#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব২৭)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
কুয়াশা কেটে রোদ উঠেছে চারদিকে। সকালের প্রথম কোমল আলোয় আলোকিত চারপাশ।কয়েক কদম এগিয়ে আসতেই তাহিয়ার চোখ পড়ল গেটের দিকে। ওখানটায় নেভি ব্লু জ্যাকেট পরা একটা মায়াবী চেহারার বাচ্চাছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার দৃষ্টি ওদের দিকেই। হাত বাড়িয়ে ডাকছে, আবার কী যেন ইশারা করছে। তাহিয়ার মনে হলো জন্মদিনের উপহারের কথাই বুঝাতে চাইছে ছেলেটা। গেটের ভেতরে অবনী নীলিমা রেহানার কথা শোনা যাচ্ছে, তার মানে ওরা সবাই কাছেই আছে! অয়ন কিছু বললেই শুনে ফেলবে। তখন কী লজ্জাটায় না পড়তে হবে ওকে! তাহিয়া ভীত ঢোক গিলল। বলল,
‘না গেলে হয় না?’
পাশ ফিরে অভীকের দিকে আগ্রহী চোখে চাইল। অভীক ঠোঁট চেপে হাসি আটকে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টায় মগ্ন। কথা বলার অবস্থায় নেই। এখন মুখ খোলা মানেই ভুবন কাঁপিয়ে হাসি দেয়া। তাহিয়ার কথায় তাহিয়ার দিকে তাকাল, ওর চোখেমুখে ভয় দেখে হাসিরা বাধ ভাঙল। উপচে পড়ল ঠোঁটের কোণে। তাহিয়া কপট রাগ দেখাল,
‘আপনার খুব মজা লাগছে, না? অয়ন আমাকে কিছু বললে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিব। তখন দেখব আপনি কী জবাব দেন!’
অভীক হেসেই বলল,
‘পাঠানো লাগবে না। বাবা নিজ থেকেই বলে দিবে।’ বলতে গিয়ে অভীকের কেমন যেন লাগল। শরীরে একটা খুশির ঝঙ্কার বয়ে গেল। তাহিয়া বুঝল না ওর কথার মর্মার্থ। বিস্মিত গলায় বলল,
‘আংকেল ও এসেছেন! আল্লাহ, আজ আমি বোধহয় লজ্জায় মরেই যাব। এই? আপনি আবার উত্তরের দায়ভার আংকেলকে দিচ্ছেন? আসতাগফিরুল্লাহ, আংকেল কী বলবেন!’
অভীক অবাক হলো। মনে মনে বলল,
‘কখনো ‘ক’ বলতে কলকাতা বুঝে যায়, কখনো আবার ‘ক’ তে ‘কাছ’ বুঝালে ও বুঝে না। বোকা মেয়ে!’
অভীকের ভাবনার মাঝে তাহিয়া আবার বলল, ‘আমার ভয় লাগছে, এত গুলো মানুষের সামনে অস্বস্তিতে পড়ে যাব। না যাই?’
ওরা তখন গেটের কাছাকাছি। অভীক হাসি থামাল। চোখ মুখ থেকে কৌতুকের আভা সরাল। তারপর আলতো করে তাহিয়ার হাতের হাতের আঙুলের ভাজে আঙুল গুজে আশ্বাসের সুরে বলল,
‘আমি থাকতে তোমার এত চিন্তা কিসের? আমি আছি তো! আমি সামলে নিব। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। কপাল থেকে চিন্তার রেখা মুছে ঠোঁটে হাসি টানো। চিন্তিত মুখে তোমাকে ভালো দেখায় না।’
এই কথায় কি কোন যাদু ছিল? না কি চিন্তার ওষুধ ছিল? না হলে অভীকের কথায় তাহিয়ার মন থেকে ভয়, চিন্তা নিমিষেই ঝরে গেল কেন? মনটা একবারে স্বচ্ছ হয়ে খুশির রংধনুতে ছেয়ে গেল কিভাবে? ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটল কেন?
শুদ্ধতা মাখিয়ে তাহিয়া প্রসন্ন হাসল। এবার আর ওর চিন্তা নেই। অভীক হাত ছেড়ে দিল। বলল,
‘এবার যাবে?’
পরবর্তী কদম তাহিয়াই বাড়াল। মুখোমুখি হলো অয়নের। মাত্রাতিরিক্ত মায়াবী চেহারার ছেলেটা মামা মামীকে দেখে ভণিতা ছাড়াই বলল,
‘আমার বার্থডে গিফট কই মামী? গিফটের জন্য সকাল থেকে খুঁজছিলাম তোমাদের। কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’
তাহিয়া তাকাল অভীকের দিকে। অভীক হাসল, ওর হাসিটা ভরসার, অভয়ের। এই হাসির পর ভয় পাওয়া সাঝে না। তাল মিলাল তাহিয়াও। অভীক অয়নকে কোলে তুলে নিল। ভাগ্নের গাল টেনে বলল,
‘বার্থডে গিফটের খোঁজ মামা দিবে তোকে। আর কখনো মামীকে জিজ্ঞেস করিস না এটা। ‘
অয়ন ভাবুক স্বরে বলল,
‘জিজ্ঞেস করল কী হবে?’
‘মামী তোকে স্পাইডার লাগিয়ে দিবে। মামীদের বাসায় অনেক স্পাইডার। এখানেও নিয়ে এসেছে দুটো। ‘ গম্ভীরমুখে বলল অভীক। ঘটনার সত্যতা যেন ওর মুখেই আছে।
অয়নের চোখেমুখে ভয়ের আভা দেখা গেল। ভীত ঢোক গিলল। ভয়ের সাথে প্রশ্ন করল,
‘ মামী স্পাইডার পুষে?’
ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘পুষে। ওরা তোর মামীর বেস্ট ফ্রেন্ড। সুখ, দুঃখের আলাপ করে একে অপরের সাথে। ঘুরতে ও যায় একসাথে। মাকড়সারা জাল উপহার দেয়। ‘
মাকড়সা সম্পর্কিত অভীকের উদ্ভট কথায় বিস্ময়ে হা তাহিয়া। কথার সারমর্ম বুঝতে পারল না। অভীকের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বুঝতে পারল অভীক মজা করছে। এমন মজা! তাহিয়া কপট রেগে বলল,
‘স্পাইডার আমার বেস্টফ্রেন্ড! আসতাগফিরুল্লাহ। কিসব বলছেন?’
অভীক হেসে অয়নের অগোচরে ধীর স্বরে বলল,
‘অয়ন স্পাইডারকে ভীষণ ভয় পায়। স্পাইডারের দোহাই দিয়ে সব কথা মানানো যায় ওকে। আপাতত স্বস্তা জোক মারা ছাড়া উপায় নেই। তাই যা বলছি মেনে নাও। পারলে সায় জানাও। ‘
ঘটনা বুঝে তাহিয়া ভ্রু নাড়াল। তারপর হেসে বলল,
‘স্পাইডার শুধু আমার নয়, তোমার মামার ও বেস্ট ফ্রেন্ড। বলা যায় আমাদের কমন ফ্রেন্ড। তোমার মামার সাথে বসে চা দোকানে বসে চা ও খায়। ভীষণ ভাব তাদের।’
অয়ন এবার মামার দিকে তাকাল। অভীক ভ্রু বাঁকিয়ে তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ আজ সকালে তো বউয়ের সাথে চা খেয়েছিলাম। ওটা একটা মাকড়সা ছিল! আজকাল মাকড়সা ও দেখতে মেয়েদের মতো হয়? অবিশ্বাস্য! ওটা বোধহয় ইচ্ছাধারী মাকড়সা ছিল। এই মানুষ, এই মাকড়সা। এখন আবার মানুষ হয়ে গেল। কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গেছে হিয়া, তুমি কি টের পাচ্ছো?’
তাহিয়া ভেবেছিল অভীকের কৌতুকে অভীককেই জব্দ করবে, শেষমেষ নিজেই জব্দ হয়ে গেল। এই লোককে জব্দ করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ওকে মাকড়সা বলল লোকটা! কী বদলোক!
তাহিয়া রেগে অভীকের বাহুতে চিমটি কাটল। অয়ন তা পরখ করে বলল,
‘মামী তুমি মামাকে চিমটি কাটলে কেন?’
‘আমার জামাই আমি চিমটি কাটব নাকি কামড়াব, আমার ব্যাপার। তোর কী তাতে?’ রাগের বশে মুখ ফসকে বলে দিল তাহিয়া।
অভীক এবার শব্দযোগেই হেসে ফেলল। তাহিয়া ভুলটা বুঝতে পারল এতক্ষণে। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। অভীক ওর লজ্জারাঙা চেহারাটা পরখ করল। চক্ষু তৃষ্ণা মিটিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরাল। মুখে গম্ভীরর্যতা টেনে অয়নের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ মামীর কথা রাখ। এখন তুই বল, জন্মদিনের উপহারের কথা আর মামীকে জিজ্ঞেস করবি? করলে কিন্তু মামী তার পোষা মাকড়সা পাঠাবে তোর বাসায়। তখন মাকড়সা তোকে কামড় দিবে, তাড়া করবে। তোকে ওদের জালে আটকে ফেলবে। তুই কি এমনটা চাস?’
ভাবনার সময় নিল না অয়ন। তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে ভয়ের সাথে বলল,
‘ মামী, আমি আর কখনো তোমাকে জন্মদিন উপহারের কথা বলব না। কখনো না। তাও আমার কাছে মাকড়সা পাঠিয়ো না। প্লিজ! আমার ভয় লাগে। ‘
তাহিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি জিজ্ঞেস না করলে আমি ও পাঠাব না। আর শুনো, জন্মদিন উপহারের কথা তুমি তোমার মামাকে জিজ্ঞেস করবে, মামা বলবে তোমায়। ‘
তাহিয়ার ইচ্ছে হলো উত্তর জানতে, সেই সাথে অভীককে জ্বালালে কী করে দেখতে।
উঠোনে রেহানার সাথে অবনী আর নীলিমা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। উঠোনের শেষপ্রান্তে থাকা গেইট উঠোন থেকে দেখা যায়। । গেইটে অভীক-তাহিয়ার খুনসুটির দৃশ্য কথা বলার ফাঁকে পরখ করছিলেন মা-মেয়ে। অবনীর কাছে চমৎকার লাগছে দৃশ্যপট।
দু’জন কখনো একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে, কথা বলছে, তাহিয়া কখনো রেগে চিমটি কাটছে, কখনো আবার লজ্জায় লাল হচ্ছে। এসবের মাঝে বিয়ের পর দেখা তাহিয়ার মুখে বয়ে চলা অস্বস্তির রেখা দেখা যাচ্ছে না। তখন দুজনের মাঝে কত দূরত্ব, কত জড়তা ছিল! অভীকের নাম নিলেই তাহিয়ার ভয়ে, অস্বস্তিতে কাঁপা-কাঁপি শুরু হতো। সেবার অভীকের চোখে চোখে রাখতেও দেখেনি তাহিয়াকে। তখন ওরা যতটা দূরে ছিল এবার ততটাই কাছে, যতটা জড়তা ছিল এবং ততটাই সহজ। ওদের খুনসুটি বলে দিচ্ছে, ওদের সম্পর্কটা ঠিক কত ধাপ এগিয়েছে। কতটা সুন্দর, স্বচ্চ আর দ্বিধাহীন হয়েছে।
অবনী কথা মা চাচীর সাথে বললেও চোখ জোড়া পুরোটা সময় ছিল গেটের দিকে। নীলিমা ও দুই একবার তাকিয়ে দেখছিলেন। মনটা ভরে এলো উনার। তাহিয়ার কবে অভীকের সাথে সহজ হতে পারবে এ নিয়ে ভীষণ চিন্তায় ছিলেন তিনি। আদৌ হবে কি-না সেটাও যেন অনিশ্চিত ছিল।
এখন দুই পক্ষ থেকেই ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেল। এবার দুই মা নিশ্চিন্ত।
রেহানার ডাক পড়ায় তিনি চলে গেলেন ঘরে। রয়ে গেল অবনী আর নীলিমা। অবনী যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। চঞ্চল গলায় বলল,
‘ মা দেখো, ওদের কী সুন্দর দেখাচ্ছে! এবার লাগছে দম্পত্তির মতো। জীবনসঙ্গীর সাথে মনসঙ্গী ও হয়ে গেছে বোধহয়। আমি এই দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় ছিলাম জানো? যাক অবশেষে দেখলাম। এখন সব ঠিকঠাক। মা, আমার ভীষণ খুশি লাগছে। তোমার ও কি খুশি লাগছে?’
