প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-১৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
প্রশান্তিমাখা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন মাহমুদা। দরজায় তার আদরের মেয়েটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে , মুখটা মলিন। বর্ষামুখর চোখ। মেয়েটাকে এক পলক দেখে নিতেই মাহমুদার হৃদয়ে প্রশান্তি খেলে গেল। মনে হলো, তিনি তাহিয়াকে বিগত কয়েক বছরেও দেখেন নি, চেহারাটা ও ভুলে গেছেন যেন। অথচ অর্ধদিন আগে ও দেখেছেন। মেয়েকে ইশারায় কাছে ডাকলেন।
মাহমুদার মুখটা মলিনতায় ভরা। মায়ের মুখশ্রী দেখে তাহিয়ার মনটা মেঘে ঢাকা পড়ল, আকস্মিক কান্না পেল ওঁর। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মায়ের শিয়রে বসল চুপটি করে। তাহিয়া পাশে বসতেই ওঁর মাথায় হাত বুলালেন মাহমুদা। মেয়েকে সংস্পর্শে আসতেই মুখের মলিনতা সরে চমৎকার হাসির রেখা দেখা গেল। মেয়ের মাথায় এক হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘লাঞ্চ করে এসেছিস?’
তাহিয়া মায়ের দিকে তাকাল এক পলক। মাহমুদার চোখে মুখে উৎফুল্লতা। যেন তার খুশিটা তাহিয়ার মাঝেই আটকে ছিল। মায়ের হাসিখুশি চেহারার দিকে তাকিয়ে তাহিয়ার মনে হলো, শুধু মা নয়, মায়ের সাথে ওঁর পুরো দুনিয়া হাসছে। সুখে ভরে গেছে মনটা। মায়ের হাসিটাই যেন তার মনের মেঘ সরিয়ে দিতে লাগল। সে ইতিবাচক উত্তর দিল। মাহমুদা ধীর স্বরে মেয়ের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক কতো আলাপ আলোচনা করল মা মেয়ে। এলোমেলো কথা বলে হাসল কিছুক্ষণ। তাহিয়া স্পষ্ট টের পেল, তার মনে জমে থাকা মেঘ সরে গিয়ে সচ্চ নীলাকাশ দেখা যাচ্ছে। দেহে চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে, চেহারায় উৎফুল্লতা।
কথার মাঝে মাহমুদা বললেন,
‘ অভীক কোথায়? অনেকক্ষণ দেখছি না যে?’
তাহিয়া ধীর স্বরে উত্তর দিল,
‘আমাকে গেটে নামিয়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। বললেন, কাজ আছে।’
নীলিমা বসা ছিলেন কেবিনের বাড়তি বেডটায়। তুহিন ও বসে আছে পাশে। তাহিয়ার কথায় নীলিমা ভ্রু কুঁচকালেন, আজ তো কলেজ ও যায় নি। তবে এই ভরদুপুরের কিসের কাজ! তিনি একপাশ সরে অভীককে কল দিলেন। কথা বলে জানতে পারলেন, অভীক বাসায় আছে। একটু বিশ্রাম করে ফিরে আসবে হাসপাতালে। নীলিমা বিশেষ পাত্তা দিলেন না। ভাবলেন, কাল থেকে ধকল যাচ্ছে। বিশ্রামের প্রয়োজনেই বাসায় গেছে। বিকেলে তিনি বাসায় গেলেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, অভীকের দেখা নেই। তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল। লোকটা আসছে না কেন! তার খবরাখবর জানতে তাহিয়া নীলিমাকে কল দিল। ফোন তোলার পর তাহিয়া জিজ্ঞেস করল,
‘আন্টি, তোমার ছেলে কোথায়? আজ আসবে না?’
তাহিয়ার উদ্ধিগ্নতা দেখে নীলিমা হাসলেন। হাসি থামিয়ে দুঃখভরা গলায় বললেন,
‘আর বলিস না। ছেলেটার বদহজম হয়েছে। এখন ছোটোঘর-বড়োঘর দৌড়াদৌড়ি করছে। ওর এই একটা সমস্যা, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন খাবার জোর করে খেলে বদহজম হয়ে যায়। আল্লাহ জানে আজ দুপুরে কী খেয়েছে?’
তাহিয়া ভীত ঢোক গিলল। দুপুরে অভীক তার হাতের রান্না করা খিচুড়িই খেয়েছে। তবে কি তার হাতের রান্না খেয়েই অভীক অসুস্থ হয়ে পড়েছে? মীরার অভিশাপ লেগে গেল! সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘এখন কেমন আছে?’
