প্রেমোদ্দীপক। পর্ব-২৪

0
979

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-২৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

বৃষ্টিস্নাত অপরাহ্নে ফুটপাত ধরে হাটছে অভীক-তাহিয়া। তাহিয়ার হাতে চকলেট বার। ও চকলেট খেতে খেতে চঞ্চল গলায় কথা বলছে। লেদার জ্যাকেটের পকেটে হাত গুঁজে রাখা অভীক প্রিয়তমার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। খানিক পরপর চঞ্চলতার দিকে তাকাচ্ছে, একটা দুইটা কথা সেও বলছে। তবে তাহিয়ার কথার মাত্রা অধিকতর। বৃষ্টি থেমেছে ঘন্টাখানেক আগে। রোদের বালাই নেই। রাস্তাঘাট শুকায়নি।
হিমেল বাতাস গায়ে মাখিয়ে বৃষ্টিভেজা পথ ধরে হাটতে ভালোই লাগছে তাহিয়ার। আজ পরিবেশের মতোই বেশ ভালো। কপোত-কপোতীর কথা বলার মাঝে অভীকের ফোন বেজে উঠল। থেমে ফোন বের করে দেখল নীলিমার কল। ফুটপাতের ধারে লোহার রেলিং দেয়া। একপাশ হয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল অভীক। তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
‘দাঁড়াও, কথা বলে নিই।’

তাহিয়া দাঁড়াল। রেলিংয়ে হাত রেখে ব্যস্ত রাস্তার গাড়ি পারাপার দেখায় মন দিল। অভীক কল রিসিভ করে বিনম্র স্বরে সালাম দিল। পাশাপাশি থাকায় ফোনে বলা অভীকের কথা কানে এলো তাহিয়ার। অপাশের জনের কথার উত্তরে অভীককে বলতে অভীক নম্র গলায় বলতে শোনা গেল,
‘ বিয়ে হলেও তাহিয়ার একটা নিজস্ব মতামত আছে। ও যাবে নাকি যাবে না সেটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কোন হস্তক্ষেপ করব না। সর্বোচ্চ প্রস্তাব দিতে পারব। এবার ওর উত্তর যদি ইতিবাচক হয়, তবে নিয়ে যাব। নয়তো ভিডিওকলেই দেখিয়ে দিও। ‘

এরপর অভীক নিরব হলো। অপাশের জনের কথা এলো বোধহয়। উত্তরে অভীক বলল,
‘আচ্ছা, আমি ওকে জিজ্ঞেস করব। যদি যেতে রাজি হয় তবে কাল সকালে রওনা দিব।’

অপাশ থেকে সায় জানাল বোধহয়, অভীক ফোন রাখল। ফোন রাখতেই তাহিয়া প্রশ্ন করল,
‘কে ফোন দিয়েছিল?’
‘মা।’
‘আমার কথা কী বলছিলো আর কোথায় যাওয়ার কথা চলছিল?’

অভীক ফোন পকেটে রেখে বলল,
‘দাদীমা তার নাতিবউ দেখতে চাইছেন। মা বলছে, তার পুত্রবধুকে নিয়ে যেতে। এখন দাদীমার নাতিবউ কি যাবে?’

