#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৬
গমগমে দুপুরবেলা।কলেজ থেকে ফিরে শাওয়ার নিয়ে মাত্র বেরিয়েছে তোহা।চুলে এখনো ভেজা তোয়ালে পেঁচানো।গুনগুন করতে করতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে বারান্দায় লাগানো ফুলের টবটার দিকে চেয়ে আছে সে।সাদা সাদা ফুল ফুটেছে গাছটায়।ফুলের আকার খুবই ছোট তবে দেখতে বেশ লাগে।সুগন্ধও আসে একটু আধটু।এই নাম না জানা ফুলের প্রতিও একটা অদ্ভুত মায়া কাজ করে তোহার।”ফুল”বস্তুটাই এমন।মনকাড়া,নজরকাড়া,হৃদয়কাড়া।
বেশ অনেকক্ষন যাবত বাসায় গোলাপজাম বানানোর অদম্য চেষ্টায় অব্যাহত আছে আতিয়া।রান্নাঘরের অবস্থা দেখার মতো।আর আতিয়ার অবস্থা আরো বেশি গোলমেলে।
বাসায় মিষ্টি বানানোর ভূতটা অবশ্য এমনি এমনি চাপেনি তার মাথায়।এর পেছনে আরমান সাহেবের কৃতিত্বই বেশি।দুদিন আগে মোড়ের দোকানের মিষ্টি নিয়ে অতি প্রশংসায় মেতে উঠেছিলেন উনি।একপর্যায়ে এক কথা দু’কথা হতে হতে বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে ফেলেছিলেন তার স্ত্রীর পক্ষে নাকি এমন মিষ্টি বানানো অসম্ভব ব্যাপার।ঠিক তখনই এই মিষ্টি বানানোর ভুতটা মাথায় ঢুকেছে আতিয়ার।আর ফলস্বরূপ আজ দুপুরের রান্না শেষেই নিজের স্বামীকে ভুল প্রমান করার খেলায় নেমেছে সে।
তবে বিপত্তি বাঁধছে বারংবার।কিছুতেই মিষ্টির মন্ডটাকে বানাতে সক্ষম হচ্ছেনা সে।হয়তো কখনো পানি বেশি পরে পাতলা হয়ে যাচ্ছে আবার কখনো বেশি ময়দা পরে ঘন হয়ে যাচ্ছে।
যারপরনাই মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে এলো আতিয়ার।গলা বাড়িয়ে হাঁক ছাড়লো সে,
—“তোহা,এদিকে আয় শিগগির।”
মায়ের ডাকে হতাশাপূর্ণ শ্বাস ছাড়লো তোহা।গোসলের আগেই দেখে গেছিলো মা মিষ্টি বানানোর চেষ্টা করছে।চুলে তোয়ালেটা খুলে রান্নাঘরের দিকে গেলো সে।উঁকি দিয়ে বললো,
—“তুমি পারছোনা তাইতো?খালামনিকে ডাকতে হবে?”
গরম চোখে তাকায় আতিয়া।উত্তপ্ত মেজাজে ফুঁসে উঠে বলে,
—“তিহানকে কখনও দেখেছিস আপার সাথে বেয়াদবি করতে?মুখে মুখে তর্ক করতে?ওর থেকে কিছু শিখতে পারিসনা?দিন দিন তো চরম বেয়াদপ হচ্ছিস।খালি মায়ের মুখের উপর কথা বলা।যা আপাকে ডেকে নিয়ে আয়।”
মায়ের তিক্ত কথায় মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেলো তোহার।যদিও সে জানে মা এগুলো রাগের বশেই বলেছে তবুও তার মনটা তো খারাপ হলোই।মুখ ভার করে আফিয়াকে ডাকতে গেলো সে।
গেট খুললো তার খালু।অর্থ্যাৎ তিহানের বাবা।আমজাদ সাহেব।
খালুকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো তোহা।মিষ্টি করে বললো,
—“খালামনি কোথায় খালু?আম্মু ডাকছিলো একটু।”
আমজাদ হাসলেন।পথ ছেড়ে বললেন,
—“ভেতরে আয় মা।তোর খালামনিতো তিহানের ঘরে।তুই ডেকে নে।”
মৃদু গতিতে মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো তোহা।নিজেই দরজাটা আটকে দিয়ে তিহানের ঘরের সামনে যেতেই লক্ষ্য করলো মেঝেতে বসে আছে তিহান।আর উপরে বিছানায় বসে তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে আফিয়া।
আরামে চোখ বন্ধ করে রেখেছে তিহান।তার উপস্থিতি টের পায়নি।
