#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-২০)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
অগ্রহায়ণের শেষান্তের এক প্রভাতের কথা। প্রকৃতিতে আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে শীত। বাতাসের সাথে মিশে আছে হিম ধারা। কুয়াশা মুঠোয় নিয়ে সকাল নামে, সন্ধ্যা নামে। কুহেলিকার ধূম্রজাল চিরে সূর্য নামতে বেলা গড়ায় অনেকখানি। কখনো বা মেঘের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে। আজকের সকালটা ধূসর। সূর্যটা মেঘের কোলে লুকিয়ে আছে। কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ। ঘড়ির কাটায় সকাল দশটা বাজে, অথচ প্রকৃতির দিকে চোখ ফেললে তড়িৎ বলে দেয়া যায় সকালটা নেমেছে সবেই, বেলা অত গড়ায় নি।
শীতের সকালে একটু বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস তাহিয়ার। তুলতুলে কম্বলটাকে শরীরে মুড়িয়ে ঘুমের দেশের বিচরণ করার মতো আনন্দদায়ক কাজ তার কাছে দুটো নেই। সকালে মাহমুদা স্কুলে যাওয়ার আগে ডেকে গিয়েছেন, কলেজে যাওয়ার তাড়া দেয়ার পর ঘুম ঘুম গলায় তাহিয়া স্পষ্ট জানিয়েছে আজ কলেজ যাবে না, শুধু ঘুমাবে। মাহমুদা তখন বিরক্তিভরে বললেন,
‘ জামাই লেকচারার, বউ ফেইলের উপর ফেইল করছে। কদিন বাদে যখন কলেজে জানাজানি হবে, তখন সবাই হাসবে, স্যারের বউ ফেইল করেছে বলে। হাসির পাত্র হতে হবে তোকে, অভীকের শিক্ষকতার উপর ও প্রশ্ন উঠবে। এবার তো সিরিয়াস হ, একটু পড়ায় মন দে। ‘
ততক্ষণে তাহিয়া নড়েচড়ে ঘুম। মেয়ের পক্ষ থেকে কোন আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে মাহমুদা হায় হায় করতে করতে চলে গেলেন। দ্বিতীয়বারের মতো তাহিয়া যখন গভীর ঘুমে বিভীর হলো তখন বালিশের পাশে রাখা ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠল। ভাইব্রেশনে পুরো খাট নড়ে উঠল যেন। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। চোখ থেকে ঘুম ছুটতেই কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ল । চোখের উপর পরা স্লিপিং মাস্ক না সরিয়ে হাতড়ে ফোন হাতে নিল। আন্দাজে স্ক্রিন টাচ করে কানে দিল। বিরক্তিভরা স্বরে কিছু বলতে যাবে, তার আগে অপাশ থেকে পুরুষালি কোমল স্বর ভেসে এলো।
‘শুভ সকাল মিসেস।’
স্বরটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চোখ বন্ধ করেই হাসল তাহিয়া। সে হাসির শব্দ হলো না, শুধু আনন্দ প্রকাশ হলো। এমন একটা স্বর শুনে ঘুম ভাঙলে প্রফুল্লচিত্তে দিন পার করা যায়। কপাল থেকে বিরক্তির ভাজ সরে গেল, আনন্দরা উঁকি দিল। অপাশের মানুষটা টের পেল না। সে নিজের অবস্থান পরিবর্তন না করে ঘুম ঘুম স্বরে ছোট্টো করে জবাব দিল,
‘ শুভ সকাল জনাব।’
তাহিয়ার স্বরে ঘুমের অস্তিত্ব টের পেয়ে উদ্ধিগ্ন হয়ে উঠল ফোনের অপাশে থাকা অভীক।
‘দশটা বাজে তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো! কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্য নেই? ‘
তাহিয়া আবার হাসল। ঘুম কাটতে শুরু করেছে। অভীকের মনোভাব যাচাই করতে বলল,
‘ভাবছি যাব না। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাব। রাতে তো আপনি ঘুমাতে দিলেন না।’
অভীকের স্বরে এবার বিস্ময় ছেয়ে গেল,
‘আমি দিই নি!’
পারতপক্ষে, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর সময় অভীক ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতে ফোন দিয়েছিল। কথার মাঝে তাহিয়া আবদার করে বসল, সারারাত কথা বলবে। বাধ্যগত বিবাহিত প্রেমিক অভীক, সহজ মনেই মেনে নিয়েছিল প্রিয়তমার আবদার। রাত তিনটা অবধি সুখ দুঃখের আলাপ করেছে অর্ধাঙ্গিনীর সাথে। কখনো প্রেয়সীর বলেছে, প্রিয়তম শুনেছে, কখনো প্রিয়তম বলেছে প্রেয়সী শুনেছে। কখনো আবার দুজনই চুপটি করে ভেবেছে। এভাবেই কেটেছে ঘন্টা তিনেক। ঘড়ির কাটা তিনটার ঘর পেরুতেই ঘুমপ্রিয় তাহিয়া ঘুমে চোখে মুখে আঁধার দেখছিল। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ঘুমানোর কথা বলে ফোন রাখল। ঘুম নেমেছিল অভীকের চোখেও। সে ঘুমকে সায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমানোর কথা থাকলেও তাহিয়া ঘুমাল না। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তাহিয়ার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি হানা দিল। লোকটা এখন তার প্রেমিক পুরুষ,তাও বৈধ। প্রেমিকদের জ্বালানো প্রেমিকাদের জাতিগত অধিকার। নতুন প্রেমে পড়লে রাত জেগে ভাবতে হয়, কথা বলতে হয়, ভালোবাসার আলাপ করতে হয়। আর মশাই আরামে ঘুমাবেন? তা তো হবে না। ঘুমে ওর চোখ ও বুজে আসছে। তবুও ঘুমাবে না, আজ অভীককে বিরক্ত করবে। এই নিমিত্তে ঘুমকে প্রাধান্য না দিয়ে অভীককে কল দেয়া শুধু করল। অভীক ঘুমের মাঝেই ফোন ধরে যখন কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বলল। তখন তাহিয়া ঠোঁট চেপে হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি ঘুমিয়ে পরেছেন?’