একজন মৃত্যুশয্যা রোগী তাহিয়াকে দেখতে চাইছে। অভীক চাইলেই ওকে জোর গলায় বলতে পারত, তোমাকে যেতেই হবে, অথবা বাড়ি যেতে হবে তৈরি থেকো। ওর মতামত ছাড়াই মাকে সিদ্ধান্ত জানাতে পারত। একজন মানুষের শেষ ইচ্ছের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে! অথচ লোকটা ওকে জোর করছে না, ওর মতামত ছাড়া সিদ্ধান্ত ও নিল না। সম্পূর্ণ ব্যাপার ওর উপর ছেড়ে দিল। বিয়ের পর স্ত্রীদের উপর স্বামী, শ্বশুরবাড়ির হুকুমাদি চলে। তাকে তাই করতে হয়, যা তার স্বামী-শ্বশুরবাড়ির লোক চায়। সে নিজস্ব মতামত প্রকাশের সুযোগ পায় না। সুযোগ পেলেও তা গ্রহন করা হয় না। শ্বশুরালয়ের সিদ্ধান্তই অটল থাকে। স্ত্রীদের মতামতের গুরুত্ব সবাই দিতে পারেনা, দিতে পারলেও দেয় না, প্রয়োজন মনে করেনা। অথচ অভীক ছোটো থেকে ছোটো বিষয়েও তাহিয়ার মতামতকে প্রাধান্য দেয়, ওর সম্পৃক্ত বিষয়গুলো ওর সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়। এই যে এখনো দিল। মেয়েরা স্বামীর কাছে সর্বপ্রথম যা চায়, তা হলো গুরুত্ব, হোক নিজের কিংবা নিজের মতামতের। অভীক দুটোই তাহিয়াকে দিচ্ছে, উপরিলাভ হিসেবে ভালো লাগায় মন ছুঁয়ে দিচ্ছে।

তাহিয়ার ভাবনার মাঝে অভীক আবার জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার যাওয়ার ইচ্ছে হলে বলো, আমি নিয়ে যাব। অন্যথায় জোর করব না।’ পুরো সিদ্ধান্ত তাহিয়ার কাধে ছেড়ে দিল অভীক।

তাহিয়া প্রসন্ন হাসল। হাসি থামিয়ে বলল,
‘অবশ্যই যাব। একজন মৃত্যুশয্যা রোগীর শেষ ইচ্ছের থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারেনা। তা কবে নিয়ে যাবেন?’

অভীক জানত তাহিয়ার পক্ষ থেকে নেতিবাচক উত্তর আসবে না। তাও আগে তাহিয়ার মতামত জানার মনস্থির করেছে। তাহিয়ার পক্ষ থেকে ইতিবাচক জবাব এলে তারপরই জনাবে। ভাবনামাফিক জবাব আসতেই প্রশান্তির হাসি টানল ঠোঁটের কোণে। বলল,
‘কাল সকালে রওনা দিব। তুমি বাসায় গিয়ে দু’দিনের কাপড় গুছিয়ে নিও। আমি সকালে তোমাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিব।’

‘ঠিক আছে।’ সায় জানাল তাহিয়া।

পরদিন সকাল সকাল রওনা হলো ওরা। তাহিয়া ইতঃপূর্বে গ্রামে যায়নি। তাহিয়ার দাদা দাদী, নানা নানী সবাই মৃত। চাচা, মামারা সবাই শহরবাসী। গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে না। সে হিসেবে যাওয়াও হয়নি বা হয়না। প্রথমবার গ্রামে যাবে আজ। সকাল থেকে বেশ উদ্দীপনা কাজ করছে ওর মাঝে। গ্রাম কেমন হবে, ওখানকার মানুষজন কেমন হবে, সবার সাথে মিশতে পারবে কি-না এসব ভাবনা হানা দিচ্ছে। মীরার কাছে প্রায় ওর দাদুবাড়ির গল্প শুনে তাহিয়া। শোনাকথা, শীতকালে গ্রামের পরিবেশ ভীষণ সুন্দর থাকে। শীতের সকালে মেঠোপথ দিয়ে হাঁটার আনন্দ বেশ। ঋতু পৌষ মাসে পা রাখার প্রথমদিন আজ। তার মানে ওখানে গেলে মীরার বলা দৃশ্যের সাথে পরিচিত হতে পারবে? ভাবতেই আনন্দ লাগল তাহিয়ার। পরক্ষণেই আনন্দ ঠেলে ভাবল, রোগী দেখতে যাচ্ছে বিয়েতে নয় যে ঘুরতে যাবে। রোগীর পাশেই বসে থাকবে পুরো সময়।

গাড়িতে বসে ও ভাবনায় মজল তাহিয়া। গভীর ভাবনায় মত্ত তাহিয়াকে পরখ করে ভ্রু কুঁচকাল পাশে বসা অভীক। বলল,
‘কিসের চিন্তায় মগ্ন আমার হিয়ারানী?’