‘ অবস্থার পরিবর্তন নেই। এখনো দৌড়াদৌড়িতে আছে। ‘
নীলিমার স্বরটা মলিন। সেই মলিনতা তাহিয়াকে ছুঁয়ে গেল,
‘আপনি স্যারের খেয়াল রাখুন। আজ আপনাদের হাসপাতালে আসতে হবেনা। আমি, আর মামা সামলে নিব।’
নীলিমা স্যালাইন বানাচ্ছিলেন। ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রাখলেন। মাহমুদা উৎসুখ হয়ে মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন,
‘কী হলো অভীকের?’
তাহিয়া বলতে চাইল, ‘ মীরার অভিশাপ লেগে বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে ছোটোঘর -বড়োঘর দৌড়াদৌড়ি করছে। ‘
কেমন শুনায় কথাটা! বলতে পারল না তাহিয়া। ধীর স্বরে বলল,
‘বদহজম হয়ে গেছে।’
মাহমুদা চিন্তিত গলায় বললেন,
‘তুই ওকে ফোন দিয়ে বল, বাড়িতে বিশ্রাম নিতে। হাসপাতালে যেন না আসে।’
মাহমুদা বারান্দায় গিয়ে অভীককে ফোন দিল। প্রথমবার রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। গম্ভীর গলা ভেসে এলো,
‘বলো!’
তাহিয়া ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘এখন কেমন আছেন?’
অভীক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাগমাখা গলায় বলল,
‘তুমি আর কখনো রান্না করবে না, ফাজিল!’
কথাটায় কি লাফিং গ্যাস ছিল? তাহিয়ার এত হাসি পেল কেন! হাসিদের দমিয়ে রাখল সে। মলিন স্বরে বলল,
‘আপনি বাসায় বিশ্রাম নিন। আমি মামা এদিকটা সামলে নিব।’
পেটে কেমন অদ্ভুত আওয়াজ করছে। পেটে হাত দিয়ে অভীক বলল,
‘তুমি যেমন ফাজিল, তোমার বান্ধবীগুলো ঠিক তেমন ফাজিল। সব ফাজিলের দল। আমি নিজেকে সামলে নিব। জুতা মেরে গরুদান করতে হবে না তোমার। ফোন রাখো, ফাজিল!’
আকস্মিক রাগটা মাথায় চড়ে বসল ওঁর। সামলানো দায় হয়ে পড়ল। ভদ্রতার খোলস ছেড়ে মেয়েটাকে কী সব বলে ফেলল! নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিল।
*
সন্ধ্যায় মীরা তার মাকে নিয়ে এলো মাহমুদাকে দেখতে। মীরার বাসা হাসপালের কাছাকাছি। মীরার মা মাজেহা জাহান, মাহমুদার পাশে বসে কুশল বিনিময় করছেন। ইতঃপূর্বে মেয়েদের কারণে বিভিন্ন সময় দেখা হয়েছে তাদের। খানিক ভাব আদান প্রদান আছে।
তাহিয়া মায়ের পাশে বসা । মীরা ইশারায় বান্ধবীকে ডেকে নিয়ে গেল করিডোরে। বাইরে যেতেই মীরা তাহিয়ার হাত ধরে বলল,
‘একদম মন খারাপ করবি না, আন্টি ঠিক হয়ে যাবেন। রোগ এত জটিল নয়, চিন্তার কিছু নেই। নিশ্চিন্ত থাক। আন্টির সামনে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবি না। তুই আন্টির বড্ডো আদরের মেয়ে। তোর মলিন মুখ দেখে আন্টিরও মন খারাপ হবে। হাসিখুশি থেকে আন্টিকে সাপোর্ট দিবি।’
মীরাকে সিরিয়াস হতে দেখা যায় না খুব একটা। সে হাসিঠাট্টার মেজাজে থাকে সবসময়। আজ ভীষণ সিরিয়াস। তার গাম্ভীর্য দেখে তাহিয়া অবাক হলো কিছুটা। উত্তর দিল না। মীরার হাতে একটা টিফিন ব্যাগ ধরা। ব্যাগটা তাহিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তোর পছন্দের নান, চিকেন ফ্রাই আর টিক্কা আছে। নিজে খাবি, সেই সাথে সবাইকে খাওয়াবি। দুঃখবিলাস করতে গিয়ে উপোস থাকা চলবে না। আর শুন, আমার বাসা যেহেতু কাছে, খাবার আমার বাসা থেকে আসবে। প্রতিবেলায় আমি নিয়ে আসব। বাইরের খাবার খাবিনা। আন্টিকে ডাক্তার কী খেতে বলল না বলল আমায় জানাবি। আমি নিজে রেঁধে আনব। আর রাতে চলে যাবি আমার বাসায়, হাসপাতালে তো ঠিকমতো ঘুম হবে না। আমার পুরো বাসা খালি। আমার বাসা তো চিনিস তুই, তুহিনকে নিয়ে চলে যাবি। নাহয় আমায় ফোন দিবি, রাত যতই হোক আমি বাবাকে নিয়ে এসে নিয়ে যাব তোদের। তোর মা মানে আমার মা, কোন কিছুর দরকার হলে নির্দ্বিধায় জানাবি আমায়। ‘
তাহিয়া নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মীরার প্রতিটা কথার ভাজে যেন ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। স্কুল জীবন থেকে বন্ধুত্ব তাদের। একে অপরের ক্রাইম পার্টনার। সব সুখে একে অপরের পাশে ছিল। এবার দুঃখে ও সঙ্গ দিতে এসেছে! এরই নাম কী বন্ধুত্ব! অসুস্থতা মানুষের আসল রূপ বের করে আনে। ইতঃপূর্বে মীরার চোখে নিজের জন্য টান দেখে নি।।আজ যেন তা দেখতে পাচ্ছে।
কথার পালাবদলে অভীকের কথা জিজ্ঞেস করল মীরা,
‘কীরে, তোর শ্রদ্ধেয় জাঁদরেল বর কোথায়? আসেনি?’