ঘুমে কাদা অভীক হু হা করছিল। তাহিয়া ‘আচ্ছা আপনি ঘুমান’ বলে ফোন রেখে দিয়েছে। এর মিনিট দুয়েক বাদে আবার কল দিয়েছে। অভীক ঘুম ঘুম স্বরেই বারবার বলছিল, ‘ঘুমিয়ে পড়ো, রাত জাগলে মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠবে।’
তাহিয়া কানে তুলেনি সে কথা,বিরক্ত করেই গিয়েছে। শেষে অভীকের চোখ থেকে ঘুম বিদায় করে ক্ষান্ত হয়েছে। অভীক যখন পুরোপুরি স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘তুমি কি কিছু বলতে চাইছো? কোন সমস্যা হয়েছে, হিয়া?’
তাহিয়া বুঝে নিল, অভীকের চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে। নিজের কার্যসিদ্ধি হয়েছে ভেবেই বাঁকা হাসল সে। হাই দিয়ে বলল,
‘ শুভ রাত্রী বলা হয়নি। সেটা বলতেই ফোন দিচ্ছিলাম। এখন বলছি, শুভ রাত্রী। আমার ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাব। আপনি ও ঘুমান।’
ঠোঁট চেপে হেসে ফোন রাখল তাহিয়া। অভীক হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল বিছানায়।
এখন অভীক সেই ঘটনাকে ইঙ্গিত করছে। তাহিয়া ঘুম ঘুম স্বরে বলল,
‘ তা নয়তো কী! রাত তিনটা অবধি আপনার কথায় ডুবে গিয়ে ঘুমাতে পারিনি আমি।’
‘তা কথা বলার আবদারটা কে করেছে শুনি?’
‘এটা তো সিচুয়েশন ডিমান্ড ছিল, প্রেমে পড়লে রাত জেগে কথা বলতে হয়। আবদারটা আপনার মনে ছিল, আমার মুখে ছিল। তাই আমি একা দোষী না।’
‘ আমাকে যে একটু পর পর কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছে, তার বেলায় দোষটাও কি আমার?’
তাহিয়া উঠে বসল। আড়মোড়া ভেঙে হেসে বলল,
‘জানেন না, প্রেমের সম্পর্কে প্রেমিকার দোষ থাকে না, সব দোষ প্রেমিকের থাকে। সে হিসেবে এই দোষটার আপনার। আমি নিরিহ ভোলাবালা মেয়ে। কোন দোষ করতে পারি?’
অভীক অফিসরুমে বসা ছিল। এক হাতে ফোন কানে ধরা, অন্য হাতে ডেস্কের উপর থাকা পেপার ওয়েট ঘুরাচ্ছে। সে অবস্থাতেই হাসল নিঃশব্দে। হেসে বলল,
‘তা আমার তথাকথিত ভোলাবালা প্রেমিকা, আপনার নিরিহ চেহারাটা কবে নাগাদ কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা যাবে?’
‘মিস করছেন না কি!’ টিপ্পনী কাটল তাহিয়া।
অভীক সরাসরি উত্তর দিল না। ঘুরিয়ে বলল,
‘স্ত্রীকে পড়ালেখার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া স্বামীর দায়িত্ব। আপাতত দায়িত্ব পালন করছি। দশটা বেজে গিয়েছে। তোমাদের ক্লাস শুরু হবে ১০:৪৫ থেকে। আসবে না?’
‘পড়ালেখা ভালো লাগে না। যাব না। ‘ মূলত আজ অভীকের ক্লাস নেই। অভীককে দেখার জন্য তাহিয়ার কলেজ যাওয়া। আজ ক্লাসে দেখা হবে না, তাই যাবে না বলে সিদ্ধান্ত ওর। অভীক বলল,
‘ প্রেমে পড়ে পড়ালেখা কেজি মাপে বিক্রি করে দেয়ার চিন্তাভাবনা আছে না কি?’
