প্রেমোদ্দীপক। পর্ব-১৯

0
1095

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১৯)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

অভীকের বুকবন্ধনীতে আবদ্ধ তাহিয়া। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও। কল্পনা এবং বাস্তবতার মাঝের দেয়ালে আটকানো মন। অভীকের পরিবর্তিত আচরণ ওর বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সবটা কল্পনা। এমনটা হয় না কি! হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। উত্তেজনায় স্নায়ুবিক দৌর্বল্যগ্রস্থ হয়ে শরীরটা কাঁপছে। ভাজ করা নেত্রপল্লব নড়ছে অনবরত। কড়া পারফিউমের একটা সুঘ্রাণ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। অম্লজানের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।

তাহিয়া যখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো, তখন অবিশ্বাসের অস্তিত্ব বিলীন করতে অভীকের কোমল স্বর এসে কানে বাজল। সেই চমৎকার ডাকটা,
‘হিয়া!’

তাহিয়া মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনল। এটা বাস্তবতা! সত্যিই লোকটা ওকে ডাকছে চমৎকার নামে? বসন্ত কী বিপরীত পক্ষেও হানা দিয়েছে? নয়তো এ আচরণ তো হওয়ার কথা নয়। ভাবনার মাঝে হাসির রেখা ফুটল তাহিয়ার ঠোঁটের কোণে, সেই হাসিতে লজ্জার গাঢ়ো আভা। মৃদুভাবে চোখ খুলল, সাদা কাপড় চোখে পড়ল। লোকটা আজ আবার সাদা শার্ট পরে এসেছে! রাগের বশ্যতায় খেয়াল করা হয়নি। এতক্ষণে খেয়াল হলো। সাদা শার্ট পরার অপরাধে কিছু বলতে মাথা তুলে তাকাল। অভীকের প্রশান্ত চাহনি এসে ধাক্কা খেল চোখে। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অন্য সময়ের মতো এই হাসিটায় কৌতুক মেশানো নেই। এ হাসি শুদ্ধ, নির্মল, মায়ায় মাখা। চোখ মুখে ও অন্যরকম অনুভূতি খেলা করছে। এই মুখভর্তির সাথে পরিচিত নয় তাহিয়া। চমকাল ও, হৃদস্পন্দন মাত্রা বেড়ে শ’পেরুলো। অভিযোগ তুলতে উদ্যত হওয়া স্বরটা অবরুদ্ধ হয়ে গেল। একটা অক্ষর ও বের হলো না। ইন্দ্রজাল ছাপানো দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরাল তাহিয়া।
অনেকটা সময় পরে নিজেকে ধাতস্থ করে মৃদুস্বরে জবাব দিল,
‘হু!’

তাহিয়ার কপালে আসা চুল সরিয়ে দিয়ে আলতো স্বরে অভীক প্রশ্ন করল,
‘ আমার সাথে বসন্তবিলাস করতে যাবে, হিয়া?’

লজ্জায় আড়ষ্ট তাহিয়া আবেশে চোখ বুজল। এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করার সাহস আছে ওর? দুই অক্ষরের নামটা ওর ভেতর থাকা রাগ, সাহস সব বাষ্প করে দিয়েছে। তাহিয়া মৃদুস্বরে বলল,
‘হু।’

রাগ পড়েছে অবশেষে। অভীক প্রসন্ন হাসল। সেই হাসিতে প্রশান্তি, স্বস্তির রেখা মিশে আছে। বুক বন্ধনী থেকে অর্ধাঙ্গিনীকে মুক্ত করে বলল,
‘ তৈরি হয়ে নাও তবে। রাত নামল বলে।’

অভীকের কাছ ঘেঁষে বসে রইল তাহিয়া। নড়ল না। চোখ বন্ধ করে নিরবতায় গা মাড়াল। এই সুন্দর মুহুর্তটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। মনে হচ্ছে এটা কোন স্বপ্ন। একটু নড়লেই স্বপ্ন ভেঙে যাবে, অভীকের মুখে ওর হৃদহরণী নামটা আর শুনতে পাবে না। নড়লে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলবে।

তাহিয়াকে বসে থাকতে অভীক বলল,
‘দেরি হয়ে যাবে, যাও। তৈরী হয়ে নাও। আমি আন্টির সাথে দেখা করে আসি। আসার পর দেখা হয়নি। ‘

উঠে দাঁড়াল অভীক। তড়িৎ চোখ খুলল তাহিয়া। আকুতিভরা স্বরে বলল,
‘যাবেন না। এখানেই বসে থাকুন। প্লিজ!’