অভীকের কথা আসতেই তাহিয়ার স্মরণে এলো সব কিছু। সে কপট রেগে বলল,
‘তোর অভিশাপ বোধহয় লেগে গেছে। স্যার এখন ছোটোঘর বড়োঘর করছে।’
কথাটা বুঝতে সময় লাগল মীরা। বোধগম্য হতেই মুখের গাম্ভীর্য সরে গেল তড়িৎ। ঠোঁটচেপে হেসে বলল,
‘তা কী রান্না করেছিস তুই?’
‘খিচুড়ি। তুই অভিশাপ ফিরিয়ে নে।’ মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিল তাহিয়া।
মীরা তার আসল রূপে ফিরে গেল। হাস্যত্মক গলায় বলল,
‘দ্যাখ, তোর মাকে আমি আমার মায়ের চোখে দেখি। কিন্তু তোর জামাইকে আমি নিজের জামাইয়ের চোখে দেখি না। আসতাগফিরুল্লাহ, ভাবতেও পারিনা। সেই ভাবনার অনাগ্রহ থেকে ভদ্রলোকের জন্য আমার কোন টান আসেনা। তাই অভিশাপ ফিরিয়ে নিতে পারব না। ‘
তাহিয়া চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
‘আমার সম্পর্কের ভিত্তিতে তিনি তোর দুলাভাই। আমার দিক ভেবে মাফ করে দে!’
মীরা মুখ বাঁকাল,
‘দুলাভাই! হাহ্! যদি ভদ্রলোক আর সব দুলাভাইয়ের মতো হত, তাও একটা কথা ছিল। দুলাভাই বলে ঠাট্টা করার, বিয়ের দিন গেটে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কোন সম্ভাবনা থাকতো, তবে এতক্ষণে নির্দ্বিধায় মাফ করে দিতাম। কিন্তু তুই স্যারকে বিয়ে করে আমাকে সব ‘শ্যালিকা অধিকার ‘ থেকে বঞ্চিত করেছিস। আমি তোর বিয়ের গেটে গিয়ে ফিতা ধরতে পারব না। মনে হবে, স্যার এক্ষুনি ধমকে উঠছেন,
‘ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে এসব করেন? যান, ক্লাসে গিয়ে বসুন। নয়তো আবার পরীক্ষার আগের রাতে স্যারকে কল দিবেন।’ স্যারের স্বভাব অনুযায়ী বলতেও পারেন। এত ঝুঁকি নিয়ে গেটে যাওয়া যাবে না। গেটের টাকা গেল বন্যার জলে। বিয়ের পর বান্ধবীর বরের সাথে কথা হাসিমজা চলে। আমি তোর বরের সাথে হাসিঠাট্টা করতে গেলে, ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফিরে আসব। এত ভয় নিয়ে ‘শালিকা অধিকার’ আদায় করা যায় না। অধিকার বঞ্চিত এই শালিকা কিভাবে দুলাভাইকে মাফ করবে, বলতো!’
তাহিয়া মলিন স্বরে বলল,
‘স্যার কষ্ট পাচ্ছেন।’
তাহিয়াকে পরখ করে মীরা টিপ্পনী কাটল,
‘কষ্ট বোধহয় স্যারের বউ ও পাচ্ছেন। কী প্রেম! আহা! ‘
থেমে বলল,
‘আমি মাফ করতে পারি, তবে তার জন্য তোকে একটা কাজ করতে হবে। ‘
‘কী কাজ?’