ধ্যানভগ্ন হলো তাহিয়ার। পাশ ফিরে চাইল, বলল,
‘ আমি কখনো গ্রামে যাই নি। জানিনা গ্রামীণ জীবন কেমন, মানিয়ে নিতে পারব কি না ভাবছি।’

অভীক এক হাত উঠিয়ে তাহিয়ার পিঠ হয়ে বাহুতে রাখল। তারপর আশ্বাসের বাণী ছুঁড়ল, বড্ড কোমলস্বরে,
‘আমি তোমার সাথে থাকতে তোমাকে চিন্তিত হওয়া মানায় না হিয়া। আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী হয়ে আমার সাথে যাচ্ছো , তোমার ভ্রমণ সুপ্রসন্ন করার দায়িত্ব আমার। আমি আছি তো, চিন্তা করো না।’

তাহিয়ার কানে সুন্দর শুনাল কথাগুলো। কাধে একটা হাত আর মাথার উপর ছাদ থাকলে মানুষ সব অসাধ্য সাধন করতে পারে। তাহিয়া তীর্যক চোখে নিজের বাহুর দিকে তাকাল। এটা সেই হাত, ভরসার হাত। বিপদ আপদে ওকে আগলে রাখা ঢাল। এমন মানুষ পাশে থাকলে আর কী লাগে? জীবন সুন্দর, সার্থক হয়। তাহিয়া স্মিত হাসল। যখন তখন ভালো লাগা প্রকাশ করতে নেই। সে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘ওখানে আমার কী কী দায় দায়িত্ব আছে ?’

অভীক ধীর স্বরে উত্তর দিল,
‘যেহেতু দাদীমাকে দেখতে যাচ্ছো, তাই চেষ্টা করবে উনাকে সময় দেয়ার। উনার পাশে বসবে, ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করবে। বাড়িতে ফুপি, চাচীরা আছে, তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলবে। এ ছাড়া আর কারো সাথে দেখা হলে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করবে, আর মাকে সঙ্গ দিবে। এসব করলেই হবে।’

তাহিয়া অবাক হয়ে বলল,
‘ সবার সাথে মিশব, কথা বলব, ব্যাস এটুকুই?’

‘তুমি ওখানে মেহমান হিসেবে যাচ্ছো। মেহমানের দায়িত্বের পরিমাণ বেশি থাকে না। তবে তুমি যদি বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে চাও তবে আরেকজনের দিকে নজর দিতে পারো। ‘
অভীকের কথায় তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল, ‘ কার দিকে নজর দিব?’

‘যার কাছে তুমি মেহমান নও, যার নিজস্ব গৃহের গৃহস্থ তুমি, সুযোগ পেলে তাকে সময় দিও একটু। বেশি না, একটু হলেই হবে। তাতেই সে সন্তুষ্ট। ‘

অভীকের স্বরটা শান্ত। ওর শান্ত কথায় অশান্ত হলো তাহিয়ার মস্তিষ্ক। অভীকের কথা তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারল না ও। অভীকের কথা বিশ্লেষণ করতে বসল। অভীক কাকে সময় দেয়ার কথা বলল? যার কাছে মেহমান নয় সে। কার কাছে মেহমান নয় সে? ওখানে নীলিমা আর অভীক ছাড়া সবাই তাহিয়ার অপরিচিত। নীলিমার কাছেও মেহমান। তবে কে? বাদ বাকি থাকা অভীক? হ্যাঁ, ওর কাছেই তো তাহিয়া মেহমান নয়, ওর নিজস্ব গৃহের গৃহস্থ তো সেই। অভীক এখানে ‘নিজস্ব গৃহ’ বলতে নিজের মন বুঝাল না কি ঘর বুঝাল? মনই হবে হয়তো, ওর তো নিজস্ব ঘর হয়নি এখনো। তারমানে অভীক নিজেকে সময় দেয়ার কথা ইঙ্গিত করেছে? এত ঘুরিয়ে বলার কী আছে? সোজাসাপটা বললেই তো হয়, আমাকে সময় দিও। লেকচারার মানুষদের কি সোজা কথা বলতে মানা? কে জানে, হয়তো তাই। এক প্রমাণ তো হাতের কাছেই।