খুশিতে তানভীরের গৃহিণী যেন বাচ্চা হয়ে গেল। মেয়ের কথার উত্তরে নীলিনা হাসলেন, প্রাণবন্ত। তার হাসিই তার খুশির পরিমাণ বলে দিল।
অবনী এগিয়ে গেল ওদের দিকে। কাছে গিয়ে তাহিয়াকে ঝাপটে ধরল। ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘তোদের এভাবে দেখে ভালো লাগছে। একটু দাঁড়া তো, আমি একটা ছবি তুলে নেই।’
ছেলেকে ভাইয়ের কোল থেকে নামিয়ে গ্রাম্য পরিবেশে নবদম্পতির ছবি তুলল অবনী। নীলিমা এসে প্রশ্ন করলেন,
‘ কোথায় গিয়েছিলি তোরা? সবাই নাস্তার জন্য খুঁজছিল তোদের।’
অভীক হেসেই বলল, ‘ হাটতে বেরিয়েছিলাম একটু। ‘
তাহিয়া চঞ্চল মনে সুন্দর সকালের বর্ণনা দিয়ে গেল। মাঝে অভিযোগের সুরে বলল,
‘আজ একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে, শুনবে আপু? আমরা হাটছিলাম, হঠাৎ দেখলাম রাস্তায় একটা গরু দাঁড়িয়ে আছে। ইয়া বড়ো বড়ো শিং, কিভাবে তাকিয়েছিল আমাদের দিকে।’
এ টুকু বলে থামল। নীলিমার উদ্দেশ্যে বলল,
‘ এরপর তোমার ছেলে কী করল জানো আন্টি? বীরবেশে গরুটাকে তাড়াতে উদ্যত হলো। গরুটার কাছে গেলে গরু কোন ক্ষতি করতো না বলো? গুতো টুতো দিলে তখন কী হতো! আমার তো ভয়ে কলিজা বেরিয়ে যাচ্ছিল। কোনমতে টেনে নিয়ে এসেছি। ভয় ডর নেই তোমার ছেলের, এসবের কোন মানে আছে, বলো? যদি কিছু হয়ে যেত? ‘
তাহিয়া চঞ্চল মনে কথা কথা বলে গেল। বলার আগে ভাবল ও না ওর কথা সামনের মানুষগুলো কিভাবে নিচ্ছে। তাহিয়ার অভিযোগবানী যেন মা-মেয়ের খুশির মাত্রা বাড়িয়ে দিল। ওর অভিযোগের মাঝে অভীকের জন্য গাঢ় যত্ন দেখতে পেল ওরা। নীলিমা মুচকি হাসছেন। গত দু’দিন ছেলের চোখে তাহিয়ার জন্য যত্নভাব দেখেছেন, আজ তা তাহিয়ার চোখে দেখতে পাচ্ছেন। শান্তি লাগছে, ভালো লাগছে।
নীলিমা মনে মনে বললেন, ‘মাশা আল্লাহ, এভাবেই হাসিখুশি থাকিস, পাশাপাশি কাছাকাছি থাকিস দুজন। ‘
মনের কথা মনে চেপে রাখলেন। ঠোঁটে হাসি, চেহারায় খুশি, স্বরে রাগ মিশিয়ে ছেলেকে চোখ রাঙালেন,
‘ তোর উচিত হয়নি গরুর কাছে যাওয়ার।’
অবনী হাসছে দাঁত দেখিয়ে। ভীষণ উপভোগ করছে ও। অবনী টিপ্পনী কাটল,
‘হ্যাঁ অভীকে গরু গুতো দিলে আমাদের তাহিয়ার কী হতো? বেচারী কমলার মতো বনবাসী হয়ে যেত না? অভী, তাহিয়ার কথা ভাবা উচিত তোর । দেখ, তোর চিন্তায় কেমন অস্থির মেয়েটা! ‘
এতক্ষণে কথার ভুল বুঝতে পারল তাহিয়া। লজ্জা পেল কিছুটা। লজ্জার মাত্রা বাড়ল যখন দেখল, সবাই হাসছে। এমনকি অভীক ও হাসছে মুখ চেপে।
তাহিয়ার কথার ভঙিটা সুন্দর লেগেছে ওর। অভীককে হাসতে দেখে তাহিয়া চোখ রাঙাল। আমাকে লজ্জায় ফেলে মজা নেয়া হচ্ছে!