অভীক প্রাণবন্ত হাসল। এই ক্ষণে নেতিবাচক উত্তর দিতে মন সায় দিচ্ছে না। মনটাও বোধহয় তাহিয়ার সঙ্গ চাইছে, কাছেপাশে বসে থাকতে চাইছে। চমৎকার এই মুহুর্তটাকে উপভোগ করতে চাইছে। তাহিয়ার পাশে বসে পড়ল। হেসে বলল,
‘আমি এখানেই আছি। এবার যাও, চেঞ্জ করে এসো। ‘

তাহিয়া তৎক্ষনাৎ গেল না। কিছু সময় বসে তারপর উঠে দাঁড়াল। চোখে মুখে উৎফুল্লতা। তাহিয়ার রুমে একটা খাট, বেড সাইডে টেবিল ল্যাম্প। বিপরীতে দিকে ক্লথ কেবিনেট, ড্রেসিংটেবিল আর পড়ার টেবিল। মাঝে দুটো বিন ব্যাগ রাখা। তাহিয়া ক্লথ কেবিনেটের দিকে পা বাড়িয়ে ভাবনায় মজল। বিয়ের পর ঘুরাঘুরির উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সুযোগ হয়নি ওদের, এটাই প্রথম। প্রেম পুরুষের সাথে বসন্তবিলাস করতে যাওয়ার সময় বাঙালি নারীরা শাড়ি জড়ায় গায়ে, চুলে খোঁফা বেধে গাজরা গুঁজে। সেও কি শাড়ি পরবে? কাজলে চোখ রাঙিয়ে, কপালে টিপ পরবে? রেশমি চুড়ি পরবে কি হাতে? সাজবে কি অভীকের নিমিত্তে? না কি সাদামাটাভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করবে প্রাণপুরুষের সামনে? দ্বিধায় পড়ল তাহিয়া। কেবিনেটের দরজা খুলে কাপড়ের ভাজে চোখ বুলাতে লাগল। আকস্মিক মাথা ঘুরিয়ে অভীকের উদ্দেশ্যে বলল,
‘শাড়ি পরি?’

বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন দেখছিল অভীক। তাহিয়ার কথা শুনে ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে বলল,
‘শাড়ি কি আমার জন্য পরবে?’

তাহিয়া সরাসরি উত্তর দিল না। ঘুরিয়ে বলল,
‘আপনি বললে শাড়ি পরে যাব।’

‘উপলক্ষ্য যদি আমি হই তবে আমি বলব পরার দরকার নেই। আগে ও বলেছি এখন ও বলছি, তুমি সেই ড্রেস পরবে, যা পরে তুমি আরামবোধ করো। তুমি শাড়িতে আরামবোধ করোনা। অস্বস্তি হয় তোমার। তারপর আবার শাড়ির সাথে চশমা পরবে না, যার কারণে মাইগ্রেন এসে হানা দিবে। আমি চাইছিনা আমার মনোরঞ্জন করতে গিয়ে তুমি অসুস্থ হও। আমার কাছে আমার মুগ্ধতার চেয়ে তোমার সুস্থতা, স্বস্তিবোধ বেশি জুরুরি। অস্বস্তিদায়ক ড্রেসাপ নেয়ার দরকার নেই। এভারেজ ড্রেসাপ নাও। ড্রেসাপে আমার মনে বিশেষ অনুভূতি জন্মাবে না বা বদলাবে না। আর যদি শাড়ি পরাটা একান্তই তোমার ইচ্ছে হয়, তবে পরতে পারো।’