‘প্রেমের আগেই বিক্রি করে দিয়েছি পড়ালেখা। মাকে স্কুলে থাকতেই বলেছি, পড়ালেখা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দাও। এসব পড়ালেখা আমার দ্বারা হবেনা। মা ঠেলেঠুলে এ অবধি নিয়ে এসেছেন। তখন আমার কথায় বিয়ে দিলে এতদিনে আমি বিয়ে শাদী করে তিন বাচ্চার মা হয়ে যেতাম। ‘ আনমনে বলে ফেলল তাহিয়া। বলেই জিহ্বা কামড়াল। ইশ! কী বলে ফেলল, এবার লোকটা মজা নিবে নিশ্চিত। হলো ও তাই।
অভীক মজার স্থলে বলল,
”স্বামী সংসার’এর ভাবনা তাহলে বাচ্চাকাল থেকেই ছিল তোমার! আমিই শুধু তোমায় অবুঝ ভেবে আসছিলাম। এদিকে তুমি যে মনে মনে তিনটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে আমার কলেজে ভর্তি করিয়ে ফেলেছো তা তো আমি কল্পনাও ভাবতে পারিনি। সাংঘাতিক! ‘
ভালোই জব্দ হলো তাহিয়া। লোকটা দুদিক থেকে সুতো টেনে গিট দিয়ে প্যাঁচাচ্ছে ওকে। সে প্রসঙ্গ ঘুরাল। স্পষ্টতর গলায় বলল,
‘ আপনার জন্য আমার অনুভূতি আছে, এগুলোকে থাকতে দিন। পড়ালেখার কথা বলে এদিক ওদিক সরাতে বাধ্য করবেন না। পড়ালেখাটা আমাদের সম্পর্কের আওতায় নেই। ওটা বাদ। ওসব পড়ালেখা কথা বলে মুড অফ করবেন না আমার, আগেই বলে দিচ্ছি।’
অভীক হাসতে হাসতেই বলে দিল এক কঠিন কথা,
‘ তোমার দেয়া শর্ত অনুযায়ী, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার আগে আমার বাসায় তোমার পা পড়বে না। এবার তুমি জানো, তুমি ফেইল করে সময় বাড়াবে, না কি সময়মতো পড়ালেখা করবে। তোমার পড়ালেখা, তোমার সংসার, তোমার সিদ্ধান্ত। আমার কী? আমি এসবে নেই। ‘
তাহিয়া স্পষ্ট টের পেল, নিজের দেয়া শর্তের জন্য সে ফেঁসে যাচ্ছে। নিজের জালে নিজেরই পা আটকাবে একদিন। শর্তের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সূচনা বোধহয় এখানেই। আফসোস হলো তাহিয়ার। অভীকের কাছে প্রকাশ করল না। স্বরে দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল,
‘পড়ালেখার সাথে আমারও কোন সম্পর্ক নেই। আমি যে কোন সময় এই ‘ছাত্রী’ নামক চাকরি থেকে ইস্তফা দিব। ‘
রেগে যাচ্ছে তাহিয়া। অভীক টের পেয়ে প্রসঙ্গ বদলাল। এসব ব্যাপারে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হবে। প্রেমের মাঝে পড়ালেখা টানলে প্রেমটা ভেস্তে যাবে। আপাতত প্রেম চলুক বাধাহীনভাবে। সে শান্ত স্বরে বলল,
‘ কলেজে সত্যিই আসবে না?’
‘না।’
‘আজ তবে দেখা হচ্ছে না।’
রাগ পড়ে গেল তাহিয়ার। প্রেমে দূরত্ব আসতে নেই, নিয়মিত সংস্পর্শে থাকতে হয়। চক্ষুতৃষ্ণা বলে একটা ব্যাপার আছে। এখন একদিন না দেখলে মন কেমন করে। মন যে এসে গেছে অভীকের প্রতি। তাহিয়া আকস্মিক প্রস্তাব দিল,
‘ আগে প্রায় বিকেলে হাঁটতে বের হতাম। পড়ন্ত বিকেলে কথা বলতে বলতে ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতাম অনেকদূর। তখন আমার হাঁটার সঙ্গী হতো মীরা। আজ মীরার বদলে আপনি আমার হাঁটার সঙ্গী হবেন?’
অভীক ভ্রু কুঁচকাল। কিছুক্ষণ ভাবল। হঠাৎ হেসে বলল,
‘ জীবনসঙ্গী হতে পারলে হাঁটারসঙ্গী ও হতে পারব। তৈরি হয়ে কল দিও। আমি এসে নিয়ে যাব।’
‘ধন্যবাদ। ‘ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল তাহিয়া। তার খুশির মাত্রা স্বর জানান দিচ্ছে। অল্পতেই খুশি মেয়েটা।
‘ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। এখন রাখি?’
‘আচ্ছা। ‘
রাখবে বলেও রাখল না অভীক। শীতল গলায় বলল,
‘উঠে কিছু খেয়ে নাও। এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে গ্যাস্ট্রিক হতে পারে। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।’
তাহিয়া প্রসন্ন হেসে ফোন রাখল।
•
ধূসর বিকেল। মৃদু বাতাসে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ফুটপাত ধরে হাঁটছে তাহিয়া-অভীক। তাহিয়ার গায়ে ডিপ পার্পল কুর্তি,জিন্স,স্কার্ফ। রেডি হওয়ার সময় চাদর নামিয়ে বিছানায় রেখেছিল। দিনের বেলায় বাসার ভেতরে শীত নেই। ভেবেছিল বের হওয়ার আগে গায়ে জড়িয়ে নিবে। কিন্তু অভীকের ফোন পেয়ে তাড়াহুড়ায় ব্যাগ নিয়েই ছুটেছে, চাদরের কথা খেয়াল থেকে সরে গিয়েছে। ভুলটা টের পেল যখন বাইরের শীতল বাতাস গা ছুঁলো। ততক্ষণে সে গেইট পেরিয়ে অভীকের সাথে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করেছে। দুজনেই নিরবে হাটছে। নিরবতা ভাঙল তাহিয়া। বলল,
‘আজকের পরিবেশটা সুন্দর, ঠান্ডা ঠান্ডা। ‘
অভীক পাশে তাকাল। একটা শীতাতপ ধমকা হাওয়া বয়ে গেল তখন। তাহিয়া কেঁপে উঠল শীতে। অভীক তা পরখ করে বলল,
‘শীতবিলাস করার জন্যই বুঝি চাদর জড়িয়ে আসো নি ?’