আগ্রহী গলায় বলল তাহিয়া। মীরা স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘বেশি কিছু নয়। এরপর স্যার যেন আমাকে ধমক না, পরীক্ষার আগের রাতে কল দেয়ার খোটা না দেন,এ মর্মে একটা চুক্তিপত্রে সাক্ষর নিবি স্যার থেকে। চুক্তিপত্র হাতে পাওয়ার সাথে সাথে আমি অভিশাপ ফিরিয়ে নিব। প্রমিজ!’
তাহিয়া খানিক ভাবল, তারপর বলল,
‘স্যার ভালো মানুষ। আমরাই বোধহয় খারাপ, তাই বকা দেন। চুক্তিপত্র নিতে পারব না। তবে সুযোগ বুঝে নিশ্চয়তা নিয়ে নিব। এবার অভিশাপ ফিরিয়ে নে, আমার জন্য হলে ও নে।’
মীরা তাহিয়ার মাথায় ঠুয়া মেরে বলল,
‘আন্টি অসুস্থ বিধায় তোর উপর দয়া আসছে। দয়া থেকে অভিশাপ ফিরিয়ে নিচ্ছি। নয়তো আমি খুশিতে জিলাপী বিতরণ করতাম, যে ধমক দিয়েছে আমাকে। তুই স্যারকে বিয়ে না করলেও পারতি, তোর জন্য আমি খুশি হতে পারছিনা।’ আবার ঠোঁট বাঁকাল মীরা।
তাহিয়া কপট রাগ দেখাল, ‘ শিক্ষক সম্পর্কে কেউ এমন কথা বলে? জানিস না, শিক্ষক বাবার সমতূল্য।’
মীরা ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘ শিক্ষক বাবার সমতূল্য, কথাটা মানিস তুই?’
তাহিয়া না ভেবেই বলে দিল,
‘না মানার কী আছে?’
‘ তাহলে আজ থেকে স্যারকে ‘বাবা’ কিংবা চাচা বলে ডাকিস!’ ব্যাঙ্গাত্মক গলায় বলল মীরা।
তাহিয়া কাঁচুমাচু করল। মীরা তাহিয়া কাধ চাপড়ে বলল,
‘কথাটা আমাদের জন্য বরাদ্দ। তোর জন্য নয়। তুই বললে সম্পর্কটা অন্যদিকে মোড় নিবে। এসব কথা আবার স্যারের সামনে বলিসনা। স্যার সিংহের গর্জন দিয়ে বলবেন,
‘ক্লাস ব্যাঙ্ক দিয়ে এসব শিখেন? যান, রুমে গিয়ে বসুন।’
দুই বান্ধবীর কথার মাঝে অভীক উপস্থিত হলো সেখানে। মীরাকে দেখে কেমন রেগে তাকাল! মীরা ভীত ঢোক গিলল। ভয়ের সাথে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
অভীক উত্তর দিল না। মীরা তাহিয়ার কানে কানে বলল,
‘স্যার এভাবে তাকাচ্ছে কেন!’
তাহিয়াও ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোর অভিশাপ দেয়ার ব্যাপারটা স্যার জেনে গেছেন।’
মীরা আঁতকে উঠল। বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে কোনমতে কেটে পড়ল। যাওয়ার সময় ঠোঁট চেপে হাসতে ভুলল না। সেই হাসি অভীকের দৃষ্টিগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকাল। মেয়েটা হাসল কেন! তার অসুস্থতার ব্যপারে জেনে গেছে? কিভাবে জানল, এই ফাজিল মেয়েটা বলেছে নিশ্চয়ই! তারপর দুজন মিলে হাসিঠাট্টা করেছে!
অভীকের ভাবনার মাঝে তাহিয়া উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘এখন কেমন আছেন? আপনি আসতে গেলে কেন? বাসায় বিশ্রাম নিতে পারতেন।’
অভীক তাহিয়ার কথা উত্তর না দিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
‘তুমি মেয়েটা ভীষণ ফাজিল। এত ফাজিল হওয়া উচিত নয় তোমার। অন্তত আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তো নয়ই।’
তাহিয়া বুঝল অভিশাপ সম্পর্কিত কারণে অভীকে ক্ষেপে গেছে। সে দ্রুত বলল,
‘আমি জীবনেও আর আপনাকে অভিশাপ দিব না। প্রমিজ!’