বিশ্লেষণ শেষে তাহিয়া কৌতুকের স্বরে বলল,
‘আমি যাকে দেখতে যাচ্ছি, তাকেই শুধু সময় দিব। বাকি কাউকে সময় দিতে পারব না। এত সময় নেই আমার। আহমেদ বাড়ির বউ আমি, কত দায়িত্ব। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা শ্বাশুড়ি আর দাদী শ্বাশুড়ির পাশে কাটাব। নড়চড় হবে না, আমার দেখাও পাবে না কেউ। বাড়তি দায়িত্ব নিতে রাজি নই আমি। ‘

অভীক চোখ ছোটো ছোটো করে চাইল তাহিয়ার পানে। মনে মনে বলল,
‘মেরি বিল্লি, মুজছে মেয়াও! সাংঘাতিক! ‘

মুখে বলল, ‘আহমেদ বাড়ির ছেলের কাছ থেকে ছেলেবউ কতক্ষণ দূরে থাকতে পারবে দেখব। এমন যেন না হয় যে, দাদী শ্বাশুড়িকে এক পলক দেখেই স্বামীর খোঁজ করা শুরু করবে। স্বামী চোখের আড়াল হলেই হন্য হয়ে খুঁজবে। না পেয়ে শ্বাশুড়ির কাছে এসে লাজুক স্বরে বলবে, আন্টি উনি কোথায়? শ্বাশুড়ি ডাকলেও তখন কিন্তু তোমার ‘উনি’ আসবে না।’

তাহিয়া ভেংচি কেটে বলল, ‘ এমনটা হবে না। আমি কাউকে দেখার জন্য হয়রান হবো না, একদম না। বাড়ি গেলে আমার উনি টুনি লাগবে না। দুই শ্বাশুড়ি হলেই হবে।’ মুখ ফসকে বলে ফেলল তাহিয়া। বলার আগে ভাবেওনি কী বলতে যাচ্ছে ও।

অভীক তাহিয়ার কাধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলল তৎক্ষনাৎ। বলল,
‘ এখনও না লাগুক। ‘

অভীকের স্বরে কেমন রাগ ভাব। মানুষ যখন কাউকে প্রচন্ড আপন ভাবতে শুরু করে তখন তার কাছে অনেক বেশি সময় আশা করে। তাকে কাছ ছাড়া করতে চায় না, অন্য কাউকে বেশি সময় দেয়াও পছন্দীয় হয়না ওদের। দূরত্ব মেনে নিতে পারেনা। অভীকের অবস্থাও বোধহয় এমন, ভাবল তাহিয়া। অনেক বেশি আপন ভাবতে শুরু করেছে ওকে। ঠোঁট চেপে হাসল ও। অভীকের সরানো হাত আবার টেনে নিজের কাধে রাখল। তারপর বলল,
‘ আমার একটাই উনি। উনাকে না লাগলে কাকে লাগবে, বলুন? উনাকে আমার কৌতুকে প্রয়োজন, উনিই তো আমাকে আগলে রাখার প্রিয়জন। উনাকেই তো লাগবে, অনেকভাবে, সবকিছুতে।’

অভীকের দৃষ্টি সামনের দিকে ফেরা ছিল। তাহিয়ার বলা মুগ্ধঘন কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তড়িৎ মাথা ঘুরিয়ে তাহিয়ার দিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকাল,
‘একটু আগেই তো আমাকে লাগছিল না, এখন আবার লাগছে কেন?’