তাহিয়া বলল,
‘তাড়াহুড়ায় বেরুতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম।’
অভীকের গায়ে ধূসর পুলওভার, কালো প্যান্ট, কালো একটা শাল ভাজ করে ঘাড়ের দিক থেকে নিয়ে সামনে ছেড়ে দেয়া। শালটা খুলে তাহিয়ার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে পরপরই বলল,
‘ ভুলে গিয়েছো নাকি আমার শাল পরার সুযোগ খুঁজছিলে, কোনটা?’ কৌতুকের সুর অভীকের।
শালটা আড়াআড়িভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল তাহিয়া। ঠান্ডাভাব কিছুটা কমে এলো। তাহিয়া শালের দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর অভীকের দিকে। চোখ সরিয়ে বলল,
‘ সুযোগের অধিকার আছে আমার। নিতেই পারি। ‘
অভীক মজার স্থলে বলল,
‘হিয়ারানী তো দেখি অধিকারের লড়াইয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। শাল না দিলে তো বোধহয় প্লেকার্ড নিয়ে মিছিলে নেমে যেতো । সাংঘাতিক। ‘
তাহিয়া হাসল। এ কথা সে কথা চলতে থাকল। কথার মাঝে এগুতে লাগল তারা। ফুটপাতের ধারে রেশমি চুড়ি নিয়ে বসেছে এক মহিলা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থামল অভীক। তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
‘চুড়ি নিবে, হিয়া?’
শতকরা পঁচানব্বই ভাগ বাঙালি নারীর রেশমি চুড়ি পছন্দ। তাহিয়ার পছন্দ অপছন্দের তালিকা সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা নেই অভীকের। ধীরে ধীরে যেগুলো সামনে আসছে সেগুলো জানতেছে। পঁচানব্বই ভাগ নারীর মধ্যে তাহিয়া আছে কি না নিশ্চিত নয় অভীক। সম্ভাবনা আছে বলেই জিজ্ঞেস করা।
অভীকের প্রশ্নে তাহিয়া থামল। চুড়ির ঝুড়ির দিকে তাকাতেই মুখটা উৎফুল্লতায় ভরে উঠল। চুড়িটা বেশ পছন্দ ওর। শাড়ি পরা হয়না বলে রেশমি চুড়িও বেশি পরা হয়না। মেয়েরা পছন্দের জিনিস গুলো না পরলেও কিনে রাখে। নিজের রুমে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করে। তাহিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। রেশমি চুড়ি দেখলেই কিনে, চুড়ির একটা আলনা নিয়েছে, তাতে সাজিয়ে রাখে। এই কাজটা আনন্দের সাথেই করে সে।
তাহিয়ার মুখভঙ্গি দেখে অভীক বুঝে নিল, তাহিয়া পঁচানব্বই ভাগ নারীর মধ্যে পড়ে। অভীক খানিক ভাবল। আমেরিকান এক জরিপে বলা হয়েছে, শতকরা আশি ভাগ নারীর পছন্দের রং নীল। বাঙালি নারীদের বিশাল একটা অংশ এই আশি ভাগে পড়ে। বিশেষ করে পোশাক আর চুড়ির দিক দিয়ে। তাহিয়াও তাদের তালিকায় পড়তে পারে, সম্ভাবনা আছে। তাহিয়ার ভাবনার মাঝে অভীক ঝুকে বসল। খুঁজে খুঁজে এক ডজন নীল চুড়ি হাতে নিল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘এটাই তোমার পছন্দ, তাই তো? হাত দাও আমি পরিয়ে দিই।’
বলে কাগজ ছাড়িয়ে তাহিয়ার হাত টেনে পরিয়ে দিল।
তাহিয়া চমকাল। হাতের দিকে তাকাল এক পলক, তারপর অভীকের দিকে। ওর নীল চুড়ি পছন্দ, লোকটা কিভাবে জানল? ওর পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে খেয়াল আছে লোকটার? ওর হাসি চওড়া হলো। জীবনে এত চুড়ি কিনেছে, এতটা খুশি, এত সুখিবোধ কখনো হয়নি। কোন চুড়ি এতটা বিশেষ লাগেনি, যতটা এই চুড়ি গুলো লাগছে। কারণটা হলো এই চুড়ি কিনে দেয়া আর পরিয়ে দেয়া মানুষটা তার ভীষণ বিশেষ । হাত নাড়িয়ে চুড়ির ঝনঝন শব্দ শুনল, বিস্তৃত হাসল।
অভীক অবাক হয়ে দেখল শুধু। এই চুড়িটার দাম কত হবে? ৩০-৪০টাকা? অথচ তাহিয়ার খুশি দেখে মনে হচ্ছে সে হীরে পেয়েছে। অল্প কয়েকটাকার জিনিসে কেউ এতটা খুশি হতে পারে জানা ছিল না অভীকের। সে তো জানতোই না তাহিয়ার পছন্দ সম্পর্কে। শুধু আইকিউ কাজে লাগিয়ে চুড়ির কথা জিজ্ঞেস করেছে, আর পরিয়ে দিয়েছে। ব্যাস? এতেই মেয়েটার খুশি দেখে মনে হচ্ছে সে চুড়ি নয় বিশ্বজয় করে এনে দিয়েছে। বউদের খুশি করতে বেশি কিছু লাগে না। একটু বুদ্ধি, একটু সময় আর কিছু টাকা খরচ করলেই খুশিটা আপনাআপনি এসে হানা দেয়।
খুশি হয়ে কয়েক ডজন চুড়ি কিনে দিল অভীক। তাহিয়া উৎফুল্ল মনে গ্রহন করল। কৃতজ্ঞতা ভরে চাইল অভীকের পানে। অভীক শুধু হাসল। বিল দিয়ে আবার হাঁটা ধরল। যেতে যেতে তাহিয়া বলল,
‘হঠাৎ চুড়ি কিনে দিলেন কেন?’
