তোর মনের অরন্যে পর্ব-৩১

0
614

#তোর_মনের_অরণ্যে
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৩১.
আমন বাড়িতে আসার পর সোজা সোহাকে রুমে নিয়ে চলে আসে। এখন রাত প্রায় আড়াইটে বাজতে চলেছে বাড়িতে আভা চৌধুরী আর সম্রাট চৌধুরী ঘুমিয়ে গেছে। আমন সোহাকে সোহার রুমে এসে সোহাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ফার্স্ট এড বক্স এনে সোহার জ্যাকেট খুলে দেয়। জ্যাকেটটা খুলে পাশে রাখার সময় আমন একবার সোহার মুখের দিকে তাকায় দেখে সোহা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমন চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়ে ।ক্ষততে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। সোহা এক ভাবে আমনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমনের চোখ মুখ কেমন একটা গম্ভীর ভাব হয়ে আছে। সোহা বুঝতেই পারেনা এত শান্ত একটা ছেলে এতোটা গম্ভীর আর এতটা রুড কি করে হতে পারে। আজকে সে পুরো সময়ে বিস্মিত হয়ে ছিল তার একবারও আজকের যে আক্রমণ টা হলো তাতে তার ভ্রুক্ষেপ হয়নি। তবে আজ সে আমনের এই প্রতিক্রিয়ার জন্য বিচলিত হয়ে পড়েছে। আমন নিঃশব্দে সোহার ক্ষতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় কোনো কথা ছাড়াই। আর সোহা এক মনে তাকিয়ে থাকে আমনের যাওয়ার দিকে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আবারো আমন রুমে আসে। সোহা তখনও একভাবে রুমের বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল তাই আমনকে আসতে দেখে তার দৃষ্টি আমনের উপর আটকে যায়। রুমে ঢুকতে আমনের চোখ সোহার উপরে। আমন পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সোহার সামনে এক হাঁটু মুড়ে বসে তার পায়ের উপর সোহার বাম হাতটা টেনে নেয়। সোহা ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমনের দিকে আমন কি করতে চলেছে সেটা বোঝার চেষ্টা চালায়। আমন পকেট থেকে একটা বক্স বের করে এক হাতে কৌশলে ওপেন করে। তার থেকে একটা প্ল্যাটিনাম এর লাভ সেপ এর ব্রেসলেট বের করে আনে। যেটা প্ল্যাটিনামের চেন এর উপরে ডায়মন্ড বসানো মাঝে “এস” আর “এম”এর লোগো বানানো আর এর দুই পাশে দুটো বড় লাভ সেপ এর লাইট পিঙ্ক ডায়মন্ড বসানো। নিচের দিকে দুটো লেস ঝুলছে যার সাহায্যে হাতের পরিমাপ মতো পরা যায়। এই লেস এর দুটোর শেষে ও দুটো একই লাভ সেপ ডায়মন্ড পাথর বসানো আছে তবে সেটা একটু ছোটো।

আমন ওটা হাতে নিয়ে সোহার পরিয়ে দিতে দিতে সোহার ভ্রু কুঁচকে রাখা মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলে ওঠে।

-“এটা আমি বানিয়ে ছিলাম তোমার জন্য। যেদিন তুমি তোমার অনুভূতি প্রকাশ করবে আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে সেদিনই তোমাকে পরিয়ে দেবো বলে রেখেছিলাম । আজকে যদি ও তুমি কথার মাঝে বলে ফেলেছিলে। আর তাই আজকেই আমি তোমাকে এটা দিয়ে দিলাম।।

সোহা একভাবে তাকিয়ে আছে আমনের দিকে আমন এর কন্ঠ এখনও কিছুটা শীতল হয়ে আছে।

-“এটা কখনো হাত থেকে খুলবে না। কখনো না মানে কখনই না। এটা আমার ভালোবাসার একটা চিহ্ন তাই আমি তোমার কাছে না থাকলেও আমার কথা তোমাকে সব সময়ে মনে করাবে। আমন সোহার চোখের দিকে তাকিয়ে আদেশ ভঙ্গিতে বলে ওঠে।

সোহা কোনো কথা না বলেই আমনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। আমন ঠোঁট এলিয়ে হেসে সোহার হাতের পিঠে তার অধর স্পর্শ করে। সোহা আবেগে চোখ বুজে নেয়। আমন উঠে দাঁড়িয়ে হুট করে বাম হাত টান দিয়ে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে সতর্কতার সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। মাথা নিচু করে সোহার কপালে অধর ছুইয়ে গভীর স্পর্শ বুলিয়ে দেয়। সোহা অনুভব করে আমনের হার্টবিট প্রচণ্ড গতিতে ছুটছে। সোহা বুঝতে পারে আজকের ঘটনার জন্য আমন এখনও বিচলিত হয়ে আছে তাকে নিয়ে তাই এখনও স্বাভাবিক হতে পারছে না। সোহা আমনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে।