‘মীরা আর তোমার মতো দুটো ছাত্রী থাকলে কোন শিক্ষকের শত্রুর দরকার পড়েনা। ট্রাস্ট মি.’ রাগ পড়ল না অভীকের। গম্ভীরমুখে বলল কথাটা।
‘মীরা অভিশাপ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি আসরের নামাযের পর মোনাজাতে আপনার সুস্থতা কামনার দোয়া করেছি। দ্বিতীয়বার অভিশাপ দিব না, প্রমিজ করছি। আর কী করব?’ অনুতাপের সুরে বলল তাহিয়া।
অভীক স্বরের গম্ভীরতা বজায় রেখে বলল,
‘তুমি শুধু আর রান্না করোনা, তাহলেই হবে। ‘
তাহিয়া চট করে কান ধরে ফেলল। বাচ্চাদের মতো করে বলল,
‘ঠিক আছে আর করব না, স্যরি।’
তাহিয়ার শিশুসুলব ভাবটায় অভীকের রাগটা পড়ে গেল বোধহয়। গম্ভীর সুরে বলল,
‘এভাবে আর কখনো সর্যি বলবে না। হাত নামাও, ফাজিল।’
বলে চলে গেল মাহমুদার কেবিনের দিকে।
*
সন্ধ্যায় গিয়ে রাতের খাবার নিয়ে ফিরে এলো মীরা। নিজে সার্ভ করে খাওয়ালো সবাইকে। খাওয়া শেষে তুহিন আর ফিরোজ সাহেবকে নিয়ে গেলো নিজের বাসায়। তাহিয়াকেও জোর করেছে, মায়ের কাছ ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগেনি বিধায় তাহিয়া যায়নি। তুহিন কিংবা ফিরোজ সাহেবের ও মীরার বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কোথাকার ভাগ্নির বান্ধবীর বাসায় যাবে রাত্রীযাপনের জন্য! ফিরোজ সাহেব ভেবেছেন গেলে বোনের বাসায় যাবেন। কাল রাত ঘুম হয়নি, আজ ঘুমিয়ে নিবেন। সকালে আবার ফিরবেন।
কিন্তু মীরা যখন তার কাছে গিয়ে বিনম্র স্বরে বলল,
‘এত রাতে ঘন্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে যাবেন, সকাল সকাল আবার দৌড়ে আসবেন। তারচেয়ে বরং আমার বাসায় চলুন। রাতে আন্টির কোন সমস্যা হলে আসা যাওয়ার ও একটা ব্যাপার আছে। আমি আপনার মেয়ের মতোই। চলুন এই মেয়ের বাসায়। আপনার যত্নের অভাব হবে না।’
মেয়েটার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে রাজি হলেন ফিরোজ সাহেব। তুহিনকে ও রাজি করিয়ে ফেলল মীরা। যাওয়ার সময় তাহিয়াকে বলে গেল, সকালে নাস্তা নিয়ে আসবে সে। বাইরে থেকে না আনে। বান্ধবীর আন্তরিকতায় বিস্মিত তাহিয়া। মেয়েটা কী চমৎকারভাবে একজন বন্ধুর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে!
সবাই চলে যাওয়ার পর তাহিয়া মায়ের পাশে বসল। ওষুধ খাইয়ে মাকে শুইয়ে দিল আলতো হাতে। মায়ের শিয়রে বসে বলল,
‘ছোটোবেলায় তুমি আমার মাথায় বিলি কেটে আমাকে ঘুম পাড়াতে, আজ আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে তোমাকে ঘুম পাড়াব।’
মাহমুদা স্মিত হেসে চোখ বন্ধ করলেন। তাহিয়া অনন্যচিত্তে বিলি কেটে ঘুম পাড়াল মাকে। ঘুম পাকাপোক্ত হতেই মায়ের পাশ ছেড়ে সরে গেল। পাছে না আবার মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। বাড়তি বিছানায় বসল কিছুক্ষণ। আকস্মিক অভীকের কথা মাথায় এলো। লোকটা কী করছে? নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
কেবিনের দরজার পাশে পাতানো চেয়ারে বসে আছে অভীক। মাথাটা চেয়ারে হেলানো, চোখ বন্ধ। চোখের পাতা নড়ছে, যার অর্থ ঘুমায়নি। ক্লান্তির গাঢ় রেখা চেহারায়, দূর্বলতায় শরীরটা নেতিয়ে পড়া জো। বদহজমের সমস্যাটা কাটতেই দূর্বল শরীর নিয়ে ছুটে এসেছে হাসপাতালে। মাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর থেকে অনবরত দৌড়াদৌড়ি করছে লোকটা, সবার ভালো থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের বিশ্রামের সময়টা কেড়ে নিচ্ছে। নিজের ছাড়া সবার খেয়াল থাকে তার। একটু নিজের কথা ভাবলে কী হয়? রাতে এতবার বলল বাসায় ফিরে যেতে, ফিরল না। উলটো বলল, তোমাদের হাসপাতালে রেখে আমার বাসায় গিয়ে ঘুমাব? কাধে ভর করা দায়িত্ব চেপে রেখে আমার চোখে ঘুম নামবে?