‘প্রেমিকের পক্ষ থেকে প্রেমিকাকে দেয়া উপহারের মধ্যে সবার উপরে থাকে চুড়ি। আমি উপরের তালিকা দিয়েই শুরু করেছি। ‘ থামল। পরপরই জিজ্ঞেস করল,
‘চুড়ি তোমার ভীষণ পছন্দ, তাই না?’
তাহিয়ার মনটা ভালো। সে চঞ্চল গলায় বলে গেল,
‘ সোনা রূপার গহনা ভালো লাগে না আমার। সোনা রূপা থেকে ও বেশি মূল্যবান এই রেশমি চুড়ি। অনেক ভালো লাগার। একটা আবেগ জড়িয়ে থাকে রেশমি চুড়িতে। কেউ আমাকে সোনায় মুড়িয়ে দিলেও আমি এত খুশি হইনা, যতটা এক ডজন চুড়ি দিলে হই।’
অভীক প্রসন্ন হাসল। মাস কয়েক আগেই ওর বন্ধু তামিমের স্ত্রী লামিয়ার সাথে ভীষণ ঝগড়া হলো তামিমের। কারণটা ছিল, পাশের বাসার ভাড়াটিয়া ওর বউকে স্বর্ণের চুড়ি উপহার দিয়েছে। ওই মহিলা চুড়ি পরে লামিয়ার কাছে এসে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করেছে। এরপর লামিয়ে বায়না ধরেছে তারও ওইরকম চুড়ি লাগবে। তামিম যেন নিয়ে দেয়। হিসেব করে দেখা গেল চুড়ির দাম এক লাখ টাকা। তামিমের কাছে তখন এত টাকা ছিল না। সে বুঝিয়ে বলল, যে পরে টাকা হলে কিনে দিবে। কিন্তু লামিয়া মানতে নারাজ। তার চুড়ি লাগবে মানে লাগবেই, চুড়ি না পেলে সে পাশের বাসার ভাবির কাছে ছোটো হয়ে যাবে। স্বামীর অবস্থা না বুঝে লামিয়া সংসারে অশান্তি শুরু করল। তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাটি নিত্য সঙ্গী হলো। তামিম প্রায় এসে ওর কাছে দুঃখের ঝুলি খুলে বসত। বাসায় যেতেই অনীহা প্রকাশ করত, স্ত্রীর অশান্তিতে বিষিয়ে উঠেছিল। শেষে ঋণ নিয়ে চুড়ি নিয়ে দিয়েছে, তবেই শান্ত হয়েছে। সবটা অভীকের নিজ চোখে দেখা।
সেই ঘটনার পর অভীকের মনে একটা ভয় কাজ করছিল, তার জীবনসঙ্গিনী ও লামিয়ার মত হবে কি না। অথচ আজ ওর জীবনসঙ্গিনী বলছে, ওর সোনা রূপা পছন্দ নয়! অভীকের মনে পড়ল, অবনীর বাসায় সোনায় মুড়িয়ে থেকেও কেমন হাঁসফাঁস করছিল তাহিয়া। সেই দিন ওর গায়ে প্রায় দশ লক্ষাধিক টাকার গহনা ছিল। সেদিন ওর মুখে এই হাসিটা ছিল না, যা আজ ত্রিশ টাকার চুড়ি এনে দিয়েছে। দুদিন আগে ঘুরতে গিয়ে নিজের স্বামীর গাড়ি দেখে খুশি হতে পারল না, যতটা রিক্সায় চড়ে হয়েছে। এক প্লেট ফুচকা আর একটা আইসক্রিমে তার মুখে যতটা হাসি ফুটেছে, তা হয়তো নামী দামী রেস্টুরেন্টের বিশাল অংঙ্কের খাবারের মিলতো না। আজ ঘুরতে যাওয়া আবদার করল, সে চাইলেই নামী দামী রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা করার আবদার করতে পারত। কিছু সে বলল কী, পথের ধারে হাটবে।
মেয়েটা লামিয়ার মতো উচ্চবিলাসী নয়, ওর শখ আহ্লাদ সব একবারেই সাদামাটা। অল্পতেই খুশি। আকস্মিক কেন যেন লামিয়ার সাথে তাহিয়াকে তুলনা করল অভীক। তাহিয়াকে বিজয়ী হিসেবে পেল। এ মেয়ে আর যাই হোক, অন্যের পরিধেয় জিনিস দেখে সংসারে অশান্তি করবে না। দামী শাড়ি গহনা, বিলাসবহুল জীবনের লোভে পড়া এই নারীসমাজে তাহিয়ার মতো মেয়ে খুব কমই পাওয়া যায়। যারা অল্পতে খুশি। এদের খুশি করা সহজ।
অভীকের আকস্মিক কেন যেন আনন্দ হলো। মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। তামিমের কথা ভেবেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হলো। তামিম হয়তো শুনলে অভীকের কাধ চাপড়ে বলল,
‘তুই খুব লাকি, এমন মেয়ে কয়জন হয়? তোর জীবনটা সেট। আমাকে দেখ, বউকে খুশি করতে ঋণের বোঝা কাধে নিয়ে পথে বসতে চলেছি, তবুও মন পাচ্ছিনা।’
অভীক প্রসন্ন হেসে বলল,
‘তুমি তো দেখি অল্পতেই খুশি। ‘
তাহিয়া জবাব দিল,
‘ ছোটো বেলায় বাবাকে হারানোর পরে কিছুটা অভাবের ছোঁয়া লেগেছিল গায়ে। তখন মা বলতেন “অল্পতে খুশি হতে শিখ। যারা অল্পতে খুশি হয়, তাদের জীবনটা সুখের হয়। ইচ্ছে, আশা স্বপ্ন গুলোকে সাধ্যের মধ্যে রাখবি, তাহলে হতাশ হবি না।” মায়ের কথায় অল্পতেই খুশি হওয়া শিখে গিয়েছি, খুশির কারণকে সাধ্যের মধ্যে নিয়ে এসেছি। সুখগুলোকে খুঁজে নিয়েছি। মায়ের সামান্য আয়ে দিনশেষে যা পেয়েছি তাতেই পৃথিবীর সব সুখ কুড়ে নিয়েছি। ‘