ধীর স্বরে বলল অভীক। তাহিয়া ঘুরে দাঁড়াল। দ্বিধা কেটে গেছে। শাড়িটা অভীকের জন্যই পরতো, শাড়ির প্রতি ওর বিশেষ টান নেই। ইচ্ছে শক্তিরা শাড়ির দিকে ঝুকছে না। তাহিয়া হ্যঙ্গারে টাঙানো কুর্তি আর থ্রী-পিসের কালেকশনে চোখ রাখল। কোথাও বের হওয়ার আগে মেয়েদের সবচেয়ে কঠিন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, ‘কী পরে যাব?’ দ্বিধা, শঙ্কার বাসা বাধে মনে। কঠিন প্রশ্নতীরে বিদ্ধ হয়ে তাহিয়া আবার দ্বিধার সাগরে ডুবল। এক একটা ড্রেসে চোখ বুলাচ্ছে আর মুখ বাঁকাচ্ছে। এটা হবে না, এটা বেশি লাইট, এটা বেশি ডার্ক, এটার লম্বা, এটা ছোটো, এমন হাজারো বাহানা। আকস্মিক সাদা থ্রি-পিসের দিকে নজর গেল। সাদা! তড়িৎ পিছন ঘুরে চাইল। অভীকের গায়ে টি-শার্ট ও সাদা। মিলিয়ে পরলে কেমন হয়? মন যখন মিলে গেছে, তখন পোশাক মিলাতে দোষ কোথায়? চঞ্চল মন সায় জানাল। সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করে চেঞ্জ করে এলো। ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল এবার। চোখে কাজল, কপালে টিপ, ঠোঁট রাঙাল ন্যুড লিপস্টিকে। চুল আঁচড়ে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে সাজগোজ সমাপ্তি ঘোষণা করল। চশমা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অভীকের উদ্দেশ্য বলল,
‘ আমি রেডি। ‘

ফোন পকেটে রেখে বিছানা ছাড়ল অভীক। তাহিয়াকে পরখ করে হেসে বলল,
‘মাশা আল্লাহ! সুন্দর লাগছে তো হিয়ারানীকে!’

অভীক তাহিয়ার রূপের প্রশংসা করেনি ইতঃপূর্বে। প্রশংসা করাটা বোধহয় দায়িত্বের মাঝে পড়ে না। আজই প্রথম প্রশংসার খাতা খুলে বসেছে, এতে অবাক হলো তাহিয়া। অভীকের প্রশংসাটা ওর অপ্রত্যাশিত ছিল। লোকটা আজ একবারে নতুন রূপে হাজির হয়ে অবাক করে চলেছে ওকে। আজ কি ওর অবাক হওয়ার দিন? হয়তোবা। তাহিয়া লাজুক হাসল। ব্যাগের জন্য এগুলো কেবিনেটের দিকে।

অভীক গেল ড্রেসিংটেবিলের সামনে। নিজেকে আয়নায় দেখে নিল একবার। হাত দিয়ে ঝরঝরে চুল আঁচড়ে নেয়ার সময় তাহিয়া বলল,

‘আপনি আজ আবার সাদা পরলেন কেন? নিষেধ করেছি না সাদা পরতে! ‘ তীক্ষ্ম অধিকারবোধ তাহিয়ার স্বরে।

অভীক থামল। হাত নামাল মাথা থেকে। সবুজ গ্যাবার্ডিন প্যান্টের পকেটে হাত গুজে এগিয়ে এলো তাহিয়ার দিকে। ভ্রু বাঁকিয়ে রগড়ের স্বরে বলল,
‘ আমাকে সাদা শার্টে দেখলে না কি বউয়ের খেয়াল এদিক ওদিক হয়। ভাবলাম, আজ না হয় খেয়ালদের ঠিক ঠিকানা দেখেই নিই, কোন দিকে যায়। তাই পরে আসা। স্ত্রীর খেয়াল রাখার সাথে সাথে স্ত্রীর খেয়ালের খেয়াল রাখাও স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব। ‘