অভীক এবার শব্দ করেই হেসে দিল।
সে ও মায়ের কাছে বিচার দিল,
‘মা, দেখো তোমার পুত্রবধূ আমায় চোখ রাঙাচ্ছে।’
তাহিয়া তড়িৎ চোখ নামাল। লোকটা কী পরিমাণ অসভ্য! সবার সামনে ওকে জব্দ করছে! লজ্জায় আড়ষ্ট তাহিয়া। নীলিমাও এবার শব্দ করে হেসে দিলেন। অবনী হাসতে হাসতে বলল,
‘ আমরা কেউ তো পারিনি তোকে শাসন করতে, চোখ রাঙাতে। এটা অসাধ্য ছিল। তাহিয়া অসাধ্য সাধন করেছে। ব্যাপারটা মন্দ না। যাক অন্তত, কেউ আছে তোকে শাসন করা। কেউ তোকে চোখ রাঙানোর সাহস রাখে। তাহিয়া, একদম শাসনে রাখবি ওকে। জামাইদের শাসনে না রাখলে হাত ফসকে যায়। ছোটো হয়ে ও বিয়ের আগে আমাকে শাসন করতো তোর জামাই, এবার ছোটো হয়ে তুই ওকে শাসন করবি। আমার প্রতিশোধ নিবি। ‘
‘ তোর ভাইকে একটা হাটুর বয়সী মেয়ে চোখ রাঙাচ্ছে আর তুই ওকে বাহ্বা দিচ্ছিস! তুই আমার বোন না শত্রু!’ কপট রাগ দেখাল অভীক। অবনী হেসে বলল,
‘আপাতত শত্রু। জানিস? আমার খুব ইচ্ছে ছিল একদিন তোকে চোখ রাঙাবো। কিন্তু তুই রেগে যে ফেস বানাস তা ভেবে পারিনি। বিশ্বাস কর, আজ তাহিয়ার তোকে চোখ রাঙানো দেখে আমার ভীষণ শান্তি লাগছে। ‘
অভীক হতাশ হয়ে মায়ের দিকে তাকাল, ‘ মা তুমি অন্তত কিছু বলো?’
নীলিমা ও কৌতুকের রেশ টেনে বললেন, ‘ তোদের মিয়া বিবির ব্যাপারে আমি তৃতীয় ব্যক্তি। এতদিন চিন্তা ছিল বলে মাঝে ছিলাম, এখন আমি নিশ্চিন্ত। মাঝে টাজে নেই। এখন থেকে তোদের ব্যাপার তোরা বুঝবি। ‘
অভীক নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
‘মা এখনো বলছি, সময় থাকতো বউকে শাসন করো। নয়তো পরে পস্তাবে। । ‘
অভীক অদ্ভুত ভঙিমায় বলল কথাটা। সবাই হেসে ফেলল। অবনী তাহিয়াকে বলল,
‘এই চোখ রাঙানোর জন্য তুই আমার কাছে থেকে গিফট পাবি।’
এতক্ষণ সবার মাঝে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল অয়ন। বড়োদের কোন কথাই ওর বোধগম্য হয়নি। মায়ের মুখে উচ্চারিত ‘গিফট’ শব্দটা শুনে টনক নাড়ল।
মাঝে এসে ফোঁড়ন কাটল,
‘কোন গিফট দেয়া নেয়া হবে না। আগে আমার গিফট দিতে হবে। ‘
থেমে অভীকের কাছে গিয়ে অভীকের হাত টেনে বলল,
‘মামা তুমি আমাকে গিফটের খোঁজ দিবে বলেছিলে তখন। আমার বোন কবে এনে দিবে, দাও?’
অয়নের আতর্কিত কথায় হাসির রেশ থামল। তাহিয়া এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। যেন সে কিছু শুনেইনি। অবনীর মুখে হাসির নব আভা ফুটে উঠল। সে মজা করেই বলল,
‘দিন কাল তো ভালোই চলছে। এবার ঘোষণা দিয়ে দে ভাই। ‘
অভীক অয়নকে কোলে নিল। এক হাতে অয়নকে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে অয়নের গাল টেনে বলল,
‘ বোন এনে দিলে কোলে নিতে পারবি?’
অয়ন ইতিবাচক মাথা নাড়াল। তাহিয়া আগ্রহী হলো। অভীকের উত্তর জানার চেষ্টায় কান পাতল। অভীক বলল,
‘তোর বোনটা একবারে ছোটো হয়ে আসবে। তুই নিজেই তো ছোটো মানুষ, ওকে কোলে নিলে তোর হাতের ফাঁক দিয়ে পড়ে যাবে। তখন ভীষণ ব্যাথা পাবে, কাঁদবে। তুই কি বোনকে ব্যাথা দিবি?’
অয়ন তড়িৎ মাথা নাড়াল। সে ব্যাথা দিবে না। করুণ চোখে চেয়ে বলল,
‘ আমি কি কোলে নিতে পারব না?’
‘পারবি, তার জন্য তোকে বড়ো হতে হবে।’
অয়ন খুশি হলো, ‘আমি বড়ো হলে কোলে নিতে পারব?’ অভীক সায় জানাল। অয়ন হেসে বলল,
‘তাহলে ওকে নিয়ে আসো এখন, আমি শুধু দেখব। বড়ো হলে কোলে নিব।’
‘ এখন তো বোন আসবে না। ‘
‘কেন?’ তড়িৎ প্রশ্ন করল অয়ন।
অভীক বলল,
‘বোন বলেছে, তুই যখন ওকে কোলে নিতে পারবি তখন আসবে। এসেই তোর কোলে চড়বে। আগে তুই বড়ো হ, তারপর আসবে বোন।’
‘আমার বোন কবে আসবে, কোন জন্মদিনে?’
অয়নের প্রশ্ন করার ধাত বেশ। অভীক ধৈর্যচ্যুত হলো না। ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিল,
‘ তোর দশম জন্মদিনে আসবে। ততদিনে তুই বড়ো হয়ে যাবি, বোনকে কোলে নিতে পারবি। বোনকে কোলে নেয়ার জন্য তোকে অপেক্ষা করতে হবে, বড়ো হতে হবে। মনে থাকবে?’
অয়ন মাথা নাড়াল। অভীক রিপিট করল,
‘কী করতে হবে?’
‘বড়ো হতে হবে। ততদিন বোনের অপেক্ষা করতে হবে। ‘
বিজ্ঞের মতো অকপটে বলল অয়ন। অভীক হেসে বলল,
‘সাবাশ! মনে থাকে যেন। ‘
অয়নের অবুঝ মাথায় বুঝ আসল। ও বলল,
‘আমি তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাব, তারপর বোনকে কোলে নিব। হুররে!’