খুশিতে ভরা স্বর তাহিয়ার। ওর কথা গুলো চমৎকার শুনাল, অভীকের মন ছুঁয়ে গেল। আসলেই অল্পতে যারা খুশি হয়, দিনশেষে তারাই সুখী হয়। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, লামিয়া আর তাহিয়া। অভীক বলল,
‘আন্টি চমৎকার শিক্ষা দিয়েছেন তোমাদের।’
এ পর্যায়ে মায়ের উপর গর্ববোধ হলো তাহিয়ার। মায়ের চিন্তাভাবনা চমৎকার। মা সবসময় সেটাই করেন যেটাতে তাহিয়া ভালো থাকবে। কিন্তু ও তৎক্ষনাৎ বিষয়টাকে সহজভাবে নিতে পারেনা। মায়ের মনের কথা না বুঝে মাকে শত্রুর খাতায় নিয়ে যায়। দিনশেষে ঠিকই বুঝে। এই যে অভীককে ধরে বেধে মা ওর জীবনে আনলেন। প্রথম প্রথম মায়ের উপর সেকি রাগ হলো ওর! মা বারবার বলছিলেন, অভীক ভালো ছেলে, তোকে ভালো রাখবে। ও বিশ্বাস করেনি। ভেবেছে, মা এমনিই বলছে। কিন্তু যখন অভীকের সাথে মিশতে শুরু করেছে তখন মায়ের কথার সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। সেই সাথে প্রতিনিয়ত অনুধাবন করতে পারছে, অভীকের মতো চমৎকার মানুষ সবার জীবনে আসে না। তার জীবনে এসেছে, মা এনে দিয়েছে। সে চাইলে আনতে পারতো না। অভীকের সুন্দর ব্যক্তিত্ব কখনোই তার চোখে পড়তো না। প্রতিনিয়ত মনে হয়, অভীক ওর জীবনের চমৎকার উপহার, এই উপহারটা আল্লাহ মায়ের মাধ্যমে ওর কাছে পাঠিয়েছেন। মায়েরা সন্তানদের ভালো বুঝেন, যতটা সন্তানরা নিজের ভালো বুঝে না। কৃতজ্ঞ মায়ের প্রতি সে।
ভাবনা গুলো মনে আসতেই মায়ের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল তাহিয়ার। সে খুশিমনে বলল,
‘আমার মা মানুষটা চমৎকার। মা হিসেবে সার্থক। ‘
অভীক তাহিয়ার মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো হালকা নেড়ে বলল,
‘আন্টির মেয়ে আন্টির মতোই চমৎকার হবে। ‘
অভীকের মনটাও হঠাৎ বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। অনাবিল শান্তিতে ছুঁয়ে যাচ্ছে মনটা। আকস্মিক রাস্তায় নেমে রিকশা ডাকল। তাহিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘চলো ঘুরে আসি।’
‘কোথায়?’ প্রশ্নটা করতে গিয়েও করল না। যেখানে নিয়ে যাক, চোখ বন্ধ করে চলে যাওয়া হবে। কাল বিলম্ব না করে হাতে হাত রেখে উঠল রিকশায়। হুড ফেলে হাওয়ায় গা বাসিয়ে চলল গন্তব্যের পথে। স্বপ্নগুলোকে পুরণ হতে দেখে ভালো লাগছে।
পথের শেষে গন্তব্য এলো। হাজার লোকের ভীড়ে ঘেরা একটা জায়গায় থামল রিকশা। রিকশা থেকে নেমে চারপাশ চোখ বুলাল তাহিয়া। নদীর তীরটাকে পর্যটন স্পট হিসেবে সাজানো হয়েছে। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। তীরে পাথর বসানো। তার উপরে হকাররা বসা। বিল দিয়ে অভীক চারদিক চোখ বুলিয়ে দূরে একটা খালি জায়গা দেখল। তাহিয়ার হাত ধরে সেদিকে এগুতে লাগল। লোকারণ্য জায়গা পার হতে গিয়ে ভীড়ে আটকাল। অভীক পাশ থেকে পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। এক হাতে তাহিয়ার শরীর টেনে কাছে নিল। অন্য হাতটা দিয়ে সামনের মানুষ সরিয়ে এগুতে লাগল। ভীড়ে বখাটেরা নারীর গায়ে বাজে স্পর্শ করে। তাই এ ব্যবস্থা। এত সচেতনতার সাথে তাহিয়া ভীড় থেকে পার করল যে কোন ছেলের স্পর্শ অবধি লাগল না। তাহিয়া ভীড়ের মাঝে বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল ইতঃপূর্বে। তাই এমন ভীড় দেখে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিল। কিন্তু অভীকের তাকে আগলে নিয়ে অভিজ্ঞতা মুছে দেয়ায় অস্বস্তিবোধ কেটে গেল। আবারও মুগ্ধতা, ভালো লাগা জোগান দিল। এমন একজন মানুষ যার জীবনে থাকে সে তো সবচেয়ে সুখী মানুষ হয়। তাহিয়া তাকিয়ে আছে অভীকের দিকে। অভীক ব্যস্ত প্রিয়তমাকে আগলে রাখতে।
নিরিবিলি একটা জায়গায় নিয়ে পাথরের উপর বসল দু’জন। আসার আগে বাদাম নিয়ে নিল। পাশাপাশি দুটো পাথরে বসা দু’জন। অভীক বাদামের খোসা ছড়াতে ছড়াতে বলল,