থেমে বলল,
‘ আজ নির্দ্বিধায় তোমার খেয়ালের মানচিত্র আমায় দেখাতে পারো। ট্রাস্ট মি, আমি কিছু মনে করব না। সায় টায় ও দিতে পারি।’ ঠোঁটের কোণে অর্থবহ হাসি।

অভীকের কথার সারমর্ম বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল তাহিয়ার। বুঝে উঠতেই কাঁচুমাচু করে উঠল। ক্লাসে দেয়া ম্যাসেজের সূত্র ধরে প্যাচিয়ে ধরেছে লোকটা! কীসব ইঙ্গিত দিচ্ছে! বদলোক। অভীকের সামনে থেকে সরে এলো তাহিয়া। ব্যাগে ফোন ঢুকিয়ে বলল,
‘ আপনি হঠাৎ অন্যরকম বিহেভ করছেন কেন?’

অভীক রুম থেকে বেরুতে বেরুতে জবাব দিল,
‘কারণ আমার বহুপ্রতীক্ষিত বসন্ত যে এসে গেছে।’

অভীক চলে গেল। তাহিয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অভীক কী বলে গেল? বহুপ্রতীক্ষিত বসন্ত! এর অর্থ কী দাঁড়ায়? অনুভূতি অভীকের পক্ষ থেকে ও ছিল। সে তাহিয়ার পক্ষ থেকে আসা বসন্তের অপেক্ষা করছিল! বসন্ত একদিক নয় দুইদিকেই এসেছে? অভীকের বসন্ত আগেই এসেছিল। ভাবতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল তাহিয়া। এতটা খুশি বোধহয় ইতঃপূর্বে হয়নি সে। আকস্মিক খুশিতে ‘প্রশ্নবোধক ‘ চিহ্ন যোগ হলো। অভীকের পক্ষ থেকে অনুভূতি থাকলে এতদিন দায়সারা আচরণ করল কেন? প্রকাশ করল না কেন? ওর তো একটাবারও মনে হয়নি দায়িত্বের বাইরে ওর প্রতি অভীকের কোন অনুভূতি আছে। কিভাবে ঢেকে রেখেছে লোকটা, আর কেন? প্রশ্নদের উত্তর মেলানো বাধ্যতামূলক। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। উত্তর না পাওয়া অবধি শান্তি পাবে না।

বসার ঘরে মাহমুদার সাথে কথা বলছে অভীক। তুহিন ও আছে পাশে। তাদের আলাপচারিতার মাঝে উপস্থিত হলো তাহিয়া। চোখে মুঝে উৎফুল্লতা, ঠোঁটের কোণে হাসি, সুখ সুখ ভাব বয়ে চলছে সারা গতরে। তুহিন বোনকে পরখ করে অবাক হলো, এই তো কিছুক্ষণ আগে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছিল। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাগ পড়ে গেল! রেগে থাকা ব্যক্তির সাথে ঘুরতে বের হচ্ছে, তাও কী হাসিখুশি ভাবে! আবহাওয়া এত দ্রুত বদলে গেল কিভাবে! তুহিন অবাক হয়ে ভগ্নিপতির দিকে তাকাল। মাহমুদার সাথে কথা বলার ফাঁকে তুহিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল অভীক। বুঝাল, সব ঠিকঠাক। মাহমুদার সাথে কথা শেষ করে যাওয়ার সময় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কি বলে যেন হেসে উঠেছিল দম্পতি। দৃশ্যটা কী চমৎকার লাগল তুহিনের। মনে প্রশান্তি বয়ে গেল, বোনটা সুখে থাকবে। তাহিয়ার কঠিন রাগ যে নিমিষেই দূর করতে পারবে, সে তাহিয়াকে ও আগলে রাখতে পারবে।