অভীক ফিরতি গাল টানল ভাগ্নের। ছেলেটা দেখতে অবনীর মতো মায়াবী হয়েছে। অয়ন থেকে চোখ সরিয়ে মা বোনের দিকে তাকাল। মায়ের চোখে চোখ পড়তেই বিব্রতবোধ করল ও। যদিও অয়নকে ইচ্ছে করেই সবার সামনে কথাগুলো বলেছে। অনেকটা ‘ঝি মেরে বউকে শাসানোর মতো।’ যাতে পরে এ নিয়ে প্রশ্ন না উঠে। নীলিমা ও বিব্রতবোধ করলেন বোধহয়। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘নাস্তা করতে আয় তোরা। ‘
অবনী হেসে বলল, ‘ওয়াইজ ডিসিশন অভী।’ পাশ কাটিয়ে ছেলেকে নিয়ে চলে গেল অবনীও।
এতক্ষণে স্ত্রীর পানে তাকাল অভীক। সূর্য্যের তীক্ষ্ম আলো এসে পড়ছে তাহিয়ার চোখে মুখে। চশমা ভেদ করে আলো গিয়ে বিধছে চোখের মণিতে। তাকাতে পারছেনা তাহিয়া। ঘনঘন পলক ফেলছে। কপাল কুঁচকে আছে। অভীক তাহিয়ার পাশ থেকে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রোদ্দুর সরল তাহিয়ার চোখ মুখ থেকে, গিয়ে পড়ল অভীকের পিঠে। তাহিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। স্বাভাবিক ভঙিতে তাকাল। পলক ফেলার মাত্রা কমে এলো।
অভীক বলল,
‘ অয়ন বুঝে গিয়েছে, আর বিরক্ত করবে না তোমায়। এবার ছেলেটাকে ভয় পাওয়া ছেড়ে দাও। ফ্রি হও।’
তাহিয়া প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি অয়নকে কী বললেন ওটা?’
অভীকের কথা ঘুরাতে ইচ্ছে হলেও এ পর্যায়ে ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিল না। কিছু কথা পরোক্ষই ভালো। ও ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘তো তুমি কি চাইছো আমার বাচ্চাদের দেখিয়ে ফেইল করতে?’
তৎক্ষনাৎ কথার মর্মার্থ বুঝল না তাহিয়া। দুটো কথার যোগসূত্র পেল না। সমীকরণ মেলালো। মিলল খানিক বাদে। উত্তর দিতে পারল না,অবাক চোখে তাকাল কেবল। অভীক বলল,
‘ফেইল করার প্রতিযোগিতায় প্রথমস্থান অধিকার করা বিজয়ীকে মা টা উপাধি দেয়া হবে না। আগে পড়াশোনা তারপর বাকিসব। বুঝেছেন?’
তাহিয়া উত্তর দিতে পারল না। এসব কথার উত্তর কী হয়, ও তো সেটাই জানে না। জব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাকরুদ্ধতার মাঝে ও একটা কথা স্বরে এসে বাড়ি খাচ্ছে। তা হলো,
‘লেকচারারদের বিয়ে করলে প্রতি পদে পদে পড়াশোনার কথা আসাটা বাধ্যতামূলক। তাদের মতে, পড়াশোনা জীবন, পড়ালেখা মরণ, দুনিয়াতে এই একটা জিনিসই তো আছে। আর কিছু নেই। ‘
•
রেজাউল আহমেদ ও এসেছেন। দেখা হতেই তিনি ঘর পছন্দ হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করেছেন। তাহিয়া হেসে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে মতামত জানিয়েছে। দিনটা ভালোই কাটল হাসিঠাট্টায়। অভীক আর নীলিমার কড়া নজরে জাহানারা তাহিয়াকে কথা শুনানোর সুযোগ ফেলেন না।
সন্ধ্যার পর বড়ো ঘরের বসার ঘরে আড্ডার আসর বসল। আড্ডার প্রথমদিকে জাহানারা বেগম ছিলেন না। তার অনুপস্থিতিতে তাহিয়া প্রাণচঞ্চল ভাবে কথা বলছিল। আড্ডা শুরুর ঘন্টাখানেক বাদে তার আগমন ঘটল। তিনি আসতেই তাহিয়া চুপসে গেল। মনে হলো এই বুঝি সবার সামনে ওকে অপমান করে বসবে। অভীকের বুঝানোর পরে রঙ নিয়ে ওর আর আফসোস নেই। কিন্তু জাহানারা সবার সামনে কটু বলে বসলে ও ভালোভাবে নিতে পারবে না। কথা থামিয়ে চুপচাপ এক কোণে বসে রইল। ওর এই চুপসে যাওয়া নীলিমা খেয়াল করলেন। পাশাপাশি বসা দু’জন। ধীর স্বরে বললেন,
‘ভয় পাস না, আজ আপা কিছু বলবেন না। আমরা আছি সবাই। নিশ্চিন্তে থাক।’
কিছু মানুষের মন্দ স্বভাব থাকে মাংসে আটকানো। একটু শিক্ষা, একটু ধাক্কা দিলে স্বভাব দূর হয়ে যায়। আবার কিছু মানুষের স্বভাবগুলো মনের গহিনে, রক্তের শিরায় মিশে থাকে। হাজার চেষ্টার পর ও তাদের স্বভাব বদলানো যায় না। নীতি কথা শুনিয়ে বা একটা ধাক্কা দিলে কিছুক্ষণ, কিছুদিন ভালো থাকে। তারপর রক্তে বয়ে চলা স্বভাব আবার উঁকি দেয়। তাহিয়ার কেন যেন মনে হয় জাহানারা দ্বিতীয় দলে। তার স্বভাব পরিবর্তন হবে না, তিনি সুযোগ পেলেই ওকে ছোবল দিবেন। বাস্তবিক অর্থে, রাতে খাবার ঘরের কথা তার অজানা। সে পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারছে না জাহানারাকে। ভয়ানক মানুষ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা ভালো। এটা ভয় নয়, এটা আত্মসম্মান রক্ষা। খারাপ মানুষের সাথে তর্কে লিপ্ত হওয়া মানে নিজের মর্যাদা কমানো। জাহানারার উপর ওর রাগ বেশ। আজ কিছু বললে হয়তো সে ও রেগে কিছু একটা বলে দিবে। সবার সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। শ্বশুরবাড়িতে নতুন বউয়ের বেয়াদবী ভালো দেখাবে না। সব দিক বিবেচনা করে তাহিয়ার মনে হলো এখান থেকে সরে যাওয়ায় ভালো হবে। ও ধীর স্বরে বলল,
‘আমার ঘুম আসছে, আমি ঘরে যাই?’