‘বাদাম হলো প্রেম ফল। প্রেমিক যুগল ঘুরতে গেলে বাদাম খাওয়া বাধ্যতামূলক। ‘
কয়েকটা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে বাতাম দিল তাহিয়ার হাতে। তাহিয়া হেসে মুখে নিল। মুখের খাওয়া শেষ করে বলল,
‘আপনি প্রেমিক যুগল সম্পর্কে পিএইচডি গবেষণা করেছেন। সব জানেন।’
‘প্রায় আটজনের একটা সার্কেল ছিল আমাদের। একমাত্র আমিই সিঙ্গেল ছিলাম। বন্ধুদের প্রেম দেখতে দেখতে সব ডিগ্রী নেয়া শেষ আমার।’
মজার স্থলে বলল অভীক।
‘ বিয়ের ভাবনা আন্টির মনে আগেই ছিল। তখন বলে দিলে আমাদের প্রেমটাও হয়ে যেত। আপনাকে বসে বসে বন্ধুদের প্রেম দেখা লাগতো না। ‘
কৌতুকের চেইন টানল তাহিয়াও।
অভীক আরেক মুঠো বাদাম তাহিয়ার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘আমার অভিজ্ঞতা কী বলে জানো? বিয়ের আগের চেয়ে বিয়ের পরের প্রেমে আনন্দ,সুখ দুটোই বেশি। স্বাধীন ভাবে প্রেম করা যায়। আর বিয়ের আগে বছরের পর বছর প্রেম করলে বিয়ের পরে মজা টজা থাকে না। কারণ সব অভিজ্ঞতা আগেই শেষ। মেজরিটি মানুষ যাদের সাথে সুন্দর মুহুর্ত কাটিয়েছে তারা অন্যের জীবন সাথী হয়ে গেছে। স্ত্রীর থাকাকালীন সময়ে প্রাক্তনের স্মৃতি আওড়ানো ও বেমানান । আমাদের দেখো, আমরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। একটা সময় আমরা যখন স্মৃতির খাতা খুলে বসব, সব সোনায় মোড়ানো মনে হবে। বিয়ের আগে বছরের পর বছর প্রেম করে যে অভিজ্ঞতা পেতাম, তা এখন পাব। এবং আরও চমৎকারভাবে। এতে মন, সংসার দুটোই ভালো থাকবে। বিয়ের পরের বেনিফিট অনেক। ‘
এতে একমত হলো তাহিয়া। অনুভূতিগুলো আসলেই চমৎকার। তাহিয়া হেসে বলল,
‘আমরা হলাম এমন প্রেমিক যুগল যাদের প্রেমের লাইসেন্স আছে। সহজ ভাষায়, লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রেমিক যুগল।’
কথাটা মজা লাগল অভীকের। শব্দ করে হাসল সে। আরও কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চলল। ভাড়ায় নৌকা চলছে। তীরে এসেছে নৌকা। অভীক বলল,
‘নৌকায় উঠবে?’
‘ভয় লাগে আমার।’ ভীত স্বরে বলল তাহিয়া।
অভীক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নদীতে এসে নৌকাভ্রমণ না করলে নদীর তীরে আসাটাই বৃথা। একটু সাহস রেখে চলো, ভয় কেটে যাবে। মজা পাবে। এসেছো যখন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে যাও।’
‘আমি সাঁতার জানি না।’ তাহিয়া বসে রইল।
‘তোমার লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রেমিক জানে, সে সামলে নিবে। আসো। ‘ হাত ধরে উঠাল অভীক। তীরে গিয়ে মাঝি ঠিক করল। তাহিয়ার অস্বস্তির কথা ভেবে চড়া দামের খালি নৌকা ঠিক করল।
নৌকা নড়ছিল এদিক ওদিক। তাহিয়া ভয়ে কাচুমাচু করছিল। কিভাবে উঠবে। অভীক আগে উঠল। পনেরো বছরের মাঝি ছেলেটাকে বলল নৌকা টেনে ধরতে যেন না নড়ে, বাড়তি টাকা দিবে। টাকার কথায় ছেলেটা তড়িৎ কাজ করল। প্রিয়তমার হাত ধরে অনন্যচিত্তে নৌকায় উঠাল অভীক।
সারাজীবন শহরের থেকেছে তাহিয়া। ঘুরাঘুরি হয়নি, নদীর কূলে ও যাওয়া হয়নি, নৌকায় ছড়া হয়নি। এই নদীটার অস্তিত্ব ও খুঁজে পায়নি এতদিন। উঠে বসার পর নৌকা এদিক ওদিক দুলছিল। তাহিয়া চোখমুখ খিচে অভীকের হাত খামচে ধরল। অভীক কিছু বলল না। শুধু এক হাতে আগলে ধরল। কিছু দূর যাওয়ার পর ডাকল,
‘হিয়া চোখ খুলো, দেখো ভিউটা অনেক সুন্দর। ‘
ধীরে চোখ খুলল তাহিয়া। সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। ঢেউ খেলে যাচ্ছে, ঢেউয়ের মাঝে নৌকা বয়ে চলছে। এদিকটায় আকাশ পরিষ্কার। সূর্য হেলে পড়ছে। রক্তিম মেঘেরা যেন নদীর কোলে মিশে গেছে, সূয্যের কমলা রঙা এসে পড়ছে নদীর পানির উপর। কী চমৎকার লাগছে। তাহিয়া মুগ্ধ গলায় বলল,
‘কী সুন্দর! ‘
‘ভয়ের পেছনে সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। ভয়কে জয় করলেই সৌন্দর্যটা উপভোগ করা যায়। ভয় কেটেছে?’