‘ আমার কাছে উনি আর রেহান দুটো অপশন ছিল। রেহানের অপশনটা কতৃপক্ষ ডিলিট করে দিয়েছে, বাদ বাকি একটাই অপশন আছে। তা হলো, ‘উনি।’ এখন অপশন সঙ্কটে ঘুরে ফিরে ‘উনার’ কাছেই যেতে হচ্ছে। লাগবে না বললেও মন মানছে না, মনের কথা শুনতে গিয়েই উনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কী আর করার, অপশন সঙ্কট। ‘ ঠোঁটের উল্টিয়ে নিষ্পাপ ভঙ্গিমায় বলল তাহিয়া। অভীকের হাসি পেল, তবে হাসল না। মুখ স্বাভাবিক রেখে বলল,
‘ কথার পন্ডিত তুমি। একমাত্র কথাটাই ভালোই পারো বলতে। ‘

‘ আরও একটা কাজও ভালো পারি। আবেগকে প্রশ্রয় দিতে পারি। ‘ হেসে বলল তাহিয়া।

‘তোমার প্রশ্রয় দেয়া আবেগই আমাকে ডুবাচ্ছে। ‘ মনে মনে বলল অভীক। মুখে বলল,
‘এত আবেগী হলে জীবন চলে না। বিবেকবান হওয়াতেই মঙ্গল। ‘

‘এখনো চলছে তো, বাকি জীবন ও চলে যাবে। দম্পতির মাঝে একজনকে আবেগী হতে হয়, একজনকে বিবেকবান। জীবন আবেগ, বিবেক দুটো মিলেই চলে। আবেগ মনকে খুশি করে, আর বিবেক জীবনকে সুখী করে। আমাদের মাঝে আপনি বিবেকবান,আমি আবেগী। দুজনেই বিবেকবান হলে জীবনটা যান্ত্রিক হয়ে যেত, এসব ভাব ভালোবাসা হতো না। দুজন দুই পথে থাকতাম, তিন বছর পরে এক হতাম। বিবেক গম্ভীর, আবেগ চঞ্চল। বিবেক যুক্তি বুঝে, আবেগ যুক্তি বুঝে না। বিবেক শর্ত ভঙ্গ করে না, আপনি করেন নি। আবেগ ভঙ্গ করে, আমি করেছি। আবেগ বিবেক মিলে গেলে তবেই জীবন সুন্দর।’

তাহিয়া থামল। তারপর আবার বলল,
‘ এই যেমন, বাইরে বৃষ্টি হলো, বিবেক চিন্তা করবে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে, ঠান্ডা থেকে অসুখ হবে, এসব থেকে বাঁচতে ভেজা উচিত নয়। আবেগ চিন্তা করবে, বৃষ্টি ভেজার মাঝে অনেক আনন্দ আছে। একটু ভেজাই যায়, অসুখ হলে দেখা যাবে। আপনি নিষেধ করবেন বৃষ্টি ভিজতে, আমি তাও ভিজব। কিছুক্ষণ আবেগের কথা শুনে তারপর বিবেকের শুনতে হয়। আমি কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আপনার কথা মেনে উঠে আসব। এতে আনন্দ ও হবে, অসুখ ও হবে না। এটাকে বলে আবেগ বিবেকের সংমিশ্রণ। ‘

মৃদুস্বরে বলে গেল তাহিয়া। অভীক মুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনল। কত গভীরভাবে চিন্তা করে এই মেয়ে। প্রশংসনীয়। অভীক হাসল। বলল,
‘ পড়াশুনা নিয়ে যদি এত গভীর চিন্তা করতে তবে ডিপার্টমেন্টে টপ করতে। ‘

তাহিয়া বিরক্তমাখা গলায় বলল,
‘এখন পড়াশোনার কথা না উঠালেই নয়? পড়াশোনার কথা বলতে ভালো লাগে না আমার।’

অভীক হেসে বলল,
‘আমি লেকচারার মানুষ। পড়াশোনা আর জ্ঞানদানই আমার প্রধান কাজ। অভ্যাসগতভাবে বেরিয়ে আসে, কী করা।’