-“মন। সোহা মোহনীয় কন্ঠে ডেকে ওঠে।

সোহার ডাকে আমন দু হাতে সোহার মুখটা তুলে ধরে তার সামনে একই রকম জড়িয়ে রাখা অবস্থায়।

-” আমি ঠিক আছি । দেখো সামান্য একটু আঘাত পেয়েছি এতে আমার কিছুই হয়নি। আর তাছাড়া আপনিও তো ছিলেন আমাকে বাঁচানোর জন্য তাইনা? সোহা আমনকে স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে।

-” ঘুমিয়ে পড় অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি আসছি মলিন হেসে বলে ওঠে।

সোহা ও হালকা হেসে মাথা নাড়ায়। আমন সোহার কপালে চোখে মুখে দুই গালে আর ঠোঁটের কোণে নিজের অধরদ্বয় গভীর ভাবে স্পর্শ করে সোহাকে ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

আমন চলে যেতে সোহা কিছু পলক তাকিয়ে থেকে নিজের হাতের দিকে তাকায়। তার হাতে আমন ব্রেসলেট পরিয়ে দিয়ে গেছে। সেখানে হেসে নিজে ও তার ঠোঁটের স্পর্শ বুলিয়ে দেয়। এর মধ্যেই হুড়মুড় করে চারজন রুমে ঢুকে যায়। সোহা চোখ বড় বড় করে তাকায় তার সামনেই আকাশ সানি অ্যাস নীহার তার দিকে তাকিয়ে ক্যাবলার মতো করে হাসছে।

-“কিরে তোরা এখন এখানে কি করছিস? এখনও ঘুমাসনি কেনো? সোহা ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে।

-” আর ঘুম! আজকে যা হলো তারপরেও বলিস আমার ঘুম আসবে? অ্যাস বলে বিছানার উপর গিয়ে বসে পড়ে।

-“হ্যাঁ একদমই তাই আজকে পুরো চোখের সামনে ফাইট সিন দেখলাম এতদিন আমরা এমন ফাইট সোহাকে করতে দেখেছি আর আজকে আমন দা কে। আকাশ বলে ওঠে।

-“হ্যাঁ আমিও ভাই কে কখনো এই রূপে দেখিনি। আর আজকে দেখেতো আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। অ্যাস বলে ওঠে।

-“হুম এই কারণেই মিস্টার আমন রোদ চৌধুরী একজন স্পাই সিনিয়র অফিসার। সোহা সবার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ।

-“মানে? সব কয়জন অবাক হয়ে বলে ওঠে।

-” মানে বলতে এটাই যে – আমন একজন স্পাই। আর স্পাই মানে গুপ্তচর। আর গুপ্তচরের কাজ কি সমস্ত নাড়ির খবর বের করে আনা। সমস্ত অজানা তথ্য বের করে আনা হলো তাদের কাজ। আমরা এন.এস.জি এর অফিসার হলেও আমাদের কাজ অপরাধীদের কে ধরা। আর একজন স্পাই এর কাজ কিন্তু আমাদের থেকেও কোনো অংশে কম নয় আমরা সামনে থেকে লড়াই করি আর তারা পিছন থেকে তাদের এই কাজ করার জন্য নিজেকে লুকিয়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করতে হয়। আর এই ক্ষেত্রে কিন্তু সব থেকে বড় পার্ট হচ্ছে কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা। স্পাই অফিসাররা সবার সামনে নিজেদেরকে যা দেখায় তারা কিন্তু আদেও তেমন নয়। আর এটাই এই লাইন এর সব থেকে বড় প্লাস পয়েন্ট আর এর জন্য কিন্তু সহজেই কেউ এদের হদীস পায়না। এরাও আমাদের মত ট্রেনিং প্রাপ্ত এদের ফাইটিং স্কিল ও কম কিছু নয় এরাও সব দিক থেকে পারদর্শী। আর এদের আরো একটা প্লাস পয়েন্ট আছে এরা যেকোনো সিস্টেম চোখের পলকে হ্যাক করে ফেলতে পারে। আমরা সামনে থেকে দেশের জন্য যেমন লড়াই করি এরাও ঠিক পিছন থেকে এমন ভাবেই লড়াই করে। তাই আজ যেমন আমরা সবাই আমনের এই হিংস্র রূপ দেখলাম এটা কিন্তু ওর আসল প্রতিক্রিয়া রাগের। যেটা সে নিজের মধ্যে দমিয়ে রাখে। আর নিজের রাগ কন্ট্রোল করাও কিন্তু একটা বড় আর্ট যার রাগ এত ভয়ংকর সেই রাগ কে সামলানো কিন্তু মুখের কথা নয়। সে সব সময়ে নিজেকে শান্ত সৃষ্ট কুল মাইন্ডের দেখায় নিজেকে আর রেগে গেলে তখন ও পুরো পুরি একটা হিংস্র রূপে পরিণতির হয়ে যায়। যেটা আজকে আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু আমন ওর রাগ কাউকে দেখায় না সচরাচর। তবে ওর ডিপার্টমেন্টে সবাই ওকে খুবই ভয়ংকর আর হিংস্র হিসাবে চেনে যতো টুকু আমি জানি। আর আমনের এই প্রতিভার জন্য আর তার কাজের জন্য স্পাই এর একজন সিনিয়র অফিসার হতে পেরেছে। সোহা সবার দিকে তাকিয়ে একভাবে বলে ওঠে।

