন হয়ে থাক। আমি টিউশন করে বেশ টাকা আয় করি, তোর খরচটা ঠিক চালিয়ে নিতে পারব। ‘

মনের কথা মুখ অবধি এলো না। মনেই রয়ে গেল। বলা হলো না। মুখে বলল,
‘ ভীষণ খুশি। তবে তোর সাথে ঝগড়াকে মিস করব। অভ্যাস হয়ে গেছে। চলে আসিস যখন তখন। ‘

তাহিয়াও বলল,
‘তুই মায়ের কথা শুনবি। রিনার সাথে ঝগড়া করবি না। রাত করে বাসায় ফিরবি না। রুমটা একটু গুছিয়ে রাখিস। অনেক অনেক ভালো থাকিস। আমি তো বউ, যখন তখন আসতে পারব না। তুই চলে যাস, আমাকে দেখে আসিস।’

আবেগীয় সংলাপের পর বিদায় হলো। একঘরে শূন্যতা ঢেলে অন্যঘরে পূর্ণতা নিয়ে গেল। এটাই বাস্তবতা। একটা মেয়েকে কত কী উৎসর্গ করতে হয়, ছোটো থেকে বড়ো হওয়া রুমটা, আদর দিয়ে মানুষ করা পবিরার, নিজ ইচ্ছে চলা জীবন সব ছেড়ে পা বাড়াতে হয় স্বামীর ঘরে। অপরিচিত লোক, অপরিচিত জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধটা মেয়েদেরই করতে হয়। তাহিয়ার এত কষ্ট নেই। সব পরিচিত ওর। তবুও নিজের ঘর, পরিবার ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। গাড়িতে উঠেও কাঁদতে বসল। অভীক আগলে নিল। কান্না থামাল, প্রেমে ভুলাল। গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছল। অভীক আগে নামল।

দরজা খুলে তাহিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘চমৎকার একটা জীবন হাতছানি দিচ্ছে তোমায়। হাতে হাত রেখে পা ফেল নতুন জীবনে। একসাথে পাড়ি দিব এই পথ। শুধু নির্দ্বিধায় হাতে রাখো হাত। আমি ছাড়ব না তো আর। ছেড়ে আসা দুঃখ ভুলিয়ে দিব, হাজির করব শত সুখ। আসো, ডাকছে তোমার সংসার, ডাকছে তোমার প্রিয়তম। সাড়া দাও। ‘

তাহিয়া কষ্টের অধ্যায় বন্ধ করেছে সবে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। অভীকের কথায় হাসি টেনেছে ঠোঁটে। সামনে দেখা পথটা সুন্দর, সুখে ভরা। পা বাড়ানোই যায়। তাহিয়া দেরি করল না। হাতে হাত রাখল। হাতে হাতে, চোখে চোখে, পায়ে পা মিলিয়ে এগুলো সামনে, তাদের নতুন জীবনের দিকে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here