তাহিয়া কথা ঘুরাল,
‘আপনি দিনদিন হিংসুটে হয়ে যাচ্ছেন লেকচারার সাহেব। লক্ষণ কিন্তু ভালো না। ‘
‘ কিসের ভিত্তিতে আমাকে হিংসুটে বললে তুমি?’ ভ্রু কুঁচকাল অভীক। তাহিয়া বলল,
‘আমি সময় দিব না বলার পর আপনার চেহারার যা অবস্থা হয়েছে সেই ভিত্তিতে বলছি। কীভাবে নাক ফুলাচ্ছিলেন, ষোড়শী কিশোরীর মতো অভিমানী চোখে চাইলেন! আমি কিন্তু সব ঠাহর করেছি।’

‘ওটা তো মজা করেছিলাম। দাদীমাকে দেখতে যাচ্ছো, দাদীমাকেই সময় দিবে। আমাকে সময় তো পরেও দিতে পারবে। সমস্যা হবে না। আপতত দাদীমাই আমাদের মধ্যমণি।’ গম্ভীর শুনাল অভীকের কথা।
তাহিয়া হেসে বলল,
‘তো আমি কোথাকার সিরিয়াসলি বলেছিলাম, আমিও মজা করেই বলেছি। দিনের পুরো সময়টা দাদীমার জন্য বরাদ্দ, ফাঁকে সামনে এলে কয়েক পলকে দেখাদেখির সময়টা আপনার। ‘

অভীক বিস্তৃত হাসল। বলল, ‘আচ্ছা। ঠিক আছে, আগে বাড়ি যাই তারপর বাকিসব দেখা যাবে। এখন ঘুমাও একটু, সকালে ঘুম হয়নি ভালোমতো। আবার মাইগ্রেন হানা দিবে।’

মূলত, তাহিয়ার ঘুম পাচ্ছে। সকালের অপূর্ণ ঘুমটা চোখে এসে ভর করেছে গাড়িতে পিঠ এলানোর পরপরই । অভীকের কথায় মগ্ন থাকায় ঘুমকে সাড়া দিতে পারেনি। অনুমতি পেয়ে সিটে মাথা রাখল। গাড়ি তখন ভাঙা রাস্তা পার হয়ে এগুচ্ছিল। ভীষণ ঝাকি দিচ্ছিল, তাহিয়ার মাথা চলে যাচ্ছিল গ্লাসের দিকে। ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছিল তাহিয়ার। তা পরখ করে অভীক এক হাতে টানল কাছে। মাথাটা আলতো করে নিজের কাধে রেখে বলল,
‘এবার ঘুমাও।’

তাহিয়া হাসল। একপলক অভীকের পানে চেয়ে আবার চোখ বুজল। একসময় ঘুমিয়েও পড়ল। অভীক ঘুমন্ত অর্ধাঙ্গিনী চাইল, চেয়ে রইল। এক সময় পলক ফেলল, প্রিয়তমার চোখে পরা চশমা খুলে নিল। অন্য হাত পিঠে দিয়ে আগলে নিল, আলতো হাতে।

তাহিয়ার ঘুম ভাঙল ঘন্টা দুয়েক পর। চোখ খুলে অভীকের বাহুডোরে আবিস্কার করল নিজেকে। সরে বসে বলল,
‘আর কতক্ষণ লাগবে?’

‘ ঘন্টাখানেক।’ ছোটো করে উত্তর দিল অভীক। তাহিয়ার জানালার দিকে এগুলো, বাইরে নজর দিল। গাড়ি শহর পেরিয়ে গ্রামের পথে ঢুকেছে। মাঝে রাস্তা, দু’পাশে সরষে ক্ষেত। কী সুন্দর লাগছে! যেন হলুদ শাড়ি পরা রূপসী কন্যা হেঁটে যাচ্ছে বাংলার বুকে। তাহিয়া বিমোহিত হয়ে চেয়ে রইল। চোখে একরাশ মুগ্ধতা।