নীলিমা আবার অভয় দিলেন, ‘ কিছু বলবে না তো! থাক। ‘
‘সত্যিই ঘুম আসছে।’
করুণ গলায় বলল তাহিয়া। বাস্তবিক অর্থেই ওর ঘুম আসছে। সকালে তাড়াতাড়ি উঠেছে, সারাদিন ঘুম হয়নি। বসার ঘরে একসেট সোফা আর একটা একটা খাট। সোফায় পুরুষরা বসেছেন, খাটে মহিলারা। বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে কম্বলের ভেতরে পা মেলে খাটের এক কোণে বসেছে তাহিয়া। আরাম পেতেই ঘুম নামছে চোখে। নীলিমা ওকে পরখ করে বললেন,
‘এই অবেলায় ঘুম আসছে তোর?’
‘হ্যাঁ। সকালে হাঁটতে যাওয়ায় ঘুম হয়নি। এখন ঘুম পাচ্ছে।’
নীলিমা বললেন, ‘আমরা সবাই এখানে। তুই ওখানে একা থাকতে পারবি? ‘
‘এখনো তো রাত বেশি হয়নি, পারব। শুধু আমাকে ঘরে দিয়ে এলেই হবে। ‘
‘অভীককে বলব, যেতে?’
তাহিয়া ঘাঢ় ঘুরিয়ে তাকাল। অভীক তার দুই চাচার সাথে কোন একটা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনার মশগুল আছে। এদিকটায় খেয়াল নেই। তাহিয়া বলল,
‘না, তুমি দরজায় দাঁড়াও। আমি চলে যাই।’
নীলিমা একা ছাড়লেন না। যা ভীতু মেয়ে, শেষে ভয়ে কেঁদে মরবে। নিজে দিয়ে গেলেন ঘরে। তাহিয়া কম্বল মুড়ে শুলো, খানিকেই ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙল অনেকটা সময় পর। আশপাশের কোথাও শিয়াল ডাকছে, ওই শব্দেই ঘুম ভেঙেছে। কলিজা কাঁপা নিয়ে চোখ খুলেছে। হাতড়ে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখল, ১১:১০ মিনিট বাজে। ঘরের মাঝে লাইট জ্বালানো। চোখ ঘুরিয়ে অভীককে খুঁজল। দুই একবার ডাকল, নাহ, সাড়াশব্দ নেই। এখনো আসেনি? এই ঘরে ও একা!
শিয়াল গুলো বিকট শব্দে ডেকে যাচ্ছে অনবরত। ঘরের পেছনে ছোট্টো একটা ডোবা। ডোবার পাড়ে অবস্থান করছে শিয়ালগুলোর। তাহিয়া জীবনে শিয়াল দেখেছে হাতে গোনা পাঁচ থেকে ছয়বার। তাও চিড়িয়াখানায়। শিয়ালের ডাক শহরে শোনা যায় না। চিড়িয়াখানার শিয়ালগুলো এভাবে ডাকে না। দুই একবার ডাক শুনেছে। সেই শোনা থেকেই বুঝেছে এটা শিয়ালের ডাক। শীতের রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশে শিয়ালের হুয়াক্কা হুয়া ডাকটা ভূতড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তার উপর শিয়ালের কলধ্বনি যেন ক্রমশ কাছে আসছে। ভয়ে অন্তরাত্মা কাঁপছে তাহিয়ার। রাত নামলেই শিয়ালের দল লোকালয়ে আসে। কিছুক্ষণ ডেকে আবার চলে যায়। গ্রামীণ মানুষের জন্য এটা স্বাভাবিক এবং পরিচিত ব্যাপার হলেও শহুরে মানুষের জন্য অস্বাভাবিক এবং অপরিচিত ভয়ানক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
শিয়ালের দল পাড় পেরিয়ে ঘরের পেছনে এসে পড়েছে। তাহিয়া কাঁপা হাতে ফোন হাতে নিল। হুলস্থুল হয়ে অভীককে কল দিল। নেটওয়ার্ক ডাউন, কল যাচ্ছেনা। তাহিয়া যেন চোখে সরষে ফুল দেখল। হতবুদ্ধি হয়ে গেল ও। বারবার কল দিতে থাকল। আকস্মিক মনে পড়ল, অভীকের কথা। কাল রাতে অভীক বলেছিল, রান্নাঘরে কিঞ্চিৎ নেটওয়ার্ক কানেকশন পাওয়া যায়। তা দিয়ে কল করা যেতে পারে। কাল বিলম্ব না করে রান্নাঘরে গেল। কল দিল। হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে, ভয়ে হাটু কাঁপছে, কন্ঠরোধ হচ্ছে। সেই ভয়মাখা কাঁপা-কাঁপি ঘামাঘামিময় পরিবেশ সৃষ্টি হলো। কল ডুকল। রিসিভ ও হলো। তাহিয়া হুলস্থুল হয়ে বলল,
‘আপনি কোথায়, তাড়াতাড়ি আসুন। প্লিজ!’ কথা বলতে গিয়েও কথা জড়িয়ে গেল ওর।
শিয়ালের ডাকটা এপাশ ভেদ করে অপাশে চলে গেল। অভীক শুনেই তাহিয়ার ভীত গলার ভয়ের কারণ ধরতে পারল। ও বলল,
‘ঘরে একা তুমি?’
‘হ্যাঁ।’
‘মা, আপু কোথায়? ওরা তো তোমার পাশে ছিল।’
‘কেউ নেই। সবাই আমাকে একা রেখে চলে গেছে।’ করুণ শুনাল তাহিয়ার স্বর। অভীক বলল,
‘মায়ের ঘরে চলে যাও। পাশেই তো।’
‘ভয়ে লাগছে। আপনি কোথায়, আসুন না?’