মাহমুদার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল অভীক তাহিয়া। পুরোটা সময় মেয়েকে পরখ করেছেন তিনি। ‘তাহিয়া অভীককের সম্পর্কটা ঠিক হয়ে গেছে’ এমন একটা কথাই এলো। খুশিতে আত্মহারা হলেন তিনি, প্রশান্তি বুক ভরে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘

নিচ তলায় এসে দেখল গেটের কাছে একটা সাদা রঙা টয়োটা প্রিমিও গাড়ি পার্ক করা। অভীক গিয়ে গাড়ির কাছে দাঁড়াল। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে বলল,
‘আসো।’

তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল। অভীক বা ওর পরিবারের গাড়ি ছিল না। অন্তত ওর জানা মতে নেই। তবে কার গাড়ি নিয়ে এসেছে অভীক? প্রশ্ন করল,
‘কার গাড়ি?’

‘আমাদের পারিবারিক গাড়ি। গত সপ্তাহে নিয়েছি, বাবা ছেলে মিলে। মা উঠেছেন। এখন আপনি উঠে ধন্য করুন।’ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল অভীক।

খবরটায় খুশি হওয়ার কথা থাকলেও খুশি হতে পারল না তাহিয়া । কত রাত জেগে জল্পনা গড়েছে, অভীকের সাথে রিকশা করে শহরের এ মাথা এ মাথা ঘুরে বেড়াবে, ফুটপাত ধরে হাটবে অলিগলি। সেসব জল্পনাদের কী হবে? রিকশার হুড তুলে রোদ্রমাখা ভরদুপুরে আইসক্রিম হাতে ঘুরা, পড়ন্ত বিকেলে হুড ফেলে মৃদু বাতাস গায়ে মাখিয়ে প্রেমপুরুষের সাথে শহরের ব্যস্ত রাস্তা পাড়ি দেয়ার মাঝে যে আনন্দ, যে সুখ নিহিত তা কী আর কারের ভেতর নিহিত থাকে? তাহিয়ার চাহিদাগুলো ভীষণ ছোটো ছোটো। অল্পতেই খুশি হওয়া মানুষদের তালিকায় ফেলা যায় ওকে। তার অল্প খুশির তালিকায় আজ রিকশায় ঘুরার কথা লিপিবদ্ধ আছে। ব্যতিক্রম কিছু হলে মনোক্ষুণ্ণ হবে।
তাহিয়া আমতাআমতা করে বলল,
‘রিকশায় যাওয়া যায় না?

‘রিকশায় যেতে চাইছো?’ অবাক হয়ে বলল অভীক। তাহিয়া ইতিবাচক মাথা নাড়াল। ভাবল অভীক হয়তো ওর মতের বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে অভীক হেসে বলল,

‘আজকের সন্ধ্যাটা তোমায় দিলাম। এই সন্ধ্যায় সবকিছু তোমার ইচ্ছেমাফিক হবে। রিকশাতেই যাব।’

কী সুন্দর শুনাল কথাটা! তাহিয়ার আজ বিস্ময়ের সাথে সাথে মুগ্ধ হওয়ার দিন। ভুল ভাঙার দিন। আজ শুধু অভীক তাকে চমকপ্রদ তথ্য জানিয়ে যাবে। তাহিয়া উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
‘সত্যিই!’

গাড়ির ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে অভীক রাস্তায় নামল। রিকশার খোঁজ করতে করতে বলল,
‘হ্যাঁ, সত্যিই। আমার সপ্তাহের এই সন্ধ্যাটা হিয়ারানীর।’

খালি রিকশা পেয়ে প্রথমে উঠল অভীক। ঝুকে তাহিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘উঠে এসো।’