আঙ্গুল দিয়ে হাল্কা করে দরজায় টোঁকা দিলো তোহা।চোখ মেলে তাকালো তিহান।তাকালো আফিয়াও।
তোহা দৃষ্টি আফিয়ার দিকে স্হির করে ছোটমুখে বললো,
—“আম্মু তোমাকে ডাকছে খালামনি।”
তোহার বিষন্ন কন্ঠ আর নত দৃষ্টিতেই যা বোঝার বুঝে গেলো তিহান।ঘাড় বাকিয়ে আফিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে মৃদু কন্ঠে সে বললো,
—“তুমি যাও মা।আমি দেখি কি হয়েছে।”
আফিয়া ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।তারও বোঝার বাকি নেই তোহার মন খারাপ।তিহানের কথার মানে বুঝতে পেরে তেলের বাটিটা তিহানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়ালো সে।বেরিয়ে যাওয়ার আগে তোহার গালে হাত রেখে বললো,
—“মন খারাপ করিসনা।তুই থাক এখানে।আমি যাচ্ছি।”
মাথা নাড়ালো তোহা।আফিয়া বেরিয়ে যেতেই তিহান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“দরজাটা ভিজিয়ে দে।”
গোমড়ামুখেই দরজা চাপিয়ে দিলো তোহা।
—“আপনি বাসায় কেনো?আমাকে নামিয়ে দিয়ে আর অফিসে যাননি?”বলতে বলতেই তিহানের পাশে এসে দাড়ালো সে।কিছুক্ষণ হাতের তেলের বাটিটা নাড়াচাড়া করলো তিহান।তারপর দুচোখ বন্ধ করে ব্যাথাতুর কন্ঠে উওর দিলো,
—“মাইগ্রেনের ব্যাথা হচ্ছে রে তিহু।মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে বোধহয়।”
সেকেন্ডেই অস্থির হয়ে উঠলো তোহা।ঝুঁকে গিয়ে তিহানের হাত থেকে তেলের বাটিটা নিয়ে হন্তদন্ত কন্ঠে বললো,
—“আচ্ছা,আপনি বসুন।আমি তেল দিয়ে চুল টেনে দেই।ব্যাথা চলে যাবে।”
প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েও প্রশান্তিদায়ক হাসি হাসলো তিহান।উঠে দাড়িয়ে যেতেই তোহা মিনমিনে কন্ঠে বললো,
—“এভাবেই তো ঠি ক ছিলো।আপনি তো অনেক লম্বা আমার থেকে।”
বাম ভ্রু উচালো তিহান।তোহার কথা তোয়াক্কা না করে বিছানায় পা তুলে হেলান দিয়ে বসে বললো,
—“তোর থেকে কয় বছরের বড় আমি?”
—“আট।”বোকা বোকা কন্ঠে ফটাফট উওর দিলো তোহা।তিহানের প্রশ্নের মানেটা বুঝতে পারেনি সে।
—“আমি নিচে মাটিতে বসব আর তুই বিছানার উপর?”
আবারো মুখ কুঁচকালো তোহা।বিরক্তি নিয়ে ঠেস দিয়ে বললো,
—“ধ্যাত্ ,বসুন উপরে।বলে তিহানের কাছে যেয়ে দাড়ালো।বাটিটা পাশের টেবিলে রেখে দুহাতে গরম করা তেল মেখে নিয়ে মাথার তালুতে ঘঁষে দিতে দিতে বললো,এত ভাব নিয়ে থাকেন কিভাবে?এজন্যই তো আপনার মাইগ্রেনের এত ব্যাথা।একদম উচিত বিচার।”
প্রত্যুওর করলোনা তিহান।ব্যাথা উপশমের আরামে চক্ষুযুগল আবারো বন্ধ হয়ে এসেছে তার।
॥
প্রায় ঘন্টা খানেক যাবত পরম যত্নে তিহানের চুল টেনে দিচ্ছে তোহা।তার পেটের কাছটায় মাথা কাত করে আলতো ভাবে ঠেকিয়ে রেখেছে তিহান।চোখ এখনো বন্ধ।তোহার একমুহূর্তও বিরক্তি আসেনি।বরং অস্থির মনটা শান্ত হচ্ছেনা কোনোক্রমেই।তিহানের ব্যাথা কমেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলেও করতে পারছেনা।ভাবছে লোকটা হয়তো আরামে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে কথা বললে আবার বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
আরো কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই তোহা নিচু গলায় বললো,
—“ব্যাথা কমেছে?”