তাহিয়ার দৃষ্টি বাইরে পড়তেই অভীক চোখ বন্ধ করল। ডান হাতটা বাঁ কাধে নিয়ে খানিকটা এদিকে ওদিক হেলে গেল। দীর্ঘক্ষণ তাহিয়ার মাথা থাকায় কাধ ব্যাথা করছে। সিটে হেলান দিয়ে স্থির হয়ে বসল। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, ক্লান্তিকে সায় জানিয়ে চোখ বুজল। তখন তাহিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে চঞ্চল গলায় বলল,
‘ গ্রামের অনেক গল্প শুনেছি, কখনো দেখা হয়নি। আজই প্রথম দেখছি। কী সুন্দর! ‘

অভীক চোখ খুলল। চেহারা থেকে ক্লান্তিভাব সরিয়ে হাসল। তাহিয়ার দিকে চশমা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ সৌন্দর্য উপভোগ করো। এদিক থেকে গ্রামের সৌন্দর্য শুরু হয়েছে, আমাদের ওদিকটা আরও সুন্দর। যত এগুবে সৌন্দর্য বাড়বে। ‘

তাহিয়া চশমা পরে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। আকস্মিক পিছু ফিরল। অভীককে পরখ করল, অভীকের চেহারায় ক্লান্তির আভা দেখতে পেল। চোখ জোড়া বন্ধ। তাহিয়া প্রকৃতি দেখা বাদ দিয়ে সিটের ব্যাক সাইড থেকে ওর হ্যান্ড ব্যাগ হাতে নিল। নিঃশব্দে চেইন খুলে হাতড়ে থার্মোস ফ্লাস্ক বের করল। আকারে বেশ ছোটো। তারপর আবার ব্যাগে চোখ রেখে কিছু খুঁজল। পেয়ে ও গেল, একটা সিরামিকের কফি মগ। মগটা ওরই, ভীষণ পছন্দের। এই মগ ও কারো সাথে শেয়ার করেনা, তুহিনের হাতে দেখলেই ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। বিশেষ জিনিস বিশেষ মানুষের সাথে আপত্তিহীনভাবে ভাগ করা যায়। নিঃসন্দেহে অভীক ওর জীবনের বিশেষ মানুষ। সকালে ব্যাগ গুছাতে গিয়ে অভীকের কথা ভেবেই রিনাকে দিয়ে সবুজ চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ভরে নিয়েছে, সাথে ব্যাগে নিয়েছে মগটা।

মগে চা ঢেলে মৃদুস্বরে ডাকল,
‘লেকচারার সাহেব, ঘুমিয়েছেন?’

অভীক ঘুমায়নি। চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তাহিয়ার ডাক শুনে অবস্থার পরিবর্তন না করেই হাসল। ডাকটা কেমন অদ্ভুত শুনাচ্ছে। চোখ খুলে বলল,
‘ এসব সাহেব টাহেব হজম হয়না আমার। নাম ধরে ডাকো। ‘

‘শিক্ষকদের নাম ধরে ডাকতে নেই। ‘তাহিয়া কৌতুকের স্বরে বলল। অভীক ও চেইন টানল, ‘ শিক্ষকটা ব্যক্তিগত হলে ডাকার অনুমতি আছে।’

তাহিয়া ওর হাতে থাকা মগটা অভীকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এসব ব্যাপারে পরে ভাবা যাবে। এখন চা খান, ক্লান্তিবোধ কমবে কিছুটা।’

অভীক বরাবরের মতো বিস্ময়ের সাথে মগ হাতে নিল। তবে এবার বিস্ময়ের মাত্রা কিছুটা বেশি ছিল। এখন চা আসার কোন পথ দেখছে না ও। চা কোথায় পেল তাহিয়া। প্রশ্ন করল,
‘চা কোথায় পেলে?’
‘বাসা থেকে বানিয়ে এনেছি।’ অন্য হাতে থাকা ফ্লাস্ক উঠিয়ে দেখাল তাহিয়া। অভীক তা পরখ করল। কিছু বলল না। চুপচাপ চায়ে চুমুক দিল, গলাধঃকরণ করে চমৎকার হাসল। এখন এই চায়ের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। প্রিয়জনগুলোই বোধহয় প্রয়োজন বুঝে। মেয়েটাও বুঝে গেল। এই চা দিয়েই মেয়েটা ওকে বশ করেছে, হাসপাতালে সেই রাতে। তারপর থেকে প্রতিদিন বশ করে যাচ্ছে, যখন ওর চায়ের ভীষণ প্রয়োজন হয়, তখন চা নিয়ে হাজির হয়। আজ আসার সময় মনে করে নিয়ে এসেছে, কাজটা হৃদয়গ্রাহী।