লোকটার দায়িত্ববোধ দেখে ক্ষণেক্ষণে মুগ্ধ হয় তাহিয়া। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে। শ্রদ্ধা জাগে, মায়া জাগে, প্রেমটা বাড়ে। এই মুহুর্তে অভীককে দেখে মায়া হচ্ছে তাহিয়ার। নিঃশব্দে গিয়ে বসল অভীকের পাশের চেয়ারটায়। পাশের লোকটাকে পরখ করে ধীর স্বরে বলল,
‘মায়ের পাশের বেডটা খালি আছে। আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন, স্যার। আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’
নিজের অবস্থার পরিবর্তন করল না অভীক। চোখ বন্ধ করেই হাসল, দু’পাটি দাঁত দৃশ্যমান হলো। চমৎকার দেখাল হাসিটা। তারপর মাথাটা এপাশ করে চোখ খুলে তাকাল তাহিয়ার দিকে। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘তুমি এতটা অবুঝ কেন, তাহিয়া?’
তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল, ‘এখানে বুঝ অবুঝের কী আছে?’
‘ ‘অস্বস্তি’ শব্দটা শুধু তোমার সংবিধানে যে আছে এমনটা নয়। আমার সংবিধান ও আছে। সেই সাথে ‘বেমানান’ নামক আরও একটা শব্দ আছে। এই শব্দ দুটোর পরিপ্রেক্ষিতেই আমি জামাতা হয়ে একই রুমে শ্বাশুড়ির পাশে বেডে থাকতে পারব না। কথার সারমর্ম না জেনে কীসব বলো!’
অভীক হাসছে। হাসছে তার চোখ। ক্লান্তমাখা মুখটায় ফুটে উঠেছে একরাশ উৎফুল্লতা। তার এহেন হাস্যজ্বল মুখ, পাশে বসে অন্তর্ভেদী চাহনিতে পরখ করল তাহিয়া। তারপর চোখ সরাল। খানিক ভাবতেই নিজের কথা এবং অভীকের কথার সারমর্ম বোধগম্য হলো। ভুলটা নজরে এলো। চুপচাপ উঠে গেল। মাথায় এলো, যে মানুষটা তার এবং তার মায়ের এত খেয়াল রাখছে সেই মানুষটার খেয়াল রাখতে হবে। এই মুহুর্তে মানুষটার ঘুমের প্রয়োজন। ঘুমের ব্যবস্থা করতে হবে। কেবিনে চলে গেল সে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অভীক মায়ামাখা গলায় বলল,
‘পাগলী।’ তার আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।
তাহিয়া পার্স হাতে নিয়ে ফিরে গেল। অভীকের চোখ বন্ধ দেখে নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ফিরে এলো মিনিট দশেক পর। হাতে দুটো ওয়ান টাইম চায়ের কাপ। একটায় দুধ চা, অন্যটায় সবুজ চা। চা হাতে নিয়ে বসল অভীকের পাশের চেয়ারটায়। ধীর স্বরে ডাকল,
‘স্যার!’
অভীক চোখ খুলল। তাহিয়া সবুজ চায়ের কাপটা অভীকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘নিন, ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
অভীক ভ্রু কুঁচকাল। প্রশ্ন করল,
‘এই মাঝরাতে চা কোথায় পেলে?’
‘ক্যান্টিন থেকে এনেছি।’
অভীক সোজা হয়ে বসল। সন্দিগ্ধ হয়ে বলল,
‘এত রাতে নিচে গিয়েছো তুমি? কেন গিয়েছো? কিছু লাগলে আমায় বলতে পারতে। ‘
অভীকের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে নিজের কাপটা দুহাতে ধরল তাহিয়া। চায়ে ফুঁ দিয়ে বলল,
‘রিসেপশনে গিয়েছি একটা কাজে। আসার সময় ভাবলাম, এক কাপ চা ভীষণ প্রয়োজন। বিশেষ করে সবুজ চা টা। তাই নিয়ে এসেছি।’
‘সবুজ চা!’