অবনীর বাসায় যাওয়ার দিন কত ভয়, কত ঝড়তা, কত দ্বিধা নিয়ে প্রথমবারের মতো অর্ধাঙ্গের হাতে হাত রেখেছিল তাহিয়া। হাত দেয়ার আগে কতবার ভেবেছে, সংখ্যাটা বোধহয় বিশের ঘরে গিয়ে দাঁড়াবে। আজ ওর মাঝে কোন জড়তা নেই, দ্বিধা নেই, নেই ভয়, নেই ভাবুক হওয়ার ইচ্ছে। আজ ও নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে, নির্ভয়ে, ভাবনাহীনভাবে তড়িৎ হাত রাখল অভীকের হাতে। হাতের উপর ভর করে উঠে বসল রিকশায়। পাশাপাশি বসল দু’জন। রিকশা চলতে শুরু করল। রা নেই কারো মুখে। বাসা থেকে বয়ে আনা প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসল তাহিয়া। নিরবতা ভেঙে প্রথম প্রশ্নটা করল,

‘এই সন্ধ্যাটা ও কি দায়িত্বের মাঝে ফেলবেন?’

আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছে। খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় চলা রিকশার বুকে ঠিকরে পড়েছে এক ফালি রূপালি আলো। দুজনার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অভীকের দৃষ্টি সামনের দিকে ছিল। তাহিয়ার প্রশ্নে ওর দিকে নিবদ্ধ হলো। নির্দ্বিধায় বলল,
‘ অবশ্যই না। আমি আজ দায়িত্বের খাতিরে আসিনি।’

তাহিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তাহলে কিসের খাতিরে এসেছেন?’

‘ প্রেমোদ্দীপকের খাতিরে।’

তাহিয়ার চোখে চোখ রেখে তড়িৎ উত্তর দিল অভীক। যেন উত্তর দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল ও। তাহিয়া অস্ফুটস্বরে একবার আওড়াল শব্দটা, ‘প্রেমোদ্দীপক!’ ইতঃপূর্বে শুনে নি শব্দটা। লোকটা আজ কঠিন ভাষায় কথা বলছে, সোজাসাপটা বলে দিলে কী হয়?
তাহিয়া করুণ গলায় বলল,
‘আপনি কি সহজ ভাষায় বলবেন?’

‘ তুমি ঠিক যেই কারণে এখন আমার সাথে এসেছো ঠিক সেই কারণে আমি ও এই সন্ধ্যাটা তোমায় দিয়েছি।’

ধীর স্বরে বলল অভীক। তাহিয়া কথার সারমর্ম বের করার চেষ্টা করল। ও অভীকের সাথে কেন এসেছে? কারণ, ও অভীকের প্রতি ওর প্রেমোময় অনুভূতি কাজ করে। তার মানে অভীকের ও ওর উপর অনুভূতি কাজ করে? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিতেই বিস্ফোরিত চোখে চাইল অভীকের দিকে। অভীকের দৃষ্টি ওর দিকেই। ঠোঁট কামড়ে হাসছে । ওর হাসিটা বলে দিচ্ছে তাহিয়ার ভাবনা সত্য। তাহিয়া সরাসরি প্রশ্ন করল,
‘আমার জন্য আপনার মনে দায়িত্বের বাইরে অনুভূতি আছে!’

‘ তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমার প্রতি আমার অনুভূতি থাকা স্বাভাবিক নয় কি?’
অভীক যেন আত্মবিশ্বাসের সাথে ভাইবাতে বসেছে, প্রশ্ন করার সাথে সাথে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। সব উত্তর যেন ওর জানা। একবারে স্বাভাবিক ও। ওর স্বাভাবিকতায় অস্বাভাবিক হয়ে গেল তাহিয়া। অস্থির হয়ে বলল,
‘ কিন্তু আমি টের পাইনি কেন!’
‘কারণ আমি প্রকাশ করিনি।’
‘কেন করেন নি?’

‘ আমি চাইনি তোমার অনুভূতি প্রকাশের আগে আমার অনুভূতি প্রকাশ হোক।’

তাহিয়া বিরক্তভরা স্বরে বলল, ‘স্পষ্ট করে বলুন।’

অভীক ধীর স্বরে বলে গেল।
‘বিয়েটা তোমার অমতে হয়েছিল বলতে গেলে। প্রথম দিকে তুমি আমায় মেনে নিতে পারোনি। তখন আমি যদি কোন আগ্রহ দেখাতাম তবে তোমার মনে হতো আমি জোর করছি, তুমি সহজভাবে নিতে পারতে না। তোমার মনে তখন আমার জন্য রাগ, ভয় ছিল। এর উপর আমার অনুভূতির প্রলেপ ছড়ানো বেমানান মনে হয়েছে আমার। তুমি আমাকে দেখলেই অস্বস্তিতে নুয়ে পড়তে, তার উপর যদি আমি প্রেমের বাণী শুনাতে বসতাম তখন আমার প্রতি তোমার রাগ কমার বদলে বাড়তো।
বিয়ের আগে আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা জানার পরপরই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিয়ে হলেও শুধুই স্বামী হওয়ার দায়িত্ব পালন করব, অনুভূতিগত ব্যাপারে তোমাকেই এগিয়ে আসতে হবে। যখন তোমার মনে আমার জন্য রাগ, ঘৃণা মুছে প্রেমোময় অনুভূতির জন্ম নিবে, এবং ভয় অস্বস্তি হীনভাবে যখন তুমি আমার কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে তখন আমি আমার অনুভূতি প্রকাশ করব। এর আগে নয়। ‘ফাজিল মেয়ে’ থেকে ‘হিয়া’ ডাকার অনুভূতি জাগ্রত করার দায়ভার ছিল তোমার। তাই আমি দায়িত্বের বাইরে দায়সারা, কঠোর ছিলাম। বসন্ত আগমন সংক্রান্ত তথ্যে আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম কাঙ্খিত দিনটা এসে গেছে। এই জন্যই এসেছি।’

লম্বা কথা বলে থামল অভীক। লম্বা শ্বাস নিল। তাহিয়া শুনল, বুঝল। তারপর আবার প্রশ্ন করল,
‘কিন্ত আপনার অনুভূতি জন্মাল কখন?’

‘দায়িত্ব পালন করতে করতে অনুভূতিটা আপনাআপনি জন্মে গিয়েছে। নিদিষ্ট দিনক্ষণ জানা নেই আমার। তবে, আমি হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকে তোমার মনে বসন্ত নামার অপেক্ষা করেছিলাম। আর কিছু জানার আছে?’

আবার ভ্রু বাঁকাল অভীক। তাহিয়া অন্যদিকে ফিরে হাসল। লোকটা ওর বসন্ত নামার অপেক্ষা করছিল! এইজন্যই বলছি বহুপ্রতীক্ষিত বসন্ত। আবেশে চোখ বুজল একবার। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলল। অভীকের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আপনার দায়সারা আচরণে আমি কষ্ট পেয়েছি।’

তাহিয়ার হাত ধরে অভীক আলতো স্বরে বলল,
‘ ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিব, চলবে?’

কী গভীর কথা! তাহিয়া আড়ষ্ট হলো। মাথা নামিয়ে হাসল মৃদু। উত্তর দিল না। ওর হাসির মাঝে উত্তর খুঁজে নিল অভীক। রিকশা এসে থামল ফুচকা হাউজের সামনে। তাহিয়ার হাত ধরে নামাল অভীক।

ফুচকা খাওয়ার সময়টায় অভীক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তাহিয়ার দিকে। অভীক স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ। বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খায় না। তাহিয়ার রাগ ভাঙানোর জন্য ফুচকা খেতে এনেছে, অন্যসময় হলে তাহিয়াকে ও খেতে দিত না। অভীককে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাহিয়া বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

অভীক কিছু বলল না, হাসল শুধু। শ্যামবতীকে দেখতে ভালো লাগছে ওর। তাহিয়া একটা ফুচকা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘একটু খান, ভালোবাসা বাড়বে।’

অভীক মজা করে বলল,
‘মনে যে টুকু জমা আছে, তাও তুমি হজম করতে পারবেনা। আর বেড়ে কী হবে?’

তাহিয়ার খাওয়া শেষ হলো। টক লেগে গিয়েছে হাতে। টিস্যু আনা হয়নি সাথে। আশেপাশে ওয়েটারকেও দেখা যাচ্ছে না। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকাল তাহিয়া। অভীক পকেটে থেকে টিস্যু এগিয়ে দিল,
‘হাত মুছে নাও।’

হাত মুছে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো তাহিয়া। বিল দিয়ে অভীক এলো পিছু পিছু। ওর হাতে কোণ আইসক্রিম। তাহিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘নাও, ঝাল কম লাগবে।’

তাহিয়া অবাক হলো। ফুচকায় ভীষণ ঝাল ছিল। তাহিয়া ঝাল খেতে পারে। ঝালের পরিমাণ বেশি থাকায় দুই একবার হু হা করেছে। লোকটা খেয়াল করেছে! প্রসন্ন হাসল তাহিয়া। এই যে ছোটো-ছোটো
কেয়ারগুলো কত ভালো লাগার সৃষ্টি করে। মুগ্ধতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

রিকশা চলছে আপনগতিতে। হুড ফেলা রিকশা। মাঝে পাশাপাশি বসা প্রেমপুরুষ এবং তার প্রেয়সী। একের হাতে রাখা অন্যের হাত। প্রেয়সীর মুক্ত হাতে আইসক্রিম ধরা। আইসক্রিম খাওয়ার মাঝে রূপালি আলোতে খানিক পরপর প্রেমপুরুষকে দেখছে মুগ্ধ চোখে । ঠোঁটের কোণে আঁকা কোমল হাসি। কী চমৎকার দৃশ্য! সময়টাকে থমকে দেয়ার ইচ্ছে জাগল অভীকের। হাতের বন্ধন শক্ত করল ও।

ইচ্ছেদের বাস্তবিক রূপ দেখে স্বপ্ন মনে হলো তাহিয়ার। বিকেল অবধি লোকটার উপর রেগে ছিল, দুজনের আবেগ ছিল দু’মুখো। আকস্মিক সন্ধ্যায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। আবেগগুলো একমুখো হয়ে গেল। নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটল। ব্যাথা পেয়ে হাত ও ডলল। অভীক হাসল দেখে। মেয়েটা একটু বেশিই আবেগী।

ঘুরে ফিরে ডিনার করে বাসার পথ ধরল ওরা। নিত্যকার নিয়মে বাসার গেইট থেকে বিদায় নিতে উদ্যত হলো অভীক। তাহিয়া বাধা দিয়ে বলল,
‘বাসায় আসুন।’

অভীক কৌতুকের সুরে বলল,
‘স্যাররা রাতদুপুরে ছাত্রীর বাসায় যায় না।’

কৌতুকের চেইন টেনে তাহিয়া বলল,
‘স্যাররা তো ছাত্রীর বেডরুমে গিয়ে ছাত্রীকে ‘হিয়া’ বলে ও ডাকে না।’

অভীক ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘বাহ্! হিয়ারানী তো দেখি চালাক হয়ে গেছে!’

তাহিয়া প্রসঙ্গ পাল্টাল, ‘শুনুন না!’

‘বলুন না!’ তাহিয়া মতো ভঙ্গি করে বলল অভীক। তাহিয়া বলল,
‘আজ মা নয় আমি বলছি, বাসায় চলুন।’

তাহিয়ার গাল টেনে অভীক বলল,
‘আপাতত প্রেম চলুক। দাম্পত্য জীবন মনকে স্পর্শ করে ফেললে ব্যাপক সমস্যা। তোমাকে এ বাসায় আরও তিন বছর থাকতে হবে। দায় হয়ে যাবে। ‘
ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কত কী বলে ফেলল অভীক। তাহিয়া বুঝল শুধু প্রথম কথাটাই।

চলবে…

ব্যস্ততার কারণে সময় হয়নি। চোখে ঘুম নিয়ে লিখেছি। শাব্দিক ভুল ত্রুটি, সেই সাথে খাপছাড়া হওয়াটা স্বাভাবিক। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here