সোহার কথা শেষ হতে সবাই নিজের মনে ভাবতে থাকে আসলেই তাই একজন স্পাই প্রধান কাজ নিজের স্বরূপ আড়াল করা নিজেকে গুপ্ত রাখা। সেই জন্য তারা কখনই আমনের এই রূপ কখনো দেখেনি। আর আজকে যে তারা আমনের এই রূপ দেখেছে তার কারণ ও তাদের কাছে স্পষ্ট আজ সোহার উপরে হওয়া হামলার জন্য আমন এর হিংস্র রূপ বাইরে এসেছে। তার রাগী চেহারা সবাই দেখেছে। তবে সোহার মাথায় ঘুরছে অন্য কথা আমনের প্রতিক্রিয়া দেখে তার মনে হচ্ছে যে এর মধ্যে আরো এমন কিছু নিশ্চয় আছে যার জন্য আমনের এমন প্রতিক্রিয়া।

————

আমন আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলতেই নিজেকে বারান্দায় ডিভানে আবিষ্কার করে। সামনেই ল্যাপটপ অন করা আছে এখনও সে রাতে কাজ করতে করতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গেছে। উঠে বসে ল্যাপটপ এর দিকে চোখ দিতেই দেখে স্ক্রিনে একটা নোট লেখা আছে।

গুড মর্নিং মন…

নিশ্চয়ই ভাবছেন যে আমি কেনো এইভাবে নোট লিখে রাখলাম আপনার জন্য। আসলেই আমি বাড়িতেই নেই আমাকে সকালেই বেরিয়ে যেতে হয়েছে। তবে চিন্তা করবেন না আমি সেফ আছি আর আমার সাথে বাকি চারজন ও আছে। আসলেই সকালেই আর্জেন্ট কল আসে হাই কমিশনারের থেকে তাই বেরিয়ে যেতে হয়েছে। আপনাকে বলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন। আর মনে হলো আপনি ভোরের দিকে ঘুমিয়েছেন তাই আর আপনাকে ডাকলাম না নোট ছেড়ে গেলাম। আপনি একদম চিন্তা করবেন না আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো নিজের কাজ শেষ করে এখানে এখনও আমার অনেক কাজ বাকি আছে। সাথে আপনার সাথে ও অনেক হিসাব নিকেশ মেটানোর আছে তাই ফিরতে তো আমাকে হবে। ভালো থাকবেন।
ওহ হ্যাঁ আরো একটা কথা ছিল আপনাকে ঘুমিয়ে থাকলে একদম বাচ্চাদের মতো লাগে স্নিগ্ধ ওই মুখটা আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। আর এই বিশেষ কারণের জন্য বিশেষ করে আপনার ঘুম ভাঙতে ইচ্ছে করেনি।❤️

ধানী লঙ্কা…❤️

নোটটা পড়তেই আমনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সোহার শেষের কথাটা পড়ে তার হাসিটা আরো বেশি প্রশস্ত হয়ে যায় কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নোটটার দিকে। তারপরেই আস্তে আস্তে আবারো তার মুখ গম্ভীর কঠিন হয়ে ওঠে।

চলবে…. ❣️

ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন…। নিজেদের মতামত জানাবেন ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here