মেয়েটা তার পছন্দের কথা জানে! অবাক হলো অভীক। বিস্ময় নিয়ে তাকাল তাহিয়ার দিকে। তাহিয়া সামনে তাকিয়ে চায়ে ফুঁ দিচ্ছে। ভয়ে আজ তার গলা কাঁপছে না, কপালে বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব চোখে পড়ছে না। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় তার পাশে বসে আছে মেয়েটা। চোখ ভরতি বিস্ময় নিয়ে দৃষ্টি ঘুরাল অভীক। চায়ে চুমুক দিল। এই মুহুর্তে এই এক কাপ চায়ের ভীষণ প্রয়োজন ছিল তার। অভীকের ধারণা, স্বাদহীন ওই চায়ে তার সতেজতা লুকিয়ে থাকে।
চায়ে প্রথম চুমুকটা দিতেই এক ফালি ধোঁয়া এসে চশমার গ্লাসটাকে ঢেকে দিল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো ওঁর। এক হাতে চায়ের কাপ ধরে অন্য হাতে চশমা খুলে নিল। একহাতে চশমা মুছার চেষ্টা করল। ব্যার্থতা এসে বরণ করল ওকে। ওর এদিকে চেয়ার খালি নেই। অভীকের অপাশে চেয়ার খালি, তাই রাখার সুযোগ ও নেই।বিরক্তির আভা চোখ থেকে সারা মুখে ছেয়ে গেল। মুখে উদ্ভট শব্দ করল। অভীক পাশে বসে সূক্ষ্ম চাহনিতে পরখ করল সবটা। মুখের সামনে থেকে চায়ের কাপ সরিয়ে পাশের চেয়ারটায় রাখল। তারপর তাহিয়ার হাত থেকে চশমা নিয়ে নিজের টি-শার্টে মুছল, দায়িত্ব সমাপ্তি ঘোষণা করল তাহিয়ার চোখে পরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। সরে বসে আবার চা হাতে নিল। তাহিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল। অভীক বলল,
‘হয় ধোঁয়া ছাড়লে চায়ে চুমুক দাও, নয়তো চশমা খুলে ফেলো।’
তাহিয়া চশমা খুলে চুমুক দিল। দুজনের মাঝের জায়গাটায় ‘নিরবতা’ নামক কারো উপস্থিতি হলো। স্বরে পর্দা পড়ে গেল, স্বর গেল আটকে। নিরবে চায়ে চুমুক দিয়ে গেল ওরা, কেউ কথা বলল না। চা শেষ হয়ে গেলে উঠে দাঁড়াল তাহিয়া। মায়ের কেবিনে গিয়ে মাকে দেখে এলো। নাহ্, মায়ের নড়চড় নেই। আবার ফিরে এলো।
অভীকের পাশে বসে বলল,
‘১০১ নাম্বার কেবিনের রোগী আজ বিকেলেই রিলিজ হয়েছে। আপাতত খালি আছে। আপনি গিয়ে ওখানে শুয়ে পড়ুন। মায়ের দেখাশোনার জন্য আমি আছি।’
অভীক চোখ তুলে চাইল। মেয়েটার চোখের শিরায় নিজের জন্য উদ্ধিগ্নতা দেখে চমৎকার হাসল। বলল,
‘ আমি এখানেই ঠিক আছি। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো ।’
তাহিয়া কোমল স্বরে বলল,
‘ আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সারাদিন শরীরে অনেক ধকল গেছে, একটু বিশ্রামের সত্যিই প্রয়োজন। মায়ের পাশে আমি থাকব। আপনি এতে বাধা না দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ুন। প্লিজ স্যার, আমি আছি তো! ‘
অভীক মৃদুহাসল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ তুমি আজকাল আমার খেয়াল রাখা শুরু করেছো দেখি। প্রথমে গ্রীণ টি, তারপর কেবিনের ব্যবস্থা। ঘটনা কী বলোতো? আগ্রহী হয়ে পড়লে না কি!’
তাহিয়া বিব্রতবোধ করল । লোকটা এমন কেন? সে আগ্রহী হলে হয়েছে, লোকটাকে টের পেতে হবে কেন? আর টের পেলেও সরাসরি তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে কেন? এতে সে বিব্রতবোধ করতে পারে, লোকটা কি জানে না? সব জানলেও প্রকাশ করতে হবে না কি! এই যে লোকটা রাতদিন তার খেয়াল রাখছে। কই সে তো বলে না, আপনি আমার প্রতি আগ্রহী হয়ে গেছেন না কি! তাহলে লোকটার বলতে হবে কেন? সব ওকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার ধান্দা। পাজি লোক একটা। বিরক্তির সাথে অন্যদিকে ফিরে বলল,
‘এ প্রশ্নটা আমি করলে?’
অভীকের চেহারায় হাসির ভাটা পড়ল না। সে হেসেই বলল,
‘প্রশ্নটা তুমি করলে আমার উত্তর হবে, তোমার উপর আমার অনেক দায়িত্ব। আমি সেই দায়িত্বের উপর আগ্রহী, তোমার উপর নয়। ‘
তাহিয়ার মনোক্ষুণ্ণ হলো। তার প্রতি আগ্রহী কেন নয়? সে কি খারাপ! দায়িত্বের বাইরে ভালোবাসা নিয়ে কবে আসবে? আদৌ আসবে! না কি দায়িত্বই পালন করে যাবে। সে যে ভালোবাসা চায়, অভীকের কাছ থেকে প্রেমোময় কথা শুনতে চায়। দায়িত্বের মধ্যে কি প্রেম পড়ে না? তবে যে সে প্রেমে পড়ে গেল! তাহিয়া বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘আমি বোধহয় সিলিবাসের বাইরে পড়ে ফেলেছি, তাই কমন আসছে না।’
মুখে বলল,
‘দায়িত্ব আমার উপর নেই?’