তাহিয়া অভীকের সেই হাসিতেই সন্তুষ্ট। মনের ভাব গুলো প্রকাশের জন্য কথা বলতে হয়না, একটু মুখভঙ্গিই যথেষ্ট। এক কাপ চা আর মুগ্ধতা নিয়ে বাকি পথ পার করল ওরা। বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়াল । তাহিয়া বাড়ির ভেতরে যেতেই নীলিমা দৌড়ে এলেন। বোধকরি, তাহিয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। দেখেই বুকে জড়িয়ে নিলেন। উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। বউ শ্বাশুড়ির আলাপের মাঝে চারজন মহিলা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নীলিমা তাহিয়াকে দেখিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘তাহিয়া, আমার ছেলের বউ।’

তারপর তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ এরা সবাই তোমার ফুপু শ্বাশুড়ি। ‘

তাহিয়া সালাম দিল। তিনজন হাসিমুখে সালাম নিয়ে কুশল বিনিময় করলেন ওর সাথে। বাকি একজন, যার নাম জাহানারা। সম্পর্কে অভীকের মেজো ফুপু। তিনি তাহিয়াকে পরখ করে মুখ কুঁচকালেন। বললেন,
‘এইডা তোমার পোলার বউ?’

নীলিমা ভীত ঢোক গিললেন। জাহানার স্বভাব সম্পর্কে তার অজানা নয়। জাহানারা নাক উঁচু স্বভাবের। কাউকে কথা বলতে দু’বার ভাবেন না, মুখের উপর অপমান করে দেন। জাহানারার বড়ো মেয়ে জাবিনের সাথে অভীকের বিয়ের কথা ভেবেছিলেন জাহানারা। প্রস্তাব ও দিয়েছেন, কিন্তু তাহিয়াকে আনবেন বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন নীলিমা। প্রস্তাব ফেরানোর পর জাহানারা ক্ষেপে আছেন নীলিমার উপর। আগে ভাইয়ের বাসা হয়ে ডাক্তার দেখাতে যেতেন, এর পর তাও বন্ধ করে দিয়েছেন। এই তো বাড়িতে আসার পর থেকে কতগুলো বাঁকা কথা শুনিয়েছেন নীলিমাকে। তাও রাগ কমেনি, এখন বাকি রাগ ঝাড়বেন তাহিয়ার উপর। জাবিনের গায়ের রঙ দুধে আলতো, অপরদিকে তাহিয়ার গায়ের রং বাদামী। দুজনের তুলনা করে কথা দিয়ে তাহিয়ার নাড়িভুড়ি বের করে ফেলবেন। শহুরে মেয়ে তাহিয়া, গ্রামের এত প্যাঁচ বুঝবে না । মন খারাপ হবে, শেষে অপরাধবোধ নীলিমারই হবে। এই ননদের কথা ভেবেই তাহিয়াকে আনার বিপক্ষে ছিলেন তিনি। কিন্তু রেবুন্নেছা বারবার বলছিলেন। রোগীর কথায় সবাই সায় দিয়ে অনুরোধ করছিল শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে। না বলে পারলেন না নীলিমা। এখন ভয় লাগছে উনার। জাহানারার আক্রোশে পড়ার আগে তাহিয়াকে নিয়ে সরে যাওয়ার মনস্থির করলে তিনি। উঠোন থেকে সরিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন, তারপর রোগীর ঘরে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মেয়েটাকে কাঁদিয়েই ছাড়ল।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here