‘আমি তো দূরে আছি। তুমি এক কাজ করো, হাত দিয়ে টিনে বাড়ি দাও, ওরা চলে যাবে। ‘
‘ভয় লাগছে।’
অভীক অভয় দিল। তাহিয়া ভয়ে ভয়ে টিনে বাড়ি দিল হাত দিয়ে। ছিটকে গেল শিয়ালের দল। ধীরে ধীরে সরে গেল ঘরে কাছ থেকে। তাহিয়া হাফ ছাড়ল। তবে ভয় কাটল না। বলল,
‘স্যার,আপনি কোথায়?’
‘আমি ব্যাটমিন্টন খেলতেছি স্কুল মাঠে। ‘
‘আমাকে একা রেখে চলে গেলেন?’ অভিমানী স্বর তাহিয়ার। অভীক হেসে বলল,
‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে বিধায় বলে আসতে পারিনি। মা আর অবনী আপুকে তোমার কাছে বসিয়ে এসেছি।’
‘এখন আসুন আপনি। ‘ দৃঢ় গলায় বলল তাহিয়া।
অভীক হাতে থাকা ব্যাটটা ওর এলাকার বন্ধু জিশানকে ধরিয়ে দিল। ইশারায় বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। অপাশ থেকে শিয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে না, চলে গেছে বোধহয়। তবুও মেয়েটা ভয় পাচ্ছে! একটু বেশিই ভীতু মেয়েটা। অভীক আনমনে হাসল। স্বর থেকে হাসি সরিয়ে বলল,
‘ প্রায় সাত বছর পর ব্যাট হাতে নিয়েছি। খেলাটা জমেছে। এখন আসতে পারব না।’
‘স্যার,আসুন না প্লিজ! আমি ভয় পাচ্ছি তো!’ অনুরোধ ঝরে গেল তাহিয়ার স্বরে। অভীকের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা সরছে না। ও বাড়ির পথে হাটছে, সে কথা জানাল না প্রিয়তমাকে। কথায় মজে রাখলে ভয় কেটে যাবে ওর। অভীক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ এতে আমার লাভ?’
‘ আমি ভয়ে মরছি, আপনি লাভ মুনাফা খুঁজছেন! ‘ অবিশ্বাস্য সুরে বলল তাহিয়া। অভীক দায়সারা জবাব দিল,
‘ লাভ ক্ষতির হিসেব ছাড়া আজ আমি বাড়ি ফিরছি না। একটা হিসেব নিকেশ হয়ে যাক।’
‘প্লিজ স্যার!’ আকুতিভরা টলটলে গলায় বলল তাহিয়া। ওর অবাক লাগছে অভীকের কান্ড। লোকটা এতটা কান্ডজ্ঞানহীন নয়। আজ এমন আচরণ করছে কেন?
অভীক নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তাহিয়া পরাস্থ হয়ে বলল,
‘ আপনার দাবিদাবা পেশ করুন?’
অভীক বাড়ির গেইটে দাঁড়াল। নেটওয়ার্ক ডাউন হচ্ছে। ওখানেই দাঁড়িয়ে কথা বলল,
‘প্রথমত, কলেজের বাইরে, ‘স্যার’ সম্বোধন বর্জন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সম্পর্ক, সম্বোধন দুটো এক ধাপ আগানোর কথা ছিল। সম্পর্ক এগিয়েছে, সম্বোধন আগায়নি। সম্পর্কের মতো সম্বোধনকে ও এক ধাপ আগাতে হবে।
তোমার মুখে ‘তুমি’ সম্বোধন চমৎকার শুনায়। আমাকে স্থায়ীভাবে এই চমৎকার শোনানো ‘তুমি’ সম্বোধন করতে হবে। এর কথা দিতে হবে। তারপর এই মুহুর্তে আমাকে কোমল গলায় অনুরোধ করতে হবে, তবে আমি ভেবে দেখব।’
‘তুমি’ সম্বোধনের আবদার করেই অভীকের মনে হলো আবদারটা এক কিশোরের আবদারের মতো হয়ে গেছে। কিভাবে বলছিল ও! ওর বলার ভঙিতে অবাক হলো তাহিয়া। ভয়ের মাঝেও হাসি পেল, অস্বস্তি ও লাগল। ‘স্যার’ সম্বোধন বাদ দেয়া যাবে। সমস্যা নেই। কিন্তু এত বড়ো মানুষটাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করবে কিভাবে? বয়স আর উচ্চতার দিক দিয়ে যারা বড়ো হয় তাদের দেখলেই মুখ দিয়ে ‘আপনি’ সম্বোধন আসে অনায়েসে। ‘তুমি’ সম্বোধন আসেনা। তাহিয়ার চেষ্টা করে দেখল। আপনিই আসছে, তুমি আসছে না। অস্বস্তি লাগছে, লজ্জাও কাজ করছে। তাহিয়া অস্বস্তিভরা স্বরে বলল,
‘ ভাব জমে মনে, সম্বোধনে কী আসে যায়? একটা ডাকলেই হলো। ‘
‘ঠিক আছে। আমি খেলায় মন দিলাম।’
‘ডাক আসছে না তো!’
‘ফোনটা রাখলাম কিন্তু!’
রাখবে বলেও রাখল না অভীক। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। তাহিয়া বলার চেষ্টা করল,
‘তু… ‘ থামল। স্বর যেন এই একটা শব্দের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বেরুচ্ছেনা। বিরক্তিভরে বলল,
‘আসুন না!’
‘দাবিদাবা পূরণ না করলে কোন আসা টাসা হবে না।’ অভীকের ও দৃঢ় স্বর।
‘আরে পারছিনা তো আমি!’