‘তুমি মানো দায়িত্ব! ‘ বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল অভীক। তাহিয়া মনে করার চেষ্টা করল, এ অবধি সে একজন স্ত্রী, পুত্রবধূর কোন দায়িত্ব পালন করেছে কি না। মনে পড়ল না। সে তার অবস্থান থেকে দায়সারা। তবে স্বীকার করতে চাইল না। আমতাআমতা করল,
‘ না মানার কী আছে?’
‘তোমার মানার তালিকায় ও কিছু নেই। তবে এ নিয়ে আমার আপত্তি কিংবা অভিযোগ নেই। আমার বাসায় যাওয়ার আগ অবধি তুমি সম্পূর্ণ দায়হীন। আমি অন্তত চাপাবো না কোন দায়িত্ব। দায়িত্ব মানুষের কাধে আপনাআপনি এসে দায়, মানা না মানা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার স্যাপার ও তোমার উপর নির্ভরশীল। তোমার হস্তক্ষেপ ছাড়া আমি সম্পর্কে নতুন মাত্রা আনব না। ‘
এ পর্যায়ে গম্ভীর হলো অভীক। পরক্ষণেই গাম্ভীর্যতা মাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বলল,
‘তোমার চোখে আমি কিন্তু আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি, তাহিয়া। তুমি কি টের পাচ্ছো? ‘ রগড় করে বলল অভীক।
তাহিয়া চশমা পরে মনে মনে বলল,
‘এটা ঠিক হচ্ছে না, আমাকে এতটা বিব্রত করা আপনার উচিত নয়। একদমই না।’
চুপ করে বসে রইল। নড়েচড়ে বসল অভীক। ক্লান্তি আর দূর্বলতায় শরীরটা ভেঙে আসছে। একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। তাহিয়া প্রস্তাব মেনে কেবিনে যাওয়া যায়। কিছুক্ষণ পরপর এসে না হয় দেখে যাবে! এই মননে উঠে দাঁড়াল অভীক। তাহিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমি যাচ্ছি। কোন সমস্যা হলে ফোন দিবে।’
তাহিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সায় জানাল। অভীক যাওয়ার আগে তাহিয়ার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
‘তুমি বোধহয় মানুষিকভাবে বড়ো হতে শুরু করেছো। ‘
*
১০১ নাম্বার কেবিনের দিকে হাটছে অভীক। তাহিয়া তাকে অনুসরণ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে কোলাহলহীন করিডোর ধরে। উদ্দেশ্য, অভীক অবস্থান ঠিকঠাক হবে কি না দেখা। তাহিয়ার অস্তিত্ব টের পেয়ে হাটা থামিয়ে পিছন ঘুরল অভীক। তাহিয়া তখন অভীকের পিছনেই, দুরত্বে এক হাত। তাহিয়াকে ওঁর পিছু আসতে দেখে বলল,
‘ আমার সাথে রাত্রীযাপনের ইচ্ছে আছে না কি তোমার!’
অর্থবহ হাসি অভীকের ঠোঁটে। তাহিয়া মাথা নাড়াল। লোকটা কী পাজি! তড়িৎ ঘুরে হাটা ধরল। দু’কদম বাড়িয়েই থামল হলো। অভীক পিছু ডাকল তাকে,
‘এই, শুনো?’
তাহিয়া পিছু ঘুরল। অভীক হেসে বলল,
‘ আমি হয়তো সহাস্যে তোমায় বরণ করব না,
কিন্তু গম্ভীরমুখে প্রত্যাখ্যান ও করব না,
তুমি চাইলেই থাকতে পারো, আমার পাশে কিংবা বুকে।
আমি হয়তো আগলে নিব না, তবে দূরে ও সরাব না।
স্ত্রীকে আগলে রাখার দায়িত্বটা যে আমার কাধে।
তুমি চাইলেই থাকতে পারো,আমার পাশে কিংবা বুকে। ‘
তাহিয়াকে লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছে করেই আবৃত্তির মতো করে বলল অভীক। মায়ের শোকে শুধু দুঃখবিলাস করে চোখের নিচে কালি না বসিয়ে,
তার কথায় লজ্জাবিলাস করে লাল নীল হোক। মন্দ কী!
চলবে…