তাহিয়া অনুভব করল, আগে থেকে ভয়ের মাত্রা কমে গেছে। এখানে আসাটা সার্থক মনে হলো ওর। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘হু। ধন্যবাদ। এই সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত ছিলাম না আমি।’
তাহিয়ার মুগ্ধঘন চেহারাটা শেষ বিকেলের আলোয় সুন্দর দেখাচ্ছিল। অভীক ফোন বের করে সংগোপনে ছবি তুলল।
ফেরার সময় প্রফুল্লচিত্তে বসল তাহিয়া। ভয় কেটে গিয়েছে। দ্বিতীয়বার নৌকায় উঠতে দ্বিধা লাগবে না। অভীক প্রশ্ন করল,
‘এখন ভয় লাগছে, হিয়া?’
তাহিয়া মাথা নাড়াল। আকস্মিক প্রশ্ন করে বসল,
‘সবাই আমাকে ‘তাহিয়া’ ডাকে, আপনি আমাকে ‘হিয়া’ ডাকেন কেন?’
প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করল অভীক,
‘ ‘তাহিয়া’, নামের অর্থ জানো?’
তাহিয়া মাথা নাড়াল, ‘হ্যাঁ, তাহিয়া অর্থ অভিবাদন, শ্রদ্ধা। ‘
‘ ‘হিয়া’ অর্থ জানো?’
‘না।’
‘হিয়া’ অর্থ মন, অন্তর, হৃদয়। তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা শ্রদ্ধার চেয়ে বেশি হৃদয়ের। প্রেমিকের ভাষায়, অন্তরের অন্তঃস্থলে যার বাস তাকে এমন নামে ডাকাই যায়।’
অভীকের স্বরটা শান্ত। ওর শান্ত স্বরের শান্ত কথায় অশান্ত হয়ে গেল তাহিয়ার মন। হৃদপিণ্ড কেমন লাফিয়ে উঠল। ‘হিয়ারানী’র বিশ্লেষণটা নিজেই করল। হিয়া মানে হৃদয় , হিয়ারানী মানে? হৃদয়রানী! কী সুন্দর নাম! একটা ডাকেই সব কথা বলে দেয়। ‘ভালোবাসি’ বলে চেঁচানো লাগে না। কায়দা করে একটা কথায় সঙ্গীকে তার স্থান দেখিয়ে দেয়া যায়। হৃদয়ে ভালো লাগার বন্যা বয়ে গেল। আহ্! প্রশান্তি! জীবনটা সুন্দর।
নৌকায় উঠেছিল ভয়ের সাথে ফিরেছে একরাশ আনন্দের সাথে। বাসায় ফেরার আগে অভীক শপিংমলে নিয়ে গেল। কাপড় দোকানে নিয়ে তাহিয়াকে বসিয়ে দিল কাপড় কিনতে। বিয়ের পর সেভাবে কেনাকাটা হয়নি। এক গাদা জামা কাপড় নিল। কী ভেবে দুটো চাদর আর সুয়েটার ও নিয়ে দিল। সাথে বলল,
‘শীত যতদিন থাকে, গরম কাপড় ছাড়া বের হবে না। ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘
শপিংমল থেকে বের হয়ে তাহিয়া বলল,
‘প্রেমিকরা কি এগুলো কিনে দেয়?’
অভীকের উত্তর যেন প্রস্তুত ছিল। তড়িৎ জবাব দিল,
‘ প্রেমিকের কাধে দায়িত্ব থাকে না, স্বামীদের কাধে দায়িত্বের পাহাড় থাকে। প্রেমিকদের দায়িত্ববান না হলেও চলে কিন্তু স্বামীদের দায়িত্ববান হওয়া বাধ্যতামূলক। প্রেমিক প্রেম বুঝে, স্বামী দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে আমি প্রেমিক নই। ‘
চলবে….
নোট- ‘তাহিয়া’ নামটা রাখা হয়েছে শুধুমাত্র ‘হিয়া’ ডাকটার জন্য। কম হলেও শ’খানেক নাম বাছাই করে এই নামটা নিয়েছি। শুধু আজকের অভীকের এই সংলাপের জন্য, আর ডাকটার জন্য সে হিসেবে নামের সার্থকতা আজ পেয়েছে।
বিঃদ্রঃ একদিন না দেয়ায় দুই দিনের পর্ব একসাথে দিলাম। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হলো?