আধো আধো চোখে তাকালো তিহান।মাথা সরিয়ে আচমকাই তোহার হাত ধরে নিজের সামনে বসিয়ে দিলো।আধভেজা চুলগুলো ততক্ষনে পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে তোহার।
তোহার চেহারার দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা ঢোঁক গিললো তিহান।মেয়েটার উদাসীনতা সহ্য হয়না তার।তথাপি হাত বারিয়ে দিলো সে।থুতনি ধরে তোহার নত মুখ তার দিকে তুলে কপালের উপর বেরিয়ে আসা চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
—“মন খারাপ কেনো?খালামনি বকেছে?”
বিরস নয়নে তাকালো তোহা।মুখ ফুটে বলতে হলোনা তার।তিহান আপনাআপনিই বুঝে নিলো।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,
—“তুই কি বাচ্চা নাকি?জানিসইতো খালামনি একটু শর্ট টেম্পার।এতটুকুতে কেউ মন খারাপ করে?মায়েরা তো বকতেই পারে।”
—“তাই বলে আম্মু শুধু শুধু এভাবে বকবে আমাকে?”চাপা স্বরে বললো তোহা।
বকার কারণ আর জিজ্ঞেস করলোনা তিহান।তোহার তিরতির করে কাঁপা ঠোঁটগুলো নজর এড়ায়নি তার।এ বিষয়ে আরো কিছু বললে এখনি কেঁদে দিবে মেয়েটা।
উঠে দাড়ালো সে।আলমারি থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করতে করতে বললো,
—“ওয়াশরুম থেকে হাতটা ধুয়ে আয়।”
চুপচাপ হাত ধুয়ে আসলো তোহা।বিছানায় বসতেই তিহান পকেট থেকে ফোন বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—“এখানেই থাক,আমার ফোন চালা,ঘুম আসলে ঘুমা।যা ইচ্ছা কর।কিন্তু রুম থেকে বের হবিনা।মাথা গরম আছে…শুধু শুধু খালামনির সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলবি।”
—“আমি খারাপ ব্যবহার করি তিহান ভাই?আম্মু অযথাই বকেছে আমাকে…”
ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে তাকে থামিয়ে দিলো তিহান।অত:পর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—“আচ্ছা চুপ কর।আমি গোসলে যাচ্ছি।তুই কিন্তু ঘরেই থাকবি।ঠিকাছে?”
উপরনিচে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো তোহা।তিহান একটু হাসলো।অত:পর জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
______________
প্রায় দেড়ঘন্টার লম্বা শাওয়ার শেষে রুমে ঢুকলো তিহান।তোহা তখন উল্টেপাল্টে ঘুমাচ্ছে।গায়ের জামাকাপড় এলোমেলো।একটু এগিয়ে গেলো তিহান।ফোনের স্ক্রীনে তোহারই একটা হাস্সোজ্জ্বল ছবি জ্বলজ্বল করছে।হয়তো ছবি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা।
মিটমিট করে হাসলো তিহান।তার গ্যালারির একটা বড় অংশ জুড়ে শুধুই তোহার ছবি।বিষয়টা তোহার অজানা নয়।উপরন্তু তার ফোনের সব পাসওয়ার্ডই মেয়েটার জানা।তবে ছবিগুলো দেখলেও সরাসরি কিছু বলেনা সে।না বলে তিহান নিজে।
একটু ঝুঁকে গেলো তিহান।তোহার হাত থেকে ফোন নিয়ে সরিয়ে রেখে হাতটা ধরে হাতের উল্টোপিঠ আলতো করে নিজের দু গালে ছুঁইয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো।
~চলবে~
[আগামীকাল আমার জন্মদিন।সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।আর হ্যাঁ,দিনটাকে একটু স্পেশাল করার জন্য কাল দুইটা পর্ব দিবো।সন্ধ্যার দিকে একটা আর রাতে একটা।❤️]