প্রেমোদ্দীপক। পর্ব-১৬

0
1195

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১৬)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা, সূর্যটা এক কোণে বসে তার সোনালি আলো ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সোনার মতো ঝলমলে রোদ্দুর এম্বুল্যান্সের খোলা জানালার ভেদ করে এসে পড়ছে তাহিয়ার চোখে মুখে। সেই আলো মাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে ওর চেহারায় ভাসা নিকষ কালো মেঘের ভেলা। আঁধার নেমেছে তার চোয়ালে।
মাহমুদার রিলিজের পর আজ বাসায় যাচ্ছে, ওর চেহারার মলিনতার কারণ অভীক। আসার সময় মনে হচ্ছিল হাসপাতালে একটা হীরাখচিত সময় ফেলে যাচ্ছে। এক কাপ চা হাতে দু’জনের খুনসুটিময় সময়টাকে মিস করবে।
বাসায় গিয়ে অভীককে এভাবে কাছে পাওয়া যাবে? আবার দূরত্ব এসে হানা দিবে। যে যার বাসায়। সারাপথ দুঃখবিলাস করে পার করল। অভীক বোধহয় খেয়াল করল। গন্তব্যে পৌঁছার পর ব্যাগপত্র নামানোর সময় যখন তাহিয়া গিয়ে অভীকের পাশে দাঁড়াল। তখন সুযোগ বুঝে অতি নিচু স্বরে বলল,
‘মন খারাপ কেন?’

কিছুটা অবাক হলো তাহিয়া। লোকটা খেয়াল করেছে! এখন যদি বুঝতে পারে মন খারাপের কারণটা সে নিজেই, তবে বাঁকা হেসে মজা নিবে। আপাতত কৌতুকের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক সে। তাই মিথ্যা বলল,

‘মায়ের শরীরটা কেমন দূর্বল লাগছে। দেখে খারাপ লাগছে। ‘ কথাটা মিথ্যা নয়। পারতপক্ষে, তার খারাপ লাগছে। তবে মন খারাপের কারণ অভীকই।

অভীক বিষয়টা নিয়ে ঘাটল না। অভয় দিয়ে বলল,
‘মাস দুয়েক লাগবে পুরোপুরি ঠিক হতে, তারপর দেখবে একবারে সুস্থ আন্টি। চিন্তা করো না।’

তাহিয়া কিছু বলল না। পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বাসায় ফেরার পর কিছুক্ষণ বসল অভীক। তাহিয়া তখন মায়ের শোয়া বসার ব্যবস্থা করছে। অভীক বোধহয় ওর আসার অপেক্ষা করছিল। মায়ের কাজ সেরে বসার ঘরে আসতেই বলল,
‘আমি চলে যাচ্ছি, দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাও।’

‘চলে যাচ্ছি’ কথাটা কান্নার ঢোলের মতো বাজল তাহিয়ার কানে। কেমন কান্না পেল। স্মৃতিমধুর সময় পার করে এখন যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না অভীককে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে মাথা নাড়াল। অভীক উঠে দাঁড়িয়ে দরজা অবধি গেল। দরজার বাইরে কালচে পাপোশটার উপর গিয়ে দাঁড়াল। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে তাহিয়া। অভীক ধীরে বলল,
‘তোমার কিন্তু এখন অনেক দায়িত্ব, তাহিয়া। দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করো।’

তড়িৎ কোন দায়িত্বের কথা মনে করতে পারল না তাহিয়া। বুঝল না অভীক কী বুঝাচ্ছে। ঢোকের সাথে কান্না গিলে বলল,
‘কী দায়িত্ব? ‘

‘জানো না তুমি!’ অবাক হলো অভীক। তাহিয়া মাথা নাড়াল। দায়সারা জবাব দিল,
‘না। আমি বরাবরই দায়িত্বে উদাসীন। কখনো সেভাবে কোন দায়িত্ব পালন করা হয়নি। তাই ধারণা ও নেই। যখন যা মনে আসে তখন তাই করি।’

থামল ও। আকস্মিক আবদারের সুরে বলে ফেলল,
‘আপনি কি আমাকে আমার দায়িত্বগুলো শিখিয়ে দিবেন?’