‘কী আর করা, রাখি তবে।’
মোক্ষম সময়ে শিয়ালদল ডেকে উঠল আবার। থেমে যাওয়া ভয় আবার জেগে উঠল তাহিয়া। ভীত ঢোক গিলল তাহিয়া। অভীক ধন্যবাদ দিল শিয়াল দলকে। মনে মনে বলল, ‘একেই বলে মকাপে ছকা।’
ডাকটা আবার আগের মতো বাড়ছে, কাছে আসছে। ভীত ঢোক গিলল তাহিয়া। এখন কোন পথ খোলা নেই। ভয়ের চাপে নিষেধাজ্ঞা ঠেলে বের হলো সেই বহুপ্রতীক্ষিত সম্বোধন।
‘তুমি… ‘ থামল তাহিয়া। সেকেন্ড খানেক সময় নিল। তারপর দ্রুতই বলল, ‘আসো না প্লিজ! আমি ভয় পাচ্ছি তো!’
অভীক ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,
‘ভয় আমি পাব না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘অভীক অর্থ ভয়শূন্য, নির্ভীক। অভীকরা ভয় পায় না। অভীকরা ভয় দেখায়।’
অভীক অবাক হলো। ওর নামের অর্থ বের করে ফেলেছে! হৃদয়স্পর্শী ব্যাপার! অভীক গেট ঠেলে ভেতরে ডুকল। বলল,
‘ আমার আসার সাথে তোমার ভয়ে দূর হওয়ার যোগসূত্র কোথায়?’
‘অভীকই আমার নির্ভীকতার কারণ। অভীরা কাছেপাশে থাকলে ভয়ডর থাকে না। থাকতে দেয়না অভীরা।”
কথাটা সুন্দর শুনাল। অভীক হাসল। তাহিয়া বিরক্তিভরে বলল,
‘এবার অন্তত আসো! আর কত কথা ঘুরাবে?’
অভীক কিছু বলল না, কদম বাড়াল। নেটওয়ার্ক ডাউন হলো, কথা শুনা গেল না। তাহিয়া অনবরত কথা বলে গেল। কথার মাঝেই দরজায় কড়া নড়ে উঠল। কে জিজ্ঞেস করল তাহিয়া? অভীক কাশল শুধু, উত্তর দিল না। তাহিয়া বিস্ময়ের সাথে দরজা খুলল। দরজায় অভীক দাঁড়ানো। পরনে কালো-ধূসর মিশেলের হুডি, কালো ট্রাউজার, স্পোর্টস সু। পকেটে হাত গুজানো। ঠোঁটের কোণে হাসি। তাহিয়া হাফ ছাড়ল। চঞ্চল গলায় অভ্যাস গলায় বলল,
‘আপনি না ব্যাটমিন্টন কোর্টে ছিলেন? এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন কিভাবে? তারমানে এতক্ষণে আপনি আশেপাশে ছিলেন? আ..’
অভীক ভ্রু কুঁচকাল। কথার মাঝে থেমে গেল তাহিয়া। অভীক বলল,
‘চলে যাব?’
দাবীর সাথে কথা বলার ভঙ্গি মিল না থাকায় মশাই রাগ করেছেন! মুখ চেপে হাসল তাহিয়া। কিছুটা সময় নিয়ে শুধরাল,
‘যেও না প্লিজ! অভ্যাস বদলাতে সময় লাগবে। একটু সময় দাও!’
কত কষ্টে নিচের দিকে ফিরে বলল কথাটা! কত কঠিন কাজ! লোকটা হাসছে, সার্থকতার হাসি! বদ! দরজা থেকে সরে দাঁড়াল তাহিয়া। অভীক ভেতরে এলো। পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে তাহিয়াকে দিল। তাহিয়া নিয়ে খুলে দেখল, মাঝারি সাইজের কেকের প্যাকেট। তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল,
‘এটা কেন?’
‘ এতকরে খেতে ডাকলাম, উঠলে না। খেলেও না। সবাই খেতে শুয়ে পড়েছে। এখন ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই! এত রাতে খাওয়ার ঘরে যাওয়া ঠিক হবে না। তারচেয়ে বরং কেক আর পানি খেয়ে নাও। অন্তত খালি পেটে থাকার চেয়ে ভালো হবে। ‘
না বলতেই কত কী বুঝে যায় লোকটা! ভয়ে টের পায় নি। এতক্ষণে টের পেল, ক্ষিধে পেটে টান পড়েছে। কিছু না খেলেই নয়। সবদিক খেয়াল থাকে লোকটার। তাহিয়া হাসল। খেতে গিয়ে অভীককে সাধল,
‘আমি একাই খাব? তুমি ও খাও।’
অভীকে সে কথার উত্তর দিল না। ও বসার ঘরের ডাবল সিট সোফায় বসা ছিল। তাহিয়া ওর দিকে কিছুটা দূরত্বে থাকা সিঙ্গেল সোফায় বসে কেক খাচ্ছে। অভীক উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তমার দিকে। তাহিয়া খাওয়া থামিয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। অভীক পায়ে পায়ে এগিয়ে তাহিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সোফার দুই হাতলে দুই হাত রেখে তাহিয়ার দিকে ঝুকল। প্রেয়সীর চোখে চোখ রেখে গভীর গলায় বলল,
‘ তোমার সব কিছুতে এত মুগ্ধতা কেন! এই যে তুমি ‘তুমি’ সম্বোধন করছো। এটা অতি সাধারণ, তাও এতটা অসাধারণ লাগছে কেন? তোমার মুখে ‘তুমি’ সম্বোধন মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর শুনাচ্ছে কেন? আমাকে এতটা ঘায়েলই বা করছে কেন? আমি তো আহত হয়ে যাচ্ছি। এবার আমার ঘা মিটাবে কে? ‘
তাহিয়ার হৃদপিণ্ড অদ্ভুত ভালোলাগায় ছটফট করছে। ও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে, লাজুক স্বরে বলল,
‘ তোমার ঘা’এর কারণ যেহেতু আমি, তবে মলম ও আমিই হব। আমি ছাড়া আর সাধ্য কার!’
চলবে…
‘অভীক’ নামটা রাখা হয়েছে শুধুমাত্র আজকের পর্বের দুটো সংলাপকে কেন্দ্র করে। নামটা রাখার উদ্দেশ্যে আজ সফল হলো। সে হিসেবে নামের সার্থকতা পেল। সার্থকতার পাল্লা ভারি হচ্ছে। টের পাচ্ছেন?