কেমন বাচ্চামো সুরে আবদার করে বসল তাহিয়া। বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল অভীকের। তাহিয়া এমন আবদার করবে সে কস্মিনকালেও ভাবে নি। অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের উত্তরে বিস্ময়মাখা প্রশ্ন করল,

‘ আমার কথা শুনবে তুমি!’

ইতিবাচক মাথা নাড়াল তাহিয়া। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা আনন্দময় হাসি ফুটল অভীকের ঠোঁটে। কোমল গলায় বলল,
‘আচ্ছা, আমার প্রতি ছাড়া সবার প্রতি তোমার উপর অর্পিত দায়িত্ব শিখিয়ে দিব। হবে?’

‘আপনারটা বাদ কেন?’ তড়িৎ প্রশ্ন করল তাহিয়া। অভীক ধীর স্বরে বলল,

‘ আমি চাইছিনা আমার শিখিয়ে দেয়া কাজ তুমি আমার উপর এপ্লাই করো। আমি শিখিয়ে দিলে ব্যাপারটা এমন হবে, কোন জুরুরি কাজে যখন আমাকে ফোন করা প্রয়োজন হবে। তখন আমাকে আগে ম্যাসেজ দিয়ে বলে দিতে হবে, আমাকে কল করো। মেসেজ দেখে তুমি কল করবে। ব্যাপারটা কেমন হয়ে যাবে না? ওটা ফরমায়েশ পালন হয়ে যাবে, দায়িত্ব পালন হবে না। আমি চাইছিনা তুমি আমার ফরমাইশে আমার প্রতি যত্নবান হও। তোমার যতটুকু ইচ্ছে হবে, করবে। বাদবাকি আমার কোন আপত্তি কিংবা অভিযোগ নেই। তা ছাড়া, অন্যদের প্রতি তোমার শুধুমাত্র দায়িত্ব আছে। আমার প্রতি দায়িত্বের চেয়ে বেশি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার জড়িয়ে আছে। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার স্যাপার বলে কয়ে কিংবা হাতে কলমে শিখিয়ে দেয়া যায় না। আপনাআপনি হতে হয়।’

কেমন করে যেন হাসল অভীক। তাহিয়ার মনে হলো শেষ প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরাল। অভীক হাসি থামিয়ে বলল,

‘আপাতত সব দায়িত্ব এক পাশে রেখে তোমাকে একনিষ্ঠ ভাবে একজন ‘সন্তান’ এর দায়িত্ব পালন করতে হবে। আন্টি অসুস্থ, তুহিন বাচ্চা মানুষ, রিনা নেই। তাই বড়ো সন্তান হিসেবে সবার দেখাশোনার দায়ভার আপাতত তোমার কাধে। সবার প্রথমে তোমাকে রিনার বাসায় গিয়ে ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ওর কাধে রান্নার ভার চাপিয়ে দিয়ে তোমাকে যেতে হবে আন্টির কাছে। মেডিসিন কবে,কখন খাওয়াতে হবে তা দেখতে হবে। খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে আন্টির সব কাজে সাহায্য লাগবে, সাহায্যকারীটা হবে তুমি।

তুহিনের কদিন বাদে বার্ষিক পরীক্ষা। আন্টির অসুস্থতার জন্য পড়ালেখা থেকে দূরে সরে গেছে ও। তুমি ওকে গাইড করবে। সকাল সকাল উঠে রিনাকে জাগিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে পাঠাবে, নাস্তা বানানো হলে তুহিনকে ডেকে সকালের নাস্তা খাইয়ে স্কুলে পাঠাবে। আন্টিকে খাইয়ে দিবে নিজ হাতে। তারপর দুপুরের রান্নার তদারকি করবে। তুহিন ফিরে এলে কী লাগবে না লাগবে দেখবে। তোমাদের আত্মীয়স্বজন আসবে আন্টিকে দেখতে। তাদের নাস্তার ব্যবস্থা, আপ্যায়ন, সবদিক একা তোমাকে সামলাতে হবে। এই দায়িত্ব গুলো একান্ত তোমার, তুমি এতে মানানসই। আমার সাহায্যটা বেমানান, তাই আমি চাইলে ও সাহায্য করতে পারব না। সব তোমাকে একা করতে হবে। পারবে সব দায়িত্ব পালন করতে?’

উত্তরের আশায় তাকাল তাহিয়ার পানে। ওর মুগ্ধভরা দৃষ্টিতে ধাক্কা গেল। ও ভাবছে, লোকটা গুনেগুনে সবকিছু মনে করে রেখেছে না কি! ও ছোটো করে উত্তর দিল,
‘পারব।’

‘মা বলছেন কদিনের জন্য এসে থাকবেন বান্ধবীর কাছে। মা এলে তোমার সমস্যা হবে না তো? বাড়তি দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছো?।’
‘সমস্যা হবে না। মা একজন কথা বলার সঙ্গী পাবেন। ভালো হবে।’
ধীরে উত্তর দিল।

‘আচ্ছা।’

হুট করেই তাহিয়া প্রশ্ন করে বসল,
‘আপনি আর আসবেন না?’

তাহিয়ার চোখে চিন্তার রেখা। তা পরখ করে প্রাণবন্ত হাসল অভীক। বলল,
‘ আমার ব্যস্ততা বাড়ছে। বেশি আসা হবে না। তা ছাড়া এখানে এখন আমাকে প্রয়োজন নেই। চেকাপের জন্য নেয়ার হলে আসব, আর মাঝে মাঝে এসে আন্টিকে দেখে যাব। এখন আসি। ভালো থেকো। ‘

অভীক যাওয়ার জন্য পা বাড়ল। সিড়ির রেলিং অবধি চলে গেল। আকস্মিক থেমে পিছন ফিরল। তাহিয়া তখনো দরজায় দাঁড়ানো। বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা, চোখ চিকচিক করছে। ওটা পানি! মেয়েটার ঠিক সমস্যাটা কোথায়? আজ এত অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেন! বুঝতে পারছে না অভীক। আবার ঘুরে পা বাড়াল। স্ত্রীর অশ্রমাখা দৃষ্টি ডিঙিয়ে আগাতে পারল না। পিছিয়ে এলো।
দরজার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো স্বরে বলল,
‘নিজের খেয়াল রেখো। সবার সাথে সাথে নিজেরও খেয়াল রেখো। কিছুর দরকার হলে ফোন দিও। এবার আসি, কেমন?’

তাহিয়া মাথা নাড়াল শুধু। অভীক যাবে বলে ও গেল না। আবার বলল,
‘এখন কলেজ যাওয়ার দরকার নেই। আন্টিকে সময় দাও। ক্লাসের নোট ম্যানেজ করে দিব আমি। সময় পেলে পড়ে নিও। ‘

তাহিয়া মাথা নাড়াল। অভীক আবার বলল,
‘একা একা সব সামলাতে গিয়ে বোর হয়ে যাবে। কখনো বান্ধবীদের বাসায় ডেকে আড্ডা দিও, ছাদে গিয়ে ঘুরে এসো। বাসায় থাকতে থাকতে মন বিষিয়ে গেলে আমায় ফোন দিও, আমি এসে কোথাও ঘুরিয়ে আনব। মনে থাকবে?’

তাহিয়া যেন মাথা নাড়ানোর মহান দায়িত্ব কাধে নিয়ে বসেছে। মাথা নাড়িয়ে গেল। অভীক হেসে বলল,
‘ এবার যেতেই হবে। এগারোটায় ক্লাস আছে। যাই।’

এবার থামল না, চলে গেল। তাহিয়া চেয়ে রইল নয়া প্রেমিকপুরুষের যাওয়ার পানে। প্রেম হতে না হতেই বিরহ এসে জেঁকে ধরল ওকে। তাহিয়ার ভাবনা ছিল অভীক পরদিন আসবে, অভীককে দেখে বিরহের চাদর ঠেলে মুক্তমনে হাসতে পারবে। বরাবরই বাস্তবতা ওর ভাবনার বিপক্ষে যায়, এবারও ব্যতিক্রম হলো না। অভীক এলো না। নীলিমা বিকেলে ব্যাগপত্র নিয়ে একাই এলেন। একদিন, দু’দিন পেরিয়ে গেল, অভীকের দেখা নেই। ওর কাছে ফোন অবধি করে না। মাহমুদার ফোনে কথা বলে খবর নেয়। নীলিমাকে বলতে শুনেছে, ভীষণ ব্যস্ততা যাচ্ছে অভীকের উপর।
.

যেই মেয়ের কদিন আগ অবধি বেলা দশটায় ঘুম ভাঙত সে এখন সাত’টায় উঠে যায়। তুহিনকে ডেকে পড়ার টেবিলে পাঠায়। রিনাকে হাজার অনুরোধ করে ফিরিয়ে এনেছে সেদিন। ওকে ঘুম থেকে তুলে রান্নাঘরে পাঠায়। সকালের নাস্তার মেন্যু বলে ফিরে আসে। মায়ের কাছে গিয়ে মাকে উঠিয়ে ফ্রেশ হতে সাহায্য করে। রিনার নাস্তা বানানো হয়ে এলে টেবিলে সার্ভ করে সবাইকে ডেকে খাওয়ায়। মাকে খাইয়ে ওষুধ হাতে তুলে দেয়। রিনা সমেত বাজারে গিয়ে বাজার করে আনে। দুপুরের রান্নার মেন্যু বলে, রিনাকে টুকটাক সাহায্য করে। মাঝে মাকে দেখে আসে। নীলিমার জন্য ফল কেটে নেয়। লাঞ্চ করিয়ে মাকে ঘুম পাড়িয়ে যখন রুমে আসে তখন ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে পড়ার উপক্রম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেলে উঠে সন্ধ্যার নাস্তার তদারকি, মায়ের দেখাশোনার পর রাতের খাবার খেয়ে মাকে ঘুম পাড়িয়ে রুমে আসে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই অভীকের ভাবনা এসে জড়ো হয় মস্তিষ্কে। চোখে ভাসে হাসপাতালের এক কাপ চায়ের আলাপের মুহুর্ত। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সময়টায়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে সুখ দুঃখের গল্প করার ইচ্ছেটা প্রবল হয়।

নব প্রেমের বিরহে অস্থির হয় মন। প্রেম পুরুষকে দেখার তৃষ্ণায় চোখ দুটো চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে। লোকটা আসে না কেন! একবার এলে কী হয়! একটা ফোন দিয়েও কি খবর নেয়া যায় না! নিষ্ঠুর লোক! অভিযোগের ঝুলি খুলে বসে। ফোনে নিয়মিত কথা হয়না তাদের। হলে তো ভিডিওকল দিয়ে দেখা যেত। এখন হুটহাট ভিডিওকল দেয়াও বেমানান লাগে। কল দেয়ার বাহানাও খুঁজে পায়না। বিষন্ন মনে দুঃখবিলাসে মত্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

দু’দিন বাদের এক সকালে নাস্তার পর কিছুক্ষণ অবসর পেল তাহিয়া। অলস মস্তিষ্কে অভীকের ভাবনা হানা দিতেই মলিন হলো মন। কলেজ গেলে দেখা যেত, এখন তো মাকে রেখে কলেজে ও যাওয়া যাবে না। কলেজ সংক্রান্ত ব্যাপার আসতেই হুট করেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তড়িঘড়ি করে রুমে গিয়ে মীরাকে কল দিল। রিসিভ হতেই ভণিতা ছাড়া বলল,
‘আজ কলেজে যাবি তুই?’

অপাশ থেকে উত্তর এলো, ‘ না।’
‘কেন যাবি না?’

‘তুই না গেলে আমি গিয়ে কী করব?একা একা বোর হবো। শৈলী যাবে। ওকে তো পড়ালেখা তাবিজ করছে। সারাদিন পড়ালেখা নিয়ে থাকে। ওর সাথে আমার জমে না। ওর চেয়ে ভালো বাসাতেই থাকি। ‘

বলা বাহুল্য, দুই বান্ধবীর মাঝে তাহিয়া মীরার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। স্কুল লাইফ থেকে একসাথে আছে তারা। শৈলীর সাথে বন্ধুত্বটা কলেজে এসে তৈরি হয়েছে। তাহিয়া অনুরোধের স্বরে বলল,
‘তুই যা না, প্লিজ?’

‘কেন বলতো!’
‘অভীক স্যারের ক্লাস করতে।’

মীরা ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল, ‘অভীক স্যারের ক্লাস করব, তাও আমি! পাগল তুই! আমারে পাগলা কুকুরে কামড়ায় নি, যে ওই জাঁদরেলের ক্লাস করে নিজেকে ধমকের তোপে ফেলব।’

স্বভাবগতভাবে বলে ফেলল মীরা। তখন মনে আসেনি যার কাছে বলছে সে স্যারের স্ত্রী। বলার পর মনে পড়ল। জিহ্বা কামড়ে বলল,
‘ভুলে গেছিলাম, ভদ্রলোক তোর বর। আচ্ছা, আমি ভদ্রভাষায় বলছি, তোর গণ্যমান্য, রাগবিশিষ্ট, ধমকীয় স্বভাবী, ভ্রু কুঁচকানোতে পারদর্শী বরের ক্লাস করতে যাব না। ‘

অন্য সময় হলে তাহিয়া রাগত আচরণ করতো। আজ মন খারাপের ভারে রাগের সিস্টেমটা কাজ করল না। সে অনুরোধের সুরে বলল,
‘প্লিজ মীরা! তুই আমাকে সবচেয়ে ভালো বান্ধবী না? তোর মতো বান্ধবী লাখে একটা, কোটিতে দুইটা হয়। তোর মতো বান্ধবী যারা পায় তাদের উচিত প্রতি শুক্রবার মসজিদে জিলাপি দেয়া। আমি দিব সামনের শুক্রবার থেকে। কত ভাগ্যবান আমি!’

মীরা নড়েচড়ে বসল,
‘এত মাখন মাখাচ্ছিস কেন বলতো! আমি ক্লাস করলে তোর লাভ কী? এমন না যে তুই পড়ালেখা বুঝবি। পড়ালেখার সাথে তো তোর জন্মের শত্রুতা। আজ হঠাৎ মিত্রতা কেন?’

এবার আসল কথা বলল তাহিয়া,
‘ বদ লোকটা মাকে বাসাত নামিয়ে দিয়ে যে গেল আর এলো না। একটা ফোন ও দিচ্ছে না। আমার দেখতে ইচ্ছে হয় না বল? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, মনে হচ্ছে কতদিন দেখিনা। চেহারা ও ভুলে গেছি। ভিডিও কল দিতে ও পারছি না। এখন তুই ক্লাসে গিয়ে ভিডিও কল দিবি। স্যার যখন ক্লাস করাবে তখন আমি দেখব। জাস্ট পাঁচ মিনিট। প্লিজ!’

মীরার সে কী হাসি! হাসতে হাসতে বলল,
‘ কদিন আগে যে মেয়ে স্যারের ছায়া দেখলেও অভিশাপের ঝুলি খুলে বসতো, আজ সেই মেয়ে স্যারকে না দেখে অস্থির মেয়েটা! ভাবা যায়! তুই তো সাংঘাতিক রকমের প্রেমে পড়েছিস তাহিয়া। আমার অবাক লাগছে ভেবেই!’

তাহিয়া করুণ গলায় বলল,
‘বিশ্বাস কর, প্রথম প্রেমের চেয়ে ভয়ানক সুন্দর আর জ্বালাকর অনুভূতি দুটো নেই। লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রেমিকের প্রেমে পড়ে আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে আমি কোন কিশোরী, এতটা আবেগ কাজ করছে। আজ না দেখলে কাল গিয়ে বাসায় গিয়ে উঠব, নিশ্চিত। তাই দয়াটা কর!’

মীরা হাসছে তো হাসছেই, থামাথামির নাম নেই। হাসতে হাসতে বলল,
‘স্কুল লাইফে টিফিনের টাকা দিয়ে আবেগ কিনে জমালে এমনই হবে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না, স্যারের মতো মানুষের উপর তুই প্রেমে পড়তে পারিস। ‘

তাহিয়া আনমনেই বলে ফেলল,
‘স্যারের উপর নয়, আমি প্রেমে পড়ে আমার জীবনসঙ্গীর উপর। যে কি না পেশাগত জীবনের বাইরের অন্যরকম একজন। এত্তো সুইট, যদি তুই আন্দাজ করতে পারতি! আমি প্রথমে শক্ত ছিলাম। অবনীর বাসায় যাওয়ার পরপর স্যারের যত্নভাব শক্ত থাকতে দিল কই? পুরো প্রেম সাগরে নিয়ে ডুবাল।’

মীরা হাসতে হাসতে তৈরি হয়ে নিল। তাহিয়ার কথা শুনে মনে ভালো লাগা কাজ করছে। স্যার বোধহয় স্বামী হিসেবে ভালো। না হয় তাহিয়ার মতো মানুষ একমাসেই এভাবে গলে যাওয়ার কথা নয়। তার চাওয়া একটাই, বান্ধবীটা সুখে থাকুক। কথা বলতে বলতে কলেজ গেল। অভীকের ক্লাসের শুরু হওয়ার মিনিট দুয়েক আগেই গিয়ে পৌঁছল ক্লাসে। সামনের দিকের একটা বেঞ্চে বসে তাহিয়াকে ভিডিও কল দিল। অভীক ক্লাসে যেতেই কানে হেডফোন গুজে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘স্যার এসে গেছে, আমি ফোন ধরছি। তুই তোর লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রেমিককে দেখে নে।’

তাহিয়া সাবধানি গলায় বলল,
‘তুই ফোন ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকবি, উনার দিকে তাকিয়ে থাকবি না বেশিক্ষণ। প্রেম টেমে পড়ে গেলে তোকে অসহ্য লাগবে আমার।’

মীরা ব্যাঙ্গ করে বলল,
‘ আমি চাইব না আমার শত্রুর প্রেম ও স্যারের মতো হোক। সেখানে নিজের কথা তো দূরে থাক। আল্লাহ মাফ করো। তোমার জামাইয়ের যে মেজাজ তুই ছাড়া কেউ তার দিকে তাকানোর সাহস করবে না, নিশ্চিন্ত থাক। ‘
‘তেমন হলে তো ভালো। ফোন ধর। ‘

মীরা বইয়ের মাঝে ফোন রাখল। ব্যাক ক্যামরা সেট করে বই বন্ধ করল, যেন স্যার কিংবা আশপাশের কেউ দেখতে না পায়। তাহিয়া স্ক্রিনে তাকাল। লোকটা সফেদা রঙের শার্ট পরেছে আজ। লেকচার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে লেকচার দিচ্ছে। মুখে পেশাগত গম্ভীরর্য। অন্যান্য দিন এই গম্ভীরতা তার ভয়ের কারণ হলেও আজ প্রশান্তির কারণ হলো। অদ্ভুত ভালো লাগা ছেয়ে গেল মনে। প্রথম প্রেমে মেয়েরা প্রেম পুরুষকে লুকিয়ে যতটা দেখে অন্য প্রেমে ততটা দেখে না। প্রেমিক পুরুষের অগোচরে তার দিকে তাকিয়ে হাসির পসরা সাজিয়ে বসে। তাহিয়ার দু’গাল লাল হলো। হায়! লজ্জা! পরপর কয়েকটা স্ক্রিনশট নিয়ে নিল। দেখার তৃষ্ণা জাগলে দেখবে। মিনিট পাঁচেক বাদেই রিনার ডাকল ওকে।

তাহিয়া বিরক্তিভরা চোখে বলল,
‘ আমার জামাই, আমি দেখব। মানুষ বিরক্ত করবে কেন? উনাকে দেখার লাইসেন্স আছে আমার কাছে। ভাবটা এমন যেন জামাই নয় প্রেমিককে দেখছি। বেয়াদব মেয়েমানুষ।’
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে কিচেনে গেল।

.

অভীকের সাথে তাহিয়ার সরাসরি দেখা হলো তার দিন দুয়েক বাদে। সাক্ষাৎটা ভীষণ অদ্ভুত ছিল। লাঞ্চের পর মাকে ঘুম পাড়িয়ে বসার ঘরে গেল তাহিয়া। তুহিন সবে স্কুল থেকে এসেছে। ফ্রেশ না হয়ে ইউনিফর্ম পরেই খেলা দেখতে বসে গেছে। পায়ের জুতাটাও খুলে নি। ঘরটা সকালেই রিনা মুছেছে। কেমন দাগ পড়ে গেছে সাদা টাইলসে! আবার মুছতে হবে। সু রেক রেখে জুতা সমেত রুমে আসার আপত্তি জানাল তাহিয়া। তুহিন দায়সারাভাবে বলল,
‘কাজের বেটি রহিমা, তোর কী তাতে?’

ব্যস লেগে গেল ঝগড়া। প্রথমে তর্ক। তারপর তর্ক গড়াল মারামারিতে। তুহিন ঝগড়ার মাঝেও যত্নবান। আলতো হাতে তাহিয়ার বাহুতে থাপ্পড় মারে, নয়তো কুশন হালকাভাবে আঘাত করে । রাগে অগ্নিশর্মা তাহিয়া মার মানেই কিল ঘুষি। কয়েক ঘা যে পিঠে পড়েছে হিসেব নেই। পিঠ জ্বালা করছে তুহিনের। সে উঠে তাহিয়ার পনিটেইল বাধা চুলের হেয়ার ব্যান্ড খুলে নিল, তার চুল টেনে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। তাহিয়া দৌড়ে গিয়ে খপ করে ধরল। এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি বসাল। আকস্মিক তুহিন সরে গেল, তাহিয়ার সজোরে হাঁকানো চড় গিয়ে বসল অভীকের শক্তপোক্ত বাহুতে।

অভীক এসেছে মিনিট দুয়েক আগে। রিনা দরজা খুলে দেয়ার পর নিঃশব্দে যখন বসার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তখন মারামারিতে মত্ত দুই ছেলেমেয়েকে চোখ পড়ল তার। তাহিয়ার চোখে ভাসা রাগ আর হাত চালানোর ভঙ্গি দেখে অবাক হলো। কী ভয়ংকর রাগ মেয়েটার! সাংঘাতিক!

মারামারি ঠেলে ভেতরে যেতে ইচ্ছে হলো না। দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। অপেক্ষা করল, ওদের ঝগড়া থামার। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়, কিন্তু এমন মিষ্টিও যে হয় এখানে না আসলে অভীকের জানা হতো না অভীকের। তাহিয়ার সর্বশক্তি দিয়ে দেয়া চড়টা হাতে পড়তেই হাতটা জ্বলে উঠল। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার মেয়েটার গায়ে এত শক্তি! আবার আঘাত করতে চাইলে অভীক কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। অভীককে দেখে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল তাহিয়া। লোকটা এখানে এলো কখন! আগের মারটা লোকটার গায়ে পড়েছে! সর্বনাশ!

তুহিন শব্দ করে হেসে উঠছে। অভীকের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ভাইয়া, আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যে কি না বউয়ের হাতে রান্না খাওয়ার আগে মার খেলেন। আপনার জন্য মায়া হচ্ছে ভাইয়া! আপনার পুরুষ নির্যাতন মামলা করা উচিত। ‘

অভীক মনে মনে বলল, ‘রান্না, মার দুটোই খেলাম। ভয়ানক টেস্ট। ‘

অভীক তাহিয়ার দিকে তাকাল। অস্বস্তিতে কাচুমাচু করছে মেয়েটা। ও করুণতার ভান করে বলল,
‘বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন আইন নেই, শালাবাবু। থাকলে কত পুরুষ স্ত্রী নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে যেত!’

তুহিন কড়া স্বরে বলল,
‘আইন বাদ। ঘরোয়া শাসন করবেন। কড়া শাসনে রাখবেন, কথায় কথায় ধমক দিবেন। কথা না শুনলে সরাসরি মারধরে চলে যাবেন। দেখবেন এক সপ্তাহে ঠিক হয়ে গেছে।’

তাহিয়া রেগে তাকাল ভাইয়ের দিকে। চোখ দিয়ে বুঝাল, ‘ তোকে আমি পরে দেখে নিব। ‘ তারপর এক রাশ লজ্জা কাধে নিয়ে রুমে চলে গেল। তাহিয়া চলে যেতেই তুহিনের চেহারার রঙ বদলে গেল। সে করুণ স্বরে বলল,
‘ভাইয়া আমি কিন্তু মজা করেছি। আপনি সিরিয়াসলি নিয়ে আপুকে মারবেন না, প্লিজ! আমার আপুটা ভীষণ একটু ছেলেমানুষ। সহজে কথা বুঝে না। তবে মনটা ভালো। ভালো করে বুঝালেই হবে। অতি অবাধ্য হলে ধমক দিয়ে শুধু। ‘

অভীক হেসে ফেলল। বলল,
‘আমার বংশে স্ত্রীদের অসম্মান করা হয় না। তা ছাড়া, স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে পুরুষত্ব প্রমাণ করার মতো স্বভাব আমার নেই। নিশ্চিন্ত থাকো। ‘

তুহিন ধীর স্বরে বলল,
‘ধমক দিতে পারেন, তবে জোরে দিয়েন না। যেন আপু কান্না না করে। আপনাকে আপু ভয় পায়, বেশি ধমক দিলে ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। একটু কোমল হবেন। আপনার সহজ কথাও আপু গুরুত্বের সাথে নিবে। আমার বোনটা যাতে কষ্ট না পায়। আমার আপনার উপর অনেক ভরসা, তা যেন না ভাঙে।’

ভাই গুলো বোধহয় এমনই হয়। বুঝ হওয়ার পর থেকে বোনকে আগলে রাখতে শুরু করে। নাইন পড়ুয়া ছেলেটা কিভাবে বিজ্ঞের মতো কথা বলছে! বড়ো ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছে। বোনের সুখ নিশ্চিত করছে। অথচ একটু আগেই বোনকে আঘাত করছিল সে! অভীক প্রাণবন্ত হাসল। তুহিনকে তার পছন্দ হয়েছে। ছেলেটার ব্যক্তিত্ব সুন্দর। বড়ো হয়ে আদর্শ মানুষ হবে নিশ্চিত। তুহিনের কাধ চাপড়ে অভয় দিল,
‘তোমার বোন আমার কাছে সুখেই থাকবে। তোমার অবধি অভিযোগ আসবে না। তোমার মনে জমানো ভরসা নীড় হারাবে না, সেই আশ্বাস আমি দিতে পারি। ছোটো মনে এত চাপ না নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকো।’

তুহিন প্রসন্ন হাসল। কৃতজ্ঞভরে বলল, ‘থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। আমি নিশ্চিন্ত থাকতে চাই। তিন বছর পরে আপনাদের অনুষ্ঠানের কন্যা সম্প্রদানের সময় বলতে চাই, আমি নিশ্চিন্ত, আপনি আমার বোনটাকে ঠিক সামলে নিবেন সারাজীবন। ভীষণ সুখে রাখবেন।’

.

তাহিয়া রুমে গিয়ে দরজা লাগাল। এরপর অভীকের সামনে যাবে কিভাবে সেটাই ভাবছে, নিশ্চিত কথা শুনাবে। নাহ্! যাবে না, শুধু আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখবে। চোক্ষু তৃষ্ণা মিটিয়েই চলে আসবে। সিদ্ধান্ত কষল তাহিয়া। বসার ঘরের দরজার ফাঁক দিকে অভীকের দিকে তাকাল। চেয়ে রইল অপলক। তার তাকানোর মাঝে ভেতর থেকে অভীকের স্বর ভেসে এলো,
‘এক কাপ সবুজ চা আনো তো, তাহিয়া!’

ধরা পড়ে কাচুমাচু করল তাহিয়া। তুহিন অভীকের পাশে বসে হাসছে। তাহিয়া প্রথমে লজ্জা পেয়ে ফিরে যেতে নিল। পরক্ষণেই থেমে গেল। লোকটা চা চাইছে, তার মানে আজ এই পড়ন্ত বিকেলে চায়ের কাপে আলাপ হবে? সেই হাসপাতালের রাতের মতো! সে যদি এক কাপ দুধ চা আর এক কাপ সবুজ চা নিয়ে যায় লোকটা কি বারান্দায় বসবে? তাকে সময় দিবে?

এলোমেলো ভাবনা নিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে গেল। রিনাকে বলল, চা